উন্নয়নের কথা ঘটা করে বলা হচ্ছে৷ কিন্তু এ উন্নয়ন কার টাকায় ও কার জন্য? যাদের জন্য এ উন্নয়ন ও যারা এ টাকার মালিক তারা কী বলছে? সরকারের কাজটা কী? তারা কি কেবলই এ অর্থের পাহারাদার নয়? নৈতিকতা, উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র কি পরস্পর পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত নয়? উন্নয়নের স্তুতি করা হবে আর গণতন্ত্রের চরিত্র নষ্ট করা হবে তা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও কিন্তু জেগেছিল গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই৷ এই গণতন্ত্রের জন্যই সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই গণতন্ত্রের জন্যই সংঘটিত হয়েছিল নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, এই গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই বিএনপি কর্তৃক একদলীয় নির্বাচন বাতিল করা হয়েছিল। গণতন্ত্রের জন্যই জীবন দিয়েছে ৩০ লাখ শহীদ, ইজ্জত দিয়েছে দু’ লাখ নারী৷ এই গণতন্ত্রের জন্যই জীবন দিয়েছে শহীদ তিতাস, ডাঃ মিলন, ফিরোজ, জাহাঙ্গীর, রাসেল ও নূর হোসেনসহ অসংখ্য শহীদ।
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নের মূল শেকড় কিন্তু গণতন্ত্র। শেকড়ে জল না ঢেলে গাছের ডালে জল ঢাললে কি কোন গাছের উপকার হয়? একজন এমপিকে যখন বলতে শোনা যায় আমাদের খাবে আর ভোট দেবে অন্যকে, তা হয় না। আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, সকলেই নৌকায় ভোট দেবেন ও তা প্রকাশ্যে দেবেন। অনেক ভোটকেন্দ্রেই প্রকাশ্যে ভোট দানের অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রার্থিতা বাতিলের ফন্দিফিকিরের অপসংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে কেন্দ্র দখল করে একের ভোট অন্যে দেয়ার অপসংস্কৃতি। গড়ে উঠেছে জবরদস্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের অপসংস্কৃতি। গড়ে উঠছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রচারকাজে বাধাদানের অপসংস্কৃতি। গড়ে উঠেছে ক্ষমতার কাছে মানুষের নতি স্বীকারের অপসংস্কৃতি। ভোট শুরু হলে মানুষকে বলতে শোনা যায় পাশতো সরকার দলই করবে। আগে দলীয় প্রতীক ছিল জাতীয় সংসদে এখন তা স্থানীয় সরকারেও দিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে করে তৃণমূলেও সংক্রমিত হয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রভাব। হারিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের উৎসবমুখরতা। সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জনকে দেখেছি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যেতে। এখন স্থানীয় নির্বাচনেও তা চালু হয়ে গেছে।
এখন আর কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিততে চাইছে না। চাইছে ছলে, বলে ও জোরে কৌশলে যেনোতেনভাবে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণ করতে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতাকেই অধিক নিরাপদ মনে করছে তারা। সরকার দলের প্রার্থী যদি কাউকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে বসে তবে তার পিছে লেগে যায়। প্রথমত চেষ্টা করে তার মনোনয়ন বাতিল করাতে। এটি না পারলে পরে করে প্রচারকাজে বাধা দান। হুমকি ধমকি ও ভীতি প্রদর্শন। এতেও নিরাপদ বোধ না করলে পরবর্তীতে কেন্দ্র দখল করে সিল প্রদান। এককথায় গণতন্ত্রের রীতিনীতি মানাতে কারও আগ্রহ নেই। আগ্রহ কেবল জিতে যাওয়াতে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মানুষও আজকাল ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করে চলেছে। ভোট দিচ্ছে ক্ষমতাধরকে। এদেশে বিরোধীদলকেও আর রাজপথে দাঁড়াতে দেখা যায় না। আর কোনদিন দাঁড়াবে বলেও বোধ হচ্ছে না। সরকার দল চায়না তারা দাঁড়াক। আর বিরোধী দলেরও নেই দাঁড়াবার মতো সাংগঠনিক কোন শক্তি। সরকার দল দলীয় প্রতীক দেবে আর ভিন্ন দলীয় প্রতীককে দেবে প্রচার কাজে বাধাদান। তাকে মাঠে নামতে দেবে না। এমন গণতন্ত্র কি আমরা চেয়েছিলাম?
অন্য দলীয় প্রতীকের প্রার্থীকে প্রচারকাজে বাধা দেবে আবার নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও দাঁড়াতে দেবে না। এমন গণতন্ত্র কি আমরা চেয়েছিলাম? কেন গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার উৎসব মুখরতা হারিয়ে যাচ্ছে? এসব ফেরৎ আসার কোন উপায় আছে কি? কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ভয় পাচ্ছে প্রার্থীরা? কেন গণতন্ত্রের বৃক্ষটাকে গণতন্ত্রের সুবাতাস বঞ্চিত করে তাকে এমন রুগ্ন শীর্ণ ও অসুস্থ করে তোলা হচ্ছে? এ কেমন কথা আমাদের খাবে আমাদের পড়বে আর ভোট দেবে অন্যে তা হয় না! তবে কি রাজকোষর মালিক হয়ে গেছে এখন পাহারাদাররা?
সরকার অবশ্যই মালিক নয় তারা পাহারাদার মাত্র। আর পাহারাদার হিসাবে জনগণ তাদের বেতনও দিচ্ছে। বেতন নিচ্ছে মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ সর্বস্তরের আমলা কর্মকর্তা কর্মচারীরা। কিন্তু বিনিময়ে তারা কি কেউ সততা, নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা দিয়ে পাহারাদারীর কাজটা সারছেন? নির্বাচন কমিশন বেতন নিচ্ছে। এ বেতনটা নিশ্চয়ই জনগণ দিচ্ছে৷ কিন্তু এর বিনিময়ে তারা কি গণতান্ত্রিক রীতি চালিত যথার্থ নির্বাচন উপহার দিতে পারছে জনগণকে? নাকি তারাও নিজেদের এ টাকার মালিক ভাবে? পরের টাকায় উন্নয়ন নিয়ে গলা ফাটানো হয় কিন্তু উন্নয়ন বরাদ্দের লুণ্ঠন নিয়ে চুপ থাকা হয়।
এককথায় গণতান্ত্রিক নৈতিকতার সবকিছুই কেমন উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। পাহারাদার হয়ে যাচ্ছে মালিক আর মালিক হয়ে যাচ্ছে পাহারাদার! পাহারাদারের অধীনস্থ মালিক চুপ করে দেখে যায় তারই অর্থের লুণ্ঠন। নইলে পাহারাদারের হাতের লাঠি মালিকের পিঠেই উঠবে এমনটাই চলছে। অথচ পাহারাদারের হাতে থাকা লাঠিটাও মালিক জনগণের টাকায় কেনা। তবে কি এটাই নিয়তির পরিহাস। তাই নয় কী? একজন এমপি তো সরাসরি নির্বাচনের আগে পরে লাঠির হুমকি দিল। রাজশাহীর একটি আসনের সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, “প্রতিটা কেন্দ্রে আমার নির্বাচনের সময় ২০০৮ সালে বলেছিলাম- একশ, দেড়শ, দুশ’ করে লাঠি কেটে রাখবেন। বলেছিলাম না? হ্যাঁ বলেছিলাম।” ২০০৮ সালের কথা এটা। ওই ফর্মুলা এবার মুণ্ডুমালা পৌর নির্বাচনে নিয়ে নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন যদি ভোটের দিন ব্যবহার করতে হয়, যদি ভোটের দিন ব্যবহার করার দরকার পড়ে, তাহলে ব্যবহার করবেন। নাহলে ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর ওই লাঠিখেলা হবে মুণ্ডুমালায়। এই কি গণতন্ত্রের ভাষা? তিনি আরও বলেছেন, “আওয়ামী লীগের খাও আওয়ামী লীগের পরো আবার আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করো।” এই কথায় কী বলবে আসল মালিক জনগণ? কী বলবেন গণতন্ত্রের বোদ্ধারা? তবে কি মালিকানা হাইজ্যাক হয়ে গেল? কী বলবেন বেচারা মালিক জনতা?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)