বাঙালি রাজনীতিক, এই পরিচয়টা হয়ত সদ্য প্রয়াত প্রণব মুখার্জীকে খুব একটা খুশি করত না। তাই তার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ঘিরে তিনি বেশ নিস্পৃহই ছিলেন। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। প্রণববাবুরও রাজনৈতিক জীবন একটা অত্যুঙ্গ পর্যায়ে এসে পৌঁছায়। এই পৌঁছানো কতোখানি সম্ভব হতো যদি সঞ্জয় গান্ধী বেঁচে থাকতেন- এটা ভারতীয় রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে শুরু করে অশোক সেন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বা প্রণববাবু, এইসব বাঙালি রাজনীতিকদের ওপর ইন্দিরা তনয় সঞ্জয় গান্ধী খুব একটা খুশি ছিলেন না। কী ছিল সঞ্জয়ের এইসব বাঙালি রাজনীতিকদের উপর অখুশি হওয়ার কারণ?
সিদ্ধার্থশঙ্করের লক্ষ্য যে প্রধানমন্ত্রীর কুর্শির প্রতি ছিল, এটা ইন্দিরা প্রথমে বুঝতে পারলেও, ঠিক মানতে পারেননি। ইন্দিরাকে এই বিষয়টি মানবার ক্ষেত্রে সঞ্জয় কার্যত একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু প্রণববাবুর প্রতি কেন সঞ্জয়ের খুব একটা ইতিবাচক ধারণা ছিল না? প্রণবের স্থিতধী বুদ্ধি অস্থিরমতির রাজনীতিককে সঞ্জয় সহ্য করতে পারতেন না? নিজেকে মায়ের উত্তরাধিকার হিসেবে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে সিদ্ধার্থশঙ্করের মতোই প্রণবও ইন্দিরাকে ‘কু’ পরামর্শ দেবেন, ছোটছেলের দুর্বিনীত স্বভাব ঘিরে ভালোমন্দ বলে, মায়ের মন বিষিয়ে দেবেন, এটাই কি ছিল সঞ্জয়ের আশঙ্কা? সঞ্জয় পরিণত রাজনীতিক না হলেও, তার মা ইন্দিরা, নিজের রাজনৈতিক বোধের গভীরতা থেকে প্রণববাবুর প্রজ্ঞা, আনুগত্য, উচ্চাকাঙ্খা- সব কিছুই যেন ছবির মতো দেখতে পেয়েছিলেন। সেই কারণেই, সঞ্জয়ের আপত্তির থেকেও মোরারজি দেশাইয়ের সরকারের আমলে প্রণববাবুর কোণঠাসা ইন্দিরার প্রতি আনুগত্যের দিকটিই পরবর্তী সময়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল।
প্রণব মুখার্জী রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খাতে কি তার একদা প্রতিদ্বন্দ্বী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে ছাপিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন? নাকি সিদ্ধার্থশঙ্করকে ছাপিয়ে যাতে না যান, ইন্দিরার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর স্বয়ং সিদ্ধার্থশঙ্করই সেই পরামর্শ দিয়েছিলেন সদ্য মাতৃহারা রাজীব গান্ধীকে? সঞ্জয় গান্ধীর তৈরি করা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন পাঞ্জাবের জার্নেল সিং ভিন্দ্রানেওয়ালা উত্তর পরিস্থিতি ভাঙতে রাজীব নির্ভর করেছিলেন সেই জরুরি অবস্থা কালের সিদ্ধার্থশঙ্করের উপর। জরুরি অবস্থাকালে ত্রাস সৃষ্টিতে তো বংশীলাল কারো থেকে কম ছিলেন না। তবু কেন বংশীলালের উপর ভরসা না করে ভিন্দ্রানেওয়ালাকে শায়েস্তা করতে বঙ্গতনয় সিদ্ধার্থশঙ্করের উপরেই ভরসা করলেন রাজীব? আর এই সিদ্ধার্থশঙ্কর, না খাবো, না অন্যকে খেতে দেব, এই মানসিকতা নিয়ে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কুর্শিকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন, তখনই শ্রীমতী গান্ধীর পরিত্যক্ত চেয়ারে যাতে কোনো অবস্থাতেই অপর বঙ্গতনয় প্রণববাবু বসতে না পারেন, তার জন্য রাজীবের কানে কি ফুসমন্তর দিয়েছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর?
ইন্দিরার জীবদ্দশার শেষ পর্বে তার দল কংগ্রেসের ভিতরে কি কোনো বিদ্রোহ মাথাচাড়া দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল? যদি নাই হয়ে থাকে, তাহলে কেন সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি জৈল সিংয়ের সঙ্গে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়েছিল ইন্দিরার? কংগ্রেস দলের ভিতরে সেই চাপা বিদ্রোহের সামান্যতম ইঙ্গিতও কি ফুটে উঠেছিল ইন্দিরার মর্মান্তিক মৃত্যুর অব্যবহিত পরে রাজীবকে ইন্দিরার শূন্য তখতে বসাবার প্রশ্নে প্রণব মুখার্জীর ভূমিকার ভিতর দিয়ে? যদি তা নাই হয়, কেন তবে মায়ের বিশেষ আস্থাভাজন প্রণবকে সামিল করলেন না রাজীব নিজের মন্ত্রীসভাতে? অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেন কিছুটা অনভিজ্ঞ বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের উপর, যিনিও অবশ্য পরে বোফর্স ইস্যুতে হয়ে উঠলেন রাজীব বিরোধী।
রাজীবের কাছ থেকে যোগ্য মর্যাদা না পেয়ে প্রগতিশীল কংগ্রেস নামক একটি দল প্রণববাবু করেছিলেন। অথচ এই প্রণববাবুই তার তীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষ থেকে ইন্দিরা হত্যাজনিত আবেগে জেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে হুগলির ইন্দুমতী ভট্টাচার্যের সাংসদ হিসেবে প্রথম দিল্লি যাত্রাকালে কার্যত নিজে সবকিছুর তদারক করেছিলেন। এইসময়কালে মমতা তো পরিগণিত হতেন প্রণবশিবিরের মানুষ হিসেবেই। আর তখন থেকে এ বি এ গণিখান চৌধুরী শিবিরের মানুষ ছিলেন সোমেন মিত্র।
রাজীব গান্ধী কিন্তু তার মায়ের অপর আস্থাভাজন গণিখানকেও নিজের মন্ত্রিসভাতে নেননি। এই গণি খানই কিন্তু ইন্দিরার শেষ মন্ত্রীসভাতে রেলমন্ত্রী হিসেবে অলঙ্কারিক উন্নয়নের জেরে সেইসময়ে বাংলাতে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এই জনপ্রিয়তা অর্জনের কাজটিই কিন্তু প্রণববাবুর পক্ষে কখনো সম্ভবপর হয়নি। না হওয়ার অবশ্য একটি বড় কারণ ছিল সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের প্রতি তার অত্যন্ত হৃদয়হীন ব্যবহার, সময়ে সময়ে অসংসদীয় শব্দবানে তাদের জর্জরিত করবার কারণে।
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রণববাবুর একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল।বস্তুত যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজনৈতিক স্বার্থে একটা সময় দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করে থেকেছেন, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটে থেকেছেন, গুজরাট গণহত্যাকালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভাতে থেকে, সেই নারকীয় ঘটনাবলী সম্পর্কে নিশ্চুপ থেকেছেন, সেই মমতাকেই বামন্থীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করবার লক্ষ্যে যথেষ্ট সমাদর প্রণববাবু করেছিলেন। বামপন্থার ঘোষিত বিরোধী হিসেবে প্রণববাবু খুবই নীতিনিষ্ঠ ছিলেন। ভারতের অর্থনীতিকে নেহরু মডেল থেকে সরিয়ে বাজার অর্থনীতিমুখী করবার ক্ষেত্রে পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সময়কালের অর্থমন্ত্রী, তথা পরবর্তীকালের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড: মনমোহন সিংয়ের বিশেষ অবদান আছে। এই পর্যায়ে প্রণব মুখার্জীর অবদানও খুব কম নয়। নরসিংহ রাও, মনমোহন, প্রণববাবুর অনুসৃত অর্থনীতির সেই ধারাপ্রবাহই পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী অনুসরণ করেছিলেন, আজকে নরেন্দ্র মোদি অনুসরণ করছেন।
বামপন্থীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করবার লক্ষ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সবরকমের সহযোগিতা প্রণববাবু করলেও পরবর্তীতে কংগ্রেস দল যখন তাকে রাষ্ট্রপতিপদপ্রার্থী করে, সাম্প্রদায়িক দলের প্রার্থীকে রোখার স্বার্থে ভারতের বেশ কিছু বামপন্থীরা প্রণববাবুকে সমর্থন করে। আবার আর এস পির মতো বামপন্থী দলগুলি প্রণববাবুকে সমর্থন করেনি। এই পরিস্থিতিতে মমতা কিন্তু প্রথম পর্যায়ে প্রণববাবুকে সমর্থন করেননি।তবে অত্যন্ত রাজনৈতিক দূরদর্শী প্রণববাবু, যে বামপন্থীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তিনি আত্মনিবেদিত ছিলেন, রাষ্ট্রপতিপদপ্রার্থী হয়ে, সেই বামেরা তাকে সমর্থন করবার পর, বামভোট যাতে সুচারুরূপে তার বাক্সে আসে, সেদিকে যথেষ্ট যত্নবান ভূমিকা পালন করেছিলেন।
রাজনীতির প্রশ্নের নীতি অপেক্ষা, যখন যেমন, তখন তেমন। যেখানে যেমন, সেখানে তেমন- এই বাস্তববোধ প্রণববাবুকে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিশেষ রকমের সাফল্য দিয়েছিল। সেই সাফল্যের অভিব্যক্তিই তার রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসর নেওয়ার পর, আর এস এসের সদর দপ্তরে যাওয়ার প্রশ্নে কোনো অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল কি না– এটা কেবল ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, গোটা উপমহাদেশের রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রেই একটা আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে, আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবত তাকে আর এস এসের অন্যতম মার্গদর্শক বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত সঙ্ঘের সদর দপ্তরে গিয়ে, যেদিন তাদের প্রতিষ্ঠাতা, তথা হিন্দুরাষ্ট্র, এই সাম্প্রদায়িক ভাবনার অন্যতম রচয়িতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে প্রণববাবু ভারতের অন্যতম সেরা সন্তান বলে অভিহিত করে এসেছিলেন, সেইদিনই প্রণব মুখার্জীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে লালিত, পালিত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই ধ্বংস বা নতুন সৃষ্টি অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ‘মার্গদার্শনিক’ প্রণব মুখার্জীকে কি ভারতের মানুষ, তথা উপমহাদেশের মানুষ, তারপর থেকে একটা নতুন আঙ্গিকে পেতে শুরু করেছিল? তার মৃত্যু সেই পাওয়ার ক্ষেত্রে বোধহয় একটা চির অপূর্ণতা তৈরি করে গেল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)