রাতের অন্ধকারে কন্যাসম ছাত্রীদেরকে ‘শায়েস্তা’ করার জন্য যে লোক গভীর রাতে ছাত্রী হলে পুলিশ ও ছাত্রদলের ক্যাডারদেরকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসলেন বিতাড়িত হবার এক যুগেরও বেশি সময় পরে।
তখনকার আন্দোলনের একটি জনপ্রিয় গান ও শ্লোগান ছিল ‘আর যেন না ফিরে আসে এমন নিষক কালো রাত’। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরে বর্বরতম সেই নিষক কালো রাত যে এনেছিলেন, সেই আনোয়ারউল্লাহ আবারো যেন স্বমহিমায় ফিরলেন মাত্র ৬ লাখ টাকায়।
খবরে প্রকাশ, গত ৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। ৫ আগস্ট ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরীর ছেলে মিতুল আনোয়ার চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের হাতে তুলে দিলেও সে খবর প্রকাশ পায় ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্বব্যিালয় বার্তায়।
অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী কেমোন ছিলেন তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০০২ সালে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার বয়স তখন ৭ মাস হয়েছে। ক্যাম্পাসে তখন বিএনপির সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের একচ্ছত্র আধিপত্য। ক্যাম্পাসে তারা চরম স্বেচ্ছাচারী ও নিয়ম বর্হিভূত শাসন চালাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে তখন অবৈধভাবে ছাত্রদলের বহিরাগত ছাত্রীরা অবস্থান করতো। তারা আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল না। আসলে তারা কোন প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী ছিল না। হলে সম্পূর্ণ বহিরাগত হিসেবেই অবস্থান করতো ছাত্রদলের ক্যাডার হিসেবে। সেই বয়স্ক মেয়েদের হল থেকে বিতাড়নের জন্য শামসুন্নাহার হলে আন্দোলনে নামে তখনকার সাধারণ ছাত্রীরা।
প্রতিশোধ নিতে ২০০২ সালের ২৩ জুলাই রাতের আঁধারে পুলিশ ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা হলে ঢুকে রাত দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত সাধারণ ছাত্রীদের উপর নির্যাতন চালায়। এর প্রতিবাদে পরের দিন থেকেই ফুঁসে উঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। নির্যাতনবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যানারে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযোগ উঠে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরীর প্রত্যক্ষ মদদে পুলিশ এই হামলা চালায়। সেসময় ছাত্রদলের ক্যাডাররাও পুলিশী অভিযানে অংশ নিয়ে ছাত্রীদের লাঞ্চনা করে। ঘটনার পরে আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী কোন কার্যকর পদক্ষেপ তো নেনইনি বরং আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর পুনরায় পুলিশ ও ছাত্রদলের ক্যাডারদেরকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন।
এমন বিবেক বিবর্জিত একজন শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকতে পারবে না এমন দাবির মুখে আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী পদত্যাগে বাধ্য হন। বিতাড়িত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তখন কে ভেবেছিল সেই আনোয়ারউল্লাহ আবারো একযুগ না পেরুতেই ফিরে আসবেন স্ব-সম্মানে! কিন্তু তিনি ফিরে আসলেন এবং বর্তমান প্রশাসন তাকে সাদরে গ্রহণও করলেন।
আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানের প্রতি যে আঘাত হেনেছিলেন তা কি পূরণ হয়েছে। সেই ক্ষতে কি প্রলেপ লেগেছে? সেই আন্দোলনে যারা পুলিশের লাঠি ও টিয়ারশেল সহ্য করেছে তারা কি আনোয়ারউল্লাহর পুনর্বাসন সহ্য করতে পেরেছে?
ছাত্রদলের হাতে যারা লাঞ্চিত হয়েছে তাদের কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেমন করে ভুলে যেতে পারলো? কেন এমন একজন বির্তকিত মানুষের নামে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করতে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে? এমন প্রশ্ন করছে অনেকে।
সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববদ্যিায় চলচ্চিত্র সংসদের কর্মী ও শামসুন্নাহার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আশরাফ সিদ্দিকী বিটু বলেন, এমন একজন বির্তকিত ব্যক্তির কাছ থেকে কেন মাত্র ৬ লাখ টাকা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে? তাদের কি টাকার এত অভাব পড়েছে? তিনি তো একজন স্বাধীনতাবিরোধী চেতনার লোক। যে রাতের আঁধারে ছাত্রী হলে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন বিএনপি সরকার ছাত্র আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ করতে। তবে এই অপকর্মের পুরস্কার হিসেবে বিএনপি সরকার তাকে সেই সময় বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠায়।’
সেই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যও ছিলেন। তিনি কীভাবে এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিলেন সেই বিষয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেন আশরাফ সিদ্দিকী।
২০০২ সালের জুলাই মাসের ২৩ তারিখের নিকষ কালো রাতের কুশিলব আনোয়ারউল্লাহর এমন মহিমান্বিত ফিরে আসায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও শামসুন্নাহার আন্দোলনের কর্মী মানবেন্দ্র দেব। তার সাথে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এর থেকে বড় লজ্জার আর কিছু থাকতে পারে না। মানবিকতা বিবর্জিত সেই আনোয়ারউল্লাহর নামে ট্রাস্ট ফান্ড কিছুতেই মানা যায় না। ওই হামলা শুধু সাধারণ ছাত্রীদের উপর ছিল না, সেই হামলা সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরই ছিল। এমন একজন ব্যাক্তিকে মর্যাদার আসনে পুনর্বাসিত করার অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।
তাকে এমন জায়গায় দেখলে লজ্জার পরিমাণটা বেড়ে যায় বলেও মনে করেন মানব। তিনি বলেন, “সেই লজ্জা আর হতাশার খবর কি আমাদের বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাখে! যে মানুষগুলি নিজেদের সম্মান বাঁচাতে একদিন রাস্তায় নেমেছিল? আনোয়ারউল্লাহ আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসাতে কি তাদেরকে অপমান করা হলো না? হাজার হাজার সাবেক শিক্ষার্থী আনোয়ারউল্লাহর ফিরে আসাতে নিজেদেরকে অপমানিত মনে করেছে। সব সম্ভবের এই দেশে একজন কুখ্যাত ভিসিও সম্মান পান এটাও দেখতে হয়।”
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সেই আন্দোলনের কর্মী মাজহারুল ইসলাম মানিক হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, “এই রকম কলঙ্কিত লোককে এমন জায়গায় মেনে নেওয়া যায় না। যে দেশে নিজামীরা মন্ত্রী হয়েছে, আনোয়ায়উল্লাহর নামে ট্রাস্ট হয়, হয়তো ভবিষ্যতে কোন হলও হবে। এটা এক অদ্ভূত দেশ। সব সম্ভবের দেশ।”
এই বিকর্তকিত লোককে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার সুযোগ দিয়ে আরেফিন স্যার ঠিক করেন নি বলে অভিমানও ঝরে তার কণ্ঠে।
আসলেই সব সম্ভবের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই মনে রাখেনি তাদের অগ্রজদের অবদানের কথা। ভুলে গেছে সামান্য কিছু টাকা বা একখন্ড স্বর্ণ মেডেলের লোভে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের এক সদ্য মাস্টার্স শেষ করা শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বললে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আসলে অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলির পাঁঠা হয়েছেন। তৎকালীন বিএনপি সরকারের ভুল নীতির ফলে তিনি পরিস্থিতির শিকার। নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে আমরা তার অবদানকে অস্বীকার করতে পারি না। তার নামে চালু হওয়া ট্রাস্ট ফান্ড নিয়ে তাই আমাদের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। বরং এই স্বর্ণপদক আমাদেরকে ভালো পড়ালেখায় উৎসাহিত করবে।”
সেই সময় আটক সাধারণ ছাত্রীদেরকে রমনা থানা হাজতে দেখতে গিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. হুমায়ন আজাদ। তিনি সেই কারাগারকে পবিত্র কারাগার হিসেবে উল্লেখ করে সেখানে ফুলের তোড়া নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন হয়তো আমাদেরকে ফুলের তোড়া দিতে হবে সেই আনোয়ারউল্লাহর নামে কোন ফলকে। কারণ আমরা অতীত ভোলা জাতি। মনে রাখি না আমাদের শত্রু-মিত্র এবং গৌরবোজ্জল অতীত।