ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা দীর্ঘ দিন থেকে বলে আসছিল একাদশ সাংসদ নির্বাচনে কোন বিতর্কিত, নিন্দিত ও সমালোচিত ব্যক্তি মনোনয়ন নমিনেশন পাবেন না। শুধুমাত্র পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতারাই মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু গত ২৫ নভেম্বর, রোববার মনোনয়ন ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে, অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি মনোনয়ন লাভ করেছেন।
মজার ব্যাপার হল চক্ষুলজ্জার কারণে যেসব বিতর্কিত ব্যক্তিকে সরাসরি আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিতে পারেনি, তাদের না দিলেও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যকে মনোনয়ন দিয়ে পারিবারিক করে দিয়েছে। অন্য কোন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কাউকে দেয়নি। এ ধরনের দুই সাংসদ হলেন কক্সবাজার-৪ আসনের (টেকনাফ-উখিয়া) আবদুর রহমান ওরফে বদি ও টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের আমানুর রহমান খান ওরফে রানা।
টাঙ্গাইলে আমানুরের জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছে রানার প্রায় আশি বছর বয়সী বাবা আতাউর রহমান খান। কক্সবাজারের আবদুর রহমান বদির জায়গায় তাঁর প্রথম স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরী। তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিচয় যা-ই থাকুক না কেন, একজন খুনের মামলার চার আসামির বয়োবৃদ্ধ পিতা, অপরজন ইয়াবার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার শীর্ষে নাম থাকা ব্যক্তির স্ত্রী। শুধু বদি নন, তার বাকি ভাইগণ, ভাগনে, বেয়াই, ফুফাতো ভাইসহ বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির নামও আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায়।
সমালোচকরা বলতেই পারেন অন্য দল যে বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিল, সেক্ষেত্রে কিছু বলা বা লেখা হল না। কারণ আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি, আমাদের অন্য দলের প্রতি সমর্থন বা ভালবাসা নেই। তাই অন্য দল কি করলো তার সাথে আওয়ামী লীগকে কেন মেলাবো?
হিংসুকরা কি চাইছেন? শেখ হাসিনা বা অন্য দলের প্রধানদের এক পাল্লায় মাপতে হবে? শেখ হাসিনার জুড়িদার অন্য কাউকে মানাতে চাইছেন? না কি শেখ হাসিনার বিকল্প আছে কেউ? নিন্দুকেররা যত যাই বলুক, সমালোচকরা যত সমালোচনায় করুক এ কথা মানতেই হবে যে, শেখ হাসিনার কোন বিকল্প আজো নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার মত কেউ নেই। দ্বিমত পোষণ করাই যায় আমার এই ব্যক্তিগত মতামতের, উঁহু গালি দেবার আগে দশবার আচ্ছা করে ভেবে বলুন তো কে হবেন শেখ হাসিনার পরিবর্তে!!! নাম খুঁজে পাচ্ছেন না তো? পাওয়াও যাবে না। শুধু তার দলের প্রধান হিসেবে কি আর কোন নেতা আছে যাকে দলের কর্মীরা চোখ বুজে মেনে নেবে ভরসা করবে। তাই একথা অনস্বীকার্য যে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।
শেখ হাসিনার বিকল্প নেই একথা যেমন সত্যি তেমনি একথা সত্যি যে, শেখ হাসিনার পাশে থাকা কেউ কেউ শেখ হাসিনার যত অর্জন তা ব্যর্থ করে তুলছে। এদের দুর্নীতি কারণে আজ এতো সমালোচনা। শেখ হাসিনা উন্নয়নের আলো জ্বালাচ্ছেন, আর তার সহচররা পিছন পিছন সেই আলো নিভিয়ে চলেছেন দুর্নীতি দিয়ে।
বিতর্ক পিছ ছাড়ছে না সরকারী দলের। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে যার জন্য, যিনি নিজ দপ্তরের পাশাপাশি সড়ক খাতেও নানা ঘটনায় বিতর্কিত, সেই শাজাহান খানকে মাদারীপুর-২ আসনের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। যিনি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হলেও শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। তিনি প্রায়ই এক পক্ষের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি নীতিমালার বিরোধিতা করেন। তার শ্রমিক সংগঠন আদালতের রায় এবং সম্প্রতি পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন বাতিল চেয়ে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করেছে।
বছর জুড়ে বিতর্কে শীর্ষে থাকার পরও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন শামীম ওসমান। নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বারবার আলোচনায় এসেছেন এই রাজনৈতিক। ত্বকী হত্যাকে কেন্দ্র করেও তিনি ও তার পরিবার বারবার আলোচনায় এসেছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতেও অভিযোগ ওঠে, আইভী এবং তার সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয় শামীম ওসমানের নির্দেশে।
নিজ দলের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না নিজাম হাজারীর। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশের অভিযোগ, গত বছরের নভেম্বর মাসে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলা শুধু নয়, ২০১৪ সালের মে মাসে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক হত্যায়ও তার হাত ছিল।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হিন্দু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে ঠাকুরগাঁও-২ আসন থেকে পরপর ছয়বার নির্বাচিত এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে। দ্য ন্যাশনাল সিটিজেন কো-অর্ডিনেশন সেল-এর তদন্তে উঠে আসে, জমি দখলের উদ্দেশ্যে দবিরুলের ছেলে মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল হিন্দুদের ওপর হামলা চালায়। ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটি জানায়, ‘ওই ঘটনায় দবিরুল সরাসরি জড়িত ছিলেন’।
র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর এক সন্ত্রাসীকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধে। সেই সাথে একই বছর পৌরসভা নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের নজরে আসার পর তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একটি অনুষ্ঠানে তিনি জানান, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান এবং ভাইস-চেয়ারম্যান প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে তিনি কীভাবে ভোট জালিয়াতি করেন।
কক্সবাজার-৩ আসন থেকে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাইমুম সরওয়ার কমল। তাকে হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদ করে। ২০১৬ সালে হিমছড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ পণ্য জব্দ করলে, তার নেতৃত্বে পণ্যগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় কমল এবং তার সমর্থকরা এক বন কর্মকর্তার ওপর চড়াও হন। এই বছরের জানুয়ারিতে এক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে ফের আলোচনায় আসেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত বছর বলেছিলেন, ‘দলের বিতর্কিত এমপিদের সাধারণ নির্বাচনে আর মনোনয়ন দেয়া হবে না। কিন্তু সে বাণীতে আওয়ামী লীগ অটল থাকতে পারলো না। যেসব এমপি শুধু বিতর্কিত নন, দুর্বৃত্তপনা ও দুর্নীতিতেও বিতর্কের সীমা ছাড়িয়েছেন, তাদের কেবল মনোনয়ন দেয়াই হল না, বরং তাদের সব ধরনের অন্যায়কে উপেক্ষা করে যেন পুরস্কৃত করা হল। তাদের শাস্তির আওতাই আনার বদলে আইন প্রণেতা বানানোর জন্য সুযোগ দেয়া হল।
আওয়ালী লীগ বিতর্কিত চরিত্রের দলীয় ব্যক্তিদের মনোনয়ন বন্ধ করলো না, তাতে জনগণ অখুশি হলেও তারা ফিরে চাইলেন না সাধারণ জনগণকে পাত্তা দিলেন না। এতে কিন্তু সমালোচনার পথ বন্ধ হল না, বরং আরো অভিযোগের পথ খুলে গেল। সরিষা থেকে ভূত তাড়ানো তো হলোই না উপরন্তু নতুন ভূত ঢোকে সে পথ নিশ্চিত হল।
পচনশীল পশ্চিমা গণতন্ত্রের অনুসারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, রাজনীতিকে কলুষযুক্ত করতে পারবে না, তা বিভিন্ন দলের মনোনয়ন দেখে মনে হল। যদি কেউ পারে, সেটা আওয়ামী লীগই পারবে। কিন্তু তার আগে আওয়ামী লীগকে ঘরের জঞ্জাল সাফ করতে হবে। যদিও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেখে মনে হল নোংরা পরিষ্কারের বদলে আরো আমদানি করলো বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)