বিজ্ঞাপনের উৎপত্তির মূল লক্ষ্যই ছিল কোনো পণ্য বা সেবা বা ধারণার বার্তা ছড়িয়ে দেয়া। কালের বিবর্তনে এই মূল লক্ষ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে উদ্দেশ্যের মাঝে বৈচিত্র্য এসেছে। বিজ্ঞাপনের কৌশলে এসেছে ভিন্নতা।
আর এসব পরিবর্তিত উদ্দেশ্য-কৌশলকে পথ করে দিতে এসেছে বিজ্ঞাপন সংস্থার মতো নানা ব্যবস্থা। পাশাপাশি চাহিদা ও মাধ্যমভেদে বিজ্ঞাপনের প্রকৃতিও বিবর্তিত হয়েছে।
উদ্দেশ্য
১৮৩৬ সালের জুনে প্যারিসের পত্রিকা ‘লা প্রেসে’র সম্পাদক এমিল দ্য জেরার্দিন প্রথম তার পত্রিকার দাম কমানো, পাঠক সংখ্যা বাড়ানো এবং মুনাফা বৃদ্ধির জন্য অর্থের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন নেয়া শুরু করেন। তার এই ফর্মুলা শিগগিরই অন্যান্য পত্রিকা অনুসরণ করতে শুরু করে।
প্রথম দিকের এসব মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের বেশিরভাগই ছিল বই ও পত্রিকার প্রচারের পাশাপাশি ঘরোয়া নানা ধরনের ওষুধ সংক্রান্ত। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞাপিত পণ্যের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
দিনের পর দিন একই বিক্রেতার পণ্যের বিজ্ঞাপন পত্রিকা ছাপানোর মধ্য দিয়ে সেগুলো পুরো দেশেই পরিচিতি পেতে থাকে। এভাবেই তৈরি হয়েছে এক একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ড নেম।
তবে সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ভুয়া বিজ্ঞাপনের সংখ্যা। ব্রিটিশ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ১৮৫০ এবং ১৮৬০’র দশকে বাড়তে থাকা সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে লক্ষ্য করে নতুন নতুন ধরনের বিভিন্ন পণ্যের ভুয়া বিজ্ঞাপন প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত হতে থাকে।
কৌশল
১৯ শতকে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন জগতে রাজত্ব ছিল কোপ ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং টোব্যাকো কোম্পানির হাতে। ধূমপান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বাভাবিক একটা বিষয় হলেও ব্র্যান্ড নেমের প্রসার, নানাবিধ বিজ্ঞাপন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে বিপণন কৌশলের ভিন্নতার কারণে ধূমপানের জগতেও পরিবর্তন নিয়ে আসে ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানিটি।
আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয় লন্ডনের টমাস যে ব্যারেটকে। পিয়ার্স সোপ কোম্পানির জন্য মনোহরী ছবি ও অভিনব স্লোগান ব্যবহার করে তিনি এমন বিজ্ঞাপন তৈরি করলেন যা পণ্যটির প্রচারে ছিল সত্যিই কার্যকর। তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্লোগান ‘Good morning. Have you used Pears’ soap?’ প্রচারের শুরু থেকে পুরো ২০ শতক জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।
ব্যারেটের বিজ্ঞাপনের উল্লেখযোগ্য একটি কৌশল ছিল পিয়ার্স ব্র্যান্ডটিকে উচ্চ সংস্কৃতি ও উন্নত মানের সঙ্গে জুড়ে দেয়া। যেমন, একটি বিজ্ঞাপনে তিনি জন এভারেটের বিখ্যাত ‘বাবলস’ চিত্রকর্মের সামনে পিয়ার্স সাবানের ছবি যোগ করে বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন।
এরপর টানা কয়েকটি বিজ্ঞাপন তিনি বানিয়েছিলেন পরিচ্ছন্ন গোছানো মধ্যবিত্ত শিশুদের ছবি দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে তিনি পিয়ার্সকে ঘরোয়া আরামের পাশাপাশি অভিজাত সমাজের আকাঙ্ক্ষার ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সফল হয়েছিলেন।
নিজের কাজের মধ্য দিয়ে ব্যারেট সফল বিজ্ঞাপনের এমন বেশ কিছু কৌশল শিখিয়ে গেছেন যা এখনো বিজ্ঞাপন নির্মাতারা অনুসরণ করছেন। বিজ্ঞাপন ও ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির ওপর বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
একই সঙ্গে তিনি বলেছেন: ‘রুচি পাল্টায়, ফ্যাশন পাল্টায়, এবং বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই পাল্টাতে হবে। এমনটা নয় যে প্রতিবারই নতুন আইডিয়া পুরনো আইডিয়ার চেয়ে ভালো হবে। কিন্তু তা অবশ্যই পুরনোটার চেয়ে ভিন্ন এবং তা বর্তমান রুচির সঙ্গে মিলবে।’
২০ শতকে পশ্চিমা বিশ্বে নারীদের জন্য উন্মুক্ত হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসার ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম ছিল বিজ্ঞাপন। নারীরাই যেহেতু বাসার বেশি কেনাকাটার কাজ করেন, সেহেতু তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য নারী মডেলের প্রয়োজন বিজ্ঞাপনদাতারা সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে থাকেন।
পাশাপাশি এই শতক থেকেই বিজ্ঞাপনে যৌনতা ও নগ্নতার ব্যবহার শুরু হয়। ১৯১১ সালে উডবারি সোপ কোম্পানি প্রথম তাদের সাবান বিক্রির জন্য যৌনতার ধারণা ব্যবহার করেছিল। এই কোম্পানিই ১৯৩৬ সালে ‘দ্য সান বাথ’ বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে প্রথম নগ্ন বিজ্ঞাপনের প্রচলন করে।
ব্রাজিল, কানাডা, চীন, জার্মানি, সাউথ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২০০৮ সালের এক তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞাপনগুলো তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল। সেখানে জার্মানি ও থাইল্যান্ডের বিজ্ঞাপনে নারীদেহ বেশি দেখানো হয়। তবে পুরুষের নগ্নতায় তেমন কোনো বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়নি।
২০ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞাপনে প্রথম মনোবিজ্ঞানের সচেতন ব্যবহার শুরু করেন তৎকালীন প্রখ্যাত আমেরিকান মনোবিদ ওয়াল্টার ডি স্কট এবং জন বি ওয়াটসন। স্কট বলেন, মানুষকে যুক্তিবাদী প্রাণী বলা হলেও এটাও সত্যি যে তাকে ও তার যুক্তিকে প্রভাবিত করা সম্ভব। অন্যের নির্দেশ ও পরামর্শে মানুষ প্রভাবিত হয়।
এই দুই মনোবিদ আরও বলেন, মানুষের মৌলিক আবেগ, যেমন ভালোবাসা, ঘৃণা ও ভয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করলে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে।
এ ধারণা থেকে তারা নির্দেশমূলক বার্তা দিয়ে বিজ্ঞাপনের আধেয় তৈরি শুরু করেন, যা দারুণভাবে কাজে দিয়েছিল। এখনো মানবীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে, যা বিপণনের প্রসারের পাশাপাশি নানা সামাজিক বার্তা ছড়াতেও অত্যন্ত কার্যকর।
এই মনোবিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কোমল পানীয়, ফাস্টফুড, এমনকি সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্যের বিজ্ঞাপনেও স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা যোগ করা শুরু হয়। এখন এই কৌশল ফেসওয়াশ থেকে শুরু করে অধিকাংশ ব্যবহার্য পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হচ্ছে।
অ্যাড এজেন্সি
১৮৪০’র দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘বিজ্ঞাপনের এজেন্সি’ ধারণাটির জন্ম হয়। ভলনি বি পামার ১৮৪২ সালে ফিলাডেলফিয়ায় প্রথম অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি খোলেন। তিনি পত্রিকার কাছ থেকে কম দামে বিজ্ঞাপনের ভালো ভালো স্পেস কিনে কিছু বেশি দামে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করতেন। কিন্তু মূল বিজ্ঞাপনটি বানাতে হতো বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিকেই। সুতরাং তাকে মূলত বিজ্ঞাপনের দালাল বলা যায়।
অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির বর্তমান ধারণার প্রচলন হয় ১৯ শতকে নিউইয়র্কে এন ডব্লিউ আইয়ার অ্যান্ড সান এজেন্সি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এজেন্সিটি বিজ্ঞাপনদাতা যেমন চান তেমনভাবে পরিকল্পনা করে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করে প্রকাশের পুরো ব্যবস্থা করে দিত। ডি বিয়ার্স, এটিঅ্যান্ডটি এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্যও স্মরণীয় কিছু স্লোগান তৈরি করেছিল এন ডব্লিউ আইয়ার অ্যান্ড সান।
১৯ শতকের পুরোটা সময়ই অ্যাড এজেন্সির ধারণাটি ব্যাপক প্রসার লাভ করে ধীরে ধীরে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এই সময় থেকেই পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপনের জন্য স্পেস বাড়তে থাকে খুব দ্রুত। ১৮৯৩ সালে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞাপনের বাজারে ৫০ হাজার ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছিল।
স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞাপন মূলত লন্ডন ও প্যারিসের মতো সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অধীনে ছিল। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর পণ্যের বিজ্ঞাপনই অধীনস্থ দেশগুলোর ধাঁচে বা সেখানকার সুপরিচিত ব্যক্তিত্বদের ব্যবহার করে আলাদা করে তৈরি করা হতো। ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাবার পর আগের বিজ্ঞাপনের ধরনগুলো অনুসরণ করে বেশ কিছু দেশি পণ্যেরও বিজ্ঞাপন তৈরি হতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে এমন অসংখ্য বিজ্ঞাপনের নমুনা আমরা দেখতে পাই।
মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলো এখনো দেশভেদে একই ধরনের বিজ্ঞাপন স্থানীয় তারকাদের নিয়ে নির্মাণ করে থাকে।
জে ওয়াল্টার থমসন প্রথম আমেরিকান এজেন্সি যা লন্ডনে ১৮৯৯ সালে অফিস খোলার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে।
বর্তমানে মাত্র চারটি বিজ্ঞাপন এজেন্সি গোষ্ঠী বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করছে: ইন্টারপাবলিক, ওমনিকম, পাবলিসিস ও ডব্লিউপিপি। এদেরকে একত্রে ‘বিগ ফোর’ বলা হয়।