বিজ্ঞাপন: খ্রিস্টপূর্বে আবির্ভাব থেকে খ্রিস্টাব্দে বিবর্তন
আবির্ভাব ও বিবর্তনের ধারায় বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যৎ (পর্ব-১)
পত্রিকা পড়ছেন, টিভি দেখছেন, বা ইন্টারনেটে কোনো ওয়েবসাইট ঘাঁটছেন- মূল আধেয় বা কনটেন্টের সঙ্গে যে জিনিসটা ভাতের সঙ্গে তরকারির মতো থাকবেই, তা হলো বিজ্ঞাপন।
শুধু গণমাধ্যমেই নয়; রাস্তায় হাঁটতে চলতেও ব্যানার-বিলবোর্ডসহ নানা আকারের বিজ্ঞাপন প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে থাকি। রোজ এত বেশি বিজ্ঞাপন আমাদের চোখে পড়ে যে, টিভি চ্যানেলে নাটক-সিনেমা বা সংবাদ বুলেটিনের মাঝে ঘন ঘন বিজ্ঞাপন না দেখলে বা পত্রিকা-ওয়েবসাইটে কম বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে আমরা অবাকই হয়ে যাই।
কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের উৎপত্তি আসলে কীভাবে? অতীতে বিজ্ঞাপন কেমন ছিল? কীভাবে তা বর্তমান রূপ পেয়েছে? এর ভবিষ্যৎই বা কী?
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন (Advertising) হচ্ছে একটি মার্কেটিং বা বিপণন কৌশল, যার মাধ্যমে যে কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনের তথ্যগুলোই হয় এমন, যাতে গ্রাহক আকৃষ্ট হতে পারেন।
বিজ্ঞাপনের লক্ষ্যই হলো এমন ব্যক্তিদের কাছে পণ্য বা সেবা সম্পর্কে তথ্য পৌঁছানো, যার ফলে সম্ভাব্য গ্রাহক শ্রেণি তৈরি হয়। বিজ্ঞাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য সেই পণ্য বা সেবা সম্পর্কে জানিয়ে গ্রাহকের চাহিদাকে বাড়িয়ে দেয়া যেন আগে প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, বিজ্ঞাপনটির মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি সেটি কেনার প্রয়োজন বোধ করেন।
সোজা ভাষায় বললে: বিজ্ঞাপন হচ্ছে ব্যবসায়িক এবং বিপণনের উদ্দেশে কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে তথ্য তার সম্ভাব্য ভোক্তার কাছে পৌঁছানো।
আবির্ভাব ও বিবর্তন
বিজ্ঞাপনের ইতিহাসের সূত্র বাঁধা অতিপ্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতার সঙ্গে। বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞাপন কোন দেশে তৈরি হয়েছিল, এ নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। তবে ধারণা করা হয় এর উৎপত্তি মিশরে।
প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাসে তৈরি কাগজে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির বার্তা লিখে দেয়ালে লাগানোর পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করত। প্রাচীন পম্পেই নগরী ও আরব সভ্যতার ধ্বংসস্তুপেও বাণিজ্যিক বার্তা এবং রাজনৈতিক প্রচারবার্তা লেখা লিপি পাওয়া গেছে।
‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ অর্থাৎ ‘হারিয়েছে’ ও ‘পাওয়া গেছে’ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রাচীন গ্রিস ও রোমে অহরহ দেখা যেত।
দেয়াল বা পাথরে আঁকার মধ্য দিয়েও প্রাচীন যুগে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন বা রাজনৈতিক প্রচারণার কাজ করা হতো, যা এখনও এশিয়া, আফ্রিকা এবং সাউথ আমেরিকায় দেখা যায়। প্রস্তরলিপি ও প্রস্তরচিত্রের এই ঐতিহ্যের প্রমাণ খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালে ইন্ডিয়ান রক আর্ট পেইন্টিংয়ের মধ্যে দেখা গেছে।
এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-প্রমাণ অনুসারে, প্রাচীন চীনের সবচেয়ে পুরনো বিজ্ঞাপনগুলো ছিল মৌখিক। একাদশ থেকে সপ্তম খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়ের চীনা গান-কবিতা নিয়ে লেখা ‘ক্লাসিক অব পোয়েট্রি’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ওই সময়টায় বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে ক্যান্ডি বিক্রি করা হতো।
প্রথমদিকে মূলত ক্যালিগ্রাফিক সাইনবোর্ড এবং কাগজে কালি দিয়ে লেখার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের কাজ সারা হতো। তবে পুরাতত্ত্ববিদরা চীনের সং সাম্রাজ্যের (৯৬০-১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলের একটি তামা ও ব্রোঞ্জের পাত পেয়েছেন। সেটি একটি বিজ্ঞাপনের প্রিন্টিং প্লেট। প্লেটটি দিয়ে চারকোনা কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপা হতো।
প্লেটটির এক অংশে লেখা ‘জিনান লিউয়ের সূক্ষ্ম সূঁচ বিপণী’। অন্য অংশে লেখা ‘আমরা উন্নত মানের ইস্পাতের রড কিনি এবং সূক্ষ্ম সুঁই তৈরি করে থাকি, যেন তা ঘরে যখন তখন ব্যবহার করা যায়’। প্লেটটির ওপরের দিকে একটি খরগোশের লোগোও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বিজ্ঞাপনের মুদ্রণ মাধ্যম।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে শহর-নগর বড় হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানকার সাধারণ জনগণ ছিল নিরক্ষর। তাই লিখিত বিজ্ঞাপনের বদলে সেখানে শুরু হলো ছবি বা প্রতীকের প্রচলন। যেমন, মুচি, দর্জি বা কামারের দোকানের পরিচিতি দিতে শব্দগুলো লেখার বদলে সাইনবোর্ডে জুতো, জামা, টুপি ও ঘোড়ার নালের ছবি রাখা হতো।
আবার শহরের মাঝখানে মুদি সরঞ্জাম বিক্রির সময় দোকানদাররা আলাদা লোকই (Street criers) রাখত, যারা চিৎকার আর হাঁকডাক করে পণ্যের গুণাগুণ সবাইকে জানিয়ে দিত। এর প্রথম নথিবদ্ধ নমুনা সংকলন পাওয়া গেছে ত্রয়োদশ শতকে গুইলম দ্য লা ভিলেনুভে রচিত ‘লেস ক্রিয়েরিয়েস দ্য প্যারি’ (Street Cries of Paris) কবিতায়।
মুদ্রণপূর্ব কালে (১৫ শতকের আগে) মূলত তিন ধরনের বিজ্ঞাপনের অস্তিত্ব ছিল: ট্রেডমার্ক (চাঁদ/তারা…), টাউন ক্রাইয়ার এবং সাইনবোর্ড।
ট্রেডমার্ক
প্রায় ৪ হাজার বছর আগেই ট্রেডমার্ক বা সিলের ব্যবহার ছিল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ওই সময়ে উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্যের সঙ্গে পাথরের একটি সরল নকশার সিল লাগিয়ে দিতেন। সময়ের সাথে সাথে সেটি কাদামাটি বা পোড়ামাটির সিলে পরিণত হয়েছে, যেখানে ছাপার মাধ্যমে ছবি যোগ করা হয়ে থাকে।
ভারতে ১৩শ’ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিভিন্ন ধরনের সিলের নমুনা পাওয়া গেছে, যেখানে প্রস্তুতকারীর শনাক্তকারী চিহ্ন যোগ করা হতো।
মধ্যযুগ থেকে উন্নত মানের পণ্য চিহ্নিত করার জন্য সরকারিভাবে বিশেষ সিল বা চিহ্নের ব্যবহার প্রচলন শুরু হয় (যেমন বাংলাদেশ বিএসটিআই’র লোগো)।
টাউন ক্রাইয়ার
এদের কথা ওপরেই বলা হয়েছে। প্রথম দিকে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা বা প্রয়োজনীয় সংবাদ চিৎকার করে নিরক্ষর জনগণকে জানানোর জন্য কিছু মানুষকে রাখা হতো। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসায়ীরাও এই লোকদের ভাড়া করে নিজেদের পণ্যের প্রচার শুরু করে। অনেকে নিজেই চিৎকার করে নিজের পণ্যের গুণাগুণ প্রচার করে গাড়িতে করে সেগুলো বিক্রি করতে থাকে। এখান থেকেই ‘হকার’ ধারণাটির উৎপত্তি।
সাইনবোর্ড
পূর্ব ও পশ্চিমা বিশ্বে সাইনবোর্ডের প্রচলন হয়েছে ভিন্ন ভিন্নভাবে। একের সঙ্গে অন্যের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাচীন মিশরীয়, রোমান এবং গ্রিকরা দোকানের বাইরে সাইনবোর্ড ঝুলানো কাজটি শুরু করে ঝুলিয়ে রাখত। এছাড়াও হাটবারসহ বিভিন্ন বড় আয়োজন সম্পর্কে জনগণকে জানানোর জন্য এ ধরনের সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হতো।
চীনেও প্রাচীনকালে উন্নত মানের সাইনবোর্ড ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মধ্যযুগীয় ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের অধিকাংশ এলাকায় সরাইখানার সামনে সাইনবোর্ড বা সাইনেজ টাঙানো বাধ্যতামূলক ছিল। মধ্যযুগ জুড়ে বাণিজ্যিক কাজে সাইনবোর্ড জাতীয় বিজ্ঞাপনের ব্যবহার ব্যাপক প্রসার পায়।
জাপানে ইদো বা টকুগাওয়া যুগে ১৮০৬ সালে প্রকাশিত একটি ফ্লাইয়ার জাতীয় বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে। সেখানে ‘কিনসেইতান’ নামক ঐতিহ্যবাহী একটি ওষুধের গুণাগুণ বর্ণনা করে তা কিনতে বলা হয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞাপন
শুরু
আধুনিক বিজ্ঞাপন তার রূপ পেতে শুরু করে ১৬ ও ১৭ শতকে পত্রিকা-ম্যাগাজিনের উন্নয়নের সাথে সাথে। ভেনিসেই প্রথম ১৬ শতকের প্রথমদিকে সাপ্তাহিক গেজেট প্রকাশ হওয়া শুরু হয়। সেখান থেকে সাপ্তাহিক প্রকাশনার ধারণা ছড়িয়ে পড়ে ইতালি জার্মানি এবং হল্যান্ডে।
ব্রিটেনে প্রথম সাপ্তাহিক প্রকাশনা ১৬২০’র দশকে চালু হয়। আর প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি কুর্যান্ট’ ১৭০২ থেকে ১৭৩৫ সাল পর্যন্ত ছাপা হতো। মুদ্রণ ও সরবরাহের খরচ বহনের জন্য প্রকাশনার প্রায় গোড়া থেকেই পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন ছাপানো শুরু হয়।
প্রথম দিকের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলো ছিল বই এবং ঘরোয়া ওষুধের। কিন্তু ১৬৫০’র দশকে নানাবিধ পণ্যের বিজ্ঞাপন লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে যায়।
মুদ্রণ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে ব্যবসায়ীরা হ্যান্ডবিল এবং ট্রেড কার্ড ছাপানো শুরু করেন। যেমন ১৬৭০’র দশকে লন্ডনে জনাথন হোল্ডার নামের এক খুচরা ব্যবসায়ী তার পণ্যের তালিকা ও মূল্য সংযোজন করে হ্যান্ডবিল তৈরি করে প্রত্যেক ক্রেতাকে বিতরণ করতে থাকেন। ওই সময়ে হোল্ডারের এই পরিকল্পনাকে তার ব্যবসার জন্য ‘বিপদজনক একটি চেষ্টা’ এবং ‘অহেতুক খরচ’ বলে মনে করা হতো।
একেবারে প্রথম দিকের ট্রেড কার্ডগুলো মোটেও কার্ড ছিল না। আদতে সেগুলো ছিল সাধারণ কাগজে মুদ্রিত বক্তব্য, তাও আবার কোন ছবি ছাড়া। ১৮ শতকের দিকে অবশেষে কার্ড জাতীয় মোটা কাগজে ছাপা শুরু হতে থাকে ট্রেড কার্ড, যেখানে ব্যবসায়ীর নাম ঠিকানাসহ উল্লেখ থাকত। বিবর্তনের ধারায় সেগুলোই বিজনেস কার্ড বা ভিজিটিং কার্ডের রূপ নিয়েছে।