চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিচ্ছিন্ন প্ল্যাকার্ড যে কোনো আন্দোলনের চরিত্রস্মারক নয়

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের মুখে সরকার, এনবিআর ভ্যাট আদায় সম্পর্কিত নতুন করে ব্যাখ্যা দেওয়ার পর এ আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অন্যমাত্রা পেয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্তের পর এ আন্দোলন অব্যাহত রাখা যৌক্তিক, নাকি বন্ধ করা যৌক্তিক এর চাইতে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের দাবি আদায়ের প্রকাশ কৌশলকে অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। 

স্পষ্টত এ ইস্যুতে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কী স্লোগান লিখে প্ল্যাকার্ড বহন করল সে ইস্যুটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে অনেকের কাছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, কোন কোন প্লাকার্ডের বক্তব্যকে উদ্দেশ করে অনেকেই আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে মরিয়া।

বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক সন্দেহ নেই, কারণ সব প্ল্যাকার্ডে লেখা সব বক্তব্যই আন্দোলনের উদ্দেশ্য যে সবক্ষেত্রে বহন করবে তা ভাবার কোন কারণ নাই। যেহেতু এ আন্দোলন এক দাবিতে বিচ্ছিন্নভাবে জড়ো হওয়া হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সংঘঠিত হয়েছে সেহেতু এখানে বিচ্ছিন্ন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে দেখার বিষয় আন্দোলনের সামগ্রিক উদ্দেশ্য। এবং আন্দোলনের সামগ্রিক উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে। 

যে কোন আন্দোলনে স্লোগান, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার-ফেস্টুন সহ বিবিধ প্রচারসামগ্রি আন্দোলন সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞাত করতে সাহায্য করে, জনমত সংগঠনে ভূমিকা রাখে। এর বাইরে আন্দোলনকারীদের এসব উপকরণ নিজেদেরকেও উদ্ধুব্ধ করে সন্দেহ নেই। কোন কোন স্লোগান কিংবা বহন করা প্ল্যাকার্ডসহ অন্যান্য উপকরণ আন্দোলনকারীদের আরও বেশি উৎসাহ যোগায় সন্দেহ নেই এক্ষেত্রে অতিউৎসাহী ধরণের অনেক কিছুই হতে পারে, এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখা যায় যখন একটা বৃহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, বলা যায় সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়।

আন্দোলনের সামগ্রিক উদ্দেশ্য যখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট নেওয়া যাবে না- তখন বাকিগুলো অনেকটাই মূল্যহীন যদি না তা আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় ও দেশপ্রেমের চেতনায় আঘাত না হানে। 

এ প্ল্যাকার্ডগুলোর মধ্যে অনেকগুলো প্ল্যাকার্ড ইতিবাচকভাবে আলোচনায় এসেছে, অনেকগুলো আবার নেতিবাচকভাবে আলোচনায়। নেতিবাচক আলোচনায় থাকা প্ল্যাকার্ডের একটায় লিখা ছিল- “মন পাবি, দেহ পাবি but VAT পাবি না”। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি এধরণের প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ানো ছিল একাধিক আন্দোলনকারী, যার মধ্যে ছেলে-মেয়ে দুই’ই ছিল। কিন্তু নেতিবাচক আলোচনার প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়াল একটা মেয়ের হাতে রাখা সে প্ল্যাকার্ড। এবং দৃষ্টিকটুভাবে সে ছবি শেয়ার করে মেয়েটিকে উদ্দেশ করে কুরুচিপুর্ণ ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে, হচ্ছে। 

এটা অনুমিত যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু রুচির দীনতা দেখে আশঙ্কা করি শিক্ষার বিষয়টি কেবল কাগজে-কলমে থেকে গেছে অনেকটাই। একই প্ল্যাকার্ড একাধিক ছেলের হাতে থাকলেও সেটা আলোচনা-সমালোচনার খোরাক না হওয়ায় ধারণা করি এখনও শিক্ষিতজনের একটা অংশ নারীকে অপমানজনকভাবে উদ্ধৃত করতে ‘নারী’ হিসেবেই দেখতে পছন্দ করে। সে জন্যে একই বিষয় নিয়ে যখন একজন নারী প্রতিবাদ করে, হতে পারে ভুলভাবে কিংবা শুদ্ধভাবে প্রতিবাদ করে তখন সে প্রতিবাদের ভাষা  আদিম রস রূপলাভ করে সমালোচনার খোরাক হয়। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনার উপকরণ হওয়া সে প্ল্যাকার্ড যেভাবেই উদ্ধৃত করা হোক না কেন এ স্লোগানগুলো শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল বক্তব্য নয়। শিক্ষার্থীরা ভ্যাট দেবে না- এটাই মূল বক্তব্য। তাই এ প্ল্যাকার্ডকে সামনে নিয়ে এসে সৎ উদ্দেশ্যে শুরু হওয়া একটা আন্দোলনে কালিমা লেপনের যে উৎসব চলছে এটা শুভকর নয়।

একটা আন্দোলনে বিভিন্ন ধরনের লোক যোগ হতে পারে, কিন্তু আমরা দেখব কী তাদের উদ্দেশ্য। যারা এই প্ল্যাকার্ড নিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা কি প্রমাণ করতে চায় ‘দেহদানের’ জন্যেই ছিল এ আন্দোলন। এধরণের অপপ্রচারের সঙ্গে গণজাগরণ আন্দোলনকালীন জামায়াত-আমার দেশ-বাঁশেরকেল্লার অপপ্রচারের কোন বৈসাদৃশ্য নেই। হুবহু, কেবল আগে যারা ওদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে নিজেদেরকে প্রগতিশীল দাবি করেছিল তারা সে প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছ থেকে অনৈতিক সে শিক্ষা গ্রহণ করেছে শুধু!

মুখে প্রগতিশীল আর অন্তরে প্রতিক্রিয়াশীলতা যদি হয় প্রকৃত পরিচয় তাহলে এখন যারা একটা ছবিকে আলোচনায় নিয়ে এসে সমালোচনার খই ফোটাচ্ছেন তাদেরকে আপনারা ভুল বিষয় উদ্ধৃত করছেন এটা মনে করিয়া দেওয়া বৃথা। তবে ধারণা করি, যারা এ প্ল্যাকার্ড নিয়ে আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা হয়ত সাময়িক উত্তেজনায়ই এটা করছে। শিক্ষার্থীরা ভ্যাট দেবে না- এ দাবির সঙ্গে প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপপ্রচারকারীদের অনেকেই একমত বলে বিশ্বাস করতে চাই।

আন্দোলনের কারণেই সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। ভ্যাট সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে এসে ব্যাখ্যা করে সাময়িকভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করেছে। আন্দোলনকারীরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে, সরকার দাবি মানবে এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যে কোন সরকার যখন কোন দাবি মানবে এটাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে, কেন কিছু লোক বিষয়টিকে সরকারের পরাজয় হিসেবে দেখছে? আর এ দলভুক্তরা স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক চোখে দেখে কেন নামছে একটা আন্দোলনে অংশ নেওয়া খুব ছোট্ট এক অংশের ছোট্ট একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে চরিত্রজনিত কালিমালেপনে।
শিক্ষার্থীরা ভ্যাট দেবে না- এ দাবির সাথে একমত ছিলাম,আছি। দাবিপূরণ হয়েছে, আমি খুশি। ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয়, এনবিআরের এ ব্যাখ্যায় ভ্যাটের ব্যাকরণগত ত্রুটি সারিয়ে নিলেই হয়। এখন টিউশন ফি না বাড়লেও আগামিতে বাড়বে এ আশঙ্কা যৌক্তিক মেনে নিয়েই বলি এখানে নজরদারির দরকার। প্রয়োজনে অলাভজনক খাতকে লাভজনকখাতে ঘোষণা দেওয়া যায়। এনবিআর, অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিশ্বাস করি না- এ ধরণের মনোভাব যে কোন পর্যায়েই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সব পর্যায়ে তাদেরকেই বিশ্বাস করতে হবে; এছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ তারাই সে কর্তৃপক্ষ! 

সৎ ও যৌক্তিক উদ্দেশ্যে শুরু হওয়া একটা আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন একটা প্ল্যাকার্ড সে আন্দোলনের চরিত্রস্মারক নয়। এ প্ল্যাকার্ডের বক্তব্য ভুল-শুদ্ধ দুইভাবেই ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, সে রকমই হচ্ছে কিন্তু কেউ যদি এ ভাষাগুলোকে ভুল ভাবেন তবে এটাও ভেবে নিতে পারেন- যে বা যারা এ প্ল্যাকার্ড বহন করেছে এটা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা; সামগ্রিকভাবে আন্দোলনের চরিত্র নয়। 
অদ্য যারা বিচ্ছিন্ন একটা প্ল্যাকার্ড ঘিরে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের উদ্দেশে শুধু বলব আবার চিন্তা করে দেখেন আপনি/ আপনারা ভুল করছেন কিনা? আমার বিশ্বাস সঠিক উত্তরটা আপনাদের নিজেদের কাছেই আছে! 

উত্তর যখন নিজের কাছে এদিক-ওদিক না ঘুরে নিজেকেই প্রশ্ন করুন!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)