দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নিজেকে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। ৪৩ বছর আগে তিনি দেশের প্রথম নারী বিচারক (মুনসেফ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ২০১৭ সালের ৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
সামাজিক-পারিপার্শ্বিক নানা প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা একজন নারী হিসেবে সফলতার চূড়ায় পৌঁছানোর গল্প সরলতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমার জন্ম ১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে। তবে আমিসহ আমাদের পাঁচ ভাইবোনের শৈশব-কৈশোর কাটে ময়মনসিংহে। আমার বয়স যখন ১১ তখন আমার আব্বা আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন মারা যান। আব্বার ইচ্ছা ছিল তার সন্তানদের মধ্যে একজন ব্যারিস্টার হবে। কিন্তু আব্বা মারা যাবার পর আমার বিধবা মায়ের পক্ষে কোন সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ানো সম্ভব ছিল না। তাই তখন আমার মনে হয়েছিল, আমি এদেশেই আইন পড়লে হয়ত আমার আব্বার ইচ্ছা খানিকটা হলেও পূরণ হবে।’
বাবার ইচ্ছেকে মনে লালন করেই তিনি ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি মোমেনশাহী ল’ কলেজে ভর্তি হন।
ল’ কলেজে পড়ার স্মৃতিচারণ করে নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘ল’ এর ক্লাস শেষ করে আমার বাসায় ফিরতে রাত ৯টার বেশি বেজে যেত। ওইসময় মফস্বল শহরে অল্প বয়সের একটা অবিবাহিত মেয়ের রাত ৯টায় একা বাসায় ফেরা সাধারণ ব্যাপার ছিল না। একপর্যায়ে ১৯৭২ সালে আমি এলএলবি পাস করি এবং পরবর্তীতে ময়মনসিংহ জজকোর্টে ওকালতিতে যুক্ত হই।’
ল’ পাস করার পর জেলার প্রথম নারী আইনজীবী হিসেবে ময়মনসিংহ জজকোর্টে যোগদান করার দিনের কথা স্মরণ করে নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘সেদিনের কথা আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত জজসাহেবের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলা কথাগুলো শুনছিলাম। ওইসময় থেকেই আমার মনের কোনে জজ হওয়ার ইচ্ছাটা উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু আমার সে ইচ্ছা আবার মুহূর্তেই থমকে গিয়েছিল। কারণ ওই সময় বাংলাদেশে নারীরা জজ হতে পারতো না। তাই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমি কোর্টে ওকালতি শুরু করলাম। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হল, আমার ওকালতির দেড় বছরের মাথায় বাংলাদেশ সরকার ‘নারীদের বিচারক না হওয়ার বিধান’ তুলে দিল। এবং পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে বিচারক (মুনসেফ) পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি এলো। আমি উৎসাহের সাথে মুনসেফ পদে আবেদন করলাম।
মুনসেফ পদে পরীক্ষার স্মৃতি তুলে ধরে নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘ওই পদে আবেদন করার কিছুদিন পর আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমি ময়মনসিংহ ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে তার কর্মস্থল খুলনায় চলে যাই। তবে পরবর্তীতে ঢাকায় আমার এক কাজিনের বাসায় থেকে মাত্র ৫-৬ দিন পড়াশুনা করে পরীক্ষাটা দেই। একে একে পরীক্ষার সবকয়েকটি ধাপে পাস করে আমি নিয়োগ পত্র পাই। এবং ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে দেশের প্রথম নারী বিচারক তথা মুনসেফ হিসেবে যোগদান করি।
নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, আমি মুনসেফ হওয়ার পর তা সংবাদপত্রে গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়েছিল। অনেকে আমাকে স্বাগতম জানিয়েছিল তবে একজন নারী বিচারক হওয়ায় অনেকেই নাক সিটকেছিল। কেউ কেউ বলেছিল, নারী বিচারক আবার কী বিচার করবে! তবে বিরূপ মন্তব্যে আমি কখনোই কান দেয়নি। বরং আমি আমার বিচারিক কার্য মন দিয়ে করতে থাকি। সে ধারাবাহিকতায় খুলনায় ৩ বছর বিচারকের কাজ করার পর আসি নারায়ণগঞ্জ এবং পরে টাঙ্গাইলে মুনসেফ হিসেবে কাজ করি। এরপর আমি প্রমোশন পেয়ে টাঙ্গাইলের সাব-জজ হই এবং পর ফরিদপুর বদলি হই। তবে ফরিদপুরে থাকা অবস্থায়ই আমি অতিরিক্ত জেলা জজ হই এবং পরবর্তীতে আমাকে ঢাকায় বদলি করা হয়। এরপর আমি কিছুদিন আইন মন্ত্রণালয়ে ডেপুটি সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করি এবং এখান থেকে প্রমোশন পেয়ে আমি দেশের প্রথম নারী জেলা জজ হই। এরপর কয়েকটি জেলাতে জেলা জজ হিসেবে আমি কাজ করি।
বিচারিক আদালতের সব কয়টি স্তরে দেশের প্রথম নারী হিসেবে সাফল্যের পর নাজমুন আরা সুলতানা নিয়োগ পান উচ্চ আদালতে। সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০০০ সালের ২৮ মে আমি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার দুই বছর পর আমি হাইকোর্টে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে যোগদান করি। আর এর দশ বছর পর ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে আমি যোগদান করি। আর ২০১৭ সালের ৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি থেকে আমি অবসরগ্রহণ। এখন হয়ত বিচারঙ্গনের নানা অভিজ্ঞতা ও ঘটনার স্মৃতিচারণ করেই কাটবে আমার অবসর জীবন।
সুদীর্ঘ ও সফল কর্মময় জীবনের কথা তুলে ধরে দেশের বিচারঙ্গনের অগ্রপথিক এই নারী বলেন, ‘আমি আমার সুদীর্ঘ বিচারিক জীবনে সমস্ত জ্ঞান–বুদ্ধি, মনোযোগ ও একাগ্রতা দিয়ে বিচার কাজ করে গেছি। ৪২ বছরের বিচারক জীবনের প্রত্যেকটা পর্যায়েই আমি সফল হয়েছি। প্রথম নারী বিচারক হিসেবে আমি ব্যর্থ হলে হয়ত বাংলাদেশে চার শতাধিক নারী বর্তমানে বিচারক হতে পারত না। আমি আসা করি দেশে নারী বিচারক ও বিচারপতির সংখ্যা আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, সাফল্যকে সঙ্গী করেই সব সময় এগিয়ে যাবে এদেশের নারী।