চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বিচার পাওয়ার আশা এখন শুধুই দুরাশা

প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাকাণ্ড

ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে বিশ্বজিৎ দাসের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার না হওয়ায় বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, সমাজ প্রতিবাদের শক্তি হারিয়েছে। আমাদের মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এসব হত্যাকাণ্ড থেমে নেই।

গত বুধবার সকালে বরগুনা শহরে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে তার স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার সময় পাশে থাকা অনেকে এ নারকীয় তাণ্ডব দেখলেও কেউ সন্ত্রাসীদের ঠেকানোর চেষ্টা করেনি।

এ হামলার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নিন্দার ঝড় ওঠে। ভিডিওতে দেখা যায়, হাতে থাকা একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে কোনো রকমে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালান রিফাত। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। দুই যুবক রামদা দিয়ে তার সারা শরীরে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে।

রিফাতের স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি এ সময় একবার নয়নকে, আরেকবার নয়নের সহযোগী রিফাত ফরাজীকে আটকানোর চেষ্টা করেন। তিনি ‘বাঁচাও’, ‘বাঁচাও’, ‘না’ ‘না’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু ততক্ষণে রামদার কোপে গুরুতর জখম হন রিফাত। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

এই ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিরোধীদলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নির্মমভাবে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যাকাণ্ডের কথা। সেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে কোপায়। বাঁচার জন্য দৌড় দিলেও তিনি শাঁখারীবাজারের রাস্তার মুখে পড়ে যান। রিকশাচালক রিপন তাকে রিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক বিশ্বজিৎকে মৃত ঘোষণা করেন।

আরেকটি ঘটনা ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবরের। সেদিন বিকেলে সিলেটের এমসি কলেজের সামনে কলেজ ছাত্রী খাদিজা বেগমকে চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে আহত করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম। প্রথম দিকে খাদিজা বেঁচে থাকবেন এমন আশা ছিল না, তবে তিনি এ যাত্রা বেঁচে গেছেন এবং খুবই ধীর গতিতে সেরে উঠেন।

বরগুনার ঘটনায় রিফাতের স্ত্রী সাহায্য চাইলেও সামনে থাকা কেউ সাড়া দিলেন না এই সামাজিক অবক্ষয়টা কেন হচ্ছে? জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মানুষ সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিয়তা পাচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর থেকে শুরু করে কোথাও নিরাপত্তা পাচ্ছে না। তারা যে এগিয়ে আসবে, পরে যদি তাদের ওপরই হামলা হয় তাহলে সেটা নিরাপত্তা কে দিবে?

কাজী রিয়াজুুল হক

তিনি বলেন, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সেই মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে, মামলার সাক্ষীদের উপস্থাপন করা, আদলতের ওপর চাপ রাখা এবং অপরাধীর শাস্তিটা দৃশ্যমান করতে হবে।

‘যতোদিন পর্যন্ত না অপরাধীদের মনের ভেতর ভয়  আসবে যে অপরাধ করলে পার পাওয়া যায় না, এবং এরজন্য কঠোর শাস্তি আছে। ততোদিন পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে।’

এসব ঘটনা যেখান ঘটবে সেখানকার প্রশাসনকে শক্ত হয়ে তদন্ত করতে হবে জানিয়ে কাজী রিয়াজুল হক বলেন: রাষ্ট্রের যে আস্থার জায়গাগুলো আছে সেগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।এবং তাদের ওপর শক্তিশালী তদারকি রাখতে হবে।

প্রকাশ্য দিবালোকে এমন বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড সমাজের কোন ব্যাধির নির্দেশ করছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিকতার সঙ্গে দুর্নীতি ব্যাপক হারে বেড়েছে। যার যে জায়গায় থাকার কথা না, সে ওই জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আবার অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি যে দায়িত্বশীলতা নিয়ে আচরণ করার কথা ছিল সেটা যখন করছে না ফলে সমাজে এ ধরনের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।’

ড. সাদেকা হালিম

তিনি বলেন, বরগুনায় রিফাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়সহ একটি গ্রুপ ভিত্তিক গ্যাং কালচারের কথা জেনেছি। প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাকাণ্ডের পর যদি পুলিশ হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে না পারে তাহলে মানুষের মধ্যে আস্থাটা কমে যায়। আর যারা এ ধরণের কাজে লিপ্ত হয় তারা পার পেয়ে যায় বলে পরে আবারও এসব কাজ করতে পিছু পা হয় না।

ড. সাদেকা হালিমের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও সমাজের একটা শক্তি ছিল, নিজস্ব একটা প্রতিবাদ ছিল সমাজের। মানুষ যদি চোখের সামনে এর অন্যায় যদি দেখতেন তাহলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে যেতেন।

কিন্তু এখন মানুষ সামনে থেকে কোনো অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে দেখলেও সেটার প্রতিবাদ করছে না কারণ ভয়ে কিংবা নিরাপত্তাহীনতার জন্য।অন্যদিকে আমরা দেখছি যে ফৌজদারি ন্যায় বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ক্রুটিবিচ্যুতির কারণে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।বাকি ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ অপরাধী শাস্তির আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।’

‘‘এছাড়াও পুলিশ, উকিল, বিচারিক আদালতে দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। সেখানে সৎলোক থাকলেও নানা কারণে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে পারছে না।

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

যে কারণে সমাজে বা রাষ্ট্রে অপরাধ কম হবে বা হবে না সে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং সেটা প্রতিস্থাপন হচ্ছে না।আগে অপরাধের প্রতিবাদ হতো এখন হচ্ছে না এর কারণ হচ্ছে সমাজের সেই শক্তিটা নেই।পরিবার ধর্ম শিক্ষা সংস্কৃতি এরকম অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহিংসা অপরাধ দুর্নীতি হ্রাস করা হয়, নির্মুল করা হয়।সেই শক্তিগুলো ও প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে।’’

বরগুনা জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, “আমরা সবাই বুঝতে পারছি যে ব্যক্তিগত কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।”

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রিফাতের বাবা বৃহস্পতিবার ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। এরই মধ্যে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করলেও গ্রেপ্তার হয়নি মামলার মূল আসামিরা।

রিফাত হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছে বরগুনাবাসী। শনিবার সকাল ১০টার দিকে বরগুনা প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ’ এর ব্যানারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সময় বক্তারা রিফাত শরীফকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।