নয় বছর আগে ২০০৭ সালের সমাপনী দিনটিতে তাঁর পার্থিব জীবনটিতে সমাপনী চিহ্ন পড়েছিল। জীবন সূচিত হয়েছিল ১৯২৪ সালের ২৫ জুলাইয়ে পিতার কর্মস্থল ফরিদপুর জেলায়। আদি বাড়ি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কৈথন গ্রামে। ৮৩ বছরের একটি জীবনকাল নিয়ে পদ্মা মেঘনা-যমুনা রূপনারানের কূলে আঁধার কাটাতে মানবতার সপক্ষে জ্বালিয়ে রেখেছেন অন্তহীন দীপশিখা। বৈরী প্রহরে ছিলেন উজানের সাহসী মাঝি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শাশ্বত প্রতিবাদের অজস্র স্বাক্ষর রেখে এই বিনীত দৃঢ়চেতা মানুষটি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন স্বীয় কাজে, প্রতিষ্ঠায়, নিবেদনে। প্রয়াণের নয় বছরে বিচারপতি কে এম সোবহানকে জানাই অভিবাদন, প্রণতি এবং হৃদয়-অঞ্জলি।
৮৩ বছরের জীবনে বিচারপতি সোবহান বাংলা প্রান্তরে ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ তিনটি আমলের নানারূপ আমলনামা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। দেখেছিলেন তিনটি আমলেই ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সামরিক জেনারেলদের সামনে কী করে বিচারক-বিচারপতিদের বিবেক ভুলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি দেখেছিলেন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর অনমনীয় নজিরও। দ্বিতীয় দেখাটিকে জীবনে প্রথম করে নিয়েছিলেন। অতএব, যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ১৯৮২ সালের স্বৈর জেনারেল রাষ্ট্রদূতের অবস্থান থেকে দেশে সরিয়ে এনে বিচারপতি সোবহানকে রাষ্ট্রের অর্পিত বিচারপতিত্বের দায়ভার ঘুচিয়ে দেন কুটিল হিংস্রতায়। সুপ্রিম কোর্টকেন্দ্রিক আইনজীবীদের সংগ্রামী সংঘবদ্ধতা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম ছিল পাকিস্তান আমল থেকেই সামরিক নেতৃত্বের কাছে বিপদশূলের মতো। প্রতিবাদের দুটি কেন্দ্র থেকে নীতিনিষ্ঠদের অপসারিত করে নীতিহীন পদলেহীদের প্রতিষ্ঠিত করা ছিল ওদের রণনীতি ও রণকৌশলের অংশ।
আনুষ্ঠানিক পদ থাকুক না থাকুক, এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, তাদের বিবেকের দীপশিখা কিছুতেই নেভে না। তাই তো আমরা ১৯৮২ সালে বিচারপতির দায়িত্ব থেকে অপসারিত কে এম সোবহানকে দেখেছি তিমিরবিনাশী দীপশিখা হাতে জীবনের কর্মক্ষম অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত অটল-অবিচল সংগ্রামী হিসেবে সম্মুখপ্রান্তে। আশির দশকজুড়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তার সবিশ্রান্ত কর্মধারা উদ্দীপিত করেছে রাজপথ সারথি আর সমাজের নানা পর্যায়ের বিবেক পরিশ্রুত মানুষগুলোকে। দানবের বিরুদ্ধে মানবের সামগ্রিক সংগ্রামের চিরায়ত সাথি হিসেবে রাখলেন দৃষ্টান্তমূলক অগ্রযাত্রার স্বাক্ষর। একই সঙ্গে শান্তি-মৈত্রী-গণতন্ত্র-মানবাধিকারের সপক্ষে যুগপৎ নানাবিধ ভূমিকা পালনে বিচারপতি কে এম সোবহানের নিরলস মনোনিবেশ বিস্মিত করেছিল নিবিষ্ট সহযোদ্ধাদেরও। যতই বাড়ছে তাঁর বয়স, ততই বাড়ছে উদ্যম।
বিংশ শতাব্দীর অন্তিম দশকে দেখেছি যুদ্ধাপরাধবিরোধী সংগ্রামের এক মানবিক প্রচ্ছদ হিসেবে তাঁকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় দেখেছেন; কিন্তু রায় কার্যকর দেখার সাধ তার পূরণ হয়নি। কিন্তু পরম প্রার্থিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজের সূচনাটুকুও দেখার সুযোগ হয়নি তাঁর। না, কোনো আক্রোশ নয়, প্রতিহিংসা নয়, বিচারপতি সোবহান ভাবতেন, বলতেনও, যুদ্ধাপরাধের বিচার না হলে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রাম এবং বিপুল আত্মত্যাগের মহিমা বিপর্যন্ত হয়ে পড়বে। আজ ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এই প্রয়াণ দিবসের অর্ঘ্য হিসেবে তাঁকে একটি সুসংবাদ জানাতে পারিথ মাননীয় বিচারপতি, আপনার সুপ্রিয় বাংলাদেশের ভূমিতে আমরা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের অভাবনীয় দৃঢ়তায়, জনগণের বিপুল সমর্থনে যুদ্ধাপরাধীদের সম্মুখভাগের বেশ কয়েকজনকে সর্বোচ্চ শান্তি বিধান করতে সক্ষম হয়েছে বাধার হিমালয়-বিঘ্ন অতিক্রম করে। কষ্ট বুকের মাঝে, স্যার, আপনি আজ প্রয়াত, এমন বিজয়ের দৃশ্য বাংলাদেশ আপনাকে দেখাতে পারল না। হ্যাঁ, স্যার বলেই ডাকতাম তাঁকে।
সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধ, মৌলবাদ আর যুক্তিহীনতার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর সুস্পষ্ট অবস্থান। দুর্বলের বিরুদ্ধে সবলের দাপটি নিবর্তনের সবধরনের প্রকাশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রবল জেদ ছিল বিচারপতি সোবহানের। জাতিগত কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ের যে সংখ্যালঘুই হোক না কেন, যখনই যেখানে অন্যায়-অবিচার-নির্যাতন-বঞ্চনার খবর মিলেছে, ছুটেছেন তিনি। নিপীড়ন যজ্ঞের অকুস্থলে গিয়ে খবর নিয়েছেন ভুক্তভোগীদের। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানবিকতায়, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে কত যে শ্রম, বুদ্ধি ও মেধার সম্মিলনে কার্যকর অবস্থান নিয়েছেন, তাঁর প্রয়াণজনিত শূন্যতায় ঢের প্রমাণ মিলেছে সংগ্রাম-সতীর্থদের কাছে।
২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় ঠাণ্ডা মাথার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনায় দেশের ৪৩টি জেলার ৬৩টি উপজেলায়, বিশেষত হিন্দু সমাজের ওপর যে রোমহর্ষক অত্যাচার পরিচালিত হয়, তার বিরুদ্ধে কঠিন সময়েও জেগে ওঠে তীব্র প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদী কর্মধারায় বিচারপতি কে এম সোবহান ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধযজ্ঞ পরিচালনার এই মানবাধিকারবিরোধী অপকর্ম সম্পর্কে দেশ-বিদেশে সচেতনতা সৃষ্টির সাহসী সংগ্রামে একনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। এদিকে ‘আন্তর্জাতিক খতমে নবুয়ত সম্মেলন’ শিরোনামে দেশের ভেতর আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হিংস্র অত্যাচার পরিচালনার ঘটনা ঘটে। এ সময় বিচারপতি সোবহানকে আমরা দেখেছি বার্ধক্যকে জয় করেও উপদ্রুত আহমদিয়া সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চলে নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়াতে, কঠিন রোদ-বৃষ্টিতেও রাজপথে প্রতিবাদী আয়োজনে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস এবং আইনে সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়েছিলেন কে এম সোবহান। ১৯৫২ সালে বিলাতের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় আইন পেশার জীবন শুরু করেন। ১৯৭১ সালে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। পূর্ব জার্মানি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বভার পালন করেন বাংলাদেশ আমলে। বাংলা এবং ইংরেজিতে চমৎকার অধিকার। কলাম লিখেছেন দেদার। নীতিনিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ। হাঁটতেন নিয়মিত। জীবনাচারে পরিমিত। সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ। প্রগতিশীল আন্দোলনের নিবিড় মিত্র। মানবিক গুণে এমন সম্পন্ন মানুষের প্রয়াণবার্ষিকীতে লেখার সুযোগ পাওয়াটাই প্রগাঢ় গর্বের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)