আমাদের দেশে শীতকালে রাজনীতি গরম থাকে। এবারও কী তাই ঘটতে চলেছে? বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বহুদিন পর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাব পেশ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ওই প্রস্তাবকে ‘চর্বিতচর্বণ ও অন্তঃসারশূন্য’ বলে মন্তব্য করেছেন। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
খালেদা জিয়া তার প্রস্তাবে বলেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল এমন সব দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সব সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন দলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। রাষ্ট্রপতি সর্বজনশ্রদ্ধেয়, প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন।
প্রস্তাবের অন্তত সাতটি জায়গায় ‘সকল দলের ঐকমত্যের’ কথা বলা হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে, তাতে নিবন্ধিত দল ছাড়াও প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা জামায়াতকে এই প্রক্রিয়ায় রাখার কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা হচ্ছে।
‘জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল এমন সব দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে’ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে গেলে তো জামায়াতকে ডাকতে হবে। আর জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল। এই দলের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হলেও দলটি সম্পর্কে বিএনপি নেত্রী এখনও অবস্থান বদলাননি। অনেক সমালোচনার পরও জামায়াত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ‘২০ দলীয় জোটের’ গুরুত্বপূর্ণ শরীক।
বর্তমান বাস্তবতায় জামায়াতকে সঙ্গে রাখলে সরকারের সঙ্গে কার্যকর কোনো আলোচনা বা সংলাপ যে এগোবে না-সেটা কি তিনি বোঝেন না? তাহলে কেন তিনি এমন একটা প্রস্তাব দিলেন? সে কি ক্রমেই রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে হারিয়ে যাওয়া বিএনপিকে দৃশ্যপটে আনবার জন্য?
প্রস্তাবে বেগম খালেদা জিয়ার আরও বলেছেন, ‘নির্বাচন-কালীন সময়ে প্রতিরক্ষাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে ভোটকেন্দ্র ও বিশেষ স্থানগুলোতে মোতায়েনের ব্যবস্থা করবে। এটা ভোটের সাত দিন আগে থেকে ফলপ্রকাশের গেজেট প্রকাশনা পর্যন্ত স্থায়ী হবে।’
এই প্রস্তাবটিও ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। অনেকে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে অভিহিত করছেন। সেনাবাহিনী বা যে কোন অস্ত্রধারী বাহিনী রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের আদেশ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ করে। তাকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার নজির পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে নেই। যার হাতে অস্ত্র তার হাতে যদি ট্রিগার চাপার ক্ষমতা দেওয়া হয় তাহলে যাকে-তাকে মেরে সেটাকে বৈধতা দেওয়া হতে পারে। আর অস্ত্রধারী মানুষ অস্ত্রের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী হয়।
সে ক্ষেত্রে তুচ্ছ কারণে গোলাগুলি বা অরাজকতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। আবার আজকাল যে হারে বাহিনীগুলোর রাজনীতিকীকরণ হয়েছে তাতে করে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ আচরণ করবে, সংযম দেখাবে সেই ভরসাই বা কোথায়?
আর ‘নিরপেক্ষ’ ‘সবার কাছে গ্রহণযোগ্য’ এমন ব্যক্তির অস্তিত্ব আদৌ বাংলাদেশে আছে কী? গত ৩৬ বছরে এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের রূপরেখা তুলে ধরার পরের দিনই বেগম খালেদা জিয়া এক টুইট-বার্তায় বলেছেন, তার দেওয়া প্রস্তাব সকলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আলোচনা শুরুর ‘ভিত’ হতে পারে। তিনি আরও বলেছেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা আগামী দিনে যথাসময়ে উপস্থাপন করা হবে।’ তার মানে সামনে আরও ‘প্যাকেজ’ আসছে। যদিও তা বিকোবে বলে মনে হয় না।
রাজনৈতিক অংক বলে, বেগম খালেদা জিয়ার কোনো প্রস্তাবই যদি আওয়ামী লীগ না মানে, তবু তারা আগামী দিনে নির্বাচনে যাবে। বিএনপির পক্ষে নির্বাচন বর্জনের কোনো সুযোগ নেই। যদি আগামী নির্বাচনে বর্জনের পথে যায়, তাহলে বিএনপি বলে কোনো কিছুর অস্ত্বিত্ব থাকবে বলে মনে হয় না।
এখন প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত বিচারে কোনো নির্বাচনে যাবে কি-না। সেই আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সব ‘রূপরেখা’, ‘প্রস্তাব’ ঝেড়ে ফেলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি যদি ‘যে কারও অধীনে যে কোনো নিয়মে’ সরকারের কাছে ‘শুধু একটা নির্বাচন’ দাবি করে-তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
গায়ের জোরে হোক, আর কৌশলের জোরেই হোক, আওয়ামী লীগ একটা নির্বাচন করেছে, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে চরম ধরা খেয়েছে। তাদের ডাকা হরতাল, অবরোধ, অসহযোগিতা, পেট্রোল বোমা, আগুন, লাশ, নৈরাজ্য অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ ঠিকই দাপটের সঙ্গে রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। ‘বৈধতার সমস্যা’ কোনো সমস্যা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে না। না দেশে, না বিদেশে। না বিবেকের কাছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা যে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারে বেগম জিয়ার প্রস্তাব ‘হাস্যকর’ ও ‘জাতির সঙ্গে তামাশা’-কথাটা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেবার মত নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা তো দেখছেন, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলটি নিজেদের ভুল নীতি ও কৌশলের কারণে কী ভাবে দিন দিন স্বখাত সলিলে ডুবছে। ক্ষমতাসীনরা যা চাইছে, যেভাবে চাইছে, বিএনপি নামক দলটি তাই করছে। সেভাবেই ‘অ্যাক্ট’ করছে। জামায়াত নির্ভরতা থেকে তারা কিছুতেই বের হতে চাইছে না।
বিএনপি জামায়াতকে ‘ত্যাজ্য’ করার সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগকেই বরং এতদিনে বিপদে পড়তে হতো। তাদের বিএনপিবিরোধী গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু মাঠে মারা যেত!
বিএনপি সে পথে না হেঁটে আওয়ামী লীগকেই স্বস্তি দিয়েছে। তারপরও যদি বিএনপি তেড়ে-ফুঁড়ে জেগে উঠার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে জিয়া অরফানেস্ট ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা তো হাতে রয়েছেই! কাজেই বিএনপি যাবে কোথায়?’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)