দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। ঢাকার শাহবাগ হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের বাতি ঘর। গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাব হওয়াতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গতি এসেছিল। বিএনপি-জামায়াত গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গণজাগরণ আন্দোলন। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটিকে দলীয় গণ্ডি হতে বের করে তারাই জনতার শ্লোগানে রূপান্তরিত করে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে কোণঠাসা হয়ে ওঠে বিএনপি জামাতের রাজনীতি আর এগিয়ে যায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের রাজনীতি। সেই গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার সম্প্রতি বিএনপি জামায়াত কর্তৃক আক্রান্ত হলেন।
১৫ আগস্ট এক পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে, নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। এ ঘটনায় পুরো নিউইয়র্কজুড়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশি অধ্যুষিত ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডে তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে ঘুরতে বের হন যুক্তরাষ্ট্রে সফররত ইমরান এইচ সরকার। এ সময় কয়েকজন যুবক তাকে ঘিরে ধরেন। একপর্যায়ে এক যুবক বলেন, এই যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে আপনারা কিছুই বলছেন না।
জবাবে ইমরান এইচ সরকার বলেন, এটি ঠিক বলছেন না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে? জবাবে ওই যুবক বলেন, বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া শাহবাগে আপনারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহ দিয়ে আন্দোলন করেছেন।
এ সময় অন্ধকার থেকে এক যুবক তার দিকে জুতা নিক্ষেপ করেন। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় এক যুবক তাকে মারার জন্য তেড়ে যাচ্ছেন।
তখন পাশে থাকা তার এক আত্মীয় বলে ওঠেন, ভাই উনাকে ছেড়ে দেন, উনি নিজেও ক্রসফায়ারের তালিকায় আছেন। ইমরান এইচ সরকার তখন বলেন, আমরা সরকারের অন্যায় কাজের সমালোচনা করে যাচ্ছি। এ পর্যায়ে পাশের যুবক বলে ওঠেন, এখন আপনাদের টাকা-পয়সার ভাগে বনছে না, তাই এখন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
কিছুদিন আগে যে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না এই অভিযোগে বিদেশে লাঞ্চিত হলো সে সরকার কর্তৃক দেশেও লাঞ্চিত হয়েছেন তিনি। তাকে চোখ বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়েছিল র্যাব। এরপর ছেড়ে দিলে তিনি বিদেশ যেতে চাইলেও তাকে বাধা দেয়া হয়। এক কথায় এখন ইমরান এইচ সরকারের পক্ষে সরকারও নেই, সরকার বিরোধীরাও নেই। এমন কি উনার সংসারও নেই।তাকে ভালোবেসে ঘর বাঁধলেন শিক্ষামন্ত্রীর কন্যা। সম্প্রতি সেই স্ত্রীও তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। তার পক্ষে নেই তার গণজাগরণ মঞ্চও। কেন এমনটি হলো?
যে গণজাগরণ মঞ্চ একদিন সারাদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করলো। সেই গণজাগরণ মঞ্চই অাভ্যন্তরীন বিবাদে নিজেদের দৃশ্যমান বিভক্তি সৃষ্টি করে মানুষের কাছে হাস্যস্পদ হয়ে উঠলো। তারা রাজাকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হয়ে শুরু করলো নিজেদের মধ্যে লড়াই। গণজাগরণ মঞ্চের পাল্টা সরকারকে ফেলে দিতে আবির্ভূত হলো হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু আজ সরকারের সাথে তার সম্পর্ক কী? গণজাগরণের ইমরান এইচ সরকারকে আইন শৃংখলা বাহিনী চোখ বেঁধে তুলে নেয় আর হেফাজতের আল্লামা শফী প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন অনেকের সাথে বৈঠক করে। কী সেলুকাস রাজনীতি! কখন শত্রু ও মিত্র হয়ে যায় বলার উপায় নেই। আজ যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে সরকার আত্মতৃপ্ত সেদিন গণজাগরণ মঞ্চ যদি এ দাবিতে সোচ্চার না হতো ও জনমত সংগঠিত না করতো এ বিচারে গতি কি আসতো? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তারাই কি এ বিচারকে যৌক্তিক করে তোলেনি? তারা যুদ্ধাপরাধী ও তার তাবেদারদের ভোট দিতে বারণ করেছিল। সেসময় এটাও কি সরকারকে জয়লাভে সাহায্য করেনি?
ইমরান এইচ সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরোধিতা করেছে। আবার এর বিরোধী দাবীদারদের দ্বারা লাঞ্চিতও হয়েছে। তার উপর এই হামলায় শাহবাগে কোন কর্মসূচিও পালিত হলো না। একসময়ের তার তুখোড় সাথীরা আজ কোথায়? মত, দ্বিমত ভুলে কি এই হামলার বিরুদ্ধে একটা কর্মসূচি দেয়া সঙ্গত ছিলো না? দার্শনিকরা বলে, তোমার মতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দিতে পারি। এসব কথা কি কেবল বই পুস্তকেই সক্রিয়? বাতাস আরামদায়ক ঝড় ভীতিকর, শীতের সকালের রোদ আরামদায়ক কিন্তু গরমের দুপুরের রোদ অস্বস্তিদায়ক। চাঁদের আলোয় রাতের বেলা হেঁটে গেলে তা হয় খুবই সুখকর কিন্তু অমাবস্যার আঁধারে ভীতিকর। পূর্ণিমা রাতে সবাই যেমন বাইরে বেরোয় তেমনই বিদ্যুত চমকালে সবাই ঘরে ঢুকে। কিন্তু তাই বলে কি গরমের দুপুরের রোদ, অমাবস্যার আঁধার ও বিদ্যুত চমকানোকে প্রকৃতি হতে দূর করা সম্ভব হবে? এখন যদি বলা হয় গরমের দুপুরের রোদ, অমাবস্যার আঁধার, ঝড় ও বজ্রপাত থাকতে পারবেনা। থাকবে শুধু মৃদু হাওয়া, শীতের রোদ ও পূর্ণিমা তখন কি প্রকৃতি থাকবে?
শতফুল ফুটতে দিলেই ফুলের বাগানের অস্তিত্ব থাকে। সেজন্যই হয়তো জ্ঞানীরা বলে গেছেন শত ফুল ফুটতে দাও। কিন্তু এদেশের রাজনীতি কি সেকথা শুনে? মতের বেড়ে ওঠার জন্যই ভিন্নমতের চর্চার প্রয়োজন নয় কি? ইমরান এইচ সরকার হামলাকারীদের বলেন, আমরা সরকারের অন্যায় কাজের বিরোধিতা করে যাচ্ছি। সাথে থাকা তার আত্মীয় বলেন, উনি নিজেও ক্রসফায়ারের তালিকায় আছেন। কেন এই উভয় পক্ষের বিরোধিতার ছোবল? বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরোধিতায় কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মধ্যেও অনেকেই রয়েছেন। বিগত দিনে গণজাগরণ মঞ্চের জামাত শিবিরের বিরোধিতা কি এ সরকার পন্থীদের পক্ষাবলম্বন করা হয়নি? ইমরান এইচ সরকারের ভূমিকা কি জামাত শিবির-বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে? তিনি তার মতো বলে যেতে থাকুক না। সরকার কোনটা গ্রহণ করবে আর কোনটা করবেনা সেটাতো ইমরান এইচ সরকারের বিষয় নয় সরকারের বিষয়।
সভা সমাবেশের অধিকার গণতান্ত্রিক রীতি। সেজন্যই প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকার দলের পাশাপাশি বিরোধী দলও থাকে। যেদেশে বিরোধী দল শক্তিশালী সেদেশে সরকার দলও শক্তিশালী হয়। তাই গণতন্ত্রের প্রয়োজনেই বিরোধী দলকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হয়। দমন পীড়ন ও বিরোধী দল নির্মূলের চিন্তা করলে তা হবে চরম আত্মঘাতী। রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও গণতন্ত্র নিয়ে না ভেবে কেবল নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে ভাবলেই দেশ ও গণতন্ত্রের কপালে শনি ভর করে। এই শনির আগমনকে যারা স্বাগত জানায় শনির শ্যেন দৃষ্টি কিন্তু পরে তার উপরেও পড়ে। লন্ড্রীর ধোপা কাপড় ভিজিয়ে ও কাপড় পিটিয়ে পরিস্কার করে। এক্ষেত্রে ধোপার উদ্দেশ্য কি কাপড়ের ক্ষতি না উপকার? ভিন্নমত ও সমালোচকদের ভূমিকা এই ধোপার মতো নয় কি? রোদ, বৃষ্টি, ঝড় জলোচ্ছ্বাস, পূর্নিমার চাঁদ, অমাবস্যা, শিলা বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা নিয়েইতো প্রকৃতি। এর যে কোন একটির বিরোধিতাই কি প্রকৃতির বিরোধিতা নয়? আর প্রকৃতির বিরোধিতা কি আত্মঘাতী নয়?
চীনা রাষ্ট্রনায়ক মাও সে তুং বলতেন, একটি কাঁচের দেয়ালে ঘেরা ঘরে কোন গাছের চারা লাগালে সে চারা বাড়বে না। লাগাতে হবে উন্মুক্ত ভূমিতে। যেখানে ঝড়ে গাছের ডাল ভাঙবে, পাতা ঝরবে, রোদে পুড়বে ও বৃষ্টিতে ভিজবে। চারাটি গরু ছাগলেও খেতে চেষ্টা করবে। তবেই চারাটি বাড়বে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির দাবিদার নীতিনির্ধারকরা কি এ বিষয়টা একটু ভাববেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)