রাজপথে কিংবা সংসদ, বিচার বিভাগ থেকে প্রশাসন আজ যেন কোথাও ঠাঁই নেই কয়েকবারের রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা বিএনপির। দীর্ঘ দেড় মাস ধরে দলের সর্বোচ্চ নেতা চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা তারেক রহমান আছেন লন্ডনে।
কঠিন এই সময়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে নিয়মিত অসফল কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। আইনের মারপ্যাচেও হেরে যাচ্ছে বারবার। গত কয়েকদিন ধরে খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে অনেক আইনী প্রক্রিয়া চলেছে। জামিন হয়েও হলো না তার। মুক্তি পেতে পেতেও হলো না।
ঠিক যেন ছোট গল্পের মতো- ‘শেষ হয়েও হলো না শেষ’। আইনি প্রক্রিয়া আর সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্যে স্পষ্ট, দীর্ঘায়িত হচ্ছে খালেদার কারাজীবন। হয়তো নির্বাচনের আগে মুক্তির আশা দুরাশা।
বিএনপির আজকের এ নাজুক পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? এমন পরিস্থিতিতে কোন পথে চলেছে দলটি জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে জানালেন, ‘আমি তো বলবো বিএনপির নাজুক পরিস্থিতি নয়, বলবো সরকার অত্যন্ত ভুল পথে চলেছে। সরকার ভীত। অস্থিরতার মধ্যে আছে। বিএনপি শক্ত থাকলে সরকারের জন্য আরো হুমকি। তাই বিএনপিকে বেকায়দায় রাখতে চায়। বিএনপিকে সমস্যায় রেখে তারা টিকে থাকতে চায়।’
‘বিএনপির এই অবস্থার জন্য সরকার দায়ী। একটি গণতান্ত্রিক দলকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়াই করতে পারছে না বিএনপি। অতীতে তারা কি করেছে সেটা না বলি। এখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছে বিএনপি।’
খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করার প্রসঙ্গ টেনে বিজ্ঞ এই রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, সম্ভবত প্রধান বিচারপতি প্রতিজ্ঞা করে এসেছেন, যে খালেদাকে কারাগারে রাখবেনই।
‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলা খুব দুর্বল। এমন মামলার জামিন হয়ে যায়। ফাঁসির আসামীরও অনেক সময় জামিন হয়েছে হাইকোর্টে। খালেদা জিয়ার এই মামলায় না হওয়ার কোন কারণ নেই। এতে বিচারপতিরা খারাপ উদাহরণ তৈরি করেছেন। খারাপ কাজ করেছেন। আমার মনে হয়, সরকারের নির্দেশে চলছেন তারা। সরকার দুদকের মামলায় হস্তক্ষেপ করছে। এর কোন প্রয়োজন ছিল না।’
আগরতলা মামলায় বিচারপতিদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিল জনগণ। বিএনপি হয়তো আইন হাতে তুলে নিবে না। কিন্তু জনগণ আইন হাতে তুলে নিলে কিছু করার থাকবে না- বলছিলেন জাফর উল্লাহ চৌধুরী।
তবে জাফর উল্লাহ চৌধুরী বিএনপির শান্তিপূর্ণ পথকে সঠিক পথ মনে করছেন এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি- আমি মনে করি বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমনকি খালেদা জিয়াকে ছাড়া হলেও নির্বাচনে যাওয়া উচিত। যেতে হবে তাদের!
বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ মনে করেন, বিএনপি যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথে আছে তা এখনো পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে আমার ধারণা, যদি অন্য কোন পথ অবলম্বন করতে হয় তাও করতে পারে দলটি। সেটি রক্তাক্ত পথও হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পথই ঠিক আছে। এখন অন্য কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই।
বহুদিন ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করতে চাচ্ছে বিএনপি। ১২ মার্চ অনুমতি মিলেনি। অনুমতি মিলেনি ১৯ মার্চও। এখন বলছে ২৯ মার্চ জনসভা করবে দলটি। অনুমতির জন্য দৌঁড়ঝাপ করছে। কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছে না। বিএনপি মহাসচিব স্বয়ং ডিএমপিতে ফোন করেছেন। কিন্তু বহুবার ফোন করার পরও ফোন রিসিভ করেননি বলে জানান তিনি। বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ডিএমপিতে গেলে সেখানকার কেউ প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখাও করেননি। এই অবস্থাতেও দলটি বলছে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই করবে এবং এই পথকেই নিজেদের জন্য কল্যাণকর পথ বলছে।
আজ নতুন একটি ঘোষণা এসেছে বিএনপির পক্ষ থেকে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাসহ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা ৩৬টি মামলায় লড়ার জন্য ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দিয়েছে দলটি।
মঙ্গলবার সকালে নয়াপল্টনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। কার্লাইল খালেদা জিয়ার মামলা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন এবং এ বিষয়ে যাবতীয় পদক্ষেপে সহযোগিতার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন বলে জানান ফখরুল।
তিনি ব্রিটেন থেকেই খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের পরামর্শ দিবেন। প্রয়োজনে বাংলাদেশে এসে খালেদার পক্ষে লড়বেন বলেও জানানো হয়।
আইন পেশায় লর্ড কার্লাইলের সিরিয়াস ক্রিমিনাল মামলায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। একই সাথে তিনি কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ লন্ডন এর চেয়ারম্যান, ২৮ বছর খণ্ডকালীন বিচারক হিসেবে হাইকোর্ট অব জাস্টিস এ কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি সাবেক এমপি, ব্রিটেনের টেরোরিজম লেজিসলেশন এর ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিভিউয়ার ছিলেন ৯ বছর।
এই পথকেই নিজেদের সঠিক পথ বলছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
চ্যানেল আই অনলাইনকে আমির খসরু বলেন, বিএনপি সঠিক পথে আছে। বিএনপি গণতান্ত্রিক দল। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই বিএনপির সঠিক পথ। দেশের ১৬/১৭ কোটি মানুষই এই পথে থাকতে চায়। আওয়ামী লীগ সঠিক পথে নেই। আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। দলটি এমন হতাশ হয়ে পড়েছে যে, কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের পথ স্বৈরতান্ত্রিক, এটি ফ্যাসিস্ট পথ, একদলীয় পথ। তারা সে পথেই হাঁটছে। এই পথে জনগণের নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়ে। জনগণ অধিকারহীন হয়ে পড়ে। গুম-খুন-সন্ত্রাস বাড়ে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণে আস্থা রাখে না। জনগণও আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখে না। এরপরও ক্ষমতায় যেতে চায় আওয়ামী লীগ। সেটি যেকোনো পথেই। তারা জনগণের চাওয়া বুঝতে পারছে না।
বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, আমরা বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ এই পথে বেশি দূর এগুতে পারবে না। ইনশাল্লাহ, খালেদা জিয়াকে আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্ত করে আনবো। তিনি আসবেন। তিনি শুধু দেশের গণতন্ত্রের মা-ই নন। আগামীতে তিনি বিশ্বের গণতন্ত্রের মা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবেন।
বিএনপি সঠিক পথে আছে; এবিষয়টির জোর দিতে আমির খসরু বলেন, আমরা শিগগিরই ২০ দলীয় জোটকে নিয়ে বসবো। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সে বিষয়ে আলোচনা করবো।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সভা বসবে গুলশানের চেয়ারপার্সনের কাযালয়ে। এই সভা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বলে ধারণা করছেন নেতাকর্মীরা। আগামীর পথ কি হবে সে বিষয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে দলটি। অনেকে বলছেন, সময় বলে দিবে কোন দল সঠিক পথে আছে- বিএনপি নাকি আওয়ামী লীগ?