বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আলোচিত তিন নেত্রী– সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, নিলোফার চৌধুরী মনি এবং হেলেন জেরিন খান। একসময় আন্দোলন-সংগ্রামে মিছিল-স্লোগানে উত্তপ্ত করে রাখতেন রাজপথ। বর্তমানে বিএনপির তেমন কোন আন্দোলনে দেখা যায় না। ফলে তাদের স্লোগানও শোনা যায় না। অনেকের আগ্রহ, তারা এখন কোথায়?
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে তাদের মুখোমুখি হয়েছিল চ্যানেল আই অনলাইন।
আইন পেশা আর পত্রপত্রিকা পড়ে দিন কাটছে
বিএনপির তুখোড় একজন নেত্রী। রাজনীতির মাঠে বেশ পরিচিত মুখ। সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, যিনি আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-মিটিংয়ে স্লোগান তুলে উত্তপ্ত করে তোলেন রাজপথ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। মিছিল-মিটিং এখন দেখা যায় না, দেখা যায় না তাঁকে স্লোগান দিতেও। বিএনপির জন্য চলছে কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে সাবেক এই সংসদ সদস্য কি করছে, কিভাবে দিন কাটছে তা অনেকেরই প্রশ্ন। এবিষয়ে জানতেই চ্যানেল আই অনলাইন মুখোমুখি হয়েছিল সাবেক এই সংসদ সদস্যের।
চ্যানেল আই অনলাইন: কেমন আছেন? কি নিয়ে ব্যস্ত আছেন এখন?
পাপিয়া: এইতো ভালো আছি। আমি আইন পেশার সাথে আছি। কাজেই আইন পেশা, পত্রপত্রিকা পড়ে এবং জনকল্যাণ আর পরিবার-পরিজন নিয়ে ব্যস্ত আছি। নিজের নির্বাচনী এলাকা চাপাইনবাবগঞ্জে নিয়মিত যাই। সেখানকার মানুষের সাথে মিটিং করি, কথা বলি। তাদের দু:খ-দুর্দশা দেখে সমাধানের চেষ্টা করি। নিজ উদ্যোগে যতোটা সম্ভব করার চেষ্টা করি এই যা।
চ্যানেল আই অনলাইন: একসময় আপনাদের স্লোগানে-মিছিলে উত্তপ্ত থাকতো রাজপথ। এখন রাজনীতি কেমন যাচ্ছে?
পাপিয়া: রাজনীতিটা হচ্ছে ঢিলে-ঢালা ভাবে। এটাকে ঠিক রাজনীতি বলা যাবে না। খুব জঘন্য রাজনৈতিক চর্চা এটি। গুম, খুন, জেল-জুলুমে আজ দেশ রাজনীতি শূন্য।
চ্যানেল আই অনলাইন: এর জন্য দায়ী কে বা কারা?
পাপিয়া: এর জন্য দায়ী সরকার। সরকার রাস্তায় নামতে দিচ্ছে না। জেল-জুলুম-নির্যাতন করছে। বিনা কারণে গ্রেফতার করে বিরোধী নেতাকর্মীদের জেলে নিয়ে নির্যাতন করছে। এই যে আমাদের হাবিব-উন-নবী সোহেলকে একবার ছাড়লো। আবার জেলগেট থেকেই গ্রেফতার করা হলো। এটি কোন ধরনের আচরণ? এটি স্বৈরাচারী আচরণ।
চ্যানেল আই অনলাইন: এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে আপনাদের করণীয় কি মনে করেন?
পাপিয়া: এই রাজনৈতিক শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এর জন্য আন্দোলনের বিকল্প নেই। আবারও উত্তপ্ত করে তুলতে হবে রাজপথ। মিছিলে-স্লোগানে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে এই সরকারকে রাস্তায় নামাতে হবে।
চ্যানেল আই অনলাইন: আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কি ভাবছেন?
পাপিয়া: আমি নিয়মিত আমার এলাকায় যাই। মানুষের সাথে কথা বলি। এলাকার জনগণ আমাদের পক্ষে আছে। কিন্তু প্রশাসন স্বৈরাচারী সরকারের দখলে। একারণে আমাদের মানুষ আজ কথা বলতে পারে না, প্রতিবাদ করতে পারে না। এখান থেকে মুক্তি আসবেই। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচন করবে। আমরা অংশগ্রহণ করবো। তবে শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন নয়। নির্দলীয় সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আমরা এদেশে আবারও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবো।
‘আমাদের দলেই আওয়ামী লীগ সরকারের গুপ্তচর আছে’
বিএনপির সহ-সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনি। জাতীয়তাবাদী দলের আরেকজন তুখোড় নেত্রী। তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে যে কজন নারী মিছিল আর স্লোগানে রাজপথ উত্তপ্ত করতেন নিলোফার চৌধুরী মনি তাদের একজন। বর্তমানে তাকেও রাজপথে দেখা যায় না। কিন্তু কিভাবে সময় যাচ্ছে তার। তার বর্তমান অবস্থা জানতেই মুখোমুখি হয়েছে চ্যানেল আই অনলাইন।
চ্যানেল আই অনলাইন: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আপনাদের কর্মসূচি কি আছে? ইদানিং মিছিল-মিটিং নেই। রাজপথে দেখা যায় না আপনাকেও। কিভাবে সময় কাটছে?
মনি: আসলে নারী দিবসের কর্মসূচি কি আছে তা আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বলতে পারবেন। আন্দোলনের সঙ্গী খুঁজে পাই না আজকাল। সরকারের জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুনের মুখে এখন ঘরে বসে থাকতে হয়। রাজনীতি করতে পারি না। ঘরে বসে, পরিবার দেখাশুনা আর আমার ছোট-খাটো ব্যবসা এসব করে সময় চলে যাচ্ছে।
চ্যানেল আই অনলাইন: রাজপথকে মিস করছেন না?
মনি: আমি স্বৈরাচারী এরশাদের সময় গুলির মুখে মাঠে নেমেছি, স্লোগান-মিছিলে উত্তাল করে তুলেছি রাজপথ। কিন্তু এই সরকারের অধীনে মাঠেও নামতে পারছি না। গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারছি না। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এর চেয়ে কষ্ট কি হতে পারে! আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ এতো বেশি বেড়ে গেছে যে এখন আর রাজপথে নামা যায় না, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ করা বা স্লোগান ধরার সুযোগ নেই। মাঠে নারী-পুরুষ দেখে না প্রশাসন। সমানতালে পিটিয়ে নাস্তানাবুদ করে দেয়। টেনে-হিঁচড়ে পুলিশ ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায়।
চ্যানেল আই অনলাইন: কিন্তু আপনারাও তো আন্দোলন সফল করতে পারছেন না? এর জন্য দায়ী কে আসলে?
মনি: আমি নিজেকে কখনো নেতা ভাবি না। দলের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে বলতে চাই, আমাদের দলেই মীর জাফর-মুনাফেক আছে। আমার মনে হয় সরকার আমাদের ভেতরেই চর নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিটি জেলা-উপজেলা পর্যায়েও একই অবস্থা মনে হচ্ছে। নয়তো আমরা কর্মসূচি বা পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তা শুরুর বহু আগেই কিভাবে জেনে যায়! এই সরকার এরশাদ সরকারকেও হার মানিয়েছে। এত জঘন্য, নিকৃষ্ট, অত্যাচারী, ভয়ংকর সরকার এদেশে আর আসেনি।
চ্যানেল আই অনলাইন: আপনার কি মনে হয় এখান থেকে উঠে আসতে পারবে বিএনপি?
মনি: আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। অতীতের মতো আন্দোলন সংগ্রাম করে অবৈধ সরকারের পতন ঘটাতে হবে। এর জন্য আমাদের দলের নেতাকর্মীদের এক হয়ে আন্দোলন করতে হবে। দেশের মানুষকে আন্দোলনে নিয়ে আসতে হবে।
‘কোন না কোনভাবে অবৈধ সরকারের পতন ঘটাবোই’
হেলেন জেরিন খান, বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য। বর্তমানে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিএনপির যে কজন নারী নেত্রী আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ মাতিয়ে রাখতেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন । বর্তমানে বিএনপি ও মহিলা দলের আয়োজনে বদ্ধরুমের সভা-সমাবেশেও জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে নেতাকর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে দেখা যায় তাঁকে। রাজপথের এই সৈনিক বর্তমানে কোথায়, কিভাবে আছেন তা জানতে আগ্রহী অনেকেই। এবিষয়ে জানতে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল চ্যানেল আই অনলাইন।
চ্যানেল আই অনলাইন: আন্দোলন সংগ্রাম নেই বললেই চলে আপনাদের। কিভাবে সময় কাটছে এখন?
হেলেন: আমরা আন্দোলনরত অবস্থায় আছি। আমাদের আন্দোলন নিয়মিত চলছে। যেভাবে আমরা সুযোগ পাচ্ছি প্রতিবাদ জানাচ্ছি অন্যায়ের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিলো একতরফা। সেই নির্বাচনে ১৫৪টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় নিয়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে, গুম হয়েছে। এই রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এটি একটি অবৈধ সরকার। এই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। কখনো প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করার সুযোগ দেয়া হলে তা করি। সূতরাং আমরা আন্দোলনরত অবস্থায় আছি। যতোদিন পর্যন্ত এই অবৈধ সরকারে পতন ঘটবে না ততোদিন আন্দোলন চালিয়ে যাব।
চ্যানেল আই অনলাইন: কিন্তু আপনারা যেভাবে স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মাতিয়ে রাখতেন সেভাবে কি এখন পারছেন?
হেলেন: সেভাবে তো আমরা পারছি না। আপনারা তো সবই দেখছেন, জানেন। আমাদের প্রকাশ্যে কোন মিছিল-মিটিং করতে দেয়া হয় না। অতীতে মিছিল-মিটিং করতে অনুমতি নিতে হতো না। এটা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার, আমার মৌলিক অধিকার। আমি মিছিল করবো, মিটিং করবো, আমার বাক স্বাধীনতা থাকবে, বক্তৃতার স্বাধীনতা থাকবে। এখন তো কোন কিছুই নেই। এখন সামান্য মানববন্ধন করতে গেলেও অনেক সময় মার খেতে হয়। মানববন্ধন করতে দেয়া হয় না। সেখান থেকে ধরে নিয়ে যায়, গ্রেফতার করা হয়। আবার অনেক সময় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, গুম করা হয়। যে কারণে, আপনি যেটি বলছেন যে, মুখোরিত স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে রাখতাম সেটা করতে পারছি না।
চ্যানেল আই অনলাইন: এখন রাজনীতির বাইরে কিভাবে সময় কাটছে?
হেলেন: আমি জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এটি বিশাল একটি দল। দেশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছি আমরা জাতীয়তাবাদী মহিলা দল। তারই দায়িত্ব দিয়েছেন ম্যাডাম। আমি তো মনে করি আরো বেশি সময় যদি থাকতো হাতে, তাহলে সময় দিতে পারতাম। এই জন্য আমি বলবো যে, আমি সংগঠনে সময় দিচ্ছি। নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে, বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড, জেলার নেতাদের সমস্যায় যতোটা সম্ভব পাশে থেকে সমাধানের চেষ্টা করি। এভাবেই আমার সময়টা চলে যায়। আর বাকীটা পরিবারকে দেয়া হয়। আমার ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় সময় দিতে হয়। পরিবার আর রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত আছি।
চ্যানেল আই অনলাইন: আপনাদের দলের একজন বলেছেন, নিজ দলেই সরকারের গুপ্তচর আছে। যারা মীর জাফরের অনুসারী। আপনি কি মনে করেন?
হেলেন: এটি তার ব্যক্তিগত মতামত। আমার কাছে এরকম মনে হয় না। এখন নেতাকর্মীরা যারা আছেন তাদের নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার কিছু নাই। দশ বছর হলো আজ। এতো নির্যাতন, এত গুম, খুন, অত্যাচার সহ্য করে নেতাকর্মীরা জাতীয়তাবাদী দলের সাথে সম্পৃক্ত আছেন। প্রতিটি নেতাকে জেলে যেতে হয়েছে। এমনকি মহাসচিবকে, যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকেও সাত থেকে আট বার জেলে যেতে হয়েছে। মোশাররফ স্যার, মওদুদ আহমেদ স্যারদের মতো লোককে বারবার জেলে যেতে হয়েছে। আমি মনে করি না যে, জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মীদের নতুন করে বিশ্বাসের পরীক্ষা দিতে হবে। আর একটি হলো যে, এত নির্যাতন, অত্যাচার করেও আওয়ামী লীগ একটি নেতাকেও বিএনপি থেকে সরাতে পারেনি। আসলে প্রযুক্তির যুগ। এখন নানা ধরনের উপায় আছে জানার। সে কারণে কোন না কোন ভাবে হয়তো জেনে যায়। প্রোগ্রাম করতে হলে একাকি করা যায় না। এর জন্য বিভিন্ন জনকে বলতে হয়। থানা, জেলা, বিভাগ, মহানগর এর নেতাকর্মীদের জানাতে হয়। নিজেরা নিজেরা আলোচনা করলেও তো কোন না কোনভাবে জেনে যায়। আর তার সুযোগ গ্রহণ করছে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার।
চ্যানেল আই অনলাইন: আপনাদের ভাষ্য মতে, এদেশে গণতন্ত্র নেই। তাহলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আপনাদের করণীয় কী?
হেলেন: আমি আগেই বলেছি, বর্তমান সরকার একেবারেই অগণতান্ত্রিক। তারা গণতন্ত্র রক্ষার কথা মুখে বলে। বাস্তবে তারা স্বৈরতন্ত্রের চাইতেও নিকৃষ্ট। তো এখন আমরা আন্দোলনরত অবস্থায় আছি। আন্দোলন একটি ধারাবাহিক ব্যাপার। এটি চলতে থাকবে। ৫ জানুয়ারির আগে যে আন্দোলন তা হয়তো আওয়ামী লীগের ভাষায় ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো আমরা আওয়ামী লীগকে হঠাতে পারিনি। আমার মনে হয় আমাদের সফলতা এটা যে, আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল ছিলো, এখন সেটি স্বৈরাচারী দলে পরিণত হয়েছে। আওয়মী লীগ আসলে কোন রকম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী না। তারা কোন রকমে যে কোন পন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে আছে। এদিক দিয়ে আমি বলবো বিএনপি সফল। বিএনপি গণতান্ত্রিক দল। তবে আমরা বিশ্বাস করি , কোনো না কোনো ভাবে আমরা আওয়ামী লীগের পতন ঘটাতে পারবো।