এক পিচ্চি ভিলেন। বয়স তার বড় জোর বছর পাঁচেক। সেই হাজারো দর্শকের নেতিবাচক দৃষ্টির স্কোর বাড়াচ্ছে প্রতিদিন। একজন কুখ্যাত দুষ্টু যেভাবে ঘরে সমাজে বিষবাষ্প ছড়ায় ওই মেয়ে শিশুটিও তেমন। কোমল চেহারার ওপর দিয়ে শক্ত চোয়াল, বাকানো ভ্রু, লোভাতুর ও ঈর্ষায় জ্বলা মুখে চরম কটুবাক্য প্রতিদিন দর্শক দেখছে, মজাও পাচ্ছে বৈকি। ওই শিশুটি তার মা’কে পর্যন্ত শেখাচ্ছে স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক লড়াইয়ে জিতে যাবার কৌশল। দর্শক ওই শিশুটির অকল্যাণ চাইছে, আর এখানেই পরিচালকের সার্থকতা(?)।
শিশুরা আগে শিশুতোষ চরিত্র করত। তারা শিশুতোষ গান গাইত। শিশুতোষ চিন্তা করত। গল্পকার, চিত্রনাট্যকার থেকে শুরু করে নাটক, চলচ্চিত্রের পরিচালকরাও শিশুদেরকে চিন্তা করতেন শিশুর মতো। সে পবিত্রতা ছড়াবে, সে মায়া ছড়াবে, সে ভালোবাসা ছড়াবে। তার সরল চিন্তা বড়দের কঠিন হৃদয়কে নরম করবে। শিশুরা বড়দের মনের গভীরে টোকা দেবে, বদ্ধ দরজা খুলে দেবে। পৃথিবীর সব শিশু একই রকম স্বর্গীয় শক্তির প্রতিনিধি। শিশুরা সত্যের প্রতিনিধি। শিশুরা স্বচ্ছতার প্রতিনিধি। তাদের সত্যের কাছে হার মেনে যায় সকল অসত্য, তাদের পরশ পাথরের ছোঁয়ায় কান্না বেরিয়ে পড়ে পাষাণ হৃদয়ের।
অথচ সেই শিশুকেই দর্শকের সামনে হাজির করা হচ্ছে পাষাণ হৃদয়ের এক হিংসুটে প্রতিনিধি হিসেবে। এখান থেকে অন্য শিশুরা শিখছে হিংসুটে হবার কৌশল, কোনো কোনো মাও হয়ত ভাবছে শিশুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কথা। এই বিষবাষ্প প্রতিদিন প্রতিরাতে ছড়াচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিশুকে উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হতো শেখেদের বিনোদনের জন্য। উটের পিঠে আতংকিত ও ক্ষতবিক্ষত শিশুর দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠতো বিকৃত ওই অমানুষেরা। আমাদের দেশের পতিতালয়ে শিশুদেরকে ভয়ঙ্কর ওষুধ খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করা হয় দ্রুত খরিদ্দার ধরানোর লক্ষ্যে।
আবার মা এবং তার প্রেমিক এক হয়ে নিজেদের পাপ গোপন করতে শিশু হত্যার মতো ঘটনা বারংবার ঘটছে। শিশুকে কূটচালের ভিলেন হিসেবে দর্শকের সামনে হাজির করার বিষয়টি এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। এটি আরো বেশি নেতিবাচক এই জন্য যে এর প্রভাব মৃদুগতিতে একেকটি পরিবারের গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে ফর্মালিন, কার্বাইটসহ ভয়ঙ্কর সব কীটনাশকের মতো। যার ফল হিসেবে ক্যান্সার অবধারিত।
ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো কাহিনীচিত্রের ভেতর দিয়ে দর্শক বিনোদন দিতে অবিরাম নানামুখি গবেষণা করে চলেছে। অগণিত সিরিয়াল চলছে। তারা নাটকের প্রধান প্লট হিসেবে বেছে নিয়েছে পারিবারিক রাজনীতি, সংকীর্ণতা, অসুস্থ প্রেমের প্রতিযোগিতা, অমানবিকতা আর অবিরাম সংঘাতের মতো বিষয়। তারা দেখছে, এগুলোকেই দর্শক খাদ্য হিসেবে নিচ্ছে বেশ।
তাদের এসব কাহিনীচিত্রে যা কিছু শিক্ষনীয় তার সবই ধ্বংসাত্নক। কারণ এখানে উৎসাহ জাগানিয়া কিছু নেই, পরোপকারের কিছু নেই, কল্যাণের কিছু নেই। তার পরিবর্তে আছে আমাদের ভবিষ্যৎকে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেবার সুদুরপ্রসারি কর্মযজ্ঞ। যা গোটা পৃথিবীর বাংলাভাষী দর্শকের জন্যই চরম ক্ষতিকর।
যারা নিয়মিত সিরিয়াল দেখেন তারা একটু মনোযোগ দিলেই বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারবেন। যতদূর জানি, ভারতীয় টিভি স্টার জলসায় ‘পটল কুমার গানওয়ালা’ দারুন জনপ্রিয় একটি সিরিয়াল। বাংলাদেশে এটি তুমুল জনপ্রিয়, দাবি অনেকের। এখানে একজন ভিলেন শিশুর দিকে দর্শকের মনোযোগ টানা হচ্ছে প্রতিদিন। শিশুর অপব্যবহার ও শিশুর শাশ্বত সৌন্দর্যে কালিমা লেপন করে এরকম আরো সিরিয়াল হয়েছে ও হচ্ছে। কেউ কোনো বাদ প্রতিবাদ করেননি। তার মানে এগুলো হজম হয়ে যাচ্ছে। একদিন এর বিষবাষ্প সংক্রমিত হতে পারে ভয়াবহ মাত্রায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)