মোদির ভাবমূর্তি নিয়ে বিশ্বখ্যাত টাইমস পত্রিকা বললো, ‘বিশাল বিভাজনকারী’। সুনাম নেই, অথচ পুনঃ এক বড়োসড়ো মোদি-সুনামিতে ভেসে গেলো ভারতীয় গণতন্ত্র। পৃথিবীতে এতো লোক ভোট দিয়ে সরকার গঠনের রাষ্ট্র আর নেই। বৃহত্তম গণতন্ত্র। চমকে গেছে ভারতের বিরোধী পক্ষের দলগুলো। মোদি বাহিনীর হাত থেকে ভারতের কেন্দ্রভূমিতে তিনটি রাজ্য ছিনিয়ে আনা বিরোধী রাহুল বাহিনীর হিম্মত বেড়ে গিয়েছিলো অনেক। আত্মবিশ্বাসে টগবগ বেলুন যে এভাবে চুপসে যাবে, তা ভুলেও ভাবতে পারেনি তারা।
এখন চলছে বুঝে দেখার পর্ব। বড় জটিল আয়না। মোদি-শাহ জুটির রাজনৈতিক শাহী এখন আরো জম্পেশ হয়ে উঠেছে। এই জুটির সাথে পাল্লা দিতে হাঁপিয়ে উঠেছিল বিরোধীওয়ালারা। পৃথিবীতে এমন রাজনৈতিক গতিশীল জুটি কখনো গড়ে উঠেছিল কিনা জানি না। প্রচণ্ড গরমেও ওরা হাঁসফাঁস হয়নি। এই জুটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সহিংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ‘নীরব নেতৃত্ব’ দিয়ে গুজরাটে গদি পোক্ত করেছিলো। তিন তিনবার গুজরাটে সরকার চালিয়ে এলো কেন্দ্রভূমি লালকেল্লার দিল্লীতে। এখানেও এখন পর পর দুটি সরকার গড়ার ‘জনাদেশ’ পেলো এই জুটি। যার পেছনে আছে এক বিশাল মতাদর্শিক ঘর, সংক্ষেপে যার নাম আরএসএস। ভারতে এখন ‘মোদি ম্যাজিক’ শব্দটি চালু শব্দ জুটি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বরাবরই ‘সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ’ তেমন বাজার পায়নি। কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল যতোই রাজনৈতিক বিবাদ-বিসম্বাদে জড়িয়ে পড়ুকনা কেন, সাম্প্রদায়িকতা সেখানে তেমন ঠাঁই করে নিতে পারেনি। ‘ মোদি ম্যাজিক’ সেই পশ্চিমবঙ্গকেও মাত করে দিয়েছে। দুই আসন থেকে আঠারো আসন। তৃণমূল চৌত্রিশ থেকে নেমে এসেছে বাইশে। ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’-এই ছিলো তাদের নির্বাচনী প্রত্যাশা। ২০২১ সালের বিধান সভা নির্বাচনে তৃণমূল আর ক্ষমতায় ফিরে আসবে না। এমনটা বলাবলি হচ্ছে ভারত জুড়ে। এমনকি তার আগেই মমতা হারাতে পারেন রাজ্য শাসনের ক্ষমতা।
বিজেপি এমনভাবে তাক লাগিয়ে দিলো। কুপোকাৎ বিরোধীপক্ষ। বিশেষত উত্তর প্রদেশে অখিলেশ-মায়াবতীরা এক হয়েও কাজ হলো না কিছুই। জাত পাতের ভোট ব্যাংকের নিরাপদ ভল্টও অনিরাপদ হয়ে গেলো। সারা ভারতে মোদি-টনিকের নেশায় কোটি কোটি মানুষ নিঃশব্দে এমন মত্ত হয়ে গেলো যে, অতীতের অনেক রেকর্ডই চুরমার হয়ে গেলো।
এই নেশাটুকু নীরব, ভয়াল। এই টনিক এমনভাবে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয়েছে, মানুষ তাতে মজে গেছে। মানুষ মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুগোষ্ঠী। সকল জাত-পাতের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এভাবে ধীরে ধীরে বুঁদ করা হয়েছে দুই ম্যাজিসিয়ানের যৌথ আয়োজনে উৎপাদিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ টনিক দ্বারা। এর কোনো জবাব জোগাড় করতে পারেনি অসাম্প্রদায়িক বিরোধী পক্ষ। এই নেশা বিরোধী ওষুধ তাদের ভান্ডারে নেই। মোদির ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বুক এখন নিশ্চয়ই ছিয়ানব্বই হয়ে গেছে।
অমর্ত্য সেন ভারতবর্ষের মানুষগুলোর উপর ক্ষেপে-টেপে অগ্নিশর্মা। ভারতের লোকদের কী বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে-এমন প্রশ্ন তার। মোদির মতো ‘মস্ত দুর্নীতিবাজ’ কী করে ভোটে জেতে?নোবেল পুরষ্কার বিজয়ীর তীব্র তিরস্কার। হুল ফোটানো নির্বাচনী মঞ্চের বক্তব্য প্রচারের রাহুল রীতিমতো অপ্রস্তুত। পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। দলীয় নেতৃত্ব তা নাকচ করে দিয়েছে। তবুও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাহুল অনড়। ভারতীয় কংগ্রেসের বিশাল অর্জন এখন মানুষের কাছে মোটেও বিবেচ্য নয়। মানুষ মোদির ভিতর নিশ্চয়তা পেয়েছে বিকাশের, নিরাপত্তার, পরম একান্ত আশ্রয়ের। মানুষ মানে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা, উচ্চ থেকে নিম্নবর্ণ।
‘মুখরা’ মমতাও কদিন থমকে পুনরায় আসরে নেমেছেন। এত ‘উন্নয়ন’ করেও মানুষের ‘মন’ পেলেন না বলে সোচ্চার অভিমান এই পশ্চিমবঙ্গ নেত্রীর। ‘মুখ্যমন্ত্রী’ পদটুকু ত্যাগ করার বাসনা ব্যক্ত করলেও দল তা মানেনি। ‘বাম’ ভোট সব ‘রামে’ গিয়েছে বলেই পশ্চিমবঙ্গে এমন মোদি-বিভঙ্গ!এমনই মূল্যায়ন মমতার।
হ্যাঁ, পরিসংখ্যান মমতার মূল্যায়নের পক্ষেই কথা বলে। যে ‘বাম’ সর্বশেষ ২০% ভোট পেতো তারা নেমে এসেছে ৭%-এ, বাকী সব গেলো কই! বাকী ১৩% থেকে লাভবান হয়েছে বিজেপি, এমনটাতো সহজ হিসাব-অংক। তবে হিসাবের গভীরে আরো হিসাব। বামেদের সমর্থনের সংখ্যাগুরু ধর্মীয়রা ভোট দিয়েছে বিজেপিতে। সংখ্যালঘু মুসলমানরা দিয়েছে তৃণমূলে। নইলে ঐ বাইশটা আসনের শিঁকে ছিড়তো না তৃণমূলের। এমনকি কংগ্রেসের মধ্যকার সংখ্যাগুরু ধর্মীয় লোকেরাও বিজেপির বাক্স ভরিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে এক তুলকালাম কাণ্ড।
তবে ‘বাম’ গেছে ‘রামে’। এই কথাটিই বাজার পেয়েছে বেশ। চৌত্রিশ বছর যে ‘বাম’ পশ্চিমবঙ্গে দাপুটে রাজত্ব চালিয়েছে, সেই বাম লোকসভায় ‘শূন্য’ পেয়েছে। বোধ করি সিপিএম-এর তিন ঘাঁটি, তিন রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ-কেরালা-ত্রিপুরা সবখানেই বামের এমনি দশা। তবে এ রাজ্য ও রাজ্য থেকে যে ছয়টি আসন তারা দখল করতে সক্ষম হয়েছে এটাও বিস্ময়েরই বটে।
মমতার দল ‘নির্মমভাবে’ বাম ঘাঁটিগুলো পশ্চিমবঙ্গে দখল করেছে। বামেরা চেয়ে চেয়ে দেখেছে বলা যায়। এবার ‘বিজিপি’ বর্ম দিয়ে তারা শোধ তুলছে। বামদের যেসব অফিস তৃণমূল অফিসে পরিণত হয়েছিলো বাহুবলে, নির্বাচনী ফলাফলের কয়েক ঘণ্টাতেই বামেরা দখল করে নিতে শুরু করেছে তাদের অফিসগুলো। বিজেপি এখন বামের পাশে ত্রাতারূপে। ‘ব’ এর নীচে একটি ফোঁটা। একটি বিন্দু। তাতে হয় ‘র’। বাংলা বর্ণ বিন্যাসে এতো কাছাকাছি সরল ব্যাপারটি এখন জটিল ক্ষমতা-রাজনীতিতে। মমতা বাহিনীর হাতে মাঠপর্যায়ে যে নির্মম আঘাত পেয়েছে মাঠের বাম, রাজ্য বাম নেতৃত্ব তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। মাঠ-বাম তাই নিজেদের উদ্ধারের পথ নিজেরাই বেছে নিয়েছে। বুদ্ধদেব-মানিক চেষ্টা করেছেন যেন বিজেপির দিকে না যায় বাম সমর্থকেরা। অস্তিত্বের প্রয়োজনে, প্রতিশোধের সুযোগে রাজনৈতিক আদর্শকে তারা পেছনে ফেলে বিজেপির ‘বর্ম’ শক্ত করে দিয়ে আত্মরক্ষার পথ খুঁজেছে। চৌত্রিশ বছর ক্ষমতায় থেকেও এখন পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার আসনে ‘মহাশূন্য’! জানিনা কী মূল্যায়নের তাত্বিক শব্দব্যঞ্জনা তৈরি করবেন ভারতীয় বাম নেতৃত্ব! এতো নিবেদন, এতো ত্যাগ, এতো ঐতিহ্য ভারতবর্ষের বাম আন্দোলনের, ধরার ধূলিতে তা কেন হারিয়ে যাচ্ছে, তার উপযুক্ত বিশ্লেষণের বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে ফের এই শক্তি জাগবে, নবরূপে, কবে?
লজ্জায় মাথা কাটা যায়, পশ্চিমবঙ্গে মাঠ-বামের অনেক হর্তা-কর্তা কমরেডদের অর্থ দিয়ে কিনেছে রাম বাহিনী, এমন কথা চাউড় সেদেশে। ভারত জুড়ে মোদি-শাহ জুটি নিঃশব্দ নোটের বিশাল যজ্ঞ ঘটিয়েছে। তবু মোদি-ম্যাজিকের সততা-প্রচ্ছদে এতটুকু কালি পড়েনি। অমর্ত্য সেনের তাই এতো ক্ষোভ! গান্ধীজী আততায়ীর বুলেটবিদ্ধ হয়ে শেষ কথা বলেছিলেন ‘হায় রাম’। অমর্ত্য সেন, আপনি কী বলবেন এখন!
‘দাম্ভিক’ মমতার পতনের শুরু। এই পতন আর কেউ ঠেকাতে পারবে না, এমনটা বলাবলি হচ্ছে উপমহাদেশে। তিস্তা নদী নিয়ে মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর করতে ঢাকা এসেছিলেন, মমতা তাতে রাজ্যের পক্ষ থেকে জোর আপত্তি তুলে মনমোহনকে প্রকাশ্য অপমানিত করতে দ্বিধা করেননি। বাংলাদেশের মানুষ তাই মমতার পতনের শুরুর সংবাদে বলা যায় একরকম ‘উল্লসিত’। এমনকি মোদির মহা উত্থানেও তাদের মনে ভরসা, এবার তিস্তার চুক্তি হবেই হবে।
বিপুল ‘জনাদেশ’ পেয়েছিলো হিটলার জ্ঞান-মনীষার সেরা দেশ জার্মানিতে। গোটা জার্মানরা ইহুদি বিরোধী বর্বরতায় মজে গিয়েছিলো। সেই হিটলারেরই ‘কোমল ভার্সন’ মোদি-এমনটা বলছেন অনেকে। কী ঘটবে এতদঞ্চলে, আশংকা চারিদিকে। কিন্তু অধিকাংশ ভারতবাসী ‘শ্রী রাম’ ধ্বনিতে আনন্দ মশগুল। একবার রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতা থেকে হটাতে বাম শক্তি ঐ বিজেপির সঙ্গে পােক্ত বন্ধন গড়েছিলো। সেই বিজেপি সুযোগ পেয়ে ত্রিপুরায় ‘সৎ ও নিবেদিত’ মানিক নেতৃত্বাধীন সরকার ও দলকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো। ভারতের দীর্ঘকালের অসাম্প্রদায়িক পশ্চিমবঙ্গে আজ বাম গেলো রামের ঘরে। সব মিলিয়ে পৃথিবী জুড়ে অসাম্প্রদায়িক শক্তির টিকে থাকার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। জরুরি কাজটি সম্পন্ন করার যোগ্য রাজনৈতিক শক্তি পৃথিবী জুড়ে কোথায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)