বামপন্থী সংগঠনগুলোতে ভাঙ্গন ও নতুন নতুন সাইনবোর্ড দল গঠন যেন নিয়তি হয়ে উঠছে। নিজেদের সাংগঠনিক ঐক্য রক্ষা করতে ব্যর্থ দলগুলো আবার বাম ঐক্যের আহ্বান জানায়। রাজনীতিতে বামপন্থীদের বিকল্প প্লাটফর্ম সৃষ্টির আহ্বান জানায়। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিভক্তি দিয়েই তাদের এই ভাঙ্গনের সূত্রপাত।
কমিউনিস্টরা কেউ রুশপন্থী আর কেউ পিকিংপন্থী পরিচিতি বহন করতে থাকে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে চীন আর সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করে। তবে সেসময় চীনপন্থীদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি হয়।কেউ কেউ বাংলাদেশ সৃষ্টির সংগ্রামকে সমর্থন জানায়, কেউ বিরোধিতা করে, কেউ আবার এ যুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই হিসেবে উল্লেখ করে।
হক-তোহার কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। পরে হক ও তোহা বিভক্ত হয়ে পড়ে ও আলাদা সংগঠন গড়ে তোলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দোহাই দিয়ে আরও একটি সংগঠন গঠিত হয় যার নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। তারা গড়ে তোলে গণবাহিনী। সেই জাসদ ভেঙ্গে কয়টি জাসদ হল ও জাসদ ভেঙ্গে বাসদ ও বাসদ ভেঙ্গে আরও কত কত সাইন বোর্ড স্বর্বস্ব বাসদ হয়েছে তাও রীতিমত অনুসন্ধানের বিষয়। যেমন জাসদ (রব), জাসদ (শাহজাহান সিরাজ), জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া -প্রধান), বাসদ (মাহবুব), বাসদ( খালেকুজ্জামান), বাসদ (রেজাউর রশীদ), বাসদ (মঈন উদ্দীন চৌধুরী লিটন), বাসদ (আবদুল্লাহ সরকার) প্রভৃতি।
কমিউনিস্ট পার্টি নাম দিয়েও অনেক সংগঠন রয়েছে যেমন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি হতে বেরিয়ে হল ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি হতে বেরিয়ে হল গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন প্রভৃতি। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ভেঙ্গে আরও একটি সাইন বোর্ড সাম্যবাদী দল হল। বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির বাংলা বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ইংরেজী বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি(বিএনপি)। এক্ষেত্রে যদি এক পার্টির নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আরেক পার্টির নাম বাংলাদেশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টি (বিএনপি) হয় সেটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? যদি তা না হয় এক পার্টির নাম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও আরেক পার্টির নাম বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল কিভাবে হয়?
আরও একটি বিষয় হল, অনেক বাম দল মার্কসবাদ, লেনিনবাদ জিন্দাবাদ বলে। স্ট্যালিন ও মাওসেতুঙের নামে তারা জয়ধ্বনি দেয়। কার্ল মার্কস তাত্ত্বিক গুরু, লেনিন ও স্ট্যালিন সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান আর মাওসেতুঙ চীনা পার্টির প্রধান। কিন্তু বামপন্থী দলগুলো নিজ দলের নেতার নামে জয়ধ্বনি দেয় না। যেমন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা বলে না, রাশেদ খান মেনন জিন্দাবাদ, কমিউনিস্ট পার্টি বলে না মুজাহিদুল ইসলাম জিন্দাবাদ, জাসদ(ইনু) বলে না হাসানুল হক ইনু জিন্দাবাদ, বাসদ (খালেকুজ্জামান) বলে না খালেকুজ্জামান জিন্দাবাদ।
কেন এই নেতারা কি দলীয় কাউন্সিলরদের মতামত ও সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়নি? তবে দলের নামে জয়ধ্বনি দিতে পারলে দলীয় প্রধানের নামে কেন নয়? বাম রাজনীতিকে জনগণের মাঝে পৌঁছাতে হলে বাম দল ও বামনেতাদেরও জনপরিচিতি আবশ্যক নয় কি? শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষের সংগঠন দাবীদার এসব সংগঠন ও নেতাদের চেনে কয়জন শ্রমিক কৃষক? দল নেতাদের পরিচালনা করে না, নেতারাই দলকে পরিচালনা করে। যার উদাহরণ তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধন ও বিয়োজন।
বামপন্থী দলগুলো কৃষক, শ্রমিক ও সর্বহারা মানুষের দল দাবীদার কিন্তু তাদের পরিচিতি শহুরে ভদ্রলোক কেন্দ্রিক। তাদের বিপ্লব কেবলই মিডিয়া কেন্দ্রিক নয় কি? জনগণ যে দলের নাম শুনেনি ও নেতা চেনে না সে দলে তারা কিভাবে যোগ দেবে? দলীয় নেতৃত্বের প্রতি অানুগত্যহীনতাই বামদলগুলোর ভাঙনের অন্যতম কারণ। এজন্যই সশস্ত্র পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মতাদর্শী ও গণঅভ্যুত্থান ও গণ আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মতাদর্শী উভয় পক্ষেই ভাঙনের ধারাবাহিকতা বিরাজমান। নিজ দলীয় ঐক্য রাখতে ব্যর্থতার পরিচয়দানকারীদের দেখা যায় বাম ঐক্যের আহ্বান জানাতে। আরও দেখা যায় সাইনবোর্ড দল হয়ে জোটে ভিড়ে যেতে।
বাংলাদেশে কয়টি বামজোট রয়েছে? গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ১১ দল, ১০ দল, ৭ দল, ৫ দল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল প্রভৃতি জোটের কী পরিচিতি ও গণসম্পৃক্ততা সৃষ্টি হল দেশে? নিজ দলীয় শক্তিতে কর্মসূচী দিতে ব্যর্থ হয়েই এসব জোট নয় কি?
এবার দেখা যাক সশস্ত্র বিপ্লবীদের বিভাজন। বিপ্লবী আব্দুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহা আলাদা হয়ে গেল।
সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টিও বহু গ্রুপে বিভক্ত হল। জোতদার ও মজুতদার খতম বাদ দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবীদের দেখা যায় নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করতে। তারা নিজেদের নিজেরা বিপ্লবী বলে আর জনগণ বলে ডাকাত। এরকম বাস্তবতাও দেখেছে মানুষ।নেতৃত্বের বিরোধের জেরে গড়ে উঠছে নতুন নতুন পার্টি। ৭/৮ জন নেতা একত্রিত হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেয় নতুন পার্টির ও মিশে যায় কোন জোটে। এখানে আদর্শিক দ্বন্দ্বের চেয়ে পদ লিপ্সাটাই মূখ্য নয় কি? জেলা উপজেলায় কমিটি নেই তারা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা!
এ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করল কে? আরও আছে বিভিন্ন বাম সংগঠনে নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও ইমেজ জেলাসি। কোন নেতা স্বমহিমায় সুপরিচিত ব্যক্তি ইমেজের অধিকারী হয়ে গেলে অন্য নেতারা তাকে সাধুবাদ না জানিয়ে বলবে, দলে ব্যক্তিত্ববাদ ঢুকে পড়েছে। বামদলগুলো বাংলাদেশে তেমন অগ্রসর হতে পারছে না মূলত তাদের দলীয় ও নেতৃত্বের পরিচিতির অভাবে। যেসব রাজনীতিক ভাল রাজনীতি বুঝেন কিন্তু জনগণের কাছে যান না ও জনগণও তাকে চেনে না সে রাজনীতিকের কী ভবিষ্যত হতে পারে?
বামপন্থীদলগুলো বাস্তবতা মানতে রাজী নন। এজন্যই বাংলাদেশের কোন বামনেতা আজও দলীয়ভাবে কোন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। বাস্তববাদী দাবিদার বামরা এই বাস্তবতা বুঝবে কবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)