বছর চারেক আগে ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিনের সঙ্গে তাঁর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ভাড়া করা বাসায় মুখোমুখি হয়েছিলাম। অসুস্থ শরীর। কথা বলেন ধীর লয়ে কিন্তু স্পষ্ট। ঋজু। অনেক কথা বললেন।
অহঙ্কার করার মতো দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন রয়েছে এই মানুষটির। নিরাভরণ, সংগ্রামী, আন্তরিক, আন্দোলন আর সরলতার এক বিশাল চৌহদ্দি পেরিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ধূসর দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকান এখন। সেখানে দেখেন প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিটাই বেশি। অপ্রাপ্তির জন্য নিজেদের ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখেন, এর জন্য অবশ্য অন্যের কাঁধে দোষ চাপান না। চাপাতে পছন্দও করেন না।
মাহবুব রেজা ।। ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলেই আপনি এসে পড়েন।
আব্দুল মতিন : আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া। কীভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম তার পেছনেও রয়েছে বড় ইতিহাস।
ছোটবেলায় আমি খুব নিরীহ ছিলাম। শুনেছি বুদ্ধি-টুদ্ধি নাকি বেশ ভালোই ছিল আমার। আমার জন্ম পাবনায়। জায়গাটার নাম শৈলজানা। যমুনার বিস্তৃত চর ছিল শৈলজানা। চারদিক খোলামেলা। প্রকৃতি ছিল দেখার মতো। এখন অবশ্য সেই শৈলজানা নামের কোনও গ্রামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। যমুনা সবকিছুকে গিলে খেয়েছে। আমরাই কেবল বেঁচে আছি।
আমার বাবা আব্দুল জলিল সাহেব একটু অন্য প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। একটু আউলা টাইপের। মেট্রিক পাস করার পর চাচার সঙ্গে অল্পদিন টুকটাক ব্যবসা করলেন। শুরু করার কিছুদিন পর তার আর ব্যবসা ভালো লাগল না। চলে গেলেন কলকাতা। ওখানে গিয়ে উঠলেন এক হিন্দু হোটেলে। বাবা একটু পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করতেন। তাই বেছে নিলেন হিন্দু হোটেল। বাবার ধারণায় মুসলমানের চেয়ে ওরা একটু বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে।
কলকাতার যে হোটেলে বাবা উঠলেন সেখানকার লোকজনদের সঙ্গে বাবা কয়েকদিনের মধ্যে বেশ খাতির জমিয়ে ফেললেন। তারা তো বাবার ব্যবহার ও চালচলন দেখে অবাক! বাবা হিন্দু হোটেলে খেয়ে, থেকে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়েন। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। হোটেলের লোকজন বাবাকে দেখে অবাক না হয়ে যায় না। আরে! এই লোক সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, করে কী?
একদিন হোটেলের লোকজন বাবাকে বুদ্ধি দিয়ে বললেন, তুমি বাপু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তোমার কথা খুলে বলো।
শেরে বাংলা তখন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কীভাবে দেখা করবেন সেই তরিকা বাবার জানা নেই। হোটেলের লোকজন তখন একে তাকে ধরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাবার দেখা করার ব্যাপারটা এগিয়ে নিলেন। ঠিক হলো। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে শেরে বাংলা বাবাকে দেখে বলেছিলেন, তোমার তো দেখছি স্বাস্থ্য খুব ভালো। দারোগার চাকরি করবা?
তারপর বাবার দারোগার চাকরি হয়ে গেল। দাদা খুব খুশি হলেন। সেই আমলে দাদা এক মণ বাতাসা দিয়ে পুরো গ্রামবাসীকে খাওয়ালেন। ছেলের দারোগা হওয়ায় দাদা কেন, বাড়ির সবাই ভাবতে লাগলেন বাবার অপার ক্ষমতার কথা। সেই যুগে একজন দারোগা পারে না এমন কোনও কাজ ছিল না।
অল্প কিছুদিন দারোগার চাকরি করে বাবার আর বুঝতে বাকি রইল না যে এ কাজে থাকলে তার অন্যায়ের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হবে। সুতরাং জেনেশুনে তো তিনি আর অন্যায় করতে পারেন না। যেই ভাবা সেই কাজ। বাবা কাউকে না জানিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিলেন। বাবার এই ইস্তফার কথা শুনে দাদা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। এ রকম আহাম্মক ছেলে তো আর দেখিনি! তুই আমার ঘর থেকে বের হ – দাদা রেগে মেগে বাবাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। বাবাও কোনও কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এরপর বাবা বিয়ে করলেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে কলকাতা গেলেন। তখনকার দিনে ভাগ্যের সন্ধানে মানুষকে কলকাতা যেতে হতো। প্রথম মহাযুদ্ধের পর সবখানে হাহাকার। কাজ নেই। তখন কলকাতায় গেলে একটা কিছু হবে এ রকম একটা বিশ্বাস সবার ভেতর কাজ করত।
কলকাতায় এক বিহারির সঙ্গে বাবার পরিচয় হলো। ঐ বিহারি ভদ্রলোকের আবার ক্যান্টনমেন্টে দোকান ছিল। মনিহারি দোকান। সেসব দোকানে নাকি ফিফটি পার্সেন্ট লাভ। বিহারি বাবাকে দেখে বললেন, কাজ করবা? বাবা বললেন, কিসের কাজ? বিহারি বললেন, দোকানদারির কাজ। বাবা রাজি হয়ে গেলেন। বেঁচে থাকতে হবে তো? অঢেল টাকা-পয়সা বিত্তবৈভবের দারোগার জীবন থেকে এসে ঢুকলেন সামান্য দোকানদারির কাজে। বাবাকে সেই কাজের জন্য কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল দার্জিলিং। দোকানটা সেখানেই।
দোকানে কাজ হওয়ার পর বাবা আমাদের পাবনার শৈলজানা থেকে নিয়ে গেলেন দার্জিলিং। তখন ১৯৩২ সাল। আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো তৃতীয় শ্রেণীতে। পাহাড়ি এলাকা। স্কুলে নেপালি, পাহাড়ি, অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার সময়টা ভালোভাবেই কেটে যেতে লাগল। যমুনার চর ছেড়ে একেবারে পাহাড়ের চূড়ায়। ভালোই লাগছিল। দিন কেটে যাচ্ছিল সুন্দর। কিন্তু এর মধ্যে ঘটল এক অঘটন। আমার তৃতীয় ভাইয়ের জন্মের সময় মা একলামশিয়ায় মারা গেলেন।
মা মারা যাওয়ার পর থেকে কেন যেন আমার পড়াশোনা থেকে মন উঠে গিয়েছিল। ঘরে মা নেই। মন ভালো নেই। কী করব? সারাদিন দুষ্টুমি করি। ঘুরে বেড়াই। এভাবে একদিন মেট্রিক পরীক্ষা এসে গেল। আমার তো মাথায় হাত! করি কী?
অঙ্ক পরীক্ষার দিন প্রশ্ন দেখে তো আমার মাথা চড়কগাছের মতো ঘুরতে লাগল। কিছু পারি না। না এলজেব্রা। না পাটিগণিত, না জ্যামিতি। মাথা ঘুরছে। সামনে সাদা খাতা। সবাই মাথা নুয়ে মন দিয়ে লিখছে। আমিই শুধু নিঃস্ব হয়ে বসে আছি। এছাড়া তো করার কিছু দেখি না। স্যারকে বললাম বাইরে যাব। তখনও পরীক্ষার এক ঘণ্টা যায়নি। স্যার বললেন, এক ঘণ্টা পার হোক তারপর দেখা যাবে।
এক ঘণ্টা পর পরীক্ষার হল থেকে বাইরে গিয়ে মাথায় পানি ঢাললাম। মাথায় পানি ঢালছি আর ভাবছি আমি এখন কী করব? পরীক্ষায় তো পাস করতে পারব না। আর পাস করতে না পারলে বাবার উত্তম-মধ্যম তো আছেই, আবার ঘর থেকে বেরও করে দিতে পারেন। এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লাম।
হলে ঢুকে কোনও মতে এদিক সেদিক করে পঁয়ত্রিশ নম্বরের উত্তর করে বেরিয়ে পড়লাম। এভাবে অন্য বিষয়গুলোও কোনওমতো পাস করা যায় সেরকম টায়-টায় নম্বরের উত্তর দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে মহাআতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করতে লাগলাম। পরীক্ষা শেষে নিজের অবস্থার পূর্বাভাস মালুম করতে পেরে দার্জিলিং থেকে সোজা পাবনায় চলে এলাম। তখন মেট্রিক পরীক্ষার পর তিন মাস ছুটি থাকত। গ্রামে গিয়ে মামা বললাম জমিতে কীভাবে হাল দিতে হয় শিখব। সাঁতার কাটা শিখব। মামা আমার কথা শুনে প্রথমটায় একটু ভড়কে গেলেও স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন রে? আমি কিছু বললাম না। তিন মাসে সবকিছু শিখে ফেললাম। তখন ভাবছি পড়াশোনায় তো ডাব্বা মারবই কী আর করা। সফল কৃষক হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। নো টেনশন।
তিন মাস পর দার্জিলিং থেকে বাবার টেলিগ্রাম পেলাম মেট্রিকে থার্ড ডিভিশন পেয়েছি এবং তাড়াতাড়ি আমাকে যেতে হবে সেখানে। আমি যে থার্ড ডিভিশন পেয়েছি তাতে আমার কোন রকমের হীনম্মন্যতা কাজ করেনি। আমি তো থার্ড ডিভিশন পাওয়ারও যোগ্য নই। তারপর ভাগ্যক্রমে তা পেয়ে গিয়ে উৎফুল্ল হতে পারিনি। তবে বাংলার প্রতি আমার একটা আলাদা আকর্ষণ কাজ করেছে সব সময়।
থার্ড ডিভিশন পাওয়ার পর ’৪৩-এ রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়েও আমি থার্ড ডিভিশনের বাইরে রেজাল্ট অর্জন করতে পারিনি। ইন্টারমিডিয়েটে থার্ড ডিভিশন নিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। তখন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহমুদ হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আমার মাথায় চিন্তা ঢুকে গেল কীভাবে কত তাড়াতাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া যায়।
ততদিনে রাজনীতি মাথার ভেতরের অনেকটুকু জায়গা দখল করে নিয়েছে। জড়িয়ে পড়েছি ছাত্র রাজনীতির কঠিন স্রোতে। ৪৬-এ পাস কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষাও দিলাম। পাকিস্তানে আমি মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হলাম। রেজাল্ট যখন বের হলো আমি তখন জেলে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা জেলে এসে বললেন, আপনি তো খুব ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছেন। অমুক তারিখে আপনার ভাইভা। আপনার জন্য তো খুব ভালো ফিউচার অপেক্ষা করছে।
তাকে বললাম, আমি অত ভালো চাকরি করব না। দরকার নেই ওসবের।
আমার আইসিএসের খবর দেশেও চলে গেছে। সবাই ভাবছিল আমি চাকরি করব, সংসার করব। কিন্তু চাকরি করব না শুনে আমার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। বাবা রেগে গেলেন সবচেয়ে বেশি।
আমি চাকরিতে ঢুকলাম না। দেশেও যোগাযোগ করলাম না। জেল থেকে বেরিয়ে ফজলুল হক হলে উঠলাম। কাজ নেই, পয়সা-কড়িও নেই। বাবা যাও কিছু পাঠাতেন সেটাও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। কী করব? তখন এক শুভাকাক্সক্ষী একটি প্রাইভেট টিউশনি ঠিক করে দিলেন। আমার ছাত্র হলেন কামাল হোসেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে ছিলেন আমার এই ছাত্রটি। কামাল তখন সেন্ট গ্রেগরিতে পড়ত। মাসে চল্লিশ টাকা মাইনে পেতাম। রাজনীতি করি, ছাত্র পড়াই বেশ চলে যাচ্ছে।
ঢাকা শহরজুড়ে তখন আন্দোলনের গন্ধ। ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে আছে। মিছিল মিটিং চলছে। ছাত্রদের দলে দলে জেলে ভরা হচ্ছে। আমরা সবাই তখন খুব ব্যস্ত। সারাদিন পার্টির কাজ। লিফলেট বিতরণ। গণসংযোগ। কর্মী সংগ্রহ। সাধারণ ছাত্রদের হলে হলে গিয়ে তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করি। কথা বলি। ছাত্রদের ভেতর অনেকের মধ্যেই দেখলাম ‘ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কী’ ধরনের প্রবণতা।
গ্রাম থেকে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ঘরের (আমিও তাদের দলভুক্ত) ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে। ডালভাত খেয়ে ভালো রেজাল্ট করে ভালো একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকে বাবা-মার কষ্ট দূর করবে এটাই সবার প্রত্যাশা। কী হবে অযথা এসব আন্দোলন-টান্দোলন করে! এ রকম একটা হাবভাব অনেকের ভেতরেই লক্ষ্য করতাম। আমরা সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ছাত্রদের এই মনোভাবটা আমি কীভাবে যেন টের পেয়ে যেতাম। দেশভাগ সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে একটা শূন্যতা তৈরি করেছিল।
আমরা হলে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের বলতাম, তোমরা কী চাও – বাংলা না উর্দু। তখন সাধারণ ছাত্রদের অনেকে ‘হ্যাঁ-না’র মধ্যখানে থাকেন। এটা আমরা বুঝতাম। কিছু বলতাম না। বলতাম না এ কারণে যে, আমাদের দেখা আছে এই সমস্ত ‘মাঝামাঝি অবস্থানকারী ছাত্ররাই’ যে কোনও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। তখন কিছু কিছু ছাত্র খুব নিম্নস্বরে আমাদের বলত, জিন্নাহ সাহেব যা চাইবেন তা-ই হবে। আমি তখন তাদের বলতাম, আমরা কী জিন্নাহর কামাই খাই নাকি? ছাত্ররা তখন কিছু বলত না। তখন আর একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতেন তারা মেধায় মননে অগ্রগামী থাকতেন আর যারা সাধারণ ছাত্র তারা শুধু সিলেবাসের পড়াশোনায় সমৃদ্ধ থাকতেন।
কথাগুলো বলতে বলতে আব্দুল মতিন উদাস নয়ন মেলে ধরলেন দরোজার বাইরে। বাইরে বৈশাখ মাসের প্রখর রৌদ্র। হাওয়া-বাতাস নেই। ভাপসা গরমের মধ্যে আব্দুল মতিনের ঘরে ঘড়ঘড় শব্দ করে ফ্যান ঘুরছে।
মাহবুব রেজা ।। আমাদের দেশে এক সময় গলাকাটা রাজনীতির কথা শোনা যেত। যারা সেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের সম্পর্কে আপনার রাজনৈতিক মূল্যায়ন করুন।
আব্দুল মতিন : গলাকাটার রাজনীতি আসলে সবাই করেনি। তবে কেউ কেউ তো করেছেই। গলাকাটা কথাটার মধ্যে একটু বেশি বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খলতাই বোঝায়। আমরাও এক সময় এই রাজনীতি করেছি। আমি আমার কথা বলছি অন্যদেরটা বলতে পারব না। বুঝতে পারলাম মানুষ আমাদের এই উদ্ভট রাজনীতি গ্রহণ করছে না।
আব্দুল মতিনের কথা পাশের ঘরে চেয়ারে বসে তাঁর স্ত্রী গুলবদননেছা মনিকা পত্রিকা পড়তে পড়তে শুনছিলেন। তিনি উঠে এলেন। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আব্দুল মতিনের দিকে তাকিয়ে আমাদের বললেন, এখানে আমার একটা কথা আছে। আপনারা যেটাকে গলাকাটা রাজনীতি বলছেন সেটা আসলে গলাকাটার রাজনীতি না। সেটা ছিল আসলে শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি। শ্রেণীশত্রু খতমের প্রক্রিয়াটা ভালো ছিল কিন্তু কিছু সুবিধাবাদী মানুষ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতিকে নিয়ে গেল তাদের গলাকাটার রাজনীতিতে। চারু মজুমদার তো মানুষের ভালোই চেয়েছিলেন।
আব্দুল মতিন তন্ময় হয়ে স্ত্রীর কথা শুনছিলেন। মাথা নেড়ে সমর্থন করলেন মনিকার কথা। তারপর বললেন, যখন দেখলাম মানুষ এই রাজনীতি নিচ্ছে না তখন আমি পার্টির নেতাদের বললাম, আমরা ভুল করছি। তারা আমাকে যতটা পারলেন বোঝালেন। আমার কাছে তাদের যুক্তি বা ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। আর একটা জিনিস আমার ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকে আমি দেখে এসেছি সেটা হলো, একবার যখন কোনও জিনিস আমার মাথায় ঢুকবে আমি সেখান থেকে আর নড়ে দাঁড়াব না। তারপর পার্টি থেকে রিজাইন করলাম। যারা শ্রেণীশত্রু খতম করার কথা বলে সাধারণ মানুষকে খতম করে তারা তো প্রকৃত অর্থে রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকেও খতম করছে। এরপর নানান কারণ দেখিয়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হয়।
মাহবুব রেজা ।। ষাটের দশকে মস্কো ও পিকিংপন্থিদের মধ্যে বিভেদ প্রগতিশীল রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?
আব্দুল মতিন : সমাজতন্ত্রের অনেক রূপ-বদল তো দেখলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের প্রয়োজনে সমাজতন্ত্র এখন নিত্য নতুন পোশাক বদল করে। মস্কো বলেন আর চীন বলেন সবই দেখা হয়েছে এই দীর্ঘ জীবনে। কোনওটার মধ্যেই এখন আর চূড়ান্ত সমাজতন্ত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরিবর্তিত সমাজতন্ত্রে বারবার সংযোজন-বিয়োজন হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীরা এখন বামদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে।
মাহবুব রেজা ।। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের গৌরবজনক ভূমিকা থাকলেও নতুন প্রজন্ম তাদের অবদানের কথা খুব একটা অবগত নয়। এই ব্যর্থতা কার?
আব্দুল মতিন : অন্য রাজনীতিবিদদের তুলনায় বামরা বোধ করি একটু বেশিমাত্রায় লাজুক। অন্যরা যেমন প্রচারের জন্য হামলে পড়ে বামরা (এখনকার দুচারজন এককালীন তথাকথিত বামদের কথা বাদ) আসলে প্রচারবিমুখ। এই দেশের রাজনৈতিক মূল্যায়নে আমরা যদি আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের চূড়ান্তে যেতে পারতাম তবে আমরা হিরো হয়ে যেতাম।
নানারকম দ্বন্দ্ব, ভাঙন, ছোট ছোট গোষ্ঠী মানসিকতা, মেরুকরণ, ডিগবাজি আর না পাওয়ার সীমাহীন অতৃপ্তিবোধ বামদের দিনকে দিন পিছিয়ে দিয়েছে। এর জন্য আমরাই দায়ী। এখনও বামদের ভেতর অনৈক্যের ধারা প্রবহমান। এভাবে চলতে থাকলে বামদের খুঁজে পেতে হলে মানুষকে একসময় জাদুঘরে যেতে হবে।
মাহবুব রেজা ।। আপনার রাজনৈতিক জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলুন ।
আব্দুল মতিন : এক জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু সফলতা দরকার? আমার মার মৃত্যুর পর থেকে আমি জীবন নিয়ে খুব সিরিয়াস ছিলাম না। একভাবে জীবন পার করলেই হলো। অত চাহিদা-টাহিদা কখনও আমাকে এলোমেলো করেনি। ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়াকে আমার জীবনের অন্যতম সফলতা বলে মনে করি। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার সে সফলতা আরও বেড়েছে।
এর বাইরে জীবনে আরও সফলতা আমার রয়েছে। যেমন কখনও চাকরি করিনি। কারও কাছে মাথানত করিনি। আপস করিনি। মিথ্যে বলিনি। চরিত্রের স্খলন হয়নি। এগুলোও তো কম বড় সফলতা নয়, কী বলেন! স্বাধীনতার পর আমাদের কত বাঘা-বাঘা রাজনীতিবিদকে দেখেছি শাসকদের সামনে গিয়ে রাতারাতি দিব্যি টাইগার থেকে ক্যাট হয়ে দিন গুজরান করেছে। বাড়ি-গাড়ি-মিল-ফ্যাক্টরি কত কিছুর মালিক বনে গেছে।
একদিনের ঘটনা বলি। জিয়াউর রহমান তখন প্রধান সামরিক শাসক এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি। একদিন আমাকে তিনি খবর পাঠালেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। অফিস ঘরে তার সামনে বসে আছি। এক পাশে টিভি চলছিল। জিয়াউর রহমান খুব চালাক ছিলেন, যাকে বলে চিকন বুদ্ধির মানুষ। কথা বলছিলেন নিচু স্বরে। ব্যস্ত মানুষ। সবকিছুতে তার অর্ডার দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করলাম। আর্মির মানুষ তো!
টেলিফোনে আরেকজনের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। আমি তার সামনে। হঠাৎ তিনি করলেন কী আমাকে ইশারায় টেলিভিশনের সাউন্ড কমানোর ইঙ্গিত করলেন। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তে। আমার বাসায় তখন পর্যন্ত টেলিভিশন তো দূরের কথা সামান্য দুই ব্যান্ডের রেডিও নেই। সঙ্গতকারণে থাকার কথাও নয়। আমি মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে জিয়াউর রহমানকে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি জানি না কীভাবে টেলিভিশনের সাউন্ড কমাতে হয়। কারণ আমার ঘরে টেলিভিশন নেই এবং এর যন্ত্রপাতির সঙ্গে আমি পরিচিত নই।
জিয়াউর রহমান ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ বিধায় তিনি তার সম্ভাব্য অনুগতদের এভাবে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নিতেন। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি শিকার ধরতেন। যারা তার কথামতো চলতেন তাদের তিনি দলে নিতেন। আমি তার সেরকম মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় ফেল মেরেছিলাম এবং তৃপ্ত বোধ করেছিলাম। উনি আর কথা না বাড়িয়ে চেয়ার থেকে উঠে এসে সাউন্ড কমিয়েছিলেন। অবশ্য সেসময় জিয়াউর রহমান অনেক বাম-ডানদের নিয়ে সার্কাস খেলেছিলেন।
মাহবুব রেজা ।। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার তুলনামুলক পার্থক্য কিভাবে করবেন ?
আব্দুল মতিন : দুটো দলের একই চেহারা। একই সমস্যা। এরা হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফেইল। মানুষ না খেয়ে মারা যায়। চাকরি পায় না। গার্মেন্টের মেয়েরা ঠিকমতো বেতন পায় না। টাকা চাইতে গিয়ে নির্যাতিত হয় আর তোমরা মন্ত্রী-এমপিরা এসির মধ্যে বসে কাঁধে কাঁধ রেখে নিজেদের বেতন বাড়াও, লজ্জা করে না তোমাদের? এদের লাজ-লজ্জাও বোধহয় নেই।
শেখ হাসিনা আর বেগম খালেদা জিয়া এই দুজনকে তো কোনওভাবেই আলাদা করা যায় না। এদের সেম প্রিন্সিপাল। নিজেদের প্রয়োজনে, স্বার্থে এরা জামায়াতের সঙ্গে সন্ধি করে। আমি দুজনের মধ্যে খুব মিল দেখতে পাই। শেখ হাসিনার ভালো পড়াশোনা আছে। লেখালেখিও করেন। প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার খাতির রয়েছে। দেশের মানুষের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ।
বেগম খালেদা জিয়া এমনিতে ইন্টিলিজেন্ট। স্বামীর মতো বুদ্ধি রয়েছে তার। তবে কথাবার্তায় চলনে-বলনে মনে হয় খালেদা জিয়ার আরও থরো এডুকেশনের প্রয়োজন আছে – এই জিনিসটির প্রকট ঘাটতি তার। আর খালেদা জিয়ার এই ঘাটতি এসে বাসা বেঁধেছে তার দুই পুত্রের মধ্যে। আর একটা জিনিস আমার খুবই খারাপ লাগে। দুই নেত্রী কেন আঙুল নাড়িয়ে কথা বলবেন? আঙুল দেখিয়ে কিংবা আঙুল নাড়িয়ে কথা বলা শোভনীয় নয়।
মাহবুব রেজা ।। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তো খুব কাছ থেকে দেখেছেন। একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে তার মূল্যায়ন কীভাবে করেন?
আব্দুল মতিন : তাকে নিয়ে অনেক কথাই বলা যায় তবে সব কথার শেষ কথা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা তিনি নিজেই। তার অনেক দোষ ক্রটি ছিল, ব্যর্থতা ছিল, দায়ভার ছিল কিন্তু একজন নেতা হিসাবে তিনি আসলেই পাকিস্তানের শাসকদের কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে এটাও সত্য। শেখ মুজিবুরের আগেও তো অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন। কই তারা তো সেঞ্চুরি করতে পারলেন না? দলকে জেতাতে পারলেন না। তিনি পেরেছিলেন। খুব কাছে থেকে তাকে দেখেছি। অবশ্য তিনি যখন ছাত্রদের তুই-তুকারি করতেন ধমক-ধামক দিতেন তখন তাকে আত্মবিশ্বাসী মনে হতো। এটাও নেতাসুলভ গুণ।
৪৭ সালে তাঁকে প্রথম দেখলাম। ফজলুল হক হলে এসে উঠলেন। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সুদর্শন মানুষ। লম্বা-চওড়া। ভারতীয় ছবির নায়কদের মতো। প্রথম দেখায় আরও অনেকে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ছাত্রলীগের নাম পরিবর্তন করা দরকার। আমি বললাম ঠিক সময়োপযোগী প্রস্তাব।
বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকালেন। প্রশংসা করলেন। একসঙ্গে কাজ করতে বললেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে কিছুকাল কাজ করলাম। কিন্তু কিছুদিন পর দেখলাম তিনি কিছু অনুগত বাহিনী নিয়ে চলতে পছন্দ করেন যারা তার কথার বাইরে যাবে না। আমি তখন তার থেকে দূরে সরে গেলাম।
বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীকে সমীহ করে চলতেন। কারণ ভাসানী বঙ্গবন্ধুর সবকিছু ভালো করে জানতেন যে কারণে ভাসানীর সামনে এলে তিনি খুব একটা কথাটথা বলতেন না। শুধু শুনতেন। মানা-না মানা পরের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের অন্যতম দুর্বল দিক হলো তিনি খুব কান কথা শুনতেন।
মাহবুব রেজা ।। মওলানা ভাসানীকে কাছ থেকে দেখেছেন, নেতা হিসাবে তাকে কেমন মনে হয়েছে?
আব্দুল মতিন : মওলানা ভাসানী সারাজীবন জনমানুষের রাজনীতি করেছেন। নয়-ছয় কথার রাজনীতি করতেন না। তবে তার রাজনীতিতে দূরদর্শিতার ভীষণ অভাব ছিল বলে মনে হয়েছে। তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনও রাজনীতি দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না। রাজনীতিতে দীর্ঘসূত্রতা একটা ফ্যাক্টর। ভাসানী কান কথাকে খুব প্রাধান্য দিতেন যে প্রবণতা বঙ্গবন্ধুরও মারাত্মকভাবে ছিল। মওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে অপরিপক্বতা বেশি মাত্রায় ছিল। মেধা আর বোধের সমন্বয় ছিল কম।
মাহবুব রেজা ।। অবসর সময়ে কী করেন?
আব্দুল মতিন : এই জীবনে ভালো বই খুব একটা পড়ার সুযোগ হয়নি। এখন যে যেটা বলছেন সেটা পড়ার চেষ্টা করি। আসলে খুব বেশি বই না পড়ে কত বড় মিস যে করেছি এখন বুঝি। এখন হাতের সামনে যা পাই তা-ই পড়ি। পড়তে ভালো না লাগলে নাটক দেখি। আমার মেয়ে মাতিয়া বানু শুকু ভালো নাটক লেখে আর ওর জামাই নুরুল আলম আতিক খুব ভালো নাটক বানায়। সত্যি ওদের নাটক আমার ভালো লাগে। নতুন ছেলে-মেয়ের গ্রুপ খুব ভালো নাটক-সিনেমা বানাচ্ছে এটা পজিটিভ ব্যাপার। এখনকার নাটকের ভাষা, কাহিনী আমার কাছে কেন যেন খুব ভালো লাগে। ভারতীয় বাংলা সিনেমা তো আগে থেকেই দেখতাম। উত্তম-সুচিত্রা আমার প্রিয় জুটি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)