অসম্ভব শক্তিতে দীপ্ত তার কন্ঠ। কাদেরও সর্বশক্তি দিয়ে কবির উচ্চারণের ঠোঁট দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। খামচে দিচ্ছে। দুটো ঠোট দুহাতের সবকটি আঙ্গুল দিয়ে আটকে রাখতে চাইল। যেন কোনো শব্দ করতে না পারে কবি। বাহারওয়ালী বেটি, বেগম রোকেয়া হতি চাচ্ছিস। নারী জাগরণ। ফেমিনিস্ট।
কবির ঠোঁট আটকে রাখতে পারল না কসাই-দস্যু। ওর হস্ত-বন্ধনীর ফাঁকফোকড় দিয়ে আবার কবি উচ্চারণ করলেন- জয় বাংলা। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা বাংলার জয়, হবে হবে হবে- হবে নিশ্চয়, সাড়ে সাত কোটি মোরা নির্ভয়, বীরের মরণ কখনোই নয়, কাপুষের বারে বারে ক্ষয়, জয় বাংলা বাংলার জয়।
স্বভাব কবি মেহেরুননেসা। আজরাইলের সামনে দাঁড়িয়েও বাক্যের পর বাক্য ছন্দে ছন্দে রচনা করে গেলেন তিনি। কাদেরের সঙ্গে আক্তার জুম্মন যোগ দিল। চিরতরে খতমের আগে কবির এই অবিনাশী জবান তারা বন্ধ করতে চায়। পারল না। কবি চরণের পর চরণ রচনা করে চলেছেন। জয় বাংলা বাংলার জয়, বাংলাদেশ অজর অক্ষয়..
কাদের মোল্লা অস্থির হয়ে উঠল। দে এক কোপ দে। বলতে তলোয়ার বাগিয়ে সত্যিই এক কোপে জুম্মন কবির কল্লা বিচ্ছিন্ন করে দিল। তার মস্তক খানিকটা দুরে গিয়ে পড়ল। কবির জিহবা তখনও নড়ছে। এরপর শুরু হল জামাতি উম্মত্ততা। কবিকে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলল। দক্ষ কসাইর হাত। নিপুন কাজ। লাশগুলো ঘরে ফেলে রাখলে হবে না। তাতে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে না। মিরপুরশরীফে ভয়ের বন্যা বইয়ে দিতে হবে। সবকটা লাশ খণ্ড খণ্ড করা হলো। কাছেই মুকুল ফৌজ মাঠ। লালপট্টি-চানতারা নিশান বরদাররা দামামা ঢোল বাজাতে বাজাতে কবিপরিবারের সদস্যদের দেহের খণ্ড খণ্ড টুকরা সেই মাঠে ছুড়ে ছুড়ে মারতে লাগল। কর্তিত কল্লা নিয়েও মাঠে ফেলল। কবির কাটা মুণ্ডু হাতে নিয়ে কসাই বলল, বল হারামজাদী জয় বাংলা বল। পারলে এবার জয় বাংলা বল। নারী ও পুরুষের চারটি কল্লা নিয়ে একশ হায়েনা ফুটবল খেলছে। কাদের মোল্লা বাহবা দিচ্ছে উচ্চকণ্ঠে। কবির মস্তক যখনই তার সামনে এসে পড়ছে। চুলের মুঠি ধরে সেটি তুলে ছুড়ে ফেলছে জল্লাদদের মচ্ছবের মাঝে।
কসাই টিক্কা খানের পর আরেক কসাই কাদের মোল্লার নাম ইতিহাসে অভিশপ্ত হয়ে গেল এক অমর কবির রক্তের অক্ষরে।
মানুষমারা মিরপুর শরীফ। ইয়াজুজ মাজুজরা চায় আরও রক্ত। আরও কলিজা। জিহবা তাদের অতৃপ্ত। অশান্ত; খুন পিয়াসায় পাগল।
পল্লব হারামজাদা। জারজ বাঙ্গাল। এবার তোকে কে রক্ষা করবে। তোর পক্ষে স্বয়ং আল্লাহ এসে দাঁড়ালেও কাজ হবে না। তোর খতম মৌলুদ হবে আজই।
কসাইর সুনিয়ন্ত্রিত চেইন অব কমান্ডে সারা মিরপুর শিয়াল বাড়িতে অবাঙ্গালি ও জামাতকর্মীদের কাদের বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙ্গালি খোঁজা হচ্ছে। রেসকোর্স ময়দানে কারা তসরিফ এনেছিল- লিস্ট ধরে তল্লাশি চলছে।
পল্লব অতি নির্ভীক। সে মসজিদের দিকে যাচ্ছিল। আসরের নামাজ পড়ে ইমাম সাহেবকে নিয়ে বাঙ্গালি অবাঙ্গালি বৈঠক করবে। শান্তিশৃঙ্খলা যেকোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে এক ঘোষণায় বলা হয়েছে সেকথা। এ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ডায়ালগ হলে ভালো হয়। ইমাম সাহেবের ইমামতিতে বৈঠকটা করা দরকার। পল্লব ইমাম হুজুরকে খুঁজতে লাগল।
পল্লবকে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না কাদের মোল্লার। মসজিদের ঠিক সামনে থেকে তাকে তুলে নিল জল্লাদ বাহিনী। পল্লব প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি। সে কাদের মোল্লাকেও বলল- মসজিদের বৈঠকের কথা। সম্প্রীতির বৈঠক। নামাজের পর সবাই বসবো।
কিসের সম্প্রীতি! কিসের শান্তি। কিসের বৈঠক। কিসের নামাজ- কিসের মসজিদ।
সুন্দরী কাঠের চলা দিয়ে পিটিয়ে মুহুর্তের মধ্যে পল্লবকে ফেলে দেয়া হলো মাটিতে। দমাদম লাত্থি মারতে থাকে কসাই কাদের। হারামজাদা, স্বাধীনতা সংগ্রাম মাড়াস। মুক্তি সংগ্রাম করস। তোর পাছা দিয়া মুক্তিসংগ্রাম বের করবো। তোর শেখ মুজিবের রাওয়াল পিন্ডিতে হইছে। তোর শেখ কামালও নাই। মুজিবের বংশ; হইছে এবার ধ্বংস। দেখি এবার কত সংগ্রাম করবি কর। অকথ্য সব গালি দেয় কাদের মোল্লা ও বিহারী গুণ্ডারা। ভুলুণ্ঠিত হলেও পল্লব ছেলেটা নির্ভিক। উঠে দাঁড়ায়। বলে, না বঙ্গবন্ধু মরে নাই। তাকে মারবে ইয়াহিয়ার সেই সাহস নাই। মুজিবের গায়ে টোকা দিলে বাংলা থেকে একটা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য পালাতে পারবে না। সবার কবর হবে এখানে।
শুনে ঠাঁ ঠাঁ করে হাসতে থাকে কসাইরা। কাদের বলে, আরেকবার বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করবি তোর জিহবা ছিড়ে নেব হারামীর বাচ্চা। গাদ্দার। তেরা জবান খিঁচ লুঙ্গা।
নিজে বিকৃতভাবে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে বলতে থাকে, ব্যাঙ্গাব্যান্ধু, ভাঙ্গাবন্ধু, বেঙ্গাবন্ধু..ভেঙ্গিবন্ধু।
পল্লব পরোয়া করে না। বলে, জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনারা। ছেলেটার শরীরে বেয়োনেট চালাতে থাকে। কাদের মোল্লা পিস্তলের নল ঢুকিয়ে দেয় ওর গলার মধ্যে। ভয় দেখায়, গুলি দিয়া তোর গলার নলী ছিদা কইরা দিমু মালাউনের বাচ্চা। জীবনে আর কোনো আওয়াজ দিতে পারবি না।
পল্লবকে কোনোক্রমেই টাইট দিতে পারছে না ঘাতকগোষ্ঠি। তার হাত পা বাঁধা হয়। দড়ি দিয়ে টেনে হিঁচড়ে বারো নম্বর থেকে এক নম্বরে আনা হয়। পল্লবকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে টানছে আর গুণ্ডাবিহারীরা সমস্বরে শ্লোগান দেয়। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ। শেখ মুজিব মুর্দাবাদ। পাকিস্তান জিন্দা, শেখ মুজিব মুর্দা।
রক্তাক্ত পল্লবকে শাহআলী মাজার এলাকা ঘুরিয়ে নেয়া হয় ঈদগাহ মাঠে। সেখানে একটা গাছের সঙ্গে তাকে ঝুলানো হয়। তারপর শুরু বিহারী ও কসাই মোল্লার অকথ্য নির্যাতন। গোলাম পাকিস্তানি তো অর্ডার দিয়েছেই, এমন টর্চার করবে, যাতে সাধারণ মানুষ চিরদিন আতঙ্কে থাকে। ছেলেটা অকথ্য যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। তারপরও তার সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা চলছেই।
এবার মালাউনের বাচ্চে, পারলে বল জয় বাংলা। বলকে দেখ, জবান খিঁচ লুঙ্গা।
পল্লব ক্ষীন স্বরে বলে, জয় বাংলা।
সঙ্গে সঙ্গে হায়েনাদের বেয়োনেট চার্জ। হারামজাদা, তোর জবান কাইটা নিব। পারলে বল বঙ্গবন্ধু।
পল্লব বিড়বিড় করে, জয় বঙ্গবন্ধু।
আর যায় কোথায়। অসম্ভব ক্ষেপেছে কসাই কাদের। এত কষ্ট সহ্য করেও হারামজাদা জয় জয় করছে। জয় শব্দ কসাইর অসহ্য। কানের মধ্যে যেন গলন্ত সিসা ঢেলে দিয়েছে কেউ।
প্রথমে পল্লবের হাতের আঙুলে সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়া হয়। হাসতে হাসতে কয়েকটা আঙুল কেটে নেয় জল্লাদরা। রক্ত গড়াচ্ছে। চুয়ে চুয়ে পড়ছে। হ্যান্ডমাইকে কাদের মোল্লা এনাউন্স করে, এই হারামজাদা জমহুরিয়া পাকিস্তানের শত্রু। হালার পুত গাদ্দার। কইতেছে, মজিবর ওর বাপ। তাই তার এই শাস্তি। মরণ না হওয়া পর্যন্ত তার আজাব চলতে থাকবে। গাদ্দার জানুক দেখুক, গাদ্দার মুজিববাদীকে লিয়ে হাম কেয়া জাহান্নুমকা আজাবকা বন্দোবস্ত করতা হ্যায়।
পর পর দুই দিন পল্লবকে ওইভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়। দ্বিতীয় দিনে কসাই কাদের হ্যান্ডমাইকে জানায়, ওয়াতানোকো বেরাদানে মিল্লাত, আজ ইয়ো গাদ্দার কিলিয়ে হাম স্পেশাল আজাব এনতেজাম কিয়া। ইয়ে হ্যায় ইয়াহিয়াকি ফৌজী আজাব।
পল্লবের গোপনাঙ্গের সঙ্গে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। প্রচন্ড উল্লাস দর্শক বিহারীদের মাঝে। পল্লব অজ্ঞান। রক্ত ঝরছে সারা শরীর থেকে। কসাই কাদের মাইক হাতে বিশ পা দক্ষিণে আবার বিশ পা উত্তরে যাচ্ছে। পাগলা কুত্তার মতো চরকি খাচ্ছে। সমানে আকথা কুকথা বলে যাচ্ছে। ইয়ে হ্যায় মুজিবকা সাথ দেনে কা পানিশমেন্ট। ইয়ে হ্যায় মুক্তি সংগ্রাম কা নতিজা।
ওয়াতানে পাকিস্তানকা ভাইয়ো, স্পেশাল এনাউন্সমেন্ট। জো পেয়ারে পাকিস্তানো ভাইয়ো ইয়ে হারামজাদাকা ছিনে মে ফায়ার করে গা, জিসকি গুলি ছিনে মে ছেদা কর দেগা, উসকে লিয়ে দো হাজার রুপেয়া ইনাম। জো জাহাবাজ ইসকো শির ছেদা কর দেনে পারেগা, উসকি লিয়ে পাঁচ হাজার রুপেয়া ইনাম।
কাদের মোল্লা নিজেই প্রথম গুলিটা করল। বুকে মানে ছিনায় লাগল না। লাগলো বাঁহাতে। পিস্তল তুলে দিল এক সঙ্গী-গুণ্ডার হাতে। তার গুলি কোমরে গিয়ে লাগল। ছ’টি গুলি ছোঁড়া হলো। এক একটা গুলি ছোঁড়া হচ্ছে; দর্শকদের বিপুল হাততালি। ছ’টার মধ্যে পাঁচটিই পল্লবের শরীরে বিঁধলো। কপালে কেউ গুলি লাগাতে পারেনি। বুকে লেগেছে দুটি গুলি। ছোটু জুম্মনের আর মোহাম্মদ আরিফের। তাদেরকে কাদের মোল্লা সঙ্গে সঙ্গে দুই দুই চার হাজার রুপেয়া ইনাম দিল। বুকের কাছেই দুটি গুলি আক্তার গুণ্ডার। ইনাম দেয়া হলো তাকেও।
কালাপানির ঝিলে আরও সাতটি লাশ পাওয়া গেল। তলোয়ার রামদা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে খতম করা হয়েছে তাদেরকে। দুপুর সন্ধ্যা রাত কাদের কসাই ও তার জল্লাদবাহিনী মিছিলে শ্লোগানে মুখরিত করে রাখছে মিরপুর। পাকিস্তান জিন্দা হ্যায়। শেখ মুজিব মুর্দা হ্যায়।
যারা সাতই মার্চে রেসকোর্সে গিয়েছিল তাদের খুঁজে বের করে খতম করছে কাদেরবাহিনী। কালাপানির ঝিল হয়ে উঠলো মোল্লার লাশখোলা। পল্লবী বধ্যভূমি।
আম্মা তখন বড় বিপন্ন। তার দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। শেখ সাহেবকে সত্যি সত্যিই কি টিক্কা-ইয়াহিয়া মেরে ফেলল। যদি নাও মেরে ফেলে, তবে তিনি কোথায়! টিক্কা-ইয়াহিয়া পাগলা ডালকুত্তার মতো রাগে ফুঁসছে। আকাশচুম্বি দম্ভ; খুনপিয়াসার অপরিসীম নেশা। ওদের পক্ষে সবই সম্ভব। শোক দুশ্চিন্তা কষ্ট দুর্ভোগ শারিরীক মানসিক ধকল আম্মাকে ভীষণভাবে কাবু ও দুর্বল করে ফেলল। মায়াবতী, স্নেহবতী, দু:খবতীর চোখের নীচে কালচে দাগ। চোখের নীচে কালি। বাবাকে যখন হায়েনারা গুলি-মর্টারের তীব্র শব্দেরর ঘনঘটার মধ্যে তুলে নিয়ে গেল অজানা-অচিন গন্তব্যে, আম্মা একদমই মেনে নিতে পারেননি। রক্ত মাংসের জীবন্ত এই মানুষটা আর কি সশরীরে ফিরবেন। ফিরতে দেবে হায়েনারা। গুম করেই ফেলল নাকি মানুষটাকে! নানারকম গুজব, রটনা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কামালকে পঁচিশের পৈশাচিক রাতেই হত্যা করা হয়েছে। মুজিবকে নির্বংশ করার প্ল্যান চূড়ান্ত। জামাল-রাসেলকেও হত্যার জন্য খুঁজছে। মুজিববংশে কোনো পুরুষকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না। সব খতম। এথনিক কিলিং স্টাইলে মুজিববংশ কিলিং। নো মার্সি। মুজিববংশের কাউকে বাঁচিয়ে রাখা মানেই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন বাংলাদেশকে পূনরায় আর আজাদ পূর্ব পাকিস্তান বানানো যাবে না। মুজিবকে পলাতক, পলায়নপর দেখিয়ে যেভাবে টিক্কা-কসাই গুলিতে ঝাঝরা করতে চেয়েছে, সেভাবেই কামালকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক উল্লাসে গুলিতে গুলিতে রক্তাক্ত করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে লাশ। শোকার্ত আম্মা তখন দিকহারা, বলতে গেলে দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য। এই তো সেদিন মাত্র তার কোল আলো করে কামাল এসেছিল। তারই পিঠাপিঠি জামাল। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিতেই হারিয়ে গেল পৃথিবী ছেড়ে! নাঁড়ী ছেড়া সন্তানের অকাল মৃত্যুর কষ্ট কেমন করে আম্মা সামলাবেন।
বাবা যখন হায়েনাদের কবলে, যখন তাকে কর্ডন করে নিয়ে যাচ্ছিল, বাবা শেষ বারের মত বলেছিলেন, রেনু, যাই।
নির্ভিকভাবে উন্নত শিরে হিমালয়ের শিখরের মতো ঋজুচিত্তে দৃপ্তপায়ে বাবা এগিয়ে যাচ্ছিলেন, আম্মার মন তখন হু হু করে উঠেছিল। ব্যাকুল আকুল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার স্বামীকে। এবার কি রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে দেশদ্রোহী সাজিয়ে ভয়ংকর প্রহসন করে ফাঁসির দড়িতে ওরা লটকাবে। বাংলার মুক্তির ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে ওরা বলবে গাদ্দারি। তারপর নির্মমভবে শেখ সাহেবকে হত্যা। আর হায়েনা-ডালকুত্তাদের আকাশবাতাস কাপানো মত্ত উল্লাস। আশঙ্কা আর দু:স্বপ্নের ঘোরে আম্মা ছুটে গিয়েছিলেন পেছন পেছন। নীচতলার সদর দরজার কাছে যেতে না যেতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। সারা ঢাকায় তখন গুলি ও হত্যার তান্ডব চলছে। বত্রিশ নম্বরের কাছে ও দূরে রক্তপাতের ঘনঘটা। অচেতন মাকে নিয়ে জামাল রাসেল পাশের শরায়ে খাম-এ আশ্রয় নেয়। এটা ডাক্তারবাড়ি। বত্রিশ নম্বরের ঠিক দেয়াল লাগোয়া। নিরাপদ নয় এই বাড়িও। বত্রিশ নম্বর যে কোনো মুহুর্তে লন্ডভন্ড করতে পারে হিংস্র ফৌজীরা। এর মধ্যেই গুলি করেছে বাইরের দিকটায়। যে কোনো সময় উড়িয়ে দিতে পারে বাড়িটা। মুজিবপরিবারের বাকি সদস্যদের সমূলে বিনাশের এরচেয়ে ভালো অ্যাকশন আর হয় না। পিন্ডি তখন অম্লান বদনে বলবে ক্ষুব্দ পাকিস্তানিরা হামলা করেছে মুজিবের ডেরায়। গুড়িয়ে দিয়েছে। পাক-পাবলিকের হাত থেকে শেখবংশকেও রক্ষা করা যায়নি। পিন্ডির পক্ষে সব সম্ভব। টিক্কার পক্ষে সবই সম্ভব। কসাই টিক্কার পিছন পিছন মহাজল্লাদ জামাতে-নেজামে পার্টির গোলাম পাকিস্তানি-কাদের মোল্লা–নিজামী-মাসুম কসাই ওঁৎ পেতে রয়েছে। ওরা ফেউয়ের মতো ফৌজী-হায়েনাদের অনুসরণ করছে। রক্ত দেখলেই চেটেপুটে খাচ্ছে। সাফ করে দিচ্ছে রক্তের দাগ। ওরা সব সময় মওকার অপেক্ষায়।
হামলা হতে পারে শরায়ে খাম-এও। রাতারাতি এই সাকিনও বদলাতে হলো। হাসিনা যে বাড়িটা নিয়েছেন, সেটির ঠাইঠিকানাও টিক্কা খানের অজানা থাকার কথা নয়। হাসিনার ভাড়া বাসার কাছেই বাশার সাহেবের বাসা। শিপিং করপোরেশনের ক্যাপ্টেন ছিলেন। অত্যন্ত সজ্জন। সৎ সাহসী। খোকাচাচার বন্ধু। জামাল মাকে নিয়ে ওই বাসাতেই উঠলো। কিন্তু আম্মার শোক-উদ্বেগ-শঙ্কাকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিল না। তিনি উদভ্রান্ত। তিনি বার বার মুর্চ্ছা যাচ্ছেন, এই তোদের বাবার কি খবর। তারে আর বুঝি বাঁচাইয়া রাখে নাই হারামীরা। কামালরে আর্মিরা গুলি করে মারছে তাই না। ওরে আমার কামালরে..ওরে আমার বাপধন.. ..কামালের লাশটাও কি দেখতে দিবে না আমারে.. ..
ডুকরে কেঁদে উঠছেন তিনি। জ্ঞান হারাচ্ছেন। আম্মার শোকে উদ্বিগ্ন অন্য সবারও চোখে জল। মহাটেনশন পুরো পরিবারে। বাবার ভাগ্যে কি ঘটেছে, কিছুই বলছে পিন্ডিচক্র। ওরা চালাকি করছে। নানা গুজব ছড়াচ্ছে বশংবদদের দিয়ে। শেখ মুজিব নেই, কামাল নেই, এটা ছড়িয়ে বাঙালির মনোবলটা ভেঙে দিতে চায়। এই ফাঁকে একটা নফর-বান্দা সরকার ঢাকায় বসিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। কোনো আওয়াজ তুললেই খতম, এমন আতঙ্ক ফেনিয়ে তুলছে সর্বত্র। রাজারবাগ পুলিশ লাইন জ্বালিয়ে দিয়েছে হানাদার আর্মি। মর্টার কামানবাজি করে ক্ষতবিক্ষত করেছে পুরো এলাকা। শয়ে শয়ে বাঙালি পুলিশকে নির্মমভাবে খতম করে নির্বিচারে। কোনোরকম আত্মরক্ষার সুযোগ দেয়নি কাপুরুষরা। নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা চলছেই। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সৈয়দপুর, রংপুর দিনাজপুর নানা জায়গায় বাঙালি খতম চলছে। অবাঙালিদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়েছে খতমে। জামাতে-নিজামী-ছাত্রসঙ্ঘর খুনীরাও খতমকাজে কমান্ডারি করছে। দিন দিন বিভীষিকার অন্ধকার তীব্র হচ্ছে। খুনখারাপি নিয়ে বিভৎস সব গালগল্পও ছড়াচ্ছে কসাইরা। শহরে কারফিউ। নিরীহ বাঙালির চলাচল বন্ধ। কিন্তু খুনি আর্মি, দাসানুদাস কসাইরা আর্মিও গাড়িতে করে টহল দিচ্ছে। শেখ সাহেব মহাজনতার ম্যান্ডেট পেয়েও গুম-বন্দী। আর জনঘৃন্য পার্টিগুলোর আর্মির সঙ্গে মিলেমিশে চষে ফিরছে শহর। ভাবখানা, গুলি-খুন-গুম করেই তারা হারামশাহী চালাবে। ঢাকার আকাশ প্রতিদিন প্রকম্পিত করছে ফৌজী হেলিকপ্টার, এয়ার ফোর্সের যুদ্ধবিমান। গগনবিদারী বিকট ভয়ংকর শব্দ। আকাশ দুভাগ করে ফাইটার প্লেন ছুটছে। অস্ত্রশস্ত্র ঢাকার বাইরে পাঠানো হচ্ছে। ফৌজী কসাইরা উড়ে উড়ে জেলায় জেলায় যাচ্ছে। বাংলাদেশকেও ওরা বেলুচিস্তানের বধ্যভূমি বানিয়েই ছাড়বে।
আম্মা শোক-কষ্টে একরকম অপ্রকৃতিস্থ। পুরো পরিবার বিধস্ত। হাসিনা সন্তান সম্ভবা। রাসেল একেবারেই অবুঝ শিশু। রেহানারও বা কি এমন বয়স। বত্রিশ নম্বরের ঠাই ছেড়ে সবাই এখন রাস্তায়। জামাল, ওয়াজেদ তবু পরিবারের সঙ্গে আছেন বলে অনেকটা রক্ষে।
ফেউ টিকটিকি অনুসরণ করছে শেখ পরিবারের অবস্থান। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, গভীর কোনো ষড়যন্ত্র চলছে। বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আবার তুমুল হামলা হলো। দরজা জানালা সব ছত্রখান। রাতে তুমুল গোলাগুলি। জানা গেল, কামালের জন্য এই অভিযান। কেউ বলছে, বাড়িতে কামাল ছিল। তাকে সেখানেই খতম করা হয়েছে। কেউ বলছে, কামাল বত্রিশ নম্বরে ছিল না। থাকার কথা নয়। কিন্তু পিন্ডির ফৌজী বুদ্ধি। তারা কবরস্থান বানিয়ে ফেলল বাড়িটাকে। বিরাট কৃতিত্ব। গুজব, রটনা সবই কেমন করে যেন আম্মার কানে যাচ্ছিল। তিনি আরও কাবু হয়ে পড়ছিলেন। কামাল মারা যায়নি বলে তাকে অনেকটা প্রকৃতিস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু বত্রিশ নম্বরে গোলাগুলির খবর পেয়ে আবার প্রচন্ড ভেঙে পড়লেন। মায়ের মন। ছেলের জন্য প্রবলভাবেই কাঁদবেই। এই বিপন্নতার মাঝেই ঘরহারা পরিবারটির জন্য জল্লাদ-কসাই-চক্ষুর অন্তরালে একটা ঠাঁই খোঁজা চলছে। হাসুর যে অবস্থা, এই বিধস্ত শহরে মুভমেন্ট একেবারে অসম্ভব। ওয়াজেদ, জামাল এখানে ওখানে যাচ্ছে। আবার তারা সেই অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি। এবার পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন। এবার পিছু ধাওয়া করছে মৃত্যু। ওয়ারী খিলগাঁও, কয়েকটা দিন এখানে ওখানে থাকা হল।
খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় গোলচক্করের অদূরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া হলো। ওয়াজেদ আনবিক শক্তি কেন্দ্রের কর্মকর্তা। সেই পরিচয়টা দেয়া হলো। বাড়িভাড়া দিতে বাড়ি মালিক যেন গড়ি মসি না করে। আম্মা হাসিনা ওয়াজেদ রেহানা জামাল রাসেল খোকাকাকার পরিবারকে নিয়ে সেই বাসায় উঠলেন। গাদাগাদি করেই সবাই থাকছে। কি ই বা করার। ফ্লোরিং চলছে। রান্নাবান্নার কোনো ছিরি ছাদ নেই। বাজার সওদা করাও মুশকিল। ফেউ টিকটিকি এখানটাতেও অনুসরণ করে চলেছে। আধপেটা আধখাওয়া দিন গুজরান হচ্ছিল। আম্মা একটু সুস্থ। তাকে সান্তনা দেয়া হচ্ছিল কামাল মরে নাই। তিনি অবশ্য ছেলেকে না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বাবাও বেঁচে আছেন। তারও আভাস মিলল। তাকে নেয়া হয়েছে পশ্চিমা পিন্ডির কয়েদে। পত্রিকায় একদিন একটা ছবি বেরুল, করাচি বিমানবন্দরে শেখ মুজিব। লাউঞ্জে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তার দুপাশে কঠোর ফৌজী পাহারা। পিন্ডির হারামশাহীর সরবরাহ করা ছবি। তাদের হুকুমে ছাপা হয়েছে সকল পত্রিকায়। ওয়াজেদ পত্রিকার একটা কপি সঙ্গে নিয়ে এলেন। আম্মাকে দেখালেন। আম্মা ছবিটা দেখে অঝোরে কাঁদলেন। যাই হোক, শেখ সাহেবকে এখনও ওরা কতল করে নাই। নফল নামাজ আদায় করলেন তিনি। আল্লাহর দরবারে আকুল হয়ে কাঁদলেন। কামালের বেঁচে থাকার পাকা সাবুদও পাওয়া গেল। একদিন সে এসে বাসায় উপস্থিত। অমন ব্যাকুল হয়ে আম্মা আর কখনও কাঁদেননি। মনে হলো, লাশ হওয়া তার ছেলে যেন মরণশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। লুকিয়ে এসেছিল কামাল। মাতৃ অন্ত:প্রাণ। মায়ের দোয়া তার নেওয়া চাই।
মাকে জড়িয়ে কামালও কাঁদল। বলল, মা, আজ রাতেই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি। এই হানাদার দখলদারদের বাংলার পবিত্র মাটি থেকে তাড়াতেই হবে। ওরা আমাদের মারতেছে আম্মা। লাশ ফেলতেছে। এই বাংলার মাটিতে ওদের কবর রচনা করতে হবে আম্মা। তোমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া করো। ওদের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। পাঞ্জাবি খানসেনা। বাঙালিরে চেনে না। কত বাঙালিরে খুন করবে। আমরাও পাল্টা জবাব দিব। ওরা পাহাড় গিরিবর্ত্ম দেখছে। বাংলার নদী খাল বিল কি জিনিস – এই হানাদাররা জানে না। সামনেই বর্ষা সিজন আসতেছে। হাড়ে হাড়ে তখন টের পাবে বাঙালি কেমন বীরের জাত। ওদেরকে আমরা খালে বিলে পানিতে চুবিয়ে মারব।
তেজোদীপ্ত কামালের কন্ঠ। সে কন্ঠে কেবলই দু:সাহস। ভয় ডর লেশ মাত্র নেই।
আম্মা মুগ্ধ চোখে সন্তানকে দেখলেন। হাসিনাও অবাক ভালোবাসায় ভাইকে দেখছে। এই কি সেই ভাই। এই তো কদিন আগেও দুভাই বোন মাঠে ফড়িং-এর পেছনে ছুটে বেড়িয়েছে। নীল লাল প্রজাপতি দেখে আব্দার করেছে, ছোট ভাইটি, একটা প্রজাপতি বাসায় নিয়ে পালবে। সেই স্বাপ্নিক কোমল ভাইটি দেশের জন্য এখন কি দৃঢ়, অবিচল। দেশকে বাঁচাতে হবে। মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে সবার সামনে থেকে সে লড়বে। বাবার নির্দেশ সে নিজের রক্ত দিয়ে পালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আম্মা কামালের কপালে স্বস্নেহে চুমু খেলেন। বললেন, অবশ্যই তুই যুদ্ধে যাবি বাপ। শেখ সাহেবের ছেলে হয়ে দেশমুক্তির এই যুদ্ধে সবার আগে তোর থাকা চাই। এই দু:খিনী বাংলাকে মুক্ত করতেই হবে বাবা। তুই যদি যুদ্ধে যেতে না চাইতিস, আমিই তোকে বাধ্য করতাম যেতে। কেবল দোয়া করি, কামিয়াব হও। জয়ী হও। তোমার জীবনের বিনিময়ে হলেও বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত স্বাধীন করতে হবে। এই কাজে কোনো রকম গাফিলতি করা চলবে না।
পুত্র ও মায়ের এই আবেগঘন দৃশ্য অশ্রুসজল করে তুলল সবাইকে। জামালও তখন অস্থির। বলল, সেও যাবে ভাইয়ের সঙ্গে। দেশ জাতির এই সঙ্গীন সময়ে সে ঘরে বসে থাকবে না। তারও লড়াইয়ের ময়দানে যাওয়া চাই ই।
অনুজের অস্থিরতা দেখে অগ্রজ কামালকে দেখা গেল খুব ধীর স্থির। বলল, তোর যাওয়ার সময় এখনও হয় নাই। এই সময়টায় তুই আম্মার পাশে থাক। শহরে থাকাও দরকার। এটাও লড়াইয়ের অংশ। এখন আমাদের লড়াইয়ের জন্য মিলিটারি ট্রেনিং দরকার। আসল লড়াই তো তারপর। তোর তো মিলিটারি ট্রেনিং আছেই। তুই তো যুদ্ধের জন্য সবসময়ই প্রস্তুত। এখন তোর যাওয়ার সময় হয় নাই। কয়েকটা দিন মায়ের পাশে থাক। ঢাকার পরিস্থিতি অবজার্ভ কর। কখন কি করতে হবে, সময়ই তোকে তা বলে দেবে।
দুই ভাই নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে নিল। রাসেল তখন বড় দুই ভাইয়ের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। তিনভাই একে অপরকে জড়িয়ে। রেহানাও জড়িয়ে ধরল ভাইদের। আস্তে আস্তে হেঁটে হাসুও ভাইদের পিঠে হাত রাখল। রাসেল দৃপ্ত কন্ঠে বলল, জয় বাংলা।
পাঁচ ভাইবোন, পরিবারের অন্য সবাই একসঙ্গে বলল, জয় বাংলা।
আম্মার চোখে আনন্দাশ্রু। তোদের বাপ এখন কাছে নেই। কোথায় কেমন আছে, কে জানে। তিনিও সজল কন্ঠে বললেন, জয় বাংলা। তারপর দোয়া পড়লেন। ফুঁ দিলেন সন্তানদের শরীরে। বললেন, হে আল্লাহ, পরওয়ার দিগার। বাংলাদেশকে তুমি শত্রুমুক্ত করো। রহমানুর রাহিম, বাংলার মানুষকে তুমি রক্ষা করো।
নিখোঁজ কামাল আর গুম-গ্রেপ্তার স্বামীর জীবিত থাকার খবর জেনে আম্মা অনেকটাই সুস্থ। বেশীর ভাগ সময় কাটাচ্ছেন জায়নামাজে। বেশী বেশী নফল নামাজ পড়ছেন। দোয়া দরুদ পড়ছেন। হাসুর খোঁজখবর রাখছেন। মা হতে যাচ্ছে বড় কন্যাটি। তার জন্য বিশেষ যত্নস্নেহ দরকার।
অস্থির বিষাক্ত ঢাকার পরিবেশ। দিনের বেলাতেও আতঙ্কের অমানিশা। ফাইটার প্লেনের তীব্র কান ফাটানো শব্দ আর গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে অহরহ। প্রতিটি রাত হায়েনা-শ্বাপদসঙ্কুল। মিলিটারি ট্রাকের শব্দ। তীব্র হুইসেল। কখন ঠাস ঠাস বিকট আওয়াজ। মগবাজারে গোলাম পাকিস্তানির বাসা। মাঝেমধ্যেই রেল লাইন পেরিয়ে একদল সশস্ত্র জঙ্গী দৌড়ে দৌড়ে ছুটছে। তারা ধাওয়া করছে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের। তাদের মাথায় পাকিস্তানী চানতারা পতাকা। হাতে রামদা, তলোয়ার। রামদা না হয় কসাইদের কাছে পাওয়া যায়। তলোয়ার কোথা থেকে জোগাড় করছে কে জানে। আশ্চর্য বিভৎস তাদের তৎপরতা। পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে আওয়াজ দিচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। দেখলে মনে হবে, তলোয়ার হাতে কোপানোর জন্য ধাওয়া করছে কোনো লোককে। সাধারণ লোকজন খুবই ভয়ের সঙ্গে এই কাণ্ডকারখানা দেখছে। কিন্তু পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেই গুন্ডাগুলো পালিয়ে যাচ্ছে কোনো গলি-উপগলির মধ্যে। আশ্চর্য বটে। কেউ লাল কাপড় বেঁধেছে হাতের সঙ্গে। জোব্বা জুব্বা পরা। এরা দৌড়াচ্ছে কেন। হঠাৎ তাদের উদয়; আবার হঠাৎ উধাও হচ্ছে কেন! এদের মনের মধ্যে নিশ্চয়ই শঙ্কা, আতঙ্ক ছড়িয়ে দৌঁড়ে ছুটে না পালালে বিপদ। সাধারণ বাঙালি নিরস্ত্র হলেও পিষে মারবে পায়ের নীচে।
বাসার সামনে টহল দিচ্ছে আর্মিও। তারা খাস উর্দুতে নানারকম এলানবাজি করছে। কিছু ফৌজী অকারণ ফাঁকা আওয়াজ করছে। মোড়ের মুদি দোকান, রুটির কারখানায় গিয়ে জানতে চাইছে, পাকিস্তানি ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ আছে কি না। কাউকে দাঁড় করিয়ে বলছে, পাকিস্তানের ন্যাশনাল এনথেম গাইতে। চোখে সুরমা দেওয়া একটা লোক বেশ কয়েকবারই আর্মির কবলে পড়েছে। প্রতিবারই তার কাছে ন্যাশনাল এনথেম শুনেছে ফৌজীরা। বেচারার মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা দিল কিনা বলা মুশকিল। তাকে আর বলতে হয় না, আর্মি দেখলেই বিচিত্র কণ্ঠে জোরে জোরে গাইতে থাকে, পাক সার জমিন বাদ সাদ। তার সঙ্গে কয়েকটা রাস্তার কুকুরও জুটেছে। কুকুর-মন বড় অদ্ভুত। যেই না সুরমানয়নকে তারা দেখছে, চলছে পিছু পিছু। আর পাকসার জমিন শুনলেই সমানে ঘেউ ঘেউ। ঘেউ ঘেউ। উৎকট সেই দৃশ্য।
মোড়েই চক্রবর্তীর বাদ্য-বাজনার দোকান। দোকান বন্ধ। ফৌজীরা একদিন দিনের বেলা দোকানটা ভাঙলো। গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দিল। হারমোনিয়াম, তবলা, ডুগডুগি, ঢোল সব বের করে রাস্তার ওপর আছড়ে ভাঙচুর করলো। পুরো রাস্তা বাদ্যযন্ত্রে ছত্রখান। মালাউন মালাউন বলে খুব গাল পাড়লো দোকানটাকে। পাশের দোকানপাটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, মালাউন আদমি কিধার হ্যায়। মালাউন চাকারাবাত্তি কিধার হ্যায়!
এক হুজুরটাইপ যুবক গিয়ে জানালো, মলাউন চক্রবর্ত্তী ইধার নেহী হ্যায়। হিন্দুস্থান ভাগ গিয়া। মলাউন রবীন্দ্রনাথ হ্যায়। মলাউন চক্রবর্ত্তী রবীন্দ্র-তারানা গায়া।
হুজুর লোকটা সম্ভবত ভেবেছিল, উর্দু বলায় বেশ বাহবা পাবে ফৌজীদের কাছে। মোটেই খাতির পেল না। বরং ওরা হুজুরকে নিয়েই পড়লো। ক্যায়সে তুম জানতা। তুম মালাউনকা ইয়ার হ্যায়। তুম মুসলমান আদমি ভি মলাউনকা ইয়ার হ্যায়। লে চলো ইয়ে হারাম পয়দা কো।
উঠিয়ে নিয়ে গেল হুজুরকে। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দিয়েছে। ফৌজী ক্যাম্প থেকে ফিরে সেই নওজোয়ানের খুব চোটপাট।খুব বীরত্ব। উর্দু ছাড়া কিছু বলেই না। সে বিভিন্ন বাসায় গিয়ে খোঁজ নেয়, কারা থাকে। কোনো মালাউন থাকে কিনা। কোনো জয়বাংলা পার্টি আছে কিনা। কোনো কমিউনিস্ট পার্টি আছে কিনা। লিস্টি বানাচ্ছে সে। জানা গেল, জোয়ানটি ছাত্রসঙ্ঘের ক্যাডার। গোলাম পাকিস্তানির গোত্র। নিকট খান্দান। করাচিতে কোনো মেডিকেল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ত। জমাতের মিল্লাতি ফরজ আদায়ে ছুটে এসেছে ঢাকাতে।
এপ্রিল মাসটা পুরো কাটলো না। একরাতে বাড়িওয়ালি এসে আম্মার হাতপা ধরে অবস্থা। কাঁদো কাঁদো তার চোখ মুখ। বলল, আল্লাহর দোহাই, আপনারা এই বাড়িতে আর থাকবেন না। আপনাদের পেছনে আজরাইল লাগছে। ওদের টিকটিকি ঠিক চিনে ফেলেছে আপনাদের। বোঝেনই তো ছাত্রসঙ্ঘের পোলাপান। ইয়াহিয়া টিক্কার চেয়েও মহা হারামী। ওরা লিস্টি করছে ঘুরে ঘুরে।
মহিলা জোর করেই আম্মার হাতে ভাড়ার টাকা ফেরত দিলেন। বললেন, আপনারা অন্য কোথাও চলে যান। ঢাকায় থাকবেন না। টিকটিকি লোকজন এসে শাসিয়েছে, মুজিবের বংশ আশ্রয় দেওয়ার পরিনাম হবে ভয়াবহ। যে কোনো সময় আর্মিরা ট্যাংক ডিনামাইট নিয়ে আসতেছে। পুরা বাড়িটাই ডিনামাইট মেরে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। লাশটাশের অস্তিত্ত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মহিলাকে দোষ দেয়া যায় না। সে নিজের বাড়ির অস্তিত্ত্ব রক্ষার দুশ্চিন্তায় যেমন অস্থির। তেমনি মুজিব পরিবারের ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা ভেবেও আতঙ্কে হয়রান। বারবারই সে বলল, হারামজাদারা বলে গেছে বাড়িওয়ালীর পরিবারকেও ব্রাশ ফায়ার করে মারবে। কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না। নো মার্সি।
কি আর করা। ঠাঁই ছাড়তে হলো। মহিলা জোর করে বের করে দেননি, এই রক্ষা। আবার বাড়ি খোঁজা। কোথায় মিলবে বাড়ি। কেউ ভাড়া দিতে চায় না। তারপরও মুশকিল আসান হলো। এবার বেগম বদরুননেসার বাড়ি। তার স্বামী নূরউদ্দিন খুবই বন্ধু বৎসল। মগবাজার চৌরাস্তার কাছেই তার বাড়ি। নীচতলাটায় থাকতে দিলেন। এখানেও প্রবল উৎপাত। জোর নজরদারি চলছে। বেশ কয়েকজন অবাঙালি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছে বাড়ির সামনে। নট নড়ন চড়ন। উর্দুতে অশ্রাব্য গালিগালাজও করছে। কদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল কিছু বিহারীও এসে জুটেছে। ওরা হৈহল্লা করছে। ভাবগতিক মোটেই সুবিধের নয়। আশপাশের দোকানপাটে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, ইধার মুজিবকা আওলাদ কিধার হ্যায়! দেখা ক্যায়া। মুজিবকা খান্দান! দেখা ক্যায়া?
লোকজন ভয়ে জবাব দেয় না। মাথা নাড়ে। বলে, কেউ দেখে নাই। অদ্ভুত হাস্যকর ব্যাপারও ঘটছে। এক টিকটিকিকে দেখা গেল, সে কোত্থেকে শেখ মুজিবের একটা ছবি জোগাড় করেছে। পত্রিকা কাটিং। ওই যে পত্রিকায় এসেছে করাচি বিমানবন্দরে ইয়াহিয়ার মিলিটারি প্রহরায় মুজিব। সেই ছবি। সেটি দেখিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করছে, ইধার মুজিবকো দেখা ক্যায়া। কিধার হ্যায় তুমহারা ব্যাঙ্গাবন্ধু!
সাধারণ মানুষ এই কৌতুককর ঘটনায়ও হাসতে পারছে না। লোকগুলো ঢাকার নয়। এদের জবানের উর্দুতে পশতু টান। চেহারা সুরত দশাসই। দুয়েকটার এমন গোঁফ, মনে হয় বিশেষ যত্নে বানানো। মগবাজারে এদের কখনও দেখা যায় নি। লোকজন মাথা নেড়ে জানায়, মুজিবকো ইধার কভি নেহি দেখা। রাতের চিত্রও ভয়ংকর। ফৌজী ট্রাক এসে গভীর রাতে থামতো। অবিরাম হর্ন বাজাতে থাকত। মাঝেমধ্যেই তরুণ বাঙালিদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। টানা হেচড়ার শব্দ। ব্যাটন দিয়ে নিষ্ঠুর প্রহারের শব্দ। বেয়োনেট চার্জ করতে করতে তুলে নিচ্ছে ছেলেগুলোকে। সত্যি অসহ্য। আর্মি আগুন দিচ্ছে বিভিন্ন বাড়িতে। জমাতের ছাত্রসঙ্ঘের গুন্ডাপান্ডা গিয়ে ডেকে আনত আর্মিকে। ওরাই ঠিক করে দিচ্ছে টার্গেট। কোনবাড়িতে জয়বাংলার পোলাপান রয়েছে। গোলাম পাকিস্তানির বাড়ির কম্পাউন্ডে হায়েনাদেও ক্যাম্প। তার সঙ্গেই ছাত্রসঙ্ঘের হাইকম্যান্ড দপ্তর।
হাসুরা একটু অবাকই হচ্ছিল, তাদেরকে কেবল নজরদারিতেই রাখা হচ্ছে। এখনও কোনো হামলা আক্রমণ হয়নি। পরে রহস্যটা বোঝা গেল। অবাঙালিগুলো শেখ কামালকে খুঁজছে। মোড়ের দোকানে তাই চব্বিশ ঘন্টা পাহারা। আম্মার সঙ্গে একবার না একবার দেখা করতে আসবেই কামাল। তখনই স্পটেই খতম করা হবে তাকে। টিক্কা সেভাবেই নাটক সাজিয়েছে। বাড়িটাকে টোপ বানানো হয়েছে। কামালকে হত্যা করতে বত্রিশ নম্বরে লন্ডভন্ড করা হয়েছে। কিন্তু তার টিকিও মেলে নি। তাই আঙ্গুল কামড়াচ্ছে টিক্কার লোকজন। এটা অনেকটাই পরিষ্কার আগে কামালের লাশ চায় ওরা। তারপর মুজিব পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত। জামালকেও তারা খুঁজছে। ওয়াজেদই কেবল খানিকটা বাইরে টাইরে বেরুচ্ছেন। তাকে ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে কম নয়। একদিন ফৌজীরা তাকে আটকালো। অয়ারলেসে কিসব উল্লসিত বাতচিৎ হলো। আটকানোর ব্যাপারটা সঙ্গে সঙ্গে হাইকমান্ডে জানানো হয়েছে। একটা অফিসার কর্কশ গলায় বলল, তুম মুজিবকা লাড়কা শেখ কামাল হ্যায়। আও, চলিয়ে হামারা সাথ। ক্যান্টনমেন্ট মে যা না পারে গা।
ওয়াজেদ বেশ থমকে গেলেন। এরা তো দেখা যাচ্ছে কামাল পরিচয়েই খতম করতে চাইছে তাকে। তিনি মৃদু প্রতিবাদ করলেন। ইংরাজিতে জানালেন, না তিনি কামাল নন।
মুজিবকা সাথ তুমহারা রিলেশন তো হ্যায়। ক্যয়া হ্যায়।
ইয়েস, আমি শেখ মুজিবের সন ইন ল। নট সন। বড় জামাতা।
ওয়াজেদ প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ও দিলেন। এটমিক এনার্জি সেন্টারের অফিসার পদপদবীর আইডি কার্ডও দেখালেন। সে যাত্রা বাঁচোয়া। ফৌজীগুলো তাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গেল না। তারা খুঁজছে কামালকে। বার বার জানতে চাইল, কামাল কিধার হ্যায়। হিন্দুস্থান চলা গিয়া। পাকিস্তান কা সাথ ফাইট করে গা। হা হা। কচ্ছপ খানেঅলা মলাউন আর্মি পাকিস্তান কা সাথ ফাইট করে গা। হাম এক পাকিস্তানি শয়ো হিন্দুস্তানি আর্মি কি লিয়ে কাফি হ্যায়। হা হা। বর্বরগুলো হাসে। হামলোগ দিল্লিমে বম্বিং করে গা। লাল কিল্লা খতম কর দেগা। সব কুছ মিছমার কর দেগা। হিন্দুস্থান হামারা মুঠিমে আয়েগা। ওয়ান ফাইন মর্নিং, দিল্লিমে হামারা রাজ হোগা। সদরে পাকিস্তান ইয়াহিয়া খান সাব হিন্দুস্থানকা শাহানশাহ হোগা। উই টেক মর্নিং কফি ইন দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট।
এক আর্মি অফিসার জানতে চাইল, মুর্শিদাবাদ কিধার হ্যায়। কিতনে দূর হ্যায়। এখান থেকে কতদূর!
লোকটার প্রশ্নের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছেন না ওয়াজেদ। মুর্শিদাবাদ দিয়ে এরা কি করবে! সিরাজউদদৌলার মুর্শিদাবাদও দখল করতে চাচ্ছে নাকি। ওয়াজেদ জানালেন, মুর্শিদাবাদ ইন্ডিয়ায়। ওয়েস্ট বেঙ্গলে। শুনে খ্যাক খ্যাক করে আর্মিগুলো হাসল। বলল, হামলোগ মুর্শিদাবাদ যা না চাহিয়ে। সিরাজদৌলা শিয়া মজহাব মে থে। হামলোগ ভি শিয়া মজহাবী হ্যায়। হাম মুর্শিদাবাদমে পাকিস্তানকা নিশান কায়েম করে গা। যিতনি হনু দুরস্ত হো, কোই বাত নেহি। হামারা এয়ার ফোর্স বম্বিং করে গা। সবকুছ খতম কর দেগা।
ওয়াজেদ ঠিক বুঝতে পারলেন না আর্মিগুলো এ কোনধরণের ঠাট্টা মশকরা করছে। কথায় কথায় সবকুছ খতম কর দেগা, এ কি ধরণের মার্শাল স্ট্রাটেজি! নাকি নির্বোধগুলো সত্যি সত্যিই প্লান আঁটছে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ঘোড়া দাবড়ে দিল্লি আর এদিক থেকে বাংলা দৌঁড়ে পশ্চিম বাংলাও দখল করে নেবে। এরা তো দেখা যাচ্ছে মগজে মস্তিষ্কে ভারত দখলেরও তাল করছে। পিন্ডি কি তবে তাদের ফৌজীগুলোকে এভাবেই মগজ ধোলাই করেছে! বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। ওয়াজেদকে আর কিছু তেমন ওরা বলল না। বরং মহাযুদ্ধের মহাপরিকল্পনা ফাঁস করে জীপ চালিয়ে চলে গেল। বেকুবদের পাল্লায় ওয়াজেদ সেদিন সত্যিই বেকুব হয়ে গিয়েছিলেন।
বেগম বদরুননেসার বাড়িতে আর থাকা হলো না। নানারকম হুজ্জতি বেড়েই চলছিল। নিরাপত্তার খাতিরে অবস্থান বদলাতে হবে। টিকটিকিগুলো মিলিটারির কিনা, নাকি লাহোর-করাচির জেলখানার দাগি ক্রিমিনাল- তা নিয়েও নানারকম কথা চলছিল। জল্লাদ টাইপ লোকগুলো মোড়ের হোটেল রেস্তোঁরায় খাওয়াদাওয়া করত। পয়সা টয়সা দিত না। ফৌজীদের সঙ্গে তাদের গভীর সহবত। মিলিটারি জিপ এলেই ছুটে গিয়ে তারা সালাম দেয়। স্যালুট মারে না। সেলাম হুজুর বলে উর্দু-পশতু-পাঞ্জাবিতে বাতচিৎ করে। আর্মির টিকটিকি হলে তো স্যালুট দেয়ার কথা। একথা ওকথায় মোড়ের দোকানে জানাজানি হতে বিশেষ সময় লাগে না- কেউ কেউ সত্যি সত্যি পশ্চিমা কারাগার থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় মুক্তি পেয়েছে। ওসমান জল্লাদ নিজে থেকেই মশহুর হয়ে উঠল। ফৈজলাবাদ কয়েদখানা থেকে সে এসেছে। ছয় খুনের কয়েদি। খুন করতে তার হাত কাঁপে না। তাকে নাকি বেলুচিস্তান কিলিং-এ নেয়া হয়েছিল। একশ বাইশটা বালুচির একাই গলা কেটেছে। তার সঙ্গে লম্বা একটা ছুরি রয়েছে। নকশাকাটা। মানুষ কাটার ছুরিতেও যে এত চমৎকার নকশা-কারুকাজ, মোড়ের দোকানিরা ভয়ে ও বিস্ময়ে হতবাক। কেমন করে মানুষের গলা কাটে, তার ডেমনেস্ট্রশনও দেখায় ওসমান। তার আরও ভয়ংকর কীর্তি-কান্ড হলো- নিজের হাতের তালু নিজেই কেটে দেখায় অবলীলায়। নিজের রক্ত দেখেও বড় উল্লাস। বিশাল সওদাগরি পাঞ্জাবি পরনে। সেটির পকেট থেকে ম্যাজিক মলম বের করে। মলমের নাম জিন্নাহ মলম। বড়ই ধন্বন্তরী। কাটা জায়গায় মলম লাগালেই রক্তপাত বন্ধ। তার রসিকতাও লা-জওয়াব। রেস্তোঁরায় বেয়ারা ছিল ছোকরা পিন্টু। একদিন পিন্টুকে সবার সামনে বলল, ছোকরার গলা কেটে সঙ্গে সঙ্গে মলম লাগিয়ে দেবে। জিন্নাহ মলম আল্লাহর কুদরত। ছোকরার কিছু হবে না। ছোকড়া মরবে না। পিন্টু ভয়ে আতঙ্কে একদম নীল। সে কোনোমতেই জিন্নাহর বলি হতে রাজি না। ওসমান তখন বাঁজখাই হাসতে হাসতে নিজের গলা কাটার ভঙ্গি করে। বলে, নিজের গলা কেটেই সে জিন্নাহর কুদরতি সবাইকে দেখাবে।
রেস্তোঁরার ম্যানেজার খুবই মুসল্লি-দুরস্ত। তার মুখভর্তি বিশাল কালোদাঁড়ি। ইদানিং ওসমানের কাছে থেকে পাওয়া লাহোরি সুরমা চোখে লাগাচ্ছে। সুরমা খুবই পাওয়ারফুল। চোখজ্বালা করে। টপ টপ করে পানি পড়ে। তারপরও ওসমানকে সাহস করে সুরমা-কেচ্ছা আর বলে নি। অনেক কষ্টে সহ্য করে যাচ্ছে। ম্যানেজার এবারও অনেক কষ্টে ওসমানকে নিরস্ত করে। বলে, হাত কেটে যে দেখিয়েছে; সেই যথেষ্ট। গলাকাটার কোনো দরকার নেই। মলমের কেরদানি বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। ওসমান বাঁজখাই হাসে, বাঙ্গাল লোগ বড়ে বুজদিল আছো। মুরগ দিল লিয়ে ক্যায়সে পাকিস্তান মিলিটারি কো সাথ লড়েগা। ইয়ে মিলিটারি সারে দুনিয়া মে আচ্ছে।
পরদিন পিন্টুকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। আর রেস্তোরার পাকানদার সানাউল্লাহ। সেও পালিয়েছে।
মগবাজার মোড় থেকে একটু ভেতরে আরেকটা বাড়ি পাওয়া গেল। ফ্লাট দোতলায়। মন্দের ভালো।
এখানে একমাসও থাকা হলো না। একদিন একটা লম্বা চওড়া পাঞ্জাবি এসে হাজির। সরাসরি দোতলায় উঠল। এসেই জোরজবরদস্তি হম্বিতম্বি। বলল, সে মিলিটারির লোক। মেজর র্যা ঙ্ক। মুজিবকা ফেমিলি কিধার হ্যায়। মুজিবকা আউরত কিধার হ্যায়। হৈচৈ বাধিয়ে ফেলল মুহুর্তের মধ্যে। ওয়াজেদ বাসায় ছিলেন। তিনি এগিয়ে গেলেন।
মেজর কর্কশ গলায় তাকে জানাল, মুজিব ফ্যামিলিকে সে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে। এটাও কোনো উটকো ঝামেলা কিনা কে জানে। এতদিন হয়তো কামালের জন্য অপেক্ষা করেছে। এখন আর সবুর করতে রাজি না।
তার কাছে ওয়ারেন্ট আছে কিনা- জানতে চাইলেন ওয়াজেদ।
সিভিল ড্রেসের লোকটা পাত্তাই দিল না প্রশ্নে। বেপরোয়া ভঙ্গিতেই বললো, ওয়ারেন্ট কিস লিয়ে। ওয়ারেন্ট কৌন মাংতা হ্যায়। ম্যায়নে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সকা অফিসার হু। ওয়ারেন্ট কা কোই জরুরত নেহি।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসার সামনে মিলিটারি ট্রাক-জীপ হাজির। বেয়োনেট উচিয়ে সশস্ত্র জওয়ানরা ঘিরে ফেলল বাড়িটা। ভোজবাজির মতো ঘটনা। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ফৌজীরা জোর করে সবাইকে গাড়িতে তুলল। কোথায় কেন নেয়া হচ্ছে, কোন প্রশ্নেরই জবাব নেই। যে কথাই ওয়াজেদ, জামাল জানতে চান-বলে, হাইকমান্ড কা অর্ডার। চলিয়ে। কিধার যা না হ্যায়, ওয়াক্ত বাতলায়েগা।
ওদিকে টিক্কা-ইয়াহিয়া ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, কি করবে! পুরো পরিবারটাকে আপাতত: কব্জা করে রাখল। শেখ মুজিবের খতম-পানিশমেন্টের আগে হিল্লে হোক, তারপর মুজিববংশকেও একই কায়দায় শায়েস্তা করা হবে। মুজিবকে হত্যার পর বাকিদের যদি ব্রাশফায়ারও করে দেয়, সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রটিয়ে দেবে, দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি ফৌজ হঠাৎ হামলা চালিয়ে পুরো মুজিব বংশের দফারফা করে দিয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তানি ফৌজকে কাজে লাগানোর বা কি দরকার। টিক্কার মাথায় নানা প্লানিং গিজ গিজ করছে। সে কেবলই বুদ্ধি পাকাচ্ছে। ব্লাডি সিভিলিয়ান। এগুলোকে খতম না করে তার শান্তি নেই। সিভিলিয়ান পলিটিশিয়ানরাই পাকিস্তানের আসল শত্রু। মালাউন হিন্দুস্থানের চাইতেও বড় শত্রু। টিক্কা কখনও ক্যান্টনমেন্ট; কখনও গভর্নর হাউস, কোথাও সুস্থির হয়ে বসতে পারছে না। ইয়াহিয়ার সঙ্গে বাতচিত হচ্ছে। এই লোকটা কোনো কাজের না। কাজের চেয়েও তার অকাজ-আকাম-কুকাম বেশী। সারাক্ষণ মদ আর মেয়েমানুষ। কি একটা রানী-রান্ডি-আউরত সে জুটিয়েছে। এই রান্ডিটা ইয়াহিয়ার কাঁধে-মাথায় হুরপরীর মত চেপে বসেছে। মিলিটারির মধ্যেও ঠাট্টা মশকরা কম নয়। জুনিয়র মেজর-কর্নেলগুলো ফিস ফিস করে বলতে ছাড়ছে না- ওই রান্ডি রানীও নাকি পিন্ডি রেজিমেন্টের ফোরস্টার জেনারেল। সবাই তাকে ডাকে জেনারেল রানী। ভাগ্যিস সে আইয়ুব খানের কাবিনে পড়ে নাই। আইয়ুব তাকে দখলে নিতে পারলে লেডি ফিল্ড মার্শাল বানিয়ে ছাড়ত। টিক্কার মনে অনেক ক্ষোভ। অনেক কষ্ট। বেলুচিস্তান ম্যাসাকার ছাড়া পাকিস্তান আর্মি অন্য কোন জায়গায় সাকসে দেখাতে পেরেছে। খালি ফোরস্টার জেনারেল, ফিল্ডমার্শাল-সব বাগাড়ম্বর। পারলে কয়েক হাজার এনিমি খতম করে দেখা। পারলে কয়েকহাজার হিন্দুস্থানি খতম করে দেখা। কই! বেলুচিস্তান অপারেশন ছাড়া কোথাও কিছু করতে পারে নি। ওরা আছে আওরত আর রান্ডি নিয়ে। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান- নামেই খালি বিশাল জেনারেল। কাজে লবডঙ্গা। তাদের সকল মার্শাল অপারেশন রান্ডি আর আউরতে গিয়েই ফিনিশড।
শেখ মুজিবকে নিয়ে ইয়াহিয়া কি করছে, খাস কোন খবর পাচ্ছে না টিক্কা খান। এহিয়া সাব কি আর করবে- সে নিশ্চয়ই ব্যস্ত রানীকে নিয়ে। আরে, ডিয়ার জেনারেল, এখন যুদ্ধ চলছে পাকিস্তানে। সিভিল ওয়ার। আপনা ঘরকা মামলা। তারপর হিন্দুস্থানকেও উষ্ঠা-মুষ্ঠা কিছু দিতে হবে। এখন মাস্টারমাইন্ড মার্শালদের খালি মদ ও মেয়ে মানুষ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। এখন তারা ব্যস্ত থাকবে মিলিটারি স্ট্রাটেজি নিয়ে। ওয়ার প্লান নিয়ে। মদ ও মেয়ে মানুষ হবে যুদ্ধজয়ের উৎসবের গনিমতের মাল। সেটা তো হবে, একদম এট দ্য এন্ড অব দি ওয়ার।
গোলাম পাকিস্তানি নামে একটা হিজড়া বাঙ্গাল লিডার এসেছিল তার পদযুগল তোয়াজ করতে। লোকটা বড়ি চালাক বটে। অতি ধুরন্ধর আক্কেলঅলা। মাথায় টুপি। পরনে শেরোয়ানি। মুখে কালো দাড়ি। সবাই সুরমা মাখে চোখে। এই লোকটা সুরমা মেখেছে কপালে। চোখে ধাক্কা লাগল টিক্কার। বলল, ক্যায়া বাত হ্যায় মিঞা। তুমহারা কপাল মে ক্যায়া প্রব্লেম হ্যায়।
গোলাম নড়ে চড়ে বসে। ক্যায়া। নেহি, কুচ নেহি।
কুচ তো হ্যায় তুমহারা কপাল মে। সুরমা কা দাগ হ্যায়।
নেহি। নেহি। প্রতিবাদ করে গোলাম। সুরমা কা দাগ নেহি। ম্যায় নে পাঁচ ওয়াক্ত সালাম পড়তা হ্যায়। তাহাজ্জুদ পড়তা হ্যায়। নফল ওয়াজিব পড়নে লিয়ে বিজি রহতে হ্যায়। ইয়ে নামাজকি দাগ হ্যায়।
টিক্কার বিশ্বাস হয় না। বাতাসে ভেসে ভেসে সে জেনারেল হয় নি। তার চোখকে ফাঁকি একটা পাচাটা কমিউনিটি লিডার। সে উঠে দাঁড়িয়ে সত্যিই গোলামের কপালে আঙ্গুল ঘষা দেয়। একগাদা সুরমা আঙ্গুলে উঠে আসে।
হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে টিক্কা। ক্যায়া বাত হ্যায়। তুম লোগ নামাজকালাম লিয়ে এইছি নাফরমান ধান্দা করতা হ্যায়। বাঙ্গালি লোগ কভি মুসলমান হুয়ে নেহি।
গোলামের দাড়িটা নকল লাগানো কিনা- সেটাও টেনে দেখতে খায়েশ হয়। ওর মুখে হালকা চাপড় দেয়। আচ্ছে আদমী আছে। এই লোককেই টিক্কার দরকার। এই লোক তো খোদার নামে গজব টাইপ কাজ করতেও দ্বিধা করবে না। টিক্কা উচ্চস্বরে হাসে। বাঙ্গাল একটা আজব-শঙ্কাও কওম আছে। শেখ মুজিবও পয়দা হচ্ছে এখানে। গোলামও পয়দা হচ্ছে। হা হা। একথা সেকথা। গনিমতের মাল ব্যাপারটি ভালো করে টিক্কা জানত না। গোলামের কাছে কঠিন ফতোয়া জানল। যুদ্ধ জিতলে সব নাকি হালাল। যদি শেখ মুজিবের তথাকথিত আযাদ বাংলাদেশকে তারা পুনরায় জয় করে নিতে পারে- পূর্ব পাকিস্তান কা মিট্টি, সহায় সম্পদ- বাড়িঘর- জায়গাজমি-কলকারখানা- অফিস আদালত- পূর্ব পাকিস্তানের সকল জেনানা- আউরত পাকিস্তানি গাজী-ফৌজীদের জন্য গনিমতের মাল হয়ে যাবে। আউরত হচ্ছে শস্য ক্ষেত্র। এই গনিমতের মাল আউরতদের সাচ্চা পাকিস্তানি পয়দা করার জন্য শস্যক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার জায়েজ ও হালাল হয়ে যাবে। গোলাম পাকিস্তানি নাকি কিসের প্রফেসর। নিজেই বলল, বহোৎ ফিলসফি জানতে হ্যায়। ফতোয়া-ফিলসফি তার বাঁও হাত কা খেল। ক্যায়া বাত। জ্ঞানের কথাও শোনালো। বলল, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের পর জার্মানিতে নাকি অমনটা হয়েছে। মিত্রশক্তি জার্মানির সব পুরুষকে নাকি খতম করে দিয়েছিল। কেবল জিন্দা রয়ে গেছে জার্মান জেনানা আর আউরত। মিত্রশক্তির আর্মি জওয়ানরা সেখানে বছরের পর বছর থেকে গেল। গেড়ে বসল। জার্মান জেনানাদের গনিমতের মাল হিসেবে ভোগ করে নতুন জার্মান-আদমীদের পয়দা করেছে তারা। বাতচিৎ শুনে টিক্কা খুব অবাক। হিটলার, জেনারেল রোমেল, নাৎসী টর্চার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নিয়ে মিলিটারি একাডেমীতে বেশ কিছু জানতে শুনতে হয়েছে তাকেও। পড়িয়েছে সে। হিটলারি জেনারেল রোমেলেল অনন্য সাধারণ যুদ্ধবুদ্ধি; হুশিয়ারি; সঠিক সময়ে কঠোরতম একশন, এসব তাকেও মুগ্ধ করেছে। সেজন্য কিছু বই পত্র তাকেও পড়তেও হয়েছে। কিন্তু জার্মানির জাতপাত সৃষ্টির এই গোপন ইতিহাস কখনও শোনে নি। এসব কথা গোলামের বানানো না সত্যি! এটা তো দেখা যাচ্ছে আস্ত একটা ইহুদি। এমন গল্প বানান হিংসুটে ইহুদির পক্ষেই সম্ভব। হিটলারের ভয়ঙ্কর সব অত্যাচারের শক্ত প্রতিশোধ নিয়েছে তারা এইসব ফ্যান্টাসি ছড়িয়ে। হা হা।
গোলাম বিচিত্র এক চিজ। কথা বলে হিস হিস করে। টিক্কার মতো পেশাদার যুদ্ধবাজও তাকে দেখে ফ্যানটাসিতে ভুগেছে। তারও মনে হয়েছে- তার সামনে গোখরো মুখো একটা নরজীব। কথা বলতে গেলেই তার মুখ গহ্বর থেকে সাপের জিহবার মতো লম্বাটে জিভটা বেরুচ্ছে। সেটি নড়ছে। হিস হিস শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দগুলো কেমন করে ভাঙা ভাঙা উর্দু শব্দে রুপান্তর হচ্ছে। অবাঙালি পাকিস্তানিরা আছে ঢাকায়। গোলাম পাকিস্তানিই তাকে আশ্বাস দিয়েছে- মিরপুর মোহাম্মদপুর, মগবাজার তাদের দখলে। গোলাম পাকিস্তানির ছাত্রসঙ্ঘের ক্যাডাররা আছে। সবাই প্রস্তুত। বীর পাকিস্তানি জনতা ঢাকায় কি কম।
গোলামের কথাটা শুনেই দারুন বুদ্ধিটা টিক্কার মাথায় খেলে যায়। সত্যিই তো। বীর পাকিস্তানি জনতা ঢাকায় তো কম নেই। কওমীরা ফৌজীরাও এখানে মওজুদ। দেশপ্রেমিক পাকিস্তানিদের পাশে দাঁড়াতেই তো লাখো ফৌজী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটে এসেছে এইখানে। অচিরেই একটা সিপাহি-জনতা গণঅভ্যূত্থান ঘটিয়ে ফেলতে হবে। খুনখারাপি রক্তপাত; গুম হত্যা তলোয়ারবাজি; দাঙ্গা ফ্যাসাদ যাই ঘটুক- সিপাহি পাবলিক মিলেমিশেই করতে হবে।
শেখ মুজিবের কল্লাকাটা এখনি করা দরকার। যত দেরী; তত মুশকিল। বিলম্বে খেসারত। বিলম্ব একটা সিভিলিয়ান শব্দ। মিলিটারি ডিকশনারীতে এই শব্দটা নেই। শেখ মুজিব এখন পুরোপুরিই গাদ্দার। দেশদ্রোহী। পাকিস্তানশাহী, কওম ও মিল্লাতের চরম শত্রু। এই শত্রুকে বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। এর মধ্যে তার চ্যালাচামুন্ডাগুলো ইনডিপেডেন্ট গভর্নমেন্টও ঘোষণা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। হিন্দুস্থানের পেটের মধ্যে ঢুকে বর্ডারে কোনো কোনাকাঞ্চিতে বসে তামাশার গভর্নমেন্ট! আরে গাদ্দার! পারলে ঢাকায় আয়। মেহেরপুর না চুয়াডাঙ্গা। একটা আমবাগান দখল করে স্বাধীন বাংলা সরকার! একটা নামও দিয়েছে আমবাগানের, গাদ্দারনগর না মুজিবনগর! আরে একটা আমবাগান দখল করে পলাপলি খেললেই কি স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হয়ে যায়। হা হা।
গোলামও তার সঙ্গে হাসছিল। সে জানাল, ওই আমবাগান মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা ওই সব জায়গা নাকি পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যেই নয়। সব হিন্দুস্থানে। কি একটা সিভিলিয়ান লিডার। নাম তাজউদ্দিন; সে নাকি প্রাইম মিনিস্টার। হা হা। তার সঙ্গে একটা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী; একটা পাতি মাস্টার, নজরুল ইসলাম সে নাকি নায়েবে সদর। আর একটা আছে, কামরুজ্জামান এগুলাই নাকি স্বাধীন বাংলা সরকার। আরে, আগানে বাগানে বসে সরকার সরকার খেললেই কি গভর্নমেন্ট কায়েম হয়ে যায়। হা হা হা।
হাসতে হাসতেই হঠাৎ যেন আড়াই হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের শক খেল টিক্কা খান। তার মাথায় যেন ঠাডা পড়ল। প্রবল বজ্রপাত। এন্টিসোশ্যাল লিডারগুলোর কত বড় দু:সাহস। তার সামনে পড়লে কল্লাকাটা করতে মোটেই দেরী করতো না। এগুলোতে ধরতে পারলে হতো। যশোরের কমান্ড কি করেছে। কেন বদমাশ মিসক্রিয়েন্টদের ধরে জেলখানায় ঢোকাতে পারল না। কড়া ফরমান পাঠিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট এডমিনিস্ট্রেশনকে। ওরা যদি আবার ইস্ট পাকিস্তানের এক ইঞ্চি ভেতরে ঢোকে, সোজা ডান্ডাবেড়ি। নো মার্সি। এমন একটা সুসংবাদ পেলে টিক্কা খান কি করবে! স্বয়ং ছুটে যাবে যশোহর জেলখানায়। হেলিকপ্টারে করে উড়ে যাবে। নিজেই ব্রাশফায়ার করে সবকটাকে মারবে। পানি পর্যন্ত গিলতে দেবে না। ওরা পানি পানি বলে চেঁচালে ওদের জিহবা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে টুকরা টুকরা করা হবে।
গাদ্দারগুলোর স্পর্ধা সত্যিই বিস্ময়কর। যে শেখ মুজিব এখন পাকিস্তানী কব্জায়, তাকে নাকি বানিয়ে দিয়েছে সদরে সরকার। সে নাকি ডল গভর্নমেন্টের প্রেসিডেন্ট। হা হা হা। এখন মুজিবের মরণ ঠেকায় কে। মুজিবকে চাইলে এই মুহুর্তেই ডেথ সেন্টেন্স দেয়া যায়। কোর্ট মার্শাল করে তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডেও দেয়া যায়। সাতই মার্চ সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গ এলান করেছে। কত বড় সাহস! পাকিস্তানি ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ডিক্লেয়ার করেছে। কত বড় বেয়াদব! পাকিস্তানীদের তর্জনী দেখায়। এই দুটি ঘটনাই মুজিবরের চরম দেশদ্রোহের প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট। আর সহ্য করা ঠিক নয়। মুজিবরের খান্দানকেও এরেস্ট করা হয়েছে। শেখ বংশ এখন পাকিস্তানের তালুবন্দি। এখন মাছির মতো পাড়া দিয়ে মারা দরকার।
মুজিবরের ডেথ ফায়ারিং কেমন হবে। একটা গুলি দিয়ে তাকে হত্যা করা ঠিক হবে না। গলায় ফাঁসি দিয়ে হত্যা করলে তো সে বেঁচে গেল। লোকটাকে ফাঁসির মঞ্চে তুলে প্রথমে ওর তর্জনির আঙ্গুল গুলিতে উড়িয়ে দিতে হবে। বেয়াদব। ওর সেই আঙ্গুল হচ্ছে সবচেয়ে বড় বেয়াদব। তারপর গুনে গুনে তিনটা গুলি করতে হবে মুজিবরের কণ্ঠনালিতে। আর কখনও জয় বাংলা বলবি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে এত কষ্ট। জিন্দাবাদ বলতে পারস না। হিন্দুস্থানি জয় জয় বলতে পারস ঠিকই। নাউজুবিল্লাহ। ওর ওই কন্ঠ নালি দিয়েই তো রেসকোর্সে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। ওর সেই কণ্ঠনালিতে অন্তত তিনটা ছেদা করা চাই। মরার আগে যেন আর জয়বাংলা, স্বাধীনতার সংগ্রাম বলতে না পারে। তিনটা ছেদা করে দিলে আর কোনো আওয়াজ বেরুবে না। হা হা।
পিন্ডিতে মুজিব খতমটা হয়ে গেলেই ঢাকায় শেখের বংশ খতম সে করতে পারে। গোলাম পাকিস্তানি যখন সঙ্গে রয়েছে, মাছি মেরে হাত ময়লা করবে না। গোলামের খান্দান ছাত্রসঙ্ঘ; তাদের সঙ্গে কয়েকটা সিপাহি লেলিয়ে দেবে। ওরাই মেরে কেটে সাফ করে ফেলবে। চাইলে দেশপ্রেমিক বিহারীগুলোকেও লেলিয়ে দেয়া যাবে। খুবই সাফ সুতরা মাস্টারপ্লান। খতম কাজ শেষ হলে রেডিও পাকিস্তানে এলান করে দেয়া হবে, বীর সিপাহি-জনতার মহান অভ্যুত্থানে মুজিব খান্দান বিনাশ হয়েছে। জনতার এত তীব্র ঘৃণা ও রোষ ছিল, একটা কুত্তাও কাঁদে নাই। গভর্নর টিক্কা খান হাজার হাজার ক্ষিপ্ত দেশপ্রেমিকের হাত থেকে মুজিবের বিবি আওরত, কন্যা জেনানা-বালবাচ্চাকেও রক্ষা করতে পারে নাই। হা হা হা। (চলবে…)
অলংকরণ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন