চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাবা (পর্ব: ষোল)

গোলাম পাকিস্তানি পিন্ডির রসে বশে থেকে কেবল খেয়ে দেয়ে সময় কাটাচ্ছে না। এটা তার ধাতে সয় না। তার মস্তিষ্ক বড় সক্রিয়। ইবলিশি বুদ্ধির কারখানা। ওস্তাদ মদুদির প্রতিটি বয়েত অক্ষরে অক্ষরে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। নতুন ডাইমেনশনও আনতে মগজ-বুদ্ধি কাজে লাগাচ্ছে। এর চেয়ে সত্য আর হয় না – পাঞ্জাবি-পাকিস্তানিরা আসলেই কোনো জাত না। তার ধুরন্ধর বুদ্ধি এখানে কাজে লাগবে না। পাঞ্জাবি মহলে সময় দেয়া পণ্ডশ্রম। এই জন্য বিস্তর ছোটাছুটি করেছে। ওস্তাদের এন্তেকালের পর করাচি, রাওয়ালপিন্ডি বিরান বিরান লাগছে। এদের পদলেহন করে কোনো ফায়দা হচ্ছে না। বুনিয়াদি জাত্যাভিমান – কওমী রক্তরক্তি ছাড়া কোনো পলিটিক্স তারা আমলে নেয় না। গোলাম তাই বসে থাকে নাই। খয়রাতি করতে নেমেছে। আরব আমীর-বাদশাদের কাছে ভালোই সাড়া পেয়েছে। ওগুলো তো বেকুবেরও বাপ। আস্ত মুরগি-আস্ত খাসি উদরে ঢুকিয়ে ফুলন্ত ভূঁড়ি নিয়ে হালাল আওরত খুঁজে বেড়ায়। পাকিস্তানি-হিন্দুস্তানি-ইয়ামেনী নওল আওরত পেলে কেমন করে হালাল করে শিকার করা যায় – তার ফিকিরবাজিতে উদয়াস্ত ব্যস্ত। ওদেরকে আমীরজাদা-বাদশাজাদা বললে ভীষণ পটে যায়।

গোলাম ভালো কামাই করেছে খয়রাতি সফরে। কিন্তু তারপর ভুল করে নাই। সব পেট্রোডলার-দিনার-দেরহাম নিয়ে পাউন্ড গলিয়ে লন্ডনে মওজুদ করেছে। ওই পাকিস্তানিদের গোলামি-পায়বরি আর বেরাদরি করে চিরদিন চলবে না। বরং পাকিস্তান রক্ষা তহবিলের নামে খয়রাতি করে যতটা পাওয়া যায় – তা নিয়ে জমাতি বায়তুল মাল খুলতে হবে। লন্ডনে সে ছেলেপেলে ভাই বেরাদর সবাইকে জমায়েত করল। তাদের ব্যবসা পাতি খুলে দিল। আগে আত্মীয়স্বজনকে দাঁড় করাবে। তারপর জমাতের নিজস্ব টাকশাল কায়েম করা চাই।

গোলাম পাকিস্তানি চরকির মত ঘুরছে। তার শকুন নজর বাংলাদেশের দিকে। দেশটাকে সে আবার পূর্ব পাকিস্তান না বানিয়ে ছাড়বে না। আবার সেখানে উড়বে চানতারা পতাকা। আবার তাদের গাড়িতে পাকিস্তানি নিশান উড়বে। শিশুকিশোর-নওজোয়ানরা গাইবে ন্যাশনাল এনথেম। পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। তারা গাইবে – পাকসার জমিন বাদ সাদ। পাকিস্তান কায়েম করা না গেলে বাংলাস্তান নাম দিয়ে জমাতের ঝান্ডা উড়াবে। কেমন করে সেই কাজটা সম্ভব? মদুদির সকল বয়েতই সে কাজে লাগাচ্ছে। স্কুল-কলেজে বয়েতি কাজ জোর কদমে চলছে। সবার অলক্ষ্যে। সব কলেজ ভার্সিটি টার্গেটে রাখা হয়েছে। তার পাবলিককে দরকার নেই। শেখ মুজিব হচ্ছে পাবলিকরাজ। তার সঙ্গে পারা যাবে না। মুজিবকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। বড়ই বুঝদিল। তার দিলে খালি মোহাব্বাত। দিলে এত দরদ থাকলে মুশকিল। মুজিব আউলিয়া-দরবেশ হতে পারে। কিন্তু বাদশাহ হওয়া তার হবে না। বাদশাহ হতে হলে আওরঙ্গজেবের মতো পাত্থর দিলের অধিকারী হতে হয়। আপন ভাইর গলা কাটতে হাত কাঁপলে চলবে না। তখতের জন্য আপন ভাইকে জবেহ করতে হবে। মসনদের জন্য যে খুনপিয়াসী হতে পারে না তার জন্য রাজার দরবার নয়।

লন্ডন জমাতি বায়তুল মালের পাউন্ড দেশে সংগোপনে ঢোকাচ্ছে গোলাম পাকিস্তানি। কাজ চমৎকার এগুচ্ছে। তার দরকার ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, সিভিল সার্ভেন্ট। তার দরকার পুলিশ সার্ভিসের লোক। তার দরকার আর্মিতে লোক। সকল রেজিমেন্টে লোক দরকার। সবার অলক্ষ্যে প্ল্যান-প্রোগ্রাম মতোই কাজ চলছিল। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিয়ে যে জাতটাকে দমন করা যায় না – তাদের বক্রপথেই ঘায়েল করতে হবে। মুজিব পাকিস্তানিদের পানিতে চুবিয়ে মেরেছে। খালে বিলে মেরেছে।

খালে চুবিয়ে মুজিবকে খতম করা যাবে না। মুজিবের বিরুদ্ধে চাই অন্য চাল। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী। আহা। বখতিয়ারের ঘোড়া। নামটা আওড়ালেই মনে মনে সালাম ঠুকে দেয় গোলাম পাকিস্তানি। তার ওষ্ঠ গিয়ে ঘোড়ার পদচুম্বন করে। মাত্র সতেরো জন অশ্বারোহী নিয়ে বঙ্গবিজয় করেছিল আড়াই হাতি লোকটা। আজাদ ইস্ট পাকিস্তানে তেমন একটা ধুরন্ধর ফর্মুলা দরকার। মানি ইজ নো প্রোবলেম। টাকার যোগান দেবে গোলাম পাকিস্তানি।

যেখানে যেখানে পাউন্ড ডলার পাঠানো দরকার – চেষ্টায় কোনো কসুর নেই। চাওয়ার আগেই পৌঁছে দিচ্ছে টাকা। আশায় আশঙ্কায় বহুত পেরেশান। ঘুম নেই। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েও ঘুম আসছে না। এসতেখারা করে দেখলে কেমন হয়। এ সম্পর্কেও মদুদির বয়েত মনে পড়ছে। এসতেখারা হচ্ছে বিজ্ঞাননির্ভর মধুর স্বপ্ন-কল্পনা। দুনিয়া জাহানে অতীত বর্তমান আগামীর সব কার্যক্রম বৈজ্ঞানিক সূত্র ধরেই এগোচ্ছে। কিন্তু তার কার্যকারণ সবার নজরে পড়ে না। অনেকে জানতে চায়। কিন্তু মনোদৈহিক পরিশ্রম করতে চায় না। চিন্তাশক্তি কাজে লাগাতে চায় না। বহুত ফিজিক্যাল ধকল। কার্যকারণ জানতে বুঝতে চাই গভীর নিবিড় মনোধ্যান-মনোনিবেশ। ধ্যানের গভীরতায় স্বপ্ন-বিশ্বাস-আকাঙ্খা মিলেমিশে হয় একাকার। এসতেখারা হচ্ছে সেই শীতলধ্যান। যা করলে কার্যকারণগুলো মস্তিষ্কে কল্পচ্ছবি হয়ে ধরা দেয়। ধরা দেয় অতীত। ধরা দেয় ভবিষ্যত।

গোলাম পাকিস্তানি এসতেখারায় বসল। গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে চাইল। ঢুকে পড়তে চাইছে স্বপ্ন-ধ্যানে। কী হতে চলেছে ঢাকায়। কী হবে আগামী দিনগুলোয়। সে যেমনটা চাইছে – তেমন আদৌ হবে কি! আজাদ ইস্ট পাকিস্তান কায়েম করা যাবে কি!

ভীষন টেনশন। এসতেখারা মোটেই জমছে না। অতীত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যত কেমন অস্পষ্ট। রক্ত আর রক্ত। ছোপ ছোপ রক্ত। দেয়ালে রক্ত। রাস্তায় রক্ত। লাশ পড়ছে। অনেক লাশ।

আনন্দ-মৌজে আরও উৎসুক গোলাম পাকিস্তানি। এসতেখারার কল্পচ্ছবি তার কামনা-বাসনা ধরেই এগুচ্ছে। শকুনের সুতীক্ষ্ণ শ্যেন নজর হানে লাশগুলোর দিকে। কার লাশ? কাদের লাশ?

শকুন পাকিস্তানির আনন্দ তখন দেখে কে!

মেজর এখন জেনারেল। মাইনর ব্লাডি সিভিলিয়ানদের মত কখনওই মাইনর থাকতে চায়নি সে। স্বপ্ন দেখেছে মহাতারকার। জলদিই প্রমোশন পাওয়া হয়ে গেছে। টু-স্টার। দো-সিতারা কায়েদে ফৌজ। কিছুদিন ধরেই তার মধুর এক সমস্যা হয়েছে। বিষয়টা সাইকোলজিক্যাল কিনা ঠিক ধরতে পারছে না। মাঝে মধ্যেই তার মনে হয় – নাকটা একটু একটু করে লম্বা হচ্ছে। অতি সুক্ষ্ণভাবে বেড়ে চলেছে। সে টের পাচ্ছে কিন্তু অন্যরা ধরতে পারছে না। হিজ নোজ ইজ অলওয়েজ ওয়ার্কিং। সবকিছুর গন্ধ পাচ্ছে। বিপদের; আনন্দের। সানগ্লাসের আড়ালে দু’চোখ লুকিয়ে রাখছে বরাবরই। বেশ সুবিধাই মিলছে। তার চোখের ভাষা দেখতে পায় না কেউ। নাকটাও অমন আড়াল করে রাখতে পারলে বেশ হতো। মহামূল্যবান নাক। কিন্তু নাকের জন্য তো আর কালারফুল নোজগ্লাস হয় না। দো-সিতারা টের পাচ্ছে – সামনে বিশাল আনন্দের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ঘটনাটা ঘটবেই। কেউ ঠেকাতে পারবে না। সে কারণে নাকটা তার লম্বা থেকে আরও লম্বা হয়ে চলেছে। টু-স্টার আনন্দে ভয়ংকর গদগদ। তার মগজে ছোট্ট একটা ইদুঁর ঠোকরাচ্ছে। কুট কুট। কুট কুট।

একটা ভাষণ এসতেমাল করা দরকার। বিসমেল্লাহে রাহমানির রাহিম। সিপাহি জনতা ভাইবেরাদর, আসসালামু আলাইকুম। খোশ খবর সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনারা ওয়াকিবহাল। মিল্লাতি কিশতি সাতসাগরের সাইক্লোনে বিভ্রান্ত নেই। বৈঠা হাল এখন ফৌজী শরীফের হাতে। মিল্লাতে বাঙ্গালাদেশ তার পাঞ্জেরী খুঁজে পেয়েছে। ইনশাল্লাহ এই দায়িত্ব কর্তব্য কওমের নিশান বরদার হয়ে কঠোরভাবে পালন করব।

জবান এস্তেমাল ঠিকমত হচ্ছে কি! কমিউনিকেটিভ হচ্ছে কিনা – সেটাও ভাবা দরকার। ফররুখ আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম তার অতি প্রিয় কবি। কায়েদে শায়ের। শায়েরে আজম। ফররুখের পাঞ্জেরী তার অতি পছন্দের শব্দ। আর হাবিলদার কবি নজরুল অতুলনীয়। আমরা ছাত্র আমরা বল; আমরা ছাত্রদল। কী অপূর্ব কবিতা। অসাধারণ ছন্দ। কবিতা-টবিতা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। তারপরও মার্চিং লিরিকস শুনতে ভাল লাগে তার।

ভাষণের এস্তেমাল আর জবানি আওয়াজ বিশেষ অগ্রসর হয় না। ইদুঁর খালি ঠোকরায়। কুট কুট। আর টু-স্টার বলে ওঠে – জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। কিসের জিন্দাবাদ। ব্লাডি ফাকিং জয় বাংলা। বল জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। চুপ! একদম ঠোঁটে কুলুপ। বিবিজানকেও বলার সময় হয় নাই। কাউকেই না। বেগমকে তো নয়ই। প্রফেশনাল কাজে বেগম-সহবত তার একদমই পছন্দ নয়।

কিন্তু ভাষণখানা উর্দু স্টাইলে সাজিয়ে রাখা দরকার। জোশ চাই। জবর জোশ চাই। বাংলাটা জবরদস্ত তার আসে না। খালি আসে জিন্দাবাদ; জিন্দাবাদ। এই একটা শব্দ শুনলেই খুনের মধ্যে আশ্চর্য উন্মাদনা। দমাদম মাস্ত কলন্দর। জিন্দাবাদ পহেলা নম্বর।

টু-স্টার টেনশনে পেরেশান। ভাষণটা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু স্পিচ একটা রেডি রাখতেই হবে। যখন তখন সুসংবাদ আসবে। তার নাক যে সুসংবাদ দিচ্ছে – তাতে একরকম নিশ্চিত – ভাষণ দিতে বিশেষ বাকি নাই। কিন্তু বিসমিল্লাহ শব্দটা ঠিক মত বলতে পারল কি! কেমন যেন বিসমেল্লাহ বিসমেল্লাহ শোনাচ্ছে। উচ্চারণ ঠিক মতো হচ্ছে না। বিভিন্ন শব্দের উচ্চারণও ঠিকঠাক হওয়া চাই। উর্দু জজবাটা রাখতে হবে। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষাটাকেও গুরুত্ব দিয়ে স্পিচ করা চাই। ভাষণখানা কোথায় এসতেমাল করতে হতে পারে! রেডিও স্টেশনই উপযুক্ত জায়গা। ওই জায়গাটাও নাপাক-হারাম করে দিয়েছে শেখ মুজিব। পাকিস্তানকে কর্তন করে দু’টুকরা যখন বানিয়েছে – নামটা বাংলাদেশ রাখার কী দরকার ছিল। আজাদ ইস্ট পাকিস্তান রাখলে কি মধুর লাগত শুনতে। আজাদ কাশ্মীর আছে না।

শুনলেই দিলখানা গুলশান গুলশান হয়ে যায়। তারপর কোরিয়া নামক দেশটা দুই টুকরা। সাউথ কোরিয়া। নর্থ কোরিয়া। জার্মানি দুই টুকরা। ইস্ট জার্মানি। ওয়েস্ট জার্মানি। হিন্দুস্তানি মুসলমান সবাই কায়েম করেছিল লড়কে লেংগে পাকিস্তান। বাঙ্গালী মুসলমান সেই লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনে মেজর পার্টি হিসেবে শামিল ছিল। পাকিস্তান – কি শরীফ – পাকপবিত্র নাম। পাক-ই-স্তান। পাকিস্তান শরীফ। পাকসাফ হয়েই তবে নামখানা উচ্চারণ করতে ইচ্ছা হয়। পাকিস্তান তো পাঞ্জাবিদের বাপদাদার সম্পত্তি না। শেখ মুজিব নামখানা ওয়েস্ট পাকিস্তানিদের কাছে বন্ধক-বন্দোবস্ত দিল কেনো! ব্লাডি পলিটিশিয়ান। পিন্ডির রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডলার-পাউন্ডের হিস্যা চাইল, কিন্তু এত সুন্দর নামটার হিস্যা ছাড়ল কেনো! মানি ইজ নো প্রব্লেম। কিন্তু নাম তো খুব বড় ফ্যাক্টর। কোশ্চেন অব ন্যাশনালিটি। টু-স্টার যখন নিজেকে প্রশ্ন করে – হোয়াট ইজ ইওর ন্যাশনালিটি! শেম শেম। লজ্জা। লজ্জা। খুব লজ্জা লাগে নিজের পাসপোর্ট খানা দেখলে। শরমে মরমে মরমে মরে যায়।

ন্যাশনালিটির জায়গায় লেখা আছে – বেঙ্গলী – সোজা কথায় বাঙালি। শুনলেই কমজাত, আতরাফ বলে মনে হয়। এটা ন্যাশনালিটি হয় কেমনে! ইন্ডিয়ায় বাঙালি আছে না! হিন্দু বাঙালি আছে না। তারা সবাই কি তবে বাঙ্গালাদেশের সিটিজেন! সবার ন্যাশনালিটিই তো বাঙ্গালি।

এই ন্যাশনালিটি নিয়ে কত সমস্যা। আরব জাহান এখনও বাঙ্গালাদেশকে মেনে নেয় নাই। স্বীকৃতি দিতে টালবাহানা করছে। টু-স্টার সব খোঁজখবরই তার চ্যানেলে পেয়ে যায়। গোলাম পাকিস্তানি আরব ওয়ার্ল্ডে সঠিক পারফরমেন্স করছে। এইরকম একটা ক্রস-ন্যাশনালিটির দেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত না। আগে ইন্ডিয়ান স্টাইলের ন্যাশনালিটি ছাড়তে হবে। তারপর নিশ্চয়ই স্বীকৃতি মিলবে।

দেশে ফ্রিডম আসছে ঠিক। কিন্তু শেখ মুজিব মনের মাধুরি মিশিয়ে অনেক অনাচার-স্বেচ্ছাচার করেছে। আর এসব মেনে নেয়া হবে না। সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। নো মার্সি। লোকটা তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কিছু বোঝে না। পাকিস্তানের ন্যাশনালিটি কি! পাকিস্তানি। শুনলেই একটা মহান শরীফ জাত বলে মনে হয়। ওই রকম একটা জবরদস্ত ন্যাশনালিটি দরকার। বেশ একখানা ভেবেও রেখেছে টু-স্টার। বাঙ্গালাদেশী। শুনতে মন্দ না। মন্দের ভাল। বেশ একটা পাকিস্তানি পাকিস্তানি ঢং আছে। আওয়ামী লীগকে দিয়ে আর হচ্ছে না। বাকশাল টাকশাল দিয়ে হবে না। নতুন পার্টি করতে হবে। কত সুন্দর সুন্দর নাম আছে – ফ্রিডম পার্টি; আজাদ পার্টি, পিপলস পার্টি, ন্যাশনালিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল পার্টি। আচ্ছা, ন্যাশনালিস্ট বাংলাটা কী! ঠিক মনে করতে পারে না সে। ধুত্তোর! ভার্সিটির একটা প্রফেসরকে ফরমান দিলেই হবে। আসল কথা – আগে ন্যাশনালিটি পাল্টাতে হবে। তারপর জবরদস্ত একটা ন্যাশনাল পার্টি ওপেন করতে হবে। দ্যাট পার্টি প্রোডিউসেস ডেমোক্রেসি। নিউ ডেমোক্রেসি। আইয়ুব খান এস্তেমাল করেছিলেন বেসিক ডেমোক্রেসি। সেই রকম ফৌজী ডেমোক্রেসি।

শেখ মুজিবের এইসব পাবলিক ডেমোক্রেসি দিয়ে দেশ চলবে না। আইয়ুবের মত ফিল্ড মার্শাল চাই। আয়রন ম্যান। টু-স্টার নিজেই একটা ডেমোক্রেসি প্রভাইড করবে।

পাকিস্তান দুই টুকরা যখন হয়েছে – নামখানার অর্ধেক হিস্যা দখলে রাখা উচিত ছিল। টু-স্টার কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারে না। নামটা ইস্ট পাকিস্তান না হয় রাখল না। পাকিস্তান নামে মুজিবের নিশ্চয়ই প্রচুর এলার্জি। কিন্তু নামের শেষে দেশ না রেখে স্তান লাগালে কী এমন মহাসমস্যা হতো? বেলুচিরা যেখানে থাকে – বেলুচিস্তান। আফগানরা থাকে আফগানিস্তান। এমনকি উজবুকরা পর্যন্ত দেশের নাম উজবুকিস্তান রেখেছে। সেখানে বাঙ্গালাস্তান ছিল সঠিক নাম। টু-স্টার না পারে কাউকে বলতে। না পারে সইতে। ইদুঁরটা মাথায় খালি কুট কুট। তবে এটা ঠিক – মওকা আসতেছে সামনে। যেদিনই মওকা আসবে – বাংলাদেশ বেতার নামক নাপাক-হারাম নামটা না বদলিয়ে সে জবানশরীফ কবুল করবে না। কি অশ্রাব্য কুৎসিত নাম। সেখানে ঢোকার আগেই বেতার লেখা সাইনবোর্ড ব্রাশফায়ার করে খতম করাবে। নামও চুড়ান্ত করে রেখেছে – রেডিও বাঙ্গালাস্তান বা রেডিও বাংলাদেশ। মওকামতন নাম বদলিয়ে শরীফ ও হালাল করতে হবে।

অনেক কিছুই সাফ সুতরা করতে হবে। কত কাজ যে বাকি। একটা নাপাক কনস্টিটিউশন করা হয়েছে। এটা কোনো কনস্টিটিউশনই হয় নি। এটাকে ভাল করে সাইজ করা দরকার। সেটার নাকি আবার চার মূলমন্ত্র। নাকি ব্লাডিগুলো চার স্তম্ভ বলে। মন্ত্র শব্দটিই হিন্দু হিন্দু লাগে। মন্ত্র ফন্ত্র মুসলমানের কাজে লাগে না। হিন্দুস্থানি মন্ত্রণায় সোসালিজম, সেকুলারিজম – এই কুমন্ত্র রাখা হয়েছে। সোসালিজম শুনলেই কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগে। দেশটা কি এখন কমিউনিস্ট। ধর্ম নাই। কর্ম নাই। কমিউনিস্টরা বাচ্চা পয়দাও নাকি নিজের ফেমিলির জন্য করে না। বাচ্চাও নাকি পয়দা করে কমিউন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য। নাউজুবিল্লাহ। আর সেকুলারিজম! এই শব্দ শুনলেই তো কান নাপাক-নাসাফ হয়ে যায়।

টু-স্টার পাক্কা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সেকুলারিজম-সোসালিজমকে ডাইরেক্ট ব্রাশ ফায়ার। যেখানে শব্দগুলো আছে – ছররা গুলি দিয়ে ঝাঁঝরা করা হবে। বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস। মানলে মানো। নইলে খতম। কোনো মার্সি-টার্সি নাই। টু-স্টারের তীব্র ইচ্ছে – কনস্টিটিউশনটা টেবিলের ওপর রেখে এক্ষুণি ব্রাশ ফায়ার করে ঝাঁঝরা করে দেয়। কোনো বিলম্ব নয়। অনেক হয়েছে। আর নয়। এনাফ ইজ এনাফ।

কুট কুট। কুট কুট।

কিন্তু এজন্য অধৈর্য হলে হবে না। সফলকাম হতে হলে মওকাবাজ হতে হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত ধরি মাছ না ছুঁই পানি হয়ে থাকতে হবে। একদিন এমন মওকা আসবে – সেটা টু-স্টার সেই কালুরঘাট বসে আন্দাজ করেছিল। তার নাক ঠিক মেসেজই দিয়েছিল। সুতরাং আর কিছুটা সময় ঘাপটি মেরে থাকতে দোষ কী! তার পরম আশ্রয় হচ্ছে সানগ্লাস। এখন কিছুদিন ঘুমাতে গেলেও সানগ্লাস চোখে রাখতে হবে। কেউ যেন টের না পায়।

আরেকটা সমস্যা অবশ্য কুট কুট করছে মস্তিষ্কে। এটার কোনো কার্যকারণ আন্দাজ করতে পারছে না। একটা কর্নেল আর দুইটা মেজর এসেছিল চুড়ান্ত মাস্টার প্ল্যান জানাতে। স্পট টু স্পট কাভারেজ। একটা ব্লুপ্রিন্ট পর্যন্ত সঙ্গে এনেছিল। পয়েন্ট পয়েন্ট তাতে নকশা করা ছিল। কার কোথায় কমান্ডিং পজিশন – কোন পয়েন্টে কার কখন একশন – এখন সব টু-স্টারের নখ দর্পণে। তিনঘন্টা ধরে ক্লোজডোর ডিসকাশন হয়েছে। কোনো খুঁটিনাটি পয়েন্ট আলোচনা-পর্যালোচনার বাইরে ছিল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে। কাগজে এঁকে এঁকে দেখা হয়েছে। কোনো ডিসপুট আছে কিনা। নো ডিসপুট।

বার বার মাস্টার প্ল্যানটা মস্তিষ্কে সাজিয়ে দেখছে টু-স্টার। রিভিউ করছে। ওয়ার সাইন্সে পেছনে শত্রু রেখে জোর কদম এগোতে নেই। সব ফর্মুলা প্রয়োগ করা হয়েছে। কোনো সমস্যা খুঁজেই পাচ্ছে না সে। আইএস আই-থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মাস্টার পিস প্রোডাকশন। আই এস আই-এর ডায়েট মানেই গড এ্যাপ্রুভড ইট হিম সেলফ।

একটা কিন্তু ভেবে রাখা ভালো। যদি ব্লুপ্রিন্ট কাজ না করে। ইন্ডিয়া তক্কে তক্কে থাকবেই। যদি তারা ভেস্তে দেয়। তখন কী হবে। টু-স্টার কেমন করে আত্মরক্ষা করবে। শামুকের মত নিজেকে গুটিয়ে নিতে কি সে পারবে!

ফাইনাল ডিসকাশনের কোনো প্রমাণপত্র টু-স্টার রাখেনি। নো ডকুমেন্টস। ব্লুপ্রিন্টের একটা কপি দুই মেজর তার কাছে গছিয়ে দিতে চেয়েছিল। টু-স্টারের বুঝতে এক সেকেন্ডও দেরি হয়নি – এটা ক্যু দেতায় তাকে কাগজে কলমে জড়িত রাখার মার্শাল স্টাইল ফন্দি। পরে কোর্ট মার্শাল হলে মোক্ষম ডকুমেন্টস। স্ক্র্যাপ কাগজ যা ছিল – সব নিজহাতে বাথরুমে ফ্লাশ করে দিয়েছে। নিজ হাতে। আর্দালি-ব্যাটম্যান কাউকে বিশ্বাস করেনি। সিক্রেট সার্ভিসে বিশ্বাসের কোনো দাম নেই। কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। কারও বিশ্বাসের দাম রাখতেও নেই। বিশ্বাস বা ফেইথ হচ্ছে একটা থার্ডক্লাস সেন্টিমেন্ট।

মানুষের বিশ্বাস বলো; ধর্মবিশ্বাস বলো – এসবকে তুমি হাতিয়ার বানাতে পার – কিন্তু কখনোই বিশ্বাসের দাস হবে না। বলি হবে না। অন্যের মধ্যে বিশ্বাস জাগাও – আস্থা দাও – নিজেকে সবার জন্য বিশ্বস্ত ইমেজে সাজাও – কিন্তু নেভার, কখনও কাউকে বিশ্বাস করবেও না। কাউকে দেয়া ওয়াদা-বিশ্বস্ততা রক্ষায় সেন্টিমেন্টাল হবে না। সব সময় খেয়াল রাখবে, তোমার কার্যসিদ্ধির জন্য কোন কাজ করা প্রয়োজন। নিষ্ঠুরভাবে তুমি সেই কাজটাই করবে।

এইসব স্পেশাল স্পিচগুলো যখন নিজের সঙ্গে নিজে বলে – টু-স্টারের তখন দারুণ প্রশান্তি লাগে। ইচ্ছে হয় কথাগুলো তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রাখে। খুব ইচ্ছা হয়। তার নাক তাকে সতর্ক সঙ্কেত দিতে দেরি করেনি। তাই নিজেকে নির্দোষ নিষ্কলুষ রাখতে সব রকম সতর্কতা এপ্লাই করেছে। তিন ঘণ্টার সিটিং-এ টু স্টার প্ল্যানপ্রোগ্রামের নকশাগুলো দেখেছে বেশি। মেজরদের কথাও শুনেছে বেশি। বলেছে কম। মাত্র কয়েকটি শব্দই বার বার বলেছে – ইয়াপ। ইট’স এনাফ। আই এ্যাম ইমপ্রেসড। আই এ্যাম ইনফরমড। গো এ্যাহেড। মাই বেস্ট উইশেস ফর ইউ মাই বয়েজ।

কথার চেয়ে মস্তিষ্ক খাটিয়েছে বেশি। মাস্টার প্ল্যান কোনোক্রমেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। সেদিকটা পুরো মস্তিষ্ক-মগজ খাটিয়ে ময়না করে দেখেছে। ভুলগুলো দেখিয়েও দিয়েছে। দিস পয়েন্ট ইজ রং মাই বয়েজ। চেঞ্জ ইট।

দুই মেজর জানতে চেয়েছে, হোয়াট ইজ টুবি ডান স্যার!

টু-স্টার মুখে কিছু বলেনি। পেন্সিল নিয়ে হালকা গোল দাগ করে বলেছে – ট্যাঙ্ক ইজ এ মাস্ট। সিভিল পলিটিশিয়ানস এন্ড ব্লাডি লিডারস আর এফ্রেড অব ট্যাঙ্ক। ফারুকস ট্যাঙ্ক স্টার্টস ফ্রম দিস পয়েন্ট।

কোনো কাগুজে ডকুমেন্ট না রাখলেও পুরো ব্লুপ্রিন্ট সে মাথায় ছবির মতো তুলে নিয়েছে। চোখ বুঁজলে বা খোলা চোখেই দেয়ালে একটু স্থির হয়ে তাকালে সব দেখতে পাচ্ছে। ক্যান্টনমেন্ট। এয়ারফোর্স। এয়ারপোর্ট। থার্টি টু প্রেমিসেস। ব্লাকপয়েন্ট। ব্লাডশেড। সবকিছু। ওকে। ওকে। ইট’স এ ওভেনপ্রোভেন মাস্টার প্ল্যান। যতবারই টুস্টার প্ল্যানটা যাচাই করে দেখছে – অপরিসীম অভূতপূর্ব অফুরন্ত আনন্দে শরীর মন চিত্ত ভরপুর হয়ে উঠছে। এবার আর সে কোনো ব্লাডি লিডারের ডিক্লারেশনের এনাউন্সমেন্ট হাতে রেডিও স্টেশনে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াবে না।

এবার সেই হবে সদরে মুল্লুক। সদরে ওয়াতান। দ্য প্রেসিডেন্ট অব দ্য রিপাবলিক।

গুড জব। ওয়েল ডান। গো এ্যাহেড। মাত্র কয়েকটি শব্দ। অর্ডারলি কর্নেল ও দুই মেজরকে এই কয়েকটি শব্দেই অফিসিয়াল এন্ড কনফিডেন্সিয়াল অর্ডার পাস করে দিয়েছে সে।

কিন্তু এখন সমস্যা অন্য জায়গায়। তার বেগম এই মোস্ট কনফিডেন্সিয়াল মিটিং সম্পর্কে কি ওয়াকিবহাল। তাকে তো জানতে দেয়া হয়নি। কখনোই সে বেগমকে তার কোনো কাজের সংশ্রবে রাখে না। বেগম ইজ বেগম। তাদের জন্য ওয়াইভস – নামে এনটারটেইনিং অর্গাইজেশন করেও দেয়া হয়েছে।

ব্লুপ্রিন্টের ব্যাপারে তাকে কেউ কি জানিয়েছে? খানিকটা সন্দেহ তো হচ্ছেই। গাঢ় এবং গভীর। সাচপিশাস।

কুট কুট। কুটকুট। কে জানাল? কর্নেল বা মেজর! না, ওরা জানানোর কথা নয়।

কে তাহলে!

মধ্যরাতে বেগম বেশ বেসামাল। বাতচিতের মাথামুন্ডু নেই। অপ্রকৃতিস্থের মতো বেগম হাসছিল। বলছিল, ম্যান ইজ মরটাল। মুজিব ইজ মরটাল। শেখ মুজিব যেদিন মরবে – আমি সেদিন বার্থ ডে সেলিব্রেট করব।

টু-স্টার প্রচণ্ড  চমকে গিয়েছিল। কিন্তু কথা বাড়ায়নি। জেরাও করেনি বেগমকে। চুপচাপ ছিল। পাত্তা দেয়নি ওর কথায়। বেগমও টু-স্টার-সাহেবের নিরুত্তাপ অভিব্যক্তি নিয়ে ভাবিত হলো না। বার বার বলছে, মুজিব ইজ মরটাল। বলে বিমলানন্দ এনজয় করছে। সে হাসছেই। ধুমধাম করে হবে বার্থডে। মহাসমারোহে করব। বিরাট কেক কাটব। মস্ত বড় কেক।

বেগমের আনন্দে বেশ বিস্মিত টু-স্টার। বেগমের বার্থ ডে যেন কবে! না, না। ব্লুপ্রিন্টের শিডিউলের সঙ্গে তো সেই ডেটটা একদমই যে মিলছে না।

কী হয়েছে এই মহিলার। মুজিবের মরণ কামনায় কেনো সে এত ব্যাকুল অস্থির। মুজিবের মরণ-সম্ভাবনায় কেনোই বা সে এত মহাআনন্দে উদ্বেল।

তার হাসিটা ভীষণ রাক্ষুসী। মুজিবের লাশটা কি বেগমের চোখের সামনে। রক্তাক্ত লাশের বুকের ওপর একটা চল্লিশ পাউন্ড মিল্ক হোয়াইট কেক রাখল। বেগম ছুরি চালিয়ে সেটা কাটছে। খাচ্ছে। তার খুশি আর হাসি কিছুতেই থামছে না।

বত্রিশ নম্বরের সাজানো গুছানো নিজের বাড়ি ছেড়ে আবার যে আশ্রয়হারা হতে হবে – আম্মা কখনোই আন্দাজ করতে পারেননি। এজন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। বাকি জীবন তিনি ওই বাড়িতে সবাইকে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন। শেখ সাহেবের গিন্নি – তার জীবনচক্র সত্যিই অদ্ভুত। বাবা অবশ্য ওয়াজেদ এবং হাসিনাকে পাশেই বাড়ি ভাড়া নিতে বলেছিলেন – পনের নম্বরে সেটি নেয়া হয়েছিল বলে রক্ষে। সে বাড়ি আদৌ নেয়া হতো না। কিন্তু হাসু মা হতে চলেছে – শত জটিল সমস্যার মধ্যেও বাবা সেটা মনে রেখেছিলেন। কখন কী হয়। পাক হায়েনারা যে কোনো সময় বত্রিশ নম্বরে হামলা করতে পারে – সে আশঙ্কা প্রবল ছিলই। ব্রাশ ফায়ার হতে পারে; রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পারে জল্লাদেরা – সে আশঙ্কাও ছিল।

পৃথিবীতে হাসুর কোল আলো করে নতুন একটি শিশু আসতে চলেছে – তার জন্য চাই সুরক্ষা। তার জন্য অন্তত চাই নিরাপদ একটু ঠাঁই। বাবা তাই নিজেই তাগাদা দিয়ে বাড়ি ভাড়াটা নিতে বলেন। বত্রিশ নম্বরের প্রতি মুহুর্তের টেনশন; অনিশ্চয়তা; নানা আতঙ্ক – এসব গর্ভবতী মায়ের জন্য মোটেই অনুকূল ছিল না। কিন্তু হাসুকে আটকে রাখবে কে! এই ভয়ংকর বিপদের দিনগুলোতে বাবা ও পরিবারের পাশে সে থাকবে না – সে হয় না। পঁচিশের সেই রক্তস্নাত রাতে হায়েনারা বত্রিশ নম্বর লণ্ডভণ্ড করে বাবাকে নিরুদ্দেশে নিয়ে যায়। ঢাকায় কারফিউ। স্তব্ধ। কবরের নীরবতা শহর জুড়ে। এই স্তব্ধতা ভালো নয়। এই নৈঃশব্দ ভাল নয়। টিক্কা-ইয়াহিয়া-রাও ফরমান একদিকে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির।

অন্যদিকে মুজিবকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে আনন্দ-গুলজারেও মত্ত। মুজিবের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাকে কেমন করে মহাশ্মশান বানানো যায় তার ব্লুপ্রিন্ট-মাস্টার প্লান একযোগে পিন্ডি ও ঢাকায় বিরচিত হচ্ছিল। মিটিং-এর পর মিটিং হচ্ছে। ডিসকাশনের পর ডিসকাশন। ঢাকার ফৌজীশালা-গভর্নর হাউস ষড়যন্ত্র-মন্ত্রণার আখড়া। পিন্ডিতে ভুট্টো একাই একশ। লারকানার ধূর্ত শৃগাল। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। তার সঙ্গে পৌনে একশ এমএলএ। ইয়াহিয়ার কাছে মহাজামাই আদর পাচ্ছে ভুট্টো। তাকে যে কোনোদিন বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। ভুট্টো ক্রমশ পশ্চিম পাকিস্তানের হর্তাকর্তা হতে চলেছে। সে জোর দেনদরবার করে চলেছে। ইয়াহিয়া হচ্ছে পার্ডনহেড। মাথাভরা গোবর। ইয়াহিয়াকে দিয়ে মুজিবকে থেঁতলে দিতে পেরে ভুট্টোরও আনন্দ অপরিসীম।

ঢাকায় ফৌজীশালায় ও গভর্নর হাউসে দাঁড়াল শকুন, দাঁতাল রক্তবাজ, গোরখোদক, কসাই মোল্লা, জল্লাদ, কলজেখোর গোলাম পাকিস্তানি, নেজাম-জমাতের কিস্তিটুপি-জিন্নাহটুপিঅলা ধর্মবাজরা কেউ দৌঁড়ে ছুটে; কেউ হামাগুড়ি দিয়ে; কেউ অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে টিক্কা-নিয়াজির রক্তপানশালায় পৌঁছে গেছে। শয়তানের আখড়ায় সবাই মচ্ছবে মাতোয়ারা। সবগুলো ইয়াজুজ মাজুজের মত জিহবায় শান দিচ্ছে। নিজেই চাটছে নিজের জিহবা। রক্তের নোনা স্বাদের জন্য উম্মাদ। লাল দরদালানের ভেতর সিরিজ মিটিং। টিক্কা-রাওফরমান-নিয়াজি ব্লুপ্রিন্ট বানিয়ে চলেছে। সব কাজ পিন্ডির মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী হচ্ছে। কোনো নয় ছয় হচ্ছে না। গোলাম পাকিস্তানি অত্যন্ত সুচতুর। সংখ্যায় অল্প হলেও তার আছে অত্যন্ত সুসংগঠিত খুনি বাহিনী। কলেজে স্কুলে মাদ্রাসায় জল্লাদ ছাত্রসংঘ করে দারুণ ফল পেয়েছে। ছাত্রসঙ্ঘের ক্যাডার মানেই বখতিয়ার খিলজির মত ক্ষিপ্র-মওকাবাজ; আওরঙ্গজেবের মতো নিষ্ঠুর। রাতের অন্ধকারে গলা কাটতে; রগ কাটতে গোলাম-মেশিন।

গোলাম দিনের বেলা টিক্কার মোলাকাতে যায় না। গভর্নর  হাউজে যায় চুপি চুপি। নিত্যনতুন ব্লুপ্রিন্টের শলা দিয়ে আসে। আর নিয়ে আসে এসাইনমেন্ট। গোলাম একঢিলে দুই মারবেই। এই তো সুযোগ। টিক্কা-ভুট্টাকে কাজে লাগিয়ে তার পার্টির একটা জবরদস্ত ফাউন্ডেশন বানিয়ে নিতে হবে এখনই। তার  তালেবান জল্লাদ-কসাইদের সঙ্গোপনে প্রয়োজনীয় অর্ডার দেয়া  হয়েছে। দেয়া হয়েছে এলাকাভিত্তিক হান্টিং-কিলিং-এর  ডিউটি।
 সব মহলমে আতঙ্ক ফেলা দো। বাঙ্গালকো জোশ কাবু করদো। নো মার্সি।

জল্লাদ তালেবানরা যাতে সাইকোলজিক্যাল ব্রেকডাউনের শিকার না হয় ইমোশনের শিকার না হয় এজন্য গোলাম পাকিস্তানি জমাতের আখড়ায় নতুন ফতোয়া দিয়েছে। ফতোয়া-এ খাস। যতদিন পাকিস্তানি  ফৌজীরা গাদ্দারি ইস্ট পাকিস্তানে থাকবে ততদিন বাঙালি রমনী তাদের জন্য গনিমতের মাল। যাকেই তারা দখল করতে পারবে তুলে নিতে পারবে সেই জেনানা ফৌজের জন্য হালাল। গনিমতের মাল শরীয়ায় জায়েজ। সম্পূর্ন হালাল। মিল্লাতি ফৌজের গনিমতের মাল হতে পারলে বাঙালি রমনীদেরও সৌভাগ্য। মিল্লাতি ঔরসে সাচ্চা পাকিস্তানি পয়দা হবে।ইস্ট পাকিস্তানিরা হারাম কওম থেকে হালাল হয়ে  মিল্লাত-ভুক্ত  হবে।  বাঙাল কওমের মধ্যে যে সব পরিবারে হারামজাদা মুক্তিসেনা আছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম-স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে যেসব পরিবার সকল ফেমিলির আওরত-বিবি-জেনানা-কন্যা সন্তান সবাই পাক ফৌজী ও গোলামী তালেবানদের জন্য গনিমতের মাল।

গোলামি ফতোয়া শুনে কসাইদের উল্লাস আকাশবাতাস কাঁপিয়ে তুলল।  ইয়াজুজ মাজুজরা দলে দলে বেরিয়ে পড়লো মিশনে। কসাই কাদের মোল্লার বাড়ি ফরিদপুর। জমাতে গোলামীর খান্দানি রক্ত। ছাত্রসঙ্ঘের জল্লাদি-কসাইগিরির সব ট্রেনিং নিয়েছে সে । পাক্কা গোলামশিষ্য। গোলাম পাকিস্তানি   তাকে ঢাকাতেই এসাইনমেন্ট দিয়েছে। তার ফুর্তির শেষ নাই। বয়েস বেশী না। কিন্তু খান্দানি জমাত-মেম্বর হওয়ায় একাই একশ। ঢাকার মিরপুর বিহারীস্থান তার কর্মস্থল। এখানে বিহারী বাঙ্গালি দাঙ্গা বাঁধিয়ে ফায়দা লুটতে হবে। বিহারীদের বাঙ্গালি খতমের সিপাহি বানাতে হবে। মদুদি যেমন পাঞ্জাবে আহমদিয়া মুসলিমদের খতম করেছে সুক্ষè কৌশলে। সেই দাঙ্গাবাজির কৌশল এখানেও ব্যাবহার করতে হবে। স্পেশাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত এই কাদের মোল্লা। কিন্তু বয়স কম বলে উত্তেজনা জোশ জজবা ধরে রাখতে পারে না।

 জজবার সল্লুকে সে মাঝে মধ্যেই ফানা হয়ে ওঠে। নিজেকে সামলতে পারে না। তার এলাকা থেকে দৌড়ে ছুটে ফৌজীশালায় চলে যায়। শুনেছে ইয়াহিয়া খান আসছে। দৌড়াতে দৌড়াতে এয়ারপোর্ট হাজির। ইয়াহিয়ার পাক উর্দু  জবান; পাকিস্তানি ফরসা খোমা দেখে তার আহ্লাদ ধরে না। পেছন পেছন হাঁটে। খানিকটা হাঁটার পর ইয়াহিয়াকে কদমবুচি করে।  পায়ের মোজার  স্পর্শ আর বুটজুতার ধুলাবালি হাতে মেখে কপালে ঘষতে থাকে। ইয়াহিয়া খুশি হয়। কৌন হ্যায় ইয়ে বাঙ্গাল জওয়ান। হু ইজ হি!
কসাই কাদের আনন্দে পারলে লাফ দেয় । বলে, ম্যায় জমাতের ইসলামি ছাত্রসঙ্ঘকা লিডার হু। মেরা নাম কাদের মোল্লা। গোলামজীকা এসাইনমেন্ট লে কর  মিরপুরমে দাখিল হু। উধার মুজিবকা আদমী পাকড়াও করনে কিলিয়ে মেরা এক গ্যাং হ্যায়। মুজিবকা আদমী হাম কতল কর দেগা।

ইয়াহিয়া এইসব কীটপতঙ্গের দিকে তাকায় না। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে স্মিত হাসে। বলে, সাসাস জেন্টলম্যান, সাবাস।  কাদের আবার গড়িয়ে পড়ে পদচুম্বন করে। ইয়াহিয়া খুশি হয়। বলে দেখো দেখো সাচ্চা বাঙ্গাল মুসলিম জওয়ান হ্যায় হামারা সাথ।  কাদের তখন পাক ফৌজী দলের কর্নেল হওয়ার জজবা নিয়ে মিরপুর ফিরে যায়।
আবার যখন সে শোনে টিক্কা খান আসছে তেজগাঁও ময়দানে।  আবার দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাজির হয়। সেই একই ভক্তিজ্ঞাপন স্টাইল। টিক্কার পায়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে কদমবুচি। পেছন পেছন হাটে। টিক্কা খা তার পরম আদর্শ। এইরকম পাত্থর দিল সে হতে চায়। পাত্থর মে গুলিস্তা পয়দা নেহি হোতা। ম্যায় বাঙ্গালকা খুন কি বুঁদ শুকনা চাতা হ্যায়।

টিক্কা বিচ্ছিন্ন কথা বার্তা শুনে উত্তেজনায় আটখানা। কী শরীফ কথা বার্তা। কী জবরজোশ জবান। টিক্কা শাহীর পেছনে যতক্ষণ হাঁটা যায় ততক্ষণ জীবন যৌবন স্বার্থক। টিক্কাকে সে জানায় পাকিস্তানকা আজাদী প্রটেক্ট করলে কি লিয়ে ম্যায় জান কুরবান কর দেগা। টিক্কা খুব খুশি হয়। বুকে টেনে নেয় তাকে। কাদের মোল্লা এবার কালো সানগ্লাস পড়ে। মটর সাইকেল চালিয়ে মিরপুর যায়। তার বুক ফুলে পর্বত। নিজেকে ফৌজী কাপ্তান কাপ্তান মনে হচ্ছে। টিক্কা ইয়াহিয়ার ফরমান তার বুকপকেটে। গোলাম পাকিস্তানির অর্ডার দিলের মহব্বতে।  সত্তুরের প্রলয়ংকরী ভোটের পর থেকে গোলাম তাকে মিরপুরে মোতায়েন করেছে। বিহারীদের ভাল করে মটিভেট করেছে। সবাই মোল্লার কমান্ডের জমাতে এসেছে। কিছুদিন ধরেই একটা কাঁটা গলায় বিধঁছিল।

পল্লব নামের নাদান একটা ছোকড়া। হারামজাদা। বলে কিনা মোসলমানের আওলাদ। মুসলমানের পয়দা হলে নাম পল্লব হয় কেমনে! কিছু একটা গন্ডগোল আছেই। কিছুতেই ছোকড়াকে সাইজ করা যাচ্ছিল না। বড় সমস্যা করছিল। পল্লব বেদ্বীন, জারজ, মালাউন বলে কাদের ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। বলেছে নামডা শুনছ নি। হালার পুত মুসলমানের পয়দা হইতে পারে না।ওর মাতৃদেবী নিশ্চয়ই হিন্দু। নমু-মালাউন। বাপটারও  ঝামেলা ঝুমেলা আছে।

কোন গুজব-প্রপাগান্ডায় কাজ হচ্ছিল না। সমস্যা হল জওয়ান তুর্কি হলেও পল্লব পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ  মসজিদে ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে আদায় করে। কোন রা’কাত বলতে গেলে কা’জা করে না। দেওবন্দি বিহারি ইমাম সাহেব তাকে পছন্দ করেন বেশ। মাঝে মধ্যে মুয়াজ্জ্বিন সাহেব অন্যত্র কোথাও গেলে পল্লব আজান দেয়।  মনোমুগ্ধকর কন্ঠ। অনেক দুর পর্যন্ত ভেসে যায় তার আজান। মিষ্টি এবং সুমধুর। বিহারী বাঙ্গালী সকল নামাজির অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে পল্লব। নামাজের এক্বামতও দেয়। বিহারীরা আবার খুব তুলনাপ্রিয়। তারা পল্লবকে বিলালী বলে ডাকে।

অল্পদিনেই সে সবার মধ্যেই অতি পপুলার হয়ে ওঠে। কাদেও মোল্লা অবশ্য পল্লবকে জমাতে দাখিল করতে চেয়েছিল। ছাত্রসঙ্ঘের সদস্য বানাতে চেয়েছিল। ওই সব দাঙ্গাবাজ সিলসিলা পল্লবের পছন্দ নয়। বরং সে কাদেও মোল্লার প্রতিদ্বন্ধী হয়ে যায়। কসাই কাদের চেষ্টা চালাচ্ছে দাঙ্গা বাঁধানোর। আর পল্লবের কাজকাম ঠিক উল্টা। সে আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে বিহারী-বাঙ্গালী মিলমহব্বত পূর্ন সহবত রক্ষার। সাতই মার্চের ভাষনের পর কসাই সামান্য কোনঠাসা হলেও বিহারী পল্লীতে তার কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছিল না। মুজিবের নামে অকথ্য সব গুজব ছড়াচ্ছে।

শেখ বংশ নিয়ে নানা কটুক্তি করছে। মুজিব আর আওয়ামী লীগ বিহারীদের মেরে কেটে খতম করবে এমন শয়তানি প্রচার চালাচ্ছে। বিহারীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। মিরপুরে বাঙ্গালি কম। তাদেরকে তারা বিদ্বেষ ও শত্রুতার নজরে দেখছে। কসাইয়ের টার্গেট বিহারীরা। সে তাদের  লিডার হতে চায়। সে যা বলবে বিহারী কওম তা অক্ষরে অক্ষরে মানবে।  কাদেরের ওপর গোলাম পাকিস্তানির হাইকমান্ড খুবই প্রসন্ন।

পল্লব এই দু:সময়ে বসে থাকতে পারে না।  সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনে এসেছে। বিহারীদের সে বোঝায় । বঙ্গবন্ধু বলেছেন বিহারী বাঙ্গালি ভাই। ঘরের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে। তারা দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধাতে চাইবে। হুশিয়ার করেছেন লিডার। বিহারী অবাঙালি সবাইকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ সাহেব। সেসব জানিয়ে সম্প্রদায়গত সৌহার্দ সম্প্রীতি রক্ষার জন্য দিনরাত খাটতে থাকে পল্লব। ঘুম নাই।  যাতে কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য জানবাজি সে লড়তে থাকে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু তরুনকে পাহারায় লাগানো হয়। কোনরকম আশঙ্কা দেখা দিলে বিহারী-বাঙ্গালি তরুনরা হাতে হাত মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোন অবস্থাতেই দাঙ্গার আগুন জ্বলতে দেবে না।

কাদের মোল্লার সামনে খুব মুশকিল। তার জামাত-মিশনী কাজে এই ছোকড়া বিষফোঁড়া হয়ে দাড়িয়েছে। হাইকমান্ডে জানায়। গোলাম অর্ডার দেয়Ñ সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকো। মওকা পেলে কোন গাফিলতি করবে না। গর্দান বরাবর কোপ দিয়ে কতল করে দেবে।

কসাই সেই অপেক্ষায় ছিল। ছায়ার মতো জল্লাদ লাগিয়ে দিয়েছে পল্লবের পেছনে। কিন্তু কিছুই করা যাচ্ছে না। মুজিবের সাত মার্চেও পর পরিস্থিতি বড় থমথমে। হাওয়া কোনদিকে বোঝা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। মুজিবের কথায় পূর্ব পাকিস্তান চলছে। কাদেরের কোনভাবেই এটা সহ্য হচ্ছে না। ওর ইচ্ছে হচ্ছে ফরিদপুর গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়া গিয়ে মুজিবরের চৌদ্দগোষ্ঠির বাড়ি ভিটা আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আসে। আগুনের পুড়ে ওর চৌদ্দগোষ্ঠি মরুক। কসাই তা বসে বসে দেখবে। বত্রিশ নম্বর মুজিবের বাড়িতেও হামলা করতে তার তীব্র ইচ্ছা। এই বাড়িটা এখনও টিক্কাশাহী ব্রাশফায়ারে ঝাঝড়া করে দিচ্ছে না। এই বাড়িটা একদম মাটিতে মিশিয়ে দেয়া দরকার। মুজিবের নামনিশানা যেন না থাকে। তারপর বিরান ভিটার ওপর সে মৌলুদশরীফ পড়বে।

পল্টন ময়দান, রেসকোর্সও কাদের মোল্লার চক্ষুশুল। হারামজাদারা পিল পিল করে নাকি গিয়েছিল। ওখানে যেগুলা গেছে সব বেজন্মা-পয়দা। এগুলা সব হিন্দুস্থানি এজেন্ট। এগুলারেও ধরে ধরে খতম করা দরকার। মিরপুর বাঙ্গালি বস্তি থেকে কারা কারা রেসকোর্সে গেছে তার একটা গোপন তালিকা করেছে তালেবর ছাত্রসংঘ। লিস্ট কাদের মোল্লার হাতে। সকলের নামঠিকানা চেহারা ছবি সব তার নখদর্পনে। কোনটাকেই ছাড়া হবে না। দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধাতে পারলে প্রত্যেকটার ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া হবে। সবগুলাকে গুলি করে খুন করবে ; রামদা দিয়ে ঘাড়ে সিনায় কুপিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হবে। নো মার্সি। সব মুজিববাদী বাঙ্গালি ধওে ধওে লাইন করাবে। তারপর সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করবে না। ওদের  এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে আগামীতে যেন ওরা মরতেও ভয় পাবে। কাদের মোল্লাকে দেখলেই যেন ওদের আজরাইল আর মওতের কথা মনে পড়ে।

পল্লব ছোকড়াটার জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে। সে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলছে। বিহারী হোক, বাঙ্গালি হোকÑ শক্তের ভক্ত; নরমের যম। বিহারী যেই দেখেছে মুজিবের

আঙুলের ইশারায়  ওয়াতান চলছে এখন তারা খুব হুশিয়ার। পল্লবের পেছনে ছেলেপেলে কম নয়। মসজিদে বসে কাদের মোল্লা অনেক খতম প্লানিং করেছে । কিন্তু সেকাজও আর করতে পারছে না। বাঙ্গালিরা সব খোঁজখবর রাখছে। পরিস্থিতি বেশ প্রতিকূল।

ছাব্বিশ সাতাশ আটাশে মার্চ মিরপুর, শিয়ালবাড়িতে কসাই-শিবিরে খুশির মচ্ছব।  কাদের আগে থেকেই সুসংবাদ পাচ্ছিল। মুজিবকে এবার জনমের  খতম করার প্লান করা হয়েছে। অপেক্ষায় ছিল সে জন্য। যখন সে জানতে পারল মুজিবকে গুম করে দিয়েছে টিক্কাখান।   তার আনন্দ আর দখে কে! সারা মিরপুওে মুখে মুখে কসাই ছড়ালে মুজিবের ঠ্যাঙ্গে গুলি কওে কল্লাকাটার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান নেয়া হয়েছে। এখন ফাসি হবে যে কোন মুহুর্তে। ইয়াহিয়া ফাসি দিলেও প্রথম প্রথম কাউকে জানাবে না। এইটাই মিলিটারি মাস্টারপ্লান। ধরার পর অজ্ঞাত স্থানে  খতম করে দেওয়ার কথা। তারপর গুজব ছড়িয়ে আস্তে আস্তে আসল রহস্য রেডিও পাকিস্তানে সদরে মিল্লাত বয়ান করবেন।

শেখ কামালকে একটা মেশিনগানসহ আর্মি ধরেছে। সে তো শেখ মুজিব না। তাকে ধরেই বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিয়ে আধমরা করেছে। তারপর ব্রাশফায়ার করে দিয়েছে। মরার আগে কামাল পানি পানি বলে কাঁদতেছিল। ফৌজীরা তাকে লাত্থিগুতা দিয়েছে। মুত্র করে দিয়েছে কামালের গায়ে। কসাই কাদেরের দেহে এখন অসম্ভব জোশ। মনে হচ্ছে সেও পাকিস্তান আর্মির সিতারা লাগানো খাকি ব্রিগেডিয়ার। মিরপুরের সর্বত্র বিশেষ করে বিহারীদের মধ্যে সে মনের মাধুরী মিশিয়ে গুজব-গল্প ছড়াতে লাগল। কামালকে কেমন করে ছেচড়ে ছেচড়ে খুন করা হয়েছে সেটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে সবাইকে বলছে। মুজিবরের বউও রেহাই পায় নাই।

সে বেটি এমনিতেই পাকিস্তান আর্মির গোলাগুলি শুনেই আধমরা হয়ে গিয়েছিল। মুজিবের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল।  কান্নাকাটি করেছে। খুব তার শখ হয়েছিল সহমরণে যাওয়ার। মুজিবের সঙ্গেই নাকি মরতে চায়। আর্মি তাকে নেয় নাই। আওরত-জেনানা একটা ঝামেলা। তাছাড়া আর্মি জানেই মুজিবহত্যার খবর পেলে জেনানাকে আর কষ্ট করে খতম করতে হবে না। এমনিতেই অক্কা পাবে।  আর্মির মাস্টারপ্লান ফালতু হতে পারে না। মুজিবের বেগম সেইরাতেই অক্কা পায়। পালিয়ে নাকি পাশের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। পারে নি। দুইবাড়ির মাঝখানের প্যাসেজে ছোট পোলাটাকে নিয়ে  মরে পড়ে ছিল। খালি জামাল, হাসিনা, রেহানা বেঁচে রয়েছে। এদেরও হিল্লে একটা হবে।

মিরপুরে কসাইমহলে বিরাট উৎসব। এই মুজিব হত্যা কামাল হত্যা বেগম হত্যা এসব উদযাপন করা দরকার। বাঙালি এখন শেষ। এবারের সংগ্রাম;পাকিস্তানের পাছামারার  সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম হিন্দুস্থানি সংগ্রাম। কর এখন সংগ্রাম। কত সংগ্রাম করবি কর। কাদের মোল্লার প্রচন্ড ইচ্ছা মুজিব বংশের বাকি যেগুলো আছে সেগুলো সে নিজেই গিয়ে খতম করে দিয়ে আসে।  হাসিনা নাকি পোয়াতি না। তাকে ছাড়ান দেয়া যাবে না। মুজিবের রক্ত। সব বিনাশ খতম করতে হবে। কিন্তু এখনই সম্ভব না। মিরপুরের বাইরে যাওয়াই মুশকিল। শহরে আর্মির কারফিউ। ইয়াহিয়া-আইয়ুবের আর্মি। ফিল্ডমার্শাল আর্মি। কারফিউর মধ্যে চড়াই পাখিও ফুরুত করলে ফায়ার করে দেয়। নিশানা এক চুলও ভুল হয় না। 

কারফিউ যখন উঠে গেল আবাঙ্গালি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কাদের মোল্লা খতম জানাজায় নামলো। এখানে সেখানে গুলি করে। বাঙ্গালির ঠ্যাঙ্গে গুলি করা তার প্রিয় শখ। দুই ঠ্যাঙ্গে চারটা গুলি। রক্ত ঝরতে থাকুক।মিরপুরে কোথাও কেউ মেডিসিন দেবে না। চিকিৎসা বন্ধ। কোন শালার পুত ডাক্তার কাজটা করলে তাকে কাদেরের আদালতে ফাঁসি। গুলির পর চিকিৎসা দিতে দিব না। হারামজাদা  রক্তক্ষরণে মর। গ্যাংগ্রিন হয়ে মর।

গোলাম পাকিস্তানির পরিস্কার ফতোয়া ভয় আর আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করো। যেটাকে ধরবে সেটাকে এমনভাবে মারবে যেন আর দশটা তা দেখে ভয়েই মরে যায়। বাকি হাজারটা  সারাজীবন দু:স্বপ্ন দেখবে। জয়বাংলাখোরদের একটা একটা করে খতম করতে হবে এখনই। মুর্দা মুজিব জান্নাতে জাহান পাকিস্তানকে মুর্দা বানিয়ে ফেলেছিল। পাকিস্তান ফের জিন্দা হো গিয়া। মুজিব মুর্দা বন গিয়া। এখনই সময়। জয়বাংলার নেশা খোর। সব হারাম-পয়দাকো খতম কর দেগা। মিরপুর পাকিস্তান কে লিয়ে কেয়ামত তক আজাদ রহেগা। ইয়ে কাদের মোল্লাকা ওসিয়ত।

কিন্তু এখন আজাদ পাকিস্তানের জন্য জশন দরকার। জসনে জুলুস দরকার। পাকিস্তানকে ফের জিন্দা করতে খুনকি জসনে জুলুস দরকার। খতমে মুজিবর; খতমে জয়বাংলার জশন করা চাই। কাদের মোল্লার বাহিনী আইয়ামে জাহিলিয়ত থেকে ঢোলশহরত কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে শ’য়ে শ’য়ে বেরিয়ে এল। বিশাল বিশাল সাইজের ঢোল। বিহারী বাজানদার একটা বাড়ি দেয় তো মিরপুর জুড়ে খুনের কম্পন। আতশবাজিতে সয়লাব। ঠা ঠা করে আতশের আওয়াজ। আকাশের বিজলীর মত চেতনা-বিনাশী ঝঞ্জা। কখনও বজ্রপাত; কখনও লাগাতার ঠাঠার তীব্রতা।

কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার যোগাড়। আখতার গুন্ডা, বেবী গুন্ডা, শাহরুম-শায়েসকান্দার, আজরাইল গুন্ডা সকলে সদলবলে বেরুলো। কারও  মাথায় লাল পট্টি। কারও মাথায় পাকিস্তানি নিশান। হাতে রামদা, শান দেয়া বিজলী-তলোয়ার;বন্দুক। গুলি ফুটাচ্ছে আকাশে। সবার সামনে সামনে কাদের মোল্লা।  ডালকুত্তার মত লাফাচ্ছে। চোখে কালো চশমা। এই সানগ্লাসটি তাকে নাকি স্বয়ং টিক্কা খান পেয়ার-মহব্বত  করে প্রাইজিং  করেছে। সে টিক্কা খানের নিশান বরদার। বিহারীরা তার পাক্কা সাবুদ পেয়ে খুশদিল। সানগ্লাস পরে কাদের ডানে তাকায় বাঁয়ে তাকায়। তার চোখ কান নাক খোলা। 

টিক্কা খানের খাস আদমী। তার চোখ জয় বাংলা খুঁজছে। তার কান জয়বাংলার খতমী আহাজারি শোনার জন্য ভীষণ উদগ্রিব। তার নাকও কাজে লিপ্ত। সে শুঁকছে কোথায় জয়বাংলার সাপোর্টার। সব অঙ্গই তৎপর । পান থেকে আর চুন খসতেও সে দেবে না।

ওই বেটির বেটি খানকি-কবিনীকে  খতম করা দরকার। বেটি থাকবি ঘরে। তুই একটা মাগী-মাতারী। কবিতা লেখন মারাস। কাদের মোল্লা অসম্ভব ক্ষিপ্ত মেহেরুননিসার  ওপর। এই আওরত পাকিস্তানের আস্তা শত্রু। বেটির নাম লিস্টে আছে। সাতই মার্চ রেসকোর্সে সে গিয়েছিল। বেটি-মাতারী মানুষ। ঘরের মধ্যে থাকবি। বোরকার মধ্যে থাকবি। বাচ্চা পয়দা করবি। কোন জেনানার স্বামীর নজরদারি ছাড়া ঘরের চৌকাঠ মারানোও হারাম। এই বেটি সেই ফতোয়া মানে না। সে  তো মুশরিক। বেদ্বীন বেনামাজী সে তো আস্ত একটা নাস্তিক।  আরে তোর ঘরের বাইরে যাওনের কি দরকার।

ঘরের বাইরে গিয়া পরপুরুষের সঙ্গে খালি ঢলাঢলি। গেছে তো গেছে সেই দূরের রেসকোর্স পর্যন্ত গেছে। হাজার হাজার পুরুষ-হারামজাদার সঙ্গে ঢলাঢলি করে আসছে। তাদের সঙ্গে মিছিল করছে। শ্লোগান দিয়েছে। হারামজাদী একখান। জেনানার গলার আওয়াজ মর্দরা শুনলে চেহারা সুরত দেখলে ; তার সঙ্গে ঢলাঢলি করলে  সে তো আম-আওরত হয়ে যায়। কোন পুরুষের জন্য আর খাস-আওরত থাকে না।  হাজার হাজার হারামী মর্দ এই বেটির বদন-সুরত দেখছে। তাদের নিশ্চয়ই তখন কাম-লালসা হয়েছে। এই বেটি এখন হারাম-আওরত। সে জেনা কওে ফেলছে। হাজার হাজার মর্দেও সঙ্গে চক্ষুমিলন-ঢলাঢলির জেনা করছে। সে একটা জেনাকর জেনানা।

জান্নাতে পাকিস্তানের মিরপুরশরীফে কোন জেনাকারী থাকতে দেয়া হবে না। এটাকে খতম করতে হবে। নো মার্সি। একটা মেহেরুননেসা খতম সেটা হবে মডেল পানিশমেন্ট। লাখো জেনানা এটা থেকে শিক্ষা নেবে। বাড়িতে বাড়িতে ছড়িয়ে যাবে এই ভয়ংকর শাস্তির খবর। বাকি জেনানারা আপনা আপনি সিধা হয়ে যাবে।

ওই বেটির কসুরের সীমা নেই। কেবল যে রেসকোর্সে গেছে তাই নয় জয় বাংলার গান গেয়েছে সকলের সঙ্গে। একাই যায় নাই। সঙ্গে ছোট ভাইদেরও নিয়ে গিয়েছিল। এই আওরতের কাছে মর্দপোলাপানও নিরাপদ নয়। ভাইবেরাদও তার কাছে রাখা ঠিক নয়। এই বদ-নষ্ট জেনানা তার নিজের ঘরের মর্দপোলাপান; তারপর পাড়া প্রতিবেশী সব পোলাপান এবং পুরুষ মানুষকে নষ্ট করছে। একটা নষ্ট মেয়েছেলে হাজারটা নষ্টামির কারন। মিরপুরশরীফ থেকে তাকে চিরতওে খতম দরকার।

তার পাপের বোঝা কে-টু পর্বতের চেয়ে কম নয়। হাশরের দিন কারাকোরাম টু পর্বত কাঁধে নিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। সে তো সেদিন পর্বতচাপা পড়েই মরবে।
হাশরের বিচার হাশরে। দুনিয়াজাহানের বিচার দুনিয়ায়। কাদেও মোল্লার ছাত্রসংঘবাহিনী   আগে থেকেই বেটিকে অনুসরণ করেছে। তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হেদায়েত করেছে।
 কবিতা লেখে! পদ্যচর্চ্চা করে! আদমী জীবজন্তুও ছবি আঁকে। বেটির কত শখ। কত বড় বেদ্বীন নাস্তিক। কবিতা লেখা তো হারাম কাজ।ছবি আঁকা হারামের উপর চার ডবল  হারাম। হারামে খাস। কাদের মোল্লার হুশিয়ারি শোনে নাই। তাকে উড়ো চিঠি দিয়ে ছাত্রসঙ্ঘ হুশিয়ার করেছে। মাইয়া মানুষ ঘরের থাক। বাইরে যাইস না। বাইরে যাওয়া জ্বেনা।  মিরপুরে থাকতে হলে জ্বেনা করিস না।

উড়োচিঠি আমলে নেয় নাই।  রেসকোর্স থেকে ফিরে এসে অসম্ভব বেড়েছিল।জয় বাংলা নামে একটা কবিতা লিখেছে। জয় বাংলা , বাংলার জয়/এই বাঙালি বড় নির্ভয়/ আমাদের বিজয় সুনিশ্চয়/ প্রয়োজনে করবো মরনেরে জয়/ এই প্রতিজ্ঞা অমর অক্ষয়।
কবিতার একটা হাতে লেখা কপি ছাত্রসঙ্ঘের ক্যাডাররা কাদের মোল্লাকে দিয়ে গেছে। কত বড় আস্পর্ধা। শুধু কবিতা লেখেই নাই। সেটি গান-সুর করে গেয়েও শোনাচ্ছে নওল ছেলেপেলেদের।

কোথায় সেই হারামজাদী । ওর জয় বাংলা ছুটিয়ে দেয়া হবে। যে হাতে এই কবিতা লিখেছে- সে হাত কব্জিসহ কাটা হবে । নো মার্সি। কয়েক  মাস ধরে অনেক সহ্য করা হয়েছে।  অনেক মুজিবর , মুজিবর করেছিস। এবার তোকে কে বাঁচাবে। কোন ব্যাঙ্গাবন্ধু তোকে বাঁচাবে। কাদের মোল্লার সঙ্গে গুন্ডাবিহারী সাঙ্গপাঙ্গ সব সময় মওজুদ। তারা কেবল হুকুমের অপেক্ষায়। টিক্কা খানের দেয়া মিলিটারী-মিল্লাতি সানগ্লাস কাদেরের চোখে। লিডার কি হুকুম কায়েম করনে কি লিয়ে জান কুরবান কর দেগা।

কাদের মোল্লা আর দেরী কেন করবে! মার্চ। মার্চ। ডাবলমার্চ। মেরে ওয়াতেনো ভাইয়ো,ডাবলমার্চ মারো। এই খানকি বেটি জ্বেনাওয়ালী। জ্বেনাওয়ালী জেনানার কোন মার্সি নাই। মাফ নাই। তাকে মাফ করলে তুমাদের জন্য জান্নাতের দরজা বন্ধ। আর যদি জ্বেনাওয়ালির শাস্তি কায়েম করতে পারো ডাইরেক্ট জান্নাতের দরোজা পাবা। সোজা গিয়া ঢুকবা। বাহাত্তরটা হুরপরী আইসা তোমার শরীর মালিশ করবে। গেলমান চাইলেও তারাও আছে।

অমন নধরকান্তি শরীফ গেলমান হয় না। অওরতি সুরত। তোমাদের কবরের কোন আজাব- হিসাব হবে না। আজরাইল আলাইহিসসালাম জান কবজ করলেই ঢুকুস মার্কা নিঁন্দ। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর টেরও পাবে না। মুন্দাঁ চোউখ খুললেই জান্নাতের শাহী দরোজায়। তোমারে গুঁলিস্তার গুল ছিটাইয়া জন্নাতে বরন করে নিবে বাহাত্তর হুরী। তাগো সুরত দুনিয়ার এই বদখত আওরতের মত নয়। একহাজারটা নূরজাহানের সুরত-সুন্দর্য এক করলেও তার একটার মত খুবসুরত জেনানা পয়দা হবে না। জান্নাতে প্রবেশ করে খালি দমাদম মাস্তকলন্দর। মৌজমস্তি সেখানে পহেলা নম্বর। কিন্তু জান্নাতের রওজা মোবারক হাসিল করতে দুনিয়াবি ফরজগুলো পালন অত্যাবশ্যক।

জ্বেনাওয়ালী আওরতকে খতম শরীয়তের আঈনে ফরজ। এই ফরজ পালন করতে হবে। মেহেরুননিসা। মুসলমান নাম নিয়া সে নাস্তিক-বেদ্বীন। ওই বেটিরে পাথর না আমরা  কোপাইয়া টুকরা করব। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। জান্নাতে মীরপুরশরীফ, জিন্দাবাদ।

বখতিয়ারের ঘোড়ার মত ওরা মিরপুরে তান্ডব করে ছুটছে। দামামা বাজিয়ে আমামায় চানতারা পতাকা আর লালনিশান বেধে সদলবলে খুনিরা টগবগ টগবগ করে মেহেরুননিসার বাড়িতে হাজির। গনিমতের আওরত। গনিমতের মাল। গন্ডগোল চলছে পাকিস্তানে।যুদ্ধ।এই সময় যে নারী যার দখলে; তারই ভোগ্যা।তাকে বলাৎকার যাই মন চায় সেটাই হালাল গোলামের পরিষ্কার ফতোয়া। হা হা হা। মেহেরকে বেধে ফেলল ওরা । তার মাকে বেধে ফেলল। সত্তুরটি হায়েনা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাড়িটাতে। দুটা মর্দপোলা পাওয়া গেল। ধাওয়া করে তাদের ধরলো।  টুকু ও বাবলু। মেহেরুননেসার ভাই। বলা নেই কওয়া নেই। আখতার গুন্ডা আর মঙ্গল গুন্ডা দুই মর্দর গলা কাটল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো।

খন্ডিত মস্তক ছিটকে গিয়ে পড়লো কাদের মোল্লার সামনে। তার মুখে চোখে বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাস।  সে লাত্থি মেরে কল্লাটাকে ঘরের আরেক কোনে ঠেলে দিল। দশবছরের ছুটকি পালিয়ে ছিল খাটের তলায়। তার চোখ ভয়ে আতঙ্কে বেরিয়ে যাওয়ার দশা। দুই ভাইর শরীরের তাজা রক্ত ছলকে তার সামনে পড়ায় সে ডুুকরে কেঁদে উঠল। আর যায় কোথায়। তার পলাতক অবস্থান আর গোপন রইল না। মেয়েটিকে টেনে হিচড়ে বের করা হল। জুম্মন কসাই অশ্লীল ভাষায় গালি দিল। অকথ্য ভাষায় কদর্য ভঙ্গিতে উর্দুতে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায় সে মৌজ করে এই নাবালিগ আওরতকে খুন করতে চায়। কাদের সহাস্যে বললো পারবি তো। দেখি পারস কিনা।

মেহেরুননিসা আর  আম্মা আর সহ্য করতে পারলেন না। আম্মা দোয়া দরুদ পড়তে লাগলেন। জোরে জোরে পড়তে লাগলেন লা হাওলা ওয়া কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।
খানকি মাতারী দোয়া দরুদ মারাও। দে ওর জবান কোপ দিয়া নামাইয়া দে।

মঙ্গল বসিয়ে দিল তলোয়ার। আম্মার হাত পা বাঁধা। তিনি তার মুখ সামান্য নড়াতেও পারেন নি। ইয়া আল্লাহ; ইয়া মাবুদ। বলতে না বলতেই তার জিহবা-কল্লা এ ফোঁড়  ওফোঁড় হয়ে গেল। ঘিলু বেরিয়ে  মাটিতে ছিটকে পড়ল। জুম্মন সকলের সামনেই ধর্ষন করল অবোধ  শিশুটিকে। আতশবাজি;ঢোলবাজিতে পুরো বাড়ি উম্মাতাল। শিশুটি অজ্ঞান হয়ে নির্জীব পড়ে রইল।

এবার জ্বেনাওয়ালী মেহেরুননেসার পালা। কাদের জানতে চায় রেসকোর্সে তোর ব্যাঙ্গাবন্ধুর মিটিংয়ে তুই গেছিলি।
মেহের জবাব দেন গিয়েছি।
তুই জয়বাংলা নিয়ে কবিতা-গান লিখছোস!
লিখেছি।

কাদের মোল্লা বিভৎস হাসে। তাই আজকে তোরে কল্লাকাটা করে  খতম করব। এই হচ্ছে তোর জয়বাংলা করার নতিজা। কুৎসিত ভয়াবহতার মুখেও ভয় পেলেন না মেহেরুননেসা।আম্মা ও  দুই ভাইয়ের নৃশংসতম মৃত্যু হল তার চোখের সামনে। রক্তাক্ত অজ্ঞান বোনটিও মৃতপ্রায়। ইয়া আল্লাহ ইয়া মাবুদ। মেহেরুননেসার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রু সামলে  বললেন,  বাংলার বিজয় সুনিশ্চিত। আমার মতো লাখো মানুষ মেরেও তোরা রেহাই পাবি না।

তোদের নিস্তার নেই। কাদের তোরও নিস্তার নেই। তুই বাংলার ইতিহাসে কসাই কাদের মোল্লা হয়ে কেয়ামত পর্যন্ত কলঙ্কিত থাকবি। তুই বাচতে পারবি না। আজকে একশ গুন্ডা কসাই মিলে আমার পরিবারকে হত্যা করলি।আমাকেও মারবি।আম্মার দোয়াদরুদপড়া মুখে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলি।  ইয়া আল্লাহ । ইয়া মাবুদ। আল্লাহকে হাজির নাজির রেখে বলছি তোকে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাড়িয়ে খেদিয়ে থুথু দিয়ে ফাঁসিতে লটকাবে। তোর নাম অভিশপ্ত হবে এই দুনিয়ায়। জয় বাংলা।

কাদের মোল্লা হিস হিস করতে করতে এগিয়ে গেল মেহেরুননেসার খুব কাছে। মুখের ওপর বিরাশি সিক্কা থাবড়া মারল। তার ঠোঁট মুখ দুহাতে ডলে দিতে লাগল। বলল মিছিল মিটিংয়ের জ্বেনাওয়ালি বেটি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বল। বল জিও পাকিস্তান। নইলে তোর কল্লা এক কোপে নামিয়ে দিব। এক কোপে কল্লাচ্ছেদ। ভয় পেল না মেহেরুননিসা ।আবার বলল জয় বাংলা। থু থু তোর জিন্দাবাদ। থু থু তোর জিও পাকিস্তান।
জয় বাংলা।

(চলবে…)

অলংকরণ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন