বার্ডের বৈঠকে, দাউদকান্দির মিটিং-সিটিং-এ চাষীর যুক্তি ও পরিকল্পনা মুগ্ধ করেছে খোন্দকারকে। মনে মনে ভেবেছে, এই না হলে পাকিস্তানি সিএসপি। ট্রেইন্ড ইন ওয়েস্ট পাকিস্তান। চাষী বলছিল, মুজিব হলো মহাভয়ঙ্কর। পুরাকালে জন্ম নিলে সে অবতার-পয়গম্বর হয়ে জন্মাত।
চাষীর এই কথা পছন্দ হয়নি রশীদের। সে শ্লেষের সঙ্গে বলে, পয়গম্বর না দিগম্বর। এই হিন্দুস্থানি দালালকে পয়গম্বর বলেন কোন সাহসে।
চাষী হাসে। বেশি মাতিয়েন না মেজর। আগে কী কই পুরাটা শুনেন। মুজিবকে ওয়েস্টার্ন-আমেরিকানরা কেন গোনে জানেন, কিসিঞ্জার কেন গোনে জানেন, সেই খবর তো রাখেন না। তারাও ভয় পায় মুজিবকে।
তাদের আশঙ্কা – মুজিব যদি বাকশাল সিস্টেম সাকসেস করে ফেলে। তাহলে থার্ড ওয়ার্ল্ডে তাদের কন্ট্রোল লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। সবাই বাকশাল টাইপ ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট কায়েম করে ইকনমিকাল সাকসেস অর্জন করতে চাইবে।
রশীদ রীতিমত ক্ষেপে যায়। থু থু। আপনার বালছালের বাকশালের গায়ে আমি বিষ্ঠা ত্যাগ করি। আমি তো বঙ্গভবনে সব কয়টা টয়লেটে লিখা রাখব বাকশাল-ওয়ে। আমরা বিষ্ঠা-মলমুত্র ত্যাগ করব সেখানে।
খোন্দকার চুপচাপ। ঠাকুরও চুপচাপ। বিব্রত হয় না চাষী। বলে, মেজর সাব, অতি উত্তেজনা ভালো না। অনেক সময় সেটা অকল্যাণও ডেকে আনে ব্রাদার। দুনিয়ার অনেক নিশ্ছিদ্র প্লান প্রোগ্রাম শেষ পর্যন্ত না-কাম হইছে অতি উত্তেজনার কবলে। ওহুদের যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ কী। লুটপাট হুড়াহুড়ি আর অতি উত্তেজনা। ইসলামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন। গনিমতের মাল বেশি খাইতে চাইবেন, দাসীবান্দিও ভাগে পাবেন না। অরিকে দমন করেন। আপনাকে অরিন্দম হতে হলে খালি বন্দুকবাজি গুলিবাজি খুনখারাপি করলেই চলবে না। ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সের গতিপ্রকৃতি-হালচাল-ডাইমেশন; সোজা কথায় যাকে বলে ভাও – সেটা বোঝার জন্য আমাদেরকে লাগবে। বাকশাল সিস্টেম তো খারাপ না। এইটা তো ইসলামের আবু জর গিফারীর থিওরি। বাকশালের মেনিফেস্টো পড়ছেন! পড়েন নাই। বন্ধ রুমের মধ্যে গিয়ে বাকশাল আর শেখ মুজিবের নাম নিয়া দশটা ফায়ার করে আসেন – মাথা ঠাণ্ডা করেন, তারপর আমি বলি।
ফারুক গভীর মনোযোগে শুনছিল। মহাবিরক্ত রশীদের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ডিয়ার মেজর, লেট দ্য সিএসপি স্পিকিং।
রশীদ এবার চুপ। চোখমুখ শুকনো করে বসে থাকে। চাষী তার পকেট থেকে ছোট একটা শিশি বের করে। একটা ছোট কাচের গ্লাসে ঢালে। পানি মেশায়। বলে, ব্রাদার, এটা হল দ্রাক্ষারিস্ট। এটা না হলে আমার চলে না। ঢক ঢক করে পুরোটা পানি গিলে ফেলে। আরে ভাই, আপনারা বুঝেন না কেন – মুজিবকে গুলি করলেই খালি মুজিব মরবে না। আসল মুজিবকে মারতে হলে খতম করতে হবে মুজিবের ফিলসফি। ওই জিনিস তো গুলি করে ট্যাঙ্কের চাকায় চাপা দিয়ে খতম করা যায় না। ধর্মগ্রন্থও মানুষ পোড়ায়। কই তাতে ধর্মের কি বিনাশ হয়। হয় না।
তবে আশার কথা হলো, এই মুহূর্তে ইন্টারন্যাশনাল লবির মধ্যে কেবল রুশিয়া বাদে কেউ মুজিবের বাকশাল ফিলসফির পক্ষে না। এমন কি দিল্লির সাউথ ব্লকে যারা হিন্দুস্থানের ক্যাপিটালাইজেশনের জন্য অতি সঙ্গোপণে লবিং করতেছে তারাও বাকশালের স্ট্রং এগেইনস্ট। ইন্ডিয়ার পেটের মধ্যে বাংলাদেশে যদি বাকশাল কায়েম হয়, সাকসেস পায় – তবে সেটা তাদের পুঁজিবাদ বিকাশের পথে হবে মহা অন্তরায়। বাকশাল সফল হলে থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোও সেটা অনুসরণ করতে চাইবে।
রশীদ ঘরের মধ্যেই বড় একদলা থু থু ফেলে।
– বালছালের সাকসেস পাবে বাকশাল। সব কোর্ট মার্শাল দিয়া উড়াইয়া দিব।
চাষী মৃদু হাসে। আপনি যেভাবে জিনিসটা সহজ দেখতেছেন, ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড সেভাবে দেখছে না। তারা ভয় পাচ্ছে। আর সেইটাই হচ্ছে আমাদের পলিসিগত প্লাসপয়েন্ট।
– বাকশালরে আবার কিসের বালছালের ভয়! কী বালছালের ইনটেলেকচুয়ালি ফুটাইতেছেন আপনি!
– ওয়ার্ড প্লিজ। আমি দ্রাক্ষারিস্ট পান করি সত্য। কিন্তু এই ধরনের বাতচিতে হ্যাবিচুয়েটেট নই। শোনেন মিয়া, কিসিঞ্জাররা মুজিবকে দেখে অন্যদৃষ্টিতে। তারা বলদ না। তাদের বুদ্ধি ইয়াহিয়ার মত হাঁটুতে না। তাদের ভয় মুজিবের অন্তর্গত ক্ষমতায়। মুজিবের ইন্টার্নাল স্পিরিটে। মুজিব যখন ছয় দফা দিল, কেউ ভাবে নাই এই জিনিস পপুলার হবে। কেউ তখন ভাবে নাই এই জিনিসকে মুজিবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাবে। মহাশকুনি খোদ ইহুদি কিসিঞ্জারও ভাবে নাই। সবাই ভাবছে শেরে বাংলা পারে নাই। নাজিমুদ্দিন পারে নাই। হিন্দুস্থানি রিফুজি সরোয়ার্দি-ভাসানী পর্যন্ত যা পারে নাই। তখন আপনার ভাষামতো মুজিব আর কোন ড্যাশ ড্যাশ পারবে? সে পারবে খালি ফাল দিতে। আর উঁচা গলায় চোঙ্গা ফুকাইতে।
কিন্তু মুজিবর ঠিকই ছয় দফা পাবলিকেরে খাওয়াইল। বাঙ্গালিরে পাগলা নাচন নাচাইল। চুঙ্গা ফুকাইতে ফুকাইতে বাংলাদেশরে স্বাধীন পর্যন্ত কইরা ফেলল। মাত্র একপঞ্চাশ বছর বয়েসের মধ্যেই তার কেরামতি দেখাইল। বিষয়টা কী বুঝতেছেন মিয়ারা। মুজিবে ঠিকই অক্ষরে অক্ষরে ছয় দফা বাস্তবায়ন করে দেখাল। পশ্চিমারা যেটা কল্পনাও করে নাই – মুজিব সবাইরে নাকানি চুবানি খাইয়ে সেটা সাকসেস করে ফেলল। এইজন্য বেঙ্গাবন্ধুকে নিয়ে তাদের মহাটেনশন। এই লোকটা মহাযাদুকর। এই লোকটা বাঁচলেই সর্বনাশ। এই লোক জিন্দা থাকলে ঠিকই বাকশালকেও ছয় দফার মতো সফল করে দেখাবে। সত্তুর-পঁচাত্তর বছর আয়ু পাইলে বাংলাদেশরে আর কন্ট্রোলে রাখা যাবে না। ব্রাজিলের প্লেয়ার পেলের ফুটবল খেলার মতো কারিকুরি জারিজুরি দেখিয়ে বাকশালের বল গোলের মধ্যে ঢোকাবেই।
চাষী এবার হাসে। তার কথায় ওস্তাদজী খোন্দকার বেশ মুগ্ধ। বেচারার মুখের শীতল হাসি দেখেই বেশ বুঝতে পারছে সে। রশীদেরও মুখ চুন। বাঞ্চোত, গাইগরুর ওলানখোর – ঘিলুমগজ তো সব হাঁটুতে। বুঝলেন কায়েদ সাব, এই হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। সরি, মেজরের সম্বোধন আমিও করলাম। ওয়েস্টার্ন ক্যাপিটালিস্ট ওয়ার্ল্ড, মুসলিম ওয়ার্ল্ড সবাই এই কারণে মুজিবের খতম চায়। এই প্লাস পয়েন্টের মওকা আমাদের ষোলআনা উসুল করতে হবে। মুজিব সবংশে খতম হলেও এই কারণে কেউ কুম্ভিরাশ্রুও বর্ষণ করবে না। তারা ছয় দফায় ধরা খেয়েছে। একাত্তরে ধরা খেয়েছে। আর ধরা খেতে চায় না। আমেরিকা আর সাউথ এশিয়ায় পরাজিত হতে চায় না।
তা ধিনা ধিনধিন। খোন্দকারের আনন্দ আর ধরে না। সব তথ্য-তত্ত্ব, বিচার বিশ্লেষণ-ডান-বাম সব দিক সে ঠাণ্ডা মাথায় জাবর কেটে দেখছে। খুব একটা সমস্যা খুঁজে পাচ্ছে না। বেশ নিখুঁতই মনে হচ্ছে প্লান-প্রোগ্রাম। চাষী ইন্টারন্যাশনাল স্কলার। তার টীকাটিপ্পনি তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রশীদ ফারুক তো বন্দুকবাজি করেই খালাস। বরকন্দাজ কবরে গেলেও বরকন্দাজ। স্বর্গে গেলেও খোন্দকারের পাশে পাশে বরকন্দাজি করবে। বন্দুকের নল আলটিমেটলি ক্ষমতার উৎস নয়। বন্দুকের নল তার চেয়ে বড় বন্দুক-কামান-ট্যাঙ্কের সামনে অচল। ক্যাপিটালিস্ট ওয়ার্ল্ড আর রুশিয়ার দ্বন্দ্ব-সংঘাত হচ্ছে আসল ব্যাপার। ওই জিনিসের ফাঁকতাল দিয়ে যেমন মুজিবর স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। এবার সেই ফাঁকতালের মাধ্যমেই মুজিবকে এবং তার ফিলসফিকে চির কবর দিতে হবে।
খোন্দকার খুশিতে বাগ বাগ। তার খায়েশ হচ্ছে এক্ষুনি ডিক্লারেশনটা লিখে ফেলে। কী লেখা যায় – আই, খন্দকার কায়েদ সাব ডিক্লেয়ার দ্য ইনডিপেডেন্স অব ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ অন বিহাফ অব বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান.. .. ..।
ধুত্তারি! এর মধ্যে শেখ মুজিব আবার ইন করল কেমনে। সে তো একটা সাসপেন্ডেড ডেড কেস। আবার সে ড্রাফট মনে মনে আউড়ায়। আই, প্রেসিডেন্ট খন্দকার ডিক্লেয়ার দ্য ইনডিপেডেন্স অব ইসলামি জমহুরিয়া ইস্ট পাকিস্তান.. .. ..। আচ্ছা এই ডিক্লারেশনের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের ঘোষনাও দিয়ে ফেললে কেমন হয়।
খোন্দকার আর ভাবতেই পারে না আনন্দে। শেখ মুজিব তো মরতেছে, এই কনফেডারেশন না করার অভিশাপে। ইন্ডিয়ায় এক্সাইল গভর্নমেন্টের টাইমে সে শেষ পর্যন্ত প্রাণপণ কোশেশ করেছিল। পারে নাই ওই হারামজাদা তাজুদ্দিনের জন্য। আরে হারামখোর, পাকিস্তানের সঙ্গে যদি কনফেডারেশন না রাখো, মুসলিম ওয়ার্ল্ডের খয়রাতি সাহায্য পাবি কেমনে। খালি ইন্ডিয়া আর রুশিয়া গম খাইয়ে বাঁচাইতে পারবে।
ভুট্টাসাব শেখ মুজিবকে লাহোরে লাস্ট কলটাও দিয়েছিল। ইস্ট পাকিস্তান ছুইটা গেছে ঠিক আছে – একটা মিউচ্যুয়াল কনফেডারেশন রাখলে খারাপ কী! মুজিব সেদিন তাতে সায় দেই নাই। খুব বাবাগিরি দেখাইতে গেছে। আসলে তো সেদিনই সে নিজের সুইসাইডাল নোটে স্বাক্ষর করে দিয়ে আসছে। ভুট্টাসাব তখন কত কষ্টে পাবলিক মিটিং-এ চিৎকার করে বলেছে, হারামজাদা বাঙ্গাল জাহান্নুম মে জায়েগা।
আচ্ছা ডিক্লারেশনটা কেমন করে সে বলবে! দু’চারবার প্রাকটিস করেও দেখা দরকার। দরজার মুখে একটা ড্রাম রেখে গেছে তার ভাতিজা। খন্দকার সেটার ওপর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। তারপর নানা ফর্মে একটার পর একটা ডিক্লারেশন দিতে থাকে।
ঐতিহাসিক ঘটনা। ইতিহাসে নিশ্চয়ই এটা ডিক্লারেশন অব কনফেডারেশন হিসেবে অমর হয়ে থাকবে।
আরেকটা সমস্যা অবশ্য খোন্দকারকে লালবাতি দেখাচ্ছে। রেড সিগনাল। ফারুক-রশীদ-ডালিম গ্যাং-এর কনসপ্রিসিতে আর্মির অবস্থান কী! তারা মুজিবের পাশে দাঁড়ালে রশীদের ফালাফালিতে কোনো ঘোড়ার ডিমও পয়দা হবে না। মাঝখান থেকে খোন্দকারও ঘ্যাচাং। এই উর্দিঅলারাই তাকে তখন ব্রাশফায়ার করে খতম করবে। মুজিব তাকে অনেক রক্ষা করেছে। এবার নিশ্চয়ই করবে না। বলবে, সবার কাছে আমি গলা লম্বা করে বলে বেড়াই – খোন্দকারকে আমি বঙ্গভবনের ঘাসকাটার আর্দালিও যদি বানাই সে আমার হুকুম অক্ষরে অক্ষরে তামিল করবে। আর সেই তুমি কিনা আমারে খতমের কনসপ্রিসি করছ। তুমি তো সিরাজ সিকদারের চাইতেও খারাপ।
বরফ-শীতল একটা আতঙ্ক-প্রবাহ খোন্দকারের শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে যায়। মুজিব যেন তার সামনেই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। মুজিবরের এমন ঠাণ্ডা চেহারা আগে কখনওই সে দেখে নাই।
আচ্ছা! একটা কাজ করলে কেমন হয়। দৌঁড়ে গিয়ে মুজিবরের পা ধরে পড়লে কি খুব মন্দ হবে? সব খুলে বলবে মুজিবকে। মুজিব যতই পা টানাটানি করুক; সে ছাড়বেই না। বলবে, আগে মাফির ডিক্লেয়ার করো, তারপর পদযুগল ছাড়ব। সে চাইলে অবশ্য তাজুদ্দিনকে এই ফাঁকতালে ফাঁসাতে পারে। মুজিবকে বলবে, বুঝলেন গোপন সূত্রের খবর। তোমার অতি পেয়ারের তাজুদ্দিন; একদল বিপথগামী আর্মির সঙ্গে মিলে মিশে তোমারে খতম করতে আসতেছে। তোমারে জানে মাইরা ফেলবে।
খোন্দকারের উপর মুজিবের অগাধ আস্থা। তাকে সে বিশ্বাস করলেও করতে পারে। এই ফুরসতে সে মুজিবের আরও আস্থাভাজন হবে। তাজুদ্দিন হবে বিরাগভাজন। মুজিব খুশি হয়ে তাকে প্রাইম মিনিস্টারও বানিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু রশীদ খোনকার তার সামনে আরও বড় মুলা ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। একেবারে সদরে বাংলাদেশ। পুরান ঢাকার গলি ঘুপচি দিয়ে সরাসরি প্রেসিডেন্ট হাউজ। বঙ্গভবন। বাঙ্গালার বড়লাট হবে সে। চাট্টিখানি কথা নয়। মুজিবের বুড়ো আঙ্গুলের নীচে উজিরে আজমের ওজারতির দুই পয়সারও ভ্যালু নাই। খালি জ্বী হুজুর গোলাম হোসেন। উল্টা দিকে রশীদের ফরমুলায় একলাফে রাষ্ট্রের মাথায়। চীফ পারসন অব দ্য কান্ট্রি – কোনটা বেশি লোভনীয়? কোনটার মধ্যে রিস্ক কম?
অবশ্য এখন আর কম রিস্ক-বেশি রিস্ক ভেবে বিশেষ লাভ নাই। রশীদ আঠার মত লেগেছে। সর্বক্ষণ তার গতিবিধি ফলো করে চলেছে। তার বাসার সামনে কদম্বগাছের নিচে একটা অচেনা গোঁফঅলা লোক চব্বিশঘণ্টা থাকে দাঁড়িয়ে। দেখতে পাঞ্জাবি-পাকিস্তানি টাইপ। এটা নির্ঘাৎ রশীদের গুপ্তচর। নিশ্চয়ই এইটাকে আইএসআই থেকে উপঢৌকন হিসেবে পাইছে।
লাস্ট সিগনাল দিতে রশীদ যখন এসেছিল, শাসিয়েও গেছে খোন্দকারকে। তার প্রচণ্ড কৌতুহল ছিল আর্মি কানেকশন নিয়ে। ফারুক হচ্ছে মোমেনশাহীর ঘাড় তেড়া। সব সময় রগ ফুলিয়ে চলে। সে আর্মিকে ম্যানেজ করতে গিয়ে ক্ষেপিয়ে দেয় কিনা কে জানে।
জিয়াউর রহমানকে নিয়ে খোন্দকারের আগ্রহের শেষ নেই। জিয়ার সঙ্গে রশীদ-ফারুকের চারপাঁচ ঘণ্টা লম্বা সিটিং হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। সে ক্যু-গ্যাং-এর সঙ্গে আছে – অবশ্যই এটা খোশ খবর। সে পোস্ট-কিলিং পরিস্থিতিতে আর্মিকে ট্যাকল দেবে, কম্যান্ড সামলাবে, সেও বুঝলাম। আর্মি কম্যান্ড তারই কব্জায়, তাও সত্য। কিন্তু জিয়াউরের আসল রি-অ্যাকশন কী। তার পোস্ট একশন কী হবে। তার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ কী!
রশীদ এসব আগরম বাগরম প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়েছে খুব।
– বডি ল্যাঙ্গোয়েজ আবার কী জিনিস। হি ইজ ইন ফেন্সি ড্রেস। হি ড্রেসড পাজামা কুর্তা।
খন্দকার বুরবাকের কথা শুনে মনে মনে হাসে। বডি ল্যাঙ্গোয়েজ নাকি ফেন্সি ড্রেস। কোন স্কুলে যে এরা ইংরেজি শিখছে। রশীদ আর একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানাল। জিয়া শুনেছে বেশি। বলেছে কম।
– চোখ খুলে শুনছে। নাকি চোখ বন্ধ করে।
– কায়েদ সাব, রাখেন আপনার ছাগলা প্রশ্ন। আপনি তার চেয়ে একটা ডিক্লারেশন অব ইনডিপেডেন্স অব ইসলামিক রিপাবলিকের ডকু ফাইনাল করে ফেলেন। আর্মির ব্যাপার আপনাকে না ভাবলেও চলবে। আর্মির স্টাইল, আদবকেতা আপনি জানেনও না। বোঝেনও না। কোনো প্রফেশনাল আর্মি অফিসার কখনওই চোখ বন্ধ করে না। কেবল কবরস্থান আর নিদ্রার বিছানাস্থান বাদে। সে সব সময় চোখ কান আর নাক রাখে খোলা।
– নাক! নাকও খোলা রাখে কেন!
– আশ্চর্য। নাক খোলা না রাখলে নিঃশ্বাস নেবে কেমন করে। হা হা।
রশীদ রসিকতা করতে পেরে আপন তৃপ্তিতে হাসে।
মনে মনে হাসে খোন্দকারও। আরে গর্দভ! আরে কবর খোঁড়া খোনকার। জিয়াউর রহমানকে তুই কদ্দুর চিনিস। সে চোখ বুজে তোদের প্ল্যানের ভূত ভবিষ্যত ভেবে দেখেছে কি না; কেমন করে বুঝলি। সারাক্ষণ থাকে সে সানগ্লাস পরে। তার স্টাইলের তুই কী জানিস। সানগ্লাসের মধ্যে চক্ষু খোলা না বন্ধ – বুঝলি কেমন করে। খোন্দকারের যত চিন্তা এই জেনারেলকে নিয়ে। একটা প্রফেশনাল আর্মি সিনিয়র অফিসার যখন এই ধরণের ক্যুদেতার প্লানের কথা নিজ কানে শুনবে – তার সর্বপ্রথম প্রফেশনাল বাধ্যবাধকতা হচ্ছে, অধস্তন কমান্ডের কন্ট্রোল ফিরিয়ে আনতে কনপ্রিসারদের ফায়ারিং স্কোয়াডে দেয়া। অন্যথায় একটু উনিশ বিশ হলে সে ফেঁসে যাবে। জুনিয়ররা বিপদে পড়লে তাকে ফাঁসাবেই। সেক্ষেত্রে সেও ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবে। একটা সিনিয়র জেনারেলের ফায়ারিং স্কোয়াড হওয়া যে কোনো দেশের প্রফেশনাল আর্মির জন্য মস্ত বড় অপমানের। ভীষণ শরমের। জিয়া ট্রেইন্ড আর্মি অফিসার। আর্মির ইনটেগ্রিটি তার জানার কথা। তার ফরজে আইন হলো, মরবে; তবুও আর্মির মর্যাদাহানি হতে দেবে না।
জেনারেল জিয়া সেটা করল না। সে ঝুঁকি নিল। মস্ত ঝুঁকি নিল। ফায়ারিং স্কোয়াডে অপমানকর লাঞ্ছনাকর শরমভরা মৃত্যুর আশঙ্কার ঝুঁকি নিল। এর রহস্য কী! সে তো বালবাচ্চাটাইপ আর্মি নয়। সে তো অগ্র পশ্চাদ ভূত-ভবিষ্যত না ভেবে রশীদ-ফারুকের কথায় ফাল দেবে না।
খোন্দকার নিজেই এখন চক্ষু মুদে চিন্তা না করে পারছে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, জিয়ারও হিসাব কিতাব ফাইনাল। সে বুঝে শুনেই রিস্ক নিচ্ছে। জিয়া তো দেখা যাচ্ছে তার সানগ্লাসের আড়াল থেকে অনেক দূর দর্শন করে ফেলেছে। সেই তবে হতে চলেছে এই ঘটনার আসল বেনেফিশিয়ারি। আর খোন্দকার এন্ড ফারুক রশীদ কোম্পানি হতে যাচ্ছে স্কেপ গোট। বলির পাঁঠা।
খোন্দকারের অন্তারাত্মা অজানা আতঙ্কে হাহাকার করে উঠল।
খোন্দকারের এখন তাহলে করণীয় কী! সে কি শেখ মুজিবের পা ধরতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ছুটবে। মুজিব মহাপুরুষের মত ক্ষমাশীল। সে তাকে ক্ষমা করে দেবে নিশ্চয়ই। বলবে, যাও। আরও একবার তোমাকে মাফ করলাম।
কিন্তু ফারুক-রশীদ গ্যাং যদি তাকে আর্মি কোর্ট মার্শালে ফাঁসিয়ে দেয়। যদি বলে দেয়, তাদের সঙ্গে সিভিলিয়ান পলিটিশিয়ানস এবং সিভিল সারভেন্টও ছিল। তখন মুজিব কি কোর্ট মার্শাল থেকে তাকে বাঁচাবে। মুজিব কি বলবে, সিভিলিয়ানের কোর্ট মার্শাল হয় না। সে কি বলবে, সিভিলিয়ান শ্যুড বি ট্রয়ালড ইন সিভিল কোর্ট। নাকি মুজিব নীরব হয়ে থাকবে। ভাববে, অনেক হয়েছে ক্ষমাক্ষমি – আর না।
কী করা উচিত তবে খোন্দকারের! সে কি জিয়ার সঙ্গে তাল মেলাবে। জ্বী হুজুরি তো তার বশংবদ বংশীয় অভ্যাস। জিয়ার সঙ্গে সেটা অব্যাহত রাখলে সমস্যা কী! জেনারেল জিয়া অলরেডি রিস্ক নিয়ে ফেলেছে। তারও তো নেয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছে না। শেখ মুজিবের পায়ের তলে পিষে মরার চেয়ে যদি বঙ্গভবনে জাঁকিয়ে বসা যায় – সে মন্দ কী!
খোন্দকারের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে টিপ্পনি কাটে রশীদ। বলে, জিয়া বেশি কথা বলে না। কিন্তু দরকারি অর্ডার-ফরমান কোনো কিছু বাকি রাখে নাই। সে আমাদের সঙ্গে অবশ্যই থাকতে বাধ্য। আমাদের মিশন সাকসেসফুল করতেও বাধ্য। হি ইজ নাউ ইন হাই রিস্ক জোন। নট ইয়ালো, হি ইজ ইন রেড জোন। আমরা ফেঁসে গেলে তাকেও যে ফাঁসিয়ে দেব, সেটা তার জানার অপেক্ষা রাখে না। চমৎকার কিছু অবজারভেশন দিয়েছে জেনারেল।
– অবজারভেশন! কিসের অবজারভেশন।
রশীদ হাসে। জিয়া বার বার ক্যাটিগরিক্যালি বলেছে আপনার কথা।
– আমার কথা!
– হ্যাঁ। আপনার কথা। বলেছে, ইজ খোন্দকার ইন দিস গেম। ভেরি টেরিবল। ভেরি সাসপিশাস। ফলো হিম টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস। দেখ, সে আবার দৌঁড়ে গিয়ে মুজিবকে সব বলে দেয় কিনা। দেখা যাবে, সব ফাঁস করে সে মুজিবের কাছের লোক সাজল।
এবার সত্যিই খোন্দকারের শরীরে বজ্রপাত হলো। সে যেন ঠাডা খেল।
খোন্দকারকে বিশেষ কিছু বলার সুযোগ দিল না রশীদ। বলল, কায়েদ সাব, উল্টা সিধা কিছু ভুলেও ভাবতে যাইয়েন না। শেখ মুজিবের পদযুগল দেখছেন। কিন্তু আপনি কখনোই আর্মির বুটজুতার লাত্থিগুতা খান নাই। বুড়ো বয়েসে এই ভাঙ্গাচুড়া হাড্ডিতে দুই চারটা লাথিও হজম করতে পারবেন না। মুজিবের ধারে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবেন কি – একদম ফাঁসায়া দিব কায়েদ সাব।
স্পট লন্ডন। গোলাম পাকিস্তানি সুবেহ সাদিকের অনেক আগেই শয্যা ত্যাগ করেছে। মন বড়ই অস্থির উচাটন। বিবিসাব পাশে নাই। থাকলে তার সঙ্গে মহব্বত করে নিজেকে সামলাতে পারত। মহব্বত আরব্য মেডিসিন। দিল খোশ রাখে। দেহ শান্ত রাখে। উত্তেজনা দুশ্চিন্তা থাকে নিয়ন্ত্রণে। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে সে দাঁড়িয়ে যায়। এটা অবশ্য সুন্নতি মেডিসিন। কিন্তু মনোসংযোগ কিছুতেই হচ্ছে না। নামাজে দাঁড়িয়েও সুরা ঠিক মত ক্বিরাত হচ্ছে না। উল্টা পাল্টা আয়াত তিলাওয়াত হচ্ছে। এইরকম রেডলেটার দিনে উল্টা পাল্টা তিলাওয়াতে সালাত আদায় শুভকর হবে না। উল্টা পাল্টা ক্বিরাত হলো কুফরি কালাম। কাউকে বান দিতে গেলে কুফরি কালাম নাকি খুব কাজ দেয়। শেখ মুজিবকে আজ কঠিন করে বান দেয়া দরকার। বানের রশি দিয়ে যেন কোনোভাবেই ছুটকারা পেতে না পারে। গোলামের ইচ্ছা ছিল, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করবে। মুজিব বংশের ওপর মহাগজবের সওয়াবি কোশেশ যেন বে-কামিয়াব না হয়। মুজিব গোষ্ঠীর ওপর যেন লানত নামে। দুনিয়াবি কোনো চেষ্টাই গোলাম বাকি রাখে নাই। আরব ওয়ার্ল্ডে যে কতবার গেছে তার ইয়ত্তা নাই। মুজিব যে একটা মালাউন; বাংলাস্থান যে একটা মালাউনি দেশ, সেখানে হিন্দুস্থানি মালুরা আধা লাখ মুসলমানকে গলা কেটে কতল করেছে, কয়েকলাখ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, সব কিছুর খোলাসা করে আজাব-গজব বিবরণ দিয়েছে। সেখানে মসজিদ আর অবশিষ্ট নাই। সব ভেঙে চুরে দিয়েছে শেখ মুজিব। সেখানে রামমন্দির-কৃষ্ণমন্দির-কালী মন্দিরের গোড়াপত্তন হয়েছে। রমনায় একটা বিশাল গোড়ামসজিদ তৈয়ার করা হইতেছিল, সেটা ভেঙ্গেও কালী মন্দির হয়েছে – গোলাম তার চেষ্টার কোন কসুর করে নাই। কিন্তু আরবরা বিশেষ ভালো না। ওরা তার মেনিফেস্টো-প্রোপাগান্ডা কতকটা গিলেছে. কতকটা গিলে নাই। আরবরা খালি বোঝে মিসকিন। আর নিজেরা খলিফা আমীর মুয়াবিয়া। তাই গোলামকে খান্দানি মিসকিন জেনে দু’হাত ভরে দানখয়রাত করেছে। দুবাইতে একটা অশিক্ষিত শেখ জানতে চেয়েছে, শেখ মুজিব আরব থেকে যাওয়া শেখ কিনা। শুনে ঘেন্নায় গোলাম পাকিস্তানির দু’কানে পোকা ঢুকেছে। পিত্ত জ্বলে গেছে।
তারপর আরব-বর্বরদের সঙ্গে আর সহবত করতে মন চায়নি। এই শুষ্ক বালির ভূখণ্ডে এত নবীরসুল আল্লাহ পাঠালেন – এদের খাসলত বদলায়নি। বিদ্যাবুদ্ধিও কিছু বাড়ে নাই। তার চেয়ে আল্লাবিল্লা করাই উত্তম। কিন্তু সালাতেও যে মনোনিবেশ হচ্ছে না। কী করা যায়। কুফরি কালাম নাকি অতি ধন্বন্তরি। মধ্যরাতে কাদের মোল্লা, সাউদী মলানা আর মইত্তা রেজাকারের ট্রাঙ্ককল এসেছিল। দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। তিনজনের কাছেই পাক্কা খবর ছিল। তারা সকলেই প্রচণ্ড আশাবাদী। বলেছে, লিডার খালি দোয়া করেন। আল্লাহর সিজদায় কপালটা ঠেকাইয়া রাখেন, যতক্ষণ না ফাইনাল সুখবর না দিতে পারি, কপাল সিজদা দিয়া তুলবেন না। ইনশাল্লাহ এবার আর মিস ফায়ার হবে না। রুকণ-এ মজলিসে শুরা মইত্তা জানাল, জিয়াউর রহমানও আছে সঙ্গে। পাক্কা খবর। আর্মি বিট্রে করবে না। কাদের মোল্লার সঙ্গে রশীদের স্পেশাল সিটিং হয়েছে। সব ঠিকঠাক। ফারুকের ট্যাঙ্কবহর সব লণ্ডভণ্ডড উৎখাত করবে। বত্রিশ নম্বরে কেয়ামতের আলামত তারা দেখাবে। মুজিব যদি কবরস্থানেও গিয়া লুকায় – কবর থেকে টেনে বের করে খতম করা হবে। ইস্ট পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক হবে।
কাদেরের কাছে গোলাম বিস্তারিত জানতে চেয়েছিল। সে বলেছে, লিডার, ট্রাঙ্ককলে সব বলা যাবে না। ইন্ডিয়ান এমবাসি দিয়া মালাউনরা সব টেপিং করতেছে। সব বলা নিরাপদ না। মালাউনরা ইন্ডিয়ান এমবাসিতে ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না। আপনি ভুট্টোসাবকে কন, কয়েকটা শাহীন পাঠাইয়া বম্বিং কইরা মালাউনের সব ঘাঁটি মিসমার কইরে দিতে। তারা যদি এরিয়াল বোম্বিং কইরে রাইতে রাইতে পালাইতে পারে, আমরা গ্রামেগঞ্জে বলব, আবাবিল পাখি আসছিল। তারা কঙ্কর নিক্ষেপ কইরে চলে গেছে। মজিবরের বাড়িতে আল্লাহর গজব নাজিল হইছিল। বাঙ্গালি হইছে হুজুগের পাবলিক, যা খাওয়াইবেন তাই খায়। সিজদা দিয়া পইড়া থাকেন – যে কোনো সময়ে রেডিওর এনাউন্সমেন্ট আসবে।
লিডার, আপনার ব্যাপারেও একটা প্লান-প্রোগ্রাম আছে। যদি কামিয়াব করতে পারি, কেল্লা ফতে। কেউ আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঠেকাইতে পারবে না। আপনি সম্মানে ইসলামিক রিপাবলিকে পা ফেলাইবেন।
গোলাম সবসময় কাদেরের উপর খুব খুশদিল। ছেলেটা গন্ডগোলের বছরও খুব ভাল সার্ভিস দিয়েছে। তার চিন্তাভাবনায় মডার্নিজম আছে। জানতে চায়, আমারে নিয়া আবার কী প্ল্যান!
– চান্দের দিন আসতেছে লিডার। সারাদেশে গ্রামেগঞ্জে ছড়াইয়া দিমু আপনারে চান্দে দেখা গেছে। হাজার লোকজন তা দেখছে। আপনার পপুলারিটির পারদ দেখবেন কেমনে একশ ছয় ডিগ্রি ছাড়াইয়া যায়।
গোলাম মনে মনে খুব খুশি হয়। কাদের মোল্লা আসলেই সব কাজের মোল্লা। ভবিষ্যত উজ্জ্বল। চান্দের বুকে তাকে প্রদর্শনের ব্যাপারে সে বিশেষ কিছু বলে না। সব কাজে আগাম অনুমতি দিতে নাই; মানাও করতে নাই – তবে করলে পরে ফায়দা লুটতে হয়।
গোলাম কেবল বলে, পাউন্ড পেট্রোডলার যা লাগবে বলবা। জিয়াসাবরেও মেসেজ পৌঁছায়া দিবা। মানি ইজ নো প্রব্লেম। মিডল ইস্টের সাহায্য-স্বীকৃতি আমি ফাইনাল করে রেখে আসছি। তারা যেন কোনো দুশ্চিন্তা টেনশন না করে।
সাঈদী মাওলানা অবশ্য একটা দুনম্বরি লাইন দেখিয়েছে। বলেছে, লিডার, কুফরি কালাম করেন। আমি ক’দিন ধরে কুফরি কালামের লাইন ধরছি। সিজদার লাইনে মুজিবের পতন কনফার্ম না হইলেও কুফরি কালামে কোনো মিস নাই। যে কোনো সুরা তিনবার করে উল্টা লাইনে পড়েন। তারপর শেখের নাম আর তার আউরত-খান্দানের নাম নিয়ে তিনবার পশ্চিমদিকে ফিরে ফুঁ দেন। মুজিবের গায়ে মউতের বান লাগবেই। কোনো মিস নাই। তবে লিডার, বেশি বড় সূরা ধরণের দরকার নাই। উল্টাইয়া লাইন ঠিক রাখা বেশ পেরেশানির হবে।
গোলাম অবাক হয়ে দেখল, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার নিয়ত করলেও তার অস্থির চিত্ত তাকে কুফরি কালামেই প্ররোচিত ও প্রবাহিত করেছে। প্ররোচিত কেনই বা করবে না। এই শেখ মুজিব গন্ডগোলের বছর তাকে কি ভোগাটাই না ভুগিয়েছে। সারাদেশে তার দুষ্কৃতিকারী বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা। ছ্যাপ। ছ্যাপ। কিসের মুক্তিযোদ্ধা। কতগুলা মালাউন- কাফের। এবার দেখব তোর মালাউন মুক্তিযোদ্ধারা কোন কামে লাগে। গন্ডগোলের বছর কি দুর্গতিই না হয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। গোলামের তখন মাথায় বাজ। যেখানেই যায়, একটার পর একটা ঠাডা খায়। তার গনিমতের মাল ফতোয়ার তখন দারুণ সাফল্য। কিন্তু টিক্কা চাক্কার ওই একমাত্র হেকমতি দিয়ে কি লাভ। আসল কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। ঘন ঘন পিন্ডি লাহোর ছুটে যাচ্ছে গোলাম। ধর্না দিচ্ছে। মুজিবকে হাতের তালুর মধ্যে পেয়েও ইয়াহিয়া কেন পিষে মারছে না। মুজিব তো আক্ষরিক অর্থেই পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে গনিমতের মাল। তাকে চাইলে ইয়াহিয়া খোজা বানিয়ে জেনারেল রানীর হেরেমের দারোয়ানও রাখতে পারে। চাইলে কতল করতে পারে। তারপরও কেন কিছু করছে না। তদুপরি জেনারেল রহিমুদ্দি খাঁর মার্শাল ল কোর্টে রাষ্ট্রদ্রোহীতার জন্য মুজিবের ফাঁসির অর্ডার হয়েছে, কেন তাকে দড়িতে ঝোলানো হচ্ছে না। কেন ব্রাশ ফায়ারিং স্কোয়াডে দেয়া হচ্ছেনা। নানা জায়গায় ফরিয়াদ জানাতে জানাতে গোলাম মহা পেরেশান। ইস্ট পাকিস্তানেও শান্তি নাই। শান্তি কমিটি করল। পিস কমিটি। পাকিস্তানের অখন্ডতা, কওমের জশন অটুট রাখার কমিটি, কাজ হচ্ছে না। রাজাকার বাহিনী করালো। কাম হচ্ছে না। আলবদর বাহিনী করল। কাম হচ্ছে না। বদর বদর বলে খালিই আওয়াজ। তাকত নাই। শক্তি নাই। নি:শেষ হয়ে পড়ছে সবকিছু। মালাউন মুক্তিযোদ্ধারা খালি জ্বালাচ্ছে। পিন্ডির আর্মিরা খালি ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে লুকাইয়া থাকতে পারলে বাঁচে। কিসের ঘোড়ার আন্ডার পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কিসের ইয়াহিয়া-টিক্কা-রহিম-নিয়াজি-জাঞ্জুয়া। সবাই খালি গনিমতের মাল খোঁজে। দুইচারটা গনিমতের বেগম এনে ক্যান্টনমেন্টের বায়তুল মালে মজুদ করেছে। তা নিয়ে খালি টানা হেচড়া। জাঞ্জুয়া টানে তার দখলে। রহিম গিয়ে মাতলামি করে। এরা তো গনিমতের বেগম ভাগবন্টন নিয়েই জমহুরিয়া পাকিস্তানের দুই টুকরা নিশ্চিত করতে চলেছে। গোলামের কাছে আলামত পরিষ্কার। ঘরেও গোলামের শান্তি নাই। তার নিজের লবেজান বিবিজান পর্যন্ত জানতে উৎসুক- দৈনিক সংগ্রামে যে আপনি বললেন, ইস্ট পাকিস্তানের সকল সম্পদ, আওরত এখন গনিমতের মাল। সারা ইস্ট পাকিস্তানী জেনানা এখন বায়তুল মাল। এগুলা পাকিস্তানী ফৌজের জন্য হালাল। তারা ইচ্ছা মতো ব্যাবহার করতে পারে, আপনে এখন বলেন, এই গনিমতের মাল কি জিনিস। গনিমতের মাল হইতে পারলে কি জান্নাতে সরাসরি দাখিল হওয়া যাবে। কথা কি সত্য! শরীয়তের ফরমান কি! কোরান-সুন্নাহ কি বিধিবিধান!
এই বিবিজানের আবার কি হলো। কী বলছে এসব! সে জান্নাতে দাখিল হওয়ার জন্য এত উতলা হইলো কেন! খাইছে! জান্নাতের লোভে পাইছে নাকি তারে!
ঘটনা বুঝতে বিশেষ পেরেশানি হয় না তার। কয়েকদিন আগে কুমিল্লা থেকে দলের এক রুকনের সমন্ধীর পরিবার এসেছিল গোলামের আস্তানায়। ওই রুকন মশহুর মওলানা। তার সমন্ধীও জমাতে ইসলামীর লোক। সম্পর্কে গোলামের কুটুম্ব। তার ছোট ভাইয়ের বউয়ের বেয়াই। সে রাজাকার বাহিনী গঠন করে খুব চমৎকার সার্ভিস দিচ্ছিল। পঞ্চাশজনের বেশি জয়বাংলার লোক আর মালাউন খতম করেছে আখাউড়া-নবীনগর এলাকায়। এলাকায় কোনো হিন্দু নাই। সব বর্ডার পাড়ি দিয়ে হিন্দুস্থানে ভেগে গেছে। তাদের সব সহায়সম্পত্তি-দোকানপাট, সোনাদানা, পিতলের কাসা এখন রাজাকারদের দখলে। সে বিলিবন্টন করেও দিয়েছে শরীয়া মোতাবেক। পাকিস্তানি বেজন্মা ফৌজ যা পারে নাই, রাজাকার-এ-ইমতিয়াজ সাহেব আলী তা কায়েম করে দেখিয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নাই। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুক। হারামজাদা মুক্তিবাহিনী নাকি আখাউড়া লাইন থেকে ঢুকে ঝটিকা হামলা করে সেই বীর-মুজাহিদকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলেছে। তার বেওয়া-বিবি আসছিল গোলামের দরবারে। পাঁচ কন্যা তার। সবাই অত্যন্ত খুবসুরত। বোরখা-নেকাব পরে থাকত। কখনও দিনের আলোয়ও ঘরের বাইরে যায় নাই। শরীয়ত মেনে ঘরের মধ্যে কানা খোড়া অন্ধের মতো জীবন কাটাচ্ছিল। গন্ডগোল শেষ হলে তাদের নিকাহ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল সাহেবের। সমন্ধ অনেক আসছে। কিন্তু গন্ডগোল দেখে সাহেব আগায় নাই।
গোলাম এ পর্যন্ত শুনে অস্থির বোধ করে। কি হয়েছে সেই জেনানাদের! মালাউনরা ওই পাড়ে তুলে নিয়ে গেছে নাকি! আপনি বেহাইন সাব, কি যে মুশকিল করেন। ঢাকায় আমার বাসায় এনে রাখতেন। সুরক্ষিত থাকতো। এখন মালাউন মুক্তির হাতে পড়ছে নিশ্চয়ই। গ্যাং রেপড হইছে। ইজ্জত-আব্রু সব নিশ্চয়ই হারাইছে। রাজাকার বাহিনীর ইজ্জত কি বিশেষ কিছু থাকল। সব মাটিতে ভুলুন্ঠিত হয়ে গেল না!
গোলামের আক্ষেপ শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো সেই বেওয়াবিবি।
– কী হইলো । এখন কান্দেন ক্যান। আমার বাসায় রাখলে আমি আমার পোলাদের জন্যও দুয়েকটা রাখতাম।
বেওয়ার কান্নার গতি আরও বেড়ে যায়।
দরজার ওপাশে বিশাল কালো জুব্বা-পর্দার আড়াল থেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে, আপনি একটা কিছু করেন বেহাই। বিহিত ব্যবস্থা নেন।
– আমি এখন আর কি করবো। হিন্দুস্থানে তো আমার হাত নাই। পাকিস্তান আর্মি হিন্দুস্থানে ঢুকতে চাইবে না।
বেওয়া আরও জোরে কাঁদে। আমার সোয়ামী নাই। আমি বেওয়া। আপনি পাকিস্তানী আর্মিরে বলেন।
– তারারে বলে কি ফায়দা হবে। তারার কিছু করার নাই।
বেওয়া এবার দরজার পর্দা সরায়। নিজের মুখের জালি পর্দা সরিয়ে বড় বড় নি:শ্বাস নেয়। দেখে গোলাম সাব কোন স্থানে বসা। বলে, বেহাই সাব। আমার মাইয়াদের মালাউনরা নেয় নাই। তারা ইস্ট পাকিস্তানেই আছে।
– কী কন আপনে। কোথায় আছে! নিছে কারা। এক্ষুনি তত্ত্ব দেন, ঠিকানা দেন। কুমিল্লার কর্নেল গুলজার খানকে বলে দিচ্ছি।
বেওয়া এবার বুক চাপড়ে কাঁদে। গোলাম এখন একটা বিপদ আন্দাজ করতে পারছে। বেহাইন সাহেবার কাছে থেকে যা শোনে, তাতে বেশ কিছুক্ষণ সে বেকুব। সাহেব আলী খুন হওয়ার পর কুমিল্লার আর্মি কমান্ডার গুলজার খান তার শাসনগাছার বাড়িতে গিয়েছিল। তার কন্যারা পাকিস্তানি ফৌজ আসছে দেখে উত্তেজনায় আবেগে আর পর্দা-পুশিদা সামলাতে পারে নাই। তাদের রূপসুরত সব আর্মির সামনে খোলাসা হয়ে পড়ে। কর্নেল বড় দিলদরদী। সে সবকটা কন্যাকে তুলে নিয়ে গেছে। উর্দুজবানে বলেছে, এই খুবসুরত লাড়কিরা বাসাবাড়িতে নিরাপদ না। তাদের ফৌজী হেফাজতে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া দরকার। তারা এখন গনিমতের মাল। গন্ডগোল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা কর্নেলের হেফাজতেই থাকবে।
গোলাম হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সে যে আশঙ্কা করেছিল, ভাগ্যিস তা বাস্তবায়ন হয় নাই। সে আশ্বাস দিয়ে বলে, কোনো টেনশন করবেন না বেহাইন। গুলজার খান আমার অতি পেয়ারের। আমারে খুব ইজ্জত-আদব করে। অসুবিধা নাই। গনিমতের মাল শরীয়তি বিধান। কুরানসুন্নাহর নির্দেশ। তারা গুলজারের হেফাজতে আছে মানে জান্নাতি প্রটেকশনে আছে। এই যে আপনি শরীয়তি লাইনে দাখিল হইলেন, আপনার আর আপনার কন্যাদের জন্য ডাইরেক্ট জান্নাত। হাশরের দিন আপনাদের খুঁইজা ডাইকা খাতিরযত্ন কইরা ডাইরেক্ট জান্নাতি লাইনে ফরোয়ার্ডিং দেওয়া হবে। পুলসিরাতও পার না হওয়া লাগতে পারে।
বেওয়াবিবিকে মনে হয় জান্নাতের সিঁড়ি মোটেই আকর্ষণ করল না। সে এবার মুর্দাবাড়ির করুণ কান্না জুড়ে দিল। বলল, তার জান্নাত লাগবে না। তার মাইয়া চাই। এর মধ্যে নানা খবর কানে আসতেছে। তার দুই কন্যা বালেগা হয়েছে। অন্য তিন কন্যা হয় নাই। তারা নাবালিকা। কুমিল্লার এক ক্যাম্পে তাদেরকে রাখা হয়েছে। সেখানে কিসের জান্নাতি পাহারা। ওই হারামজাদা গুলজার আর বেশ কয়েকজন খানসেনা নিয়মিত সেখানে যাচ্ছে। তার কন্যাদের ব্যবহার করছে। নাবালিকা কন্যারাও বলাৎকার থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সর্বশেষ সে শুনছে, কোনো এক ক্যাপ্টেন তার সেজ কন্যার স্তনের বোঁটা কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে। তার কন্যা বুঝি আর জিন্দা নাই।
গোলাম আযম নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। অাসতাগফিরুল্লাহ। খামোশ বেহাইনসাব। একজন বেওয়া হইয়া এইসব নাপাক-হারাম কথা একজন বেগানা পুরুষের সামনে কেমন করে আপনি বলতেছেন। লানৎ লানৎ। আপনি জ্বেনার পাপ করতেছেন। গোলাম কড়া ধমক দেয়, আপনার মুখের কি পর্দা-পুশিদা নাই। আপনার কি লজ্জা-শরম বলতে কিছু নাই।
বেহাইনকে সেদিন জোর করে বাসা থেকে উচ্ছেদ করেছিল গোলাম । কিন্তু তার নিজের বিবি নতুন উৎপাত হয়ে আবির্ভুত হয়েছে। সরল সহজ মহিলা। জান্নাতি লাইনের জন্য সে লবেজান। তার বুঝতে বিশেষ বাকি নাই, সোয়ামির কাছে জান্নাতের স্পেশাল টিকেট রয়েছে। পাকবাহিনীর কোনো ক্যাম্পে এখন দাখিল হলেই হয়।
গোলাম বড় পেরেশান। সাধের ইস্ট পাকিস্তানে তার আর বুঝি থাকা হচ্ছে না। পাট গুছানোর সময় ঘনিয়েছে। ইস্ট পাকিস্তান খুব দ্রুত দারুল হরব হতে চলেছে। ঠিক আছে। ইস্ট পাকিস্তান সে ছাড়বে। কিন্তু তার আগে লাস্ট ফায়ারটা করে যাওয়া অবশ্যই দরকার। মইত্তা কই। মজাহেদ কই। কাদের মোল্লাকেও লাস্ট সিগনালটা দেওয়া দরকার।
শেখ মুজিব মোটেই টলেন নি। তাকে কাবু করা গেল না। তিনি হিমালয়। তিনি হিমালয় হয়েই রইলেন। তার উপর বিচিত্র সব ফৌজী টর্চার চলছে। শেখের বেটাকে ভয়ংকর ভয় দেখাতে হবেই। তার দিলের মধ্যে যেন জান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। প্রাণভয়ে সে যেন জেলখানার গরাদ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়। লয়ালপুর জিন্দানখানা। বিশাল কারবার। নানারকম চিন্তাভাবনা চলছে। নানা এক্সপেরিমেন্টাল হররিজম চলছে। ইয়াহিয়ার চোখে ঘুম নাই। গাদ্দারির ইস্ট পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয়। টিক্কা ফিক্কা দিয়ে কোনো কাজই হচ্ছে না। তারা তার পায়ের নোখেরও যুগ্যি না। বেলুচিস্তানে কি আকামকুকাম করেছে, সেই সবের নাম ভাঙ্গিয়েই চলছে। ইয়াহিয়া তো হুকুম দিয়েই আসছে, দরকারে ত্রিশ লাখ কেন, বাঙ্গাল হারামজাদা কমজাতকো মিট্টিমে মিলা দো। তারপরও কেন টিক্কা পারছে না। বাঙ্গাল কি এমন জাত যে লোহুর দরিয়া বইয়েও সুবিধা করা যাচ্ছে না। বজ্জাত বাস্টার্ড মুক্তিগুলোই আসল সমস্যা। খালবিল নদী নালা দিয়ে পিল পিল করে ঢুকছে। পিন্ডি থেকে এত গোলাবারুদ পাঠাচ্ছে ইয়াহিয়া, সেসব নাকি লুটপাট করে পাকিস্তান আর্মিকেই খতম করছে মুক্তিরা। চব্বিশ ঘন্টা শরাব, বেগম রানীর সান্নিধ্য কোনো কিছুই ভাল লাগছে না। চারদিকে খালি অশান্তি। ভুট্টো, গোলাম আজম, মোনেম খা, বাঙ্গাল খা, পাকিস্তান খা, কোনো সিভিলিয়ানই কাজের না। সবাই আর্মির কাঁধে বন্দুক রেখে নিজের ঝোল পাউরুটি খাওয়ায় ব্যস্ত। দুর্দিনে ভুট্টোর সঙ্গে পাওয়ার শেয়ারও করেছে। তাকে জমহুরিয়ার ফরেন মিনিস্টার করা হয়েছে। ইয়াহিয়ার বড় আশা ছিল, ভুট্টো ইউনাইেটেড নেশনস, আমেরিকা, লন্ডন সব জায়গায় মারাত্মক হাল্লা গুল্লা করবে। ভাবখানা যেন কত বড় কিসিঞ্জার। কিন্তু তার কিসিঞ্জারিও কাজে আসছে না। সে তো খালি হারামজাদা বাঙ্গাল জাহান্নুম মে জায়েগা বলেই খালাস। আবে লারকানার বান্দি কা আওলাদ, গালিগালাজ করার জন্য তো ইয়াহিয়াই আছে। তুই একটা লাইনঘাট কর। মুজিবরকে সারা দুনিয়ায় টাইট দে। বল, মুজিব একটা গাদ্দার। সে পাকিস্তানকে দুই টুকরা করেছে। তাকে খতম ছাড়া কোনো উপায় নাই। জাতিসংঘ যাচ্ছিস, আমেরিকার-লন্ডন যাচ্ছিস- সবজায়গায় প্রোপাগান্ডা কর। তা নয়। মুজিবকে খতম করলে কি কি সমস্যা, তুমি আছো সেইসব বয়ানে।
এই ভুট্টোকে বুঝতেও ইয়াহিয়ার বিশেষ বাকী নাই। সে আছে নিজের আখের গোছানোর তালে। সে এখন পশ্চিম পাকিস্তানের বাদশাহীর স্বপ্ন দেখে চলেছে। ভুট্টো নেবে ওয়েস্ট পাকিস্তান। আর মুজিব নেবে ইস্ট পাকিস্তান। মাঝখান দিয়ে ইয়াহিয়ার গলায় রশি। উভয় সঙ্কটে জেনারেলের সুইসাইডাল কন্ডিশন। ভুলটা সে মার্চ মাসেই করেছে। আরও আগে ভাগে ঢাকায় গিয়ে নজরদারি করা দরকার ছিল। খাদিমরাজাকে তো ব্লাংক অর্ডার দেয়াই ছিল। যে কোনো ছুতানাতায় মুজিবকে মারো। খতম জানাজা পড়ো। সে চাইলে সাতই মার্চে ক্রাশ ডাউন করতে পারতো। সে চাইলে পচিশে মার্চ ক্রাশ-আউট করতে পারত। মুজিবকে খালি বেয়োনেটের কয়েকটা গুতা দিয়ে ধরে আনতে কে বলেছে। তাকে তার বাড়ির মধ্যেই খতম করা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ প্লানিং। তাকে তখন সবংশে ধ্বংস করলেও কোনো সমস্যা হতো না। বলা যেত, তার পোলাপান ফুটুস ফাটুস করেছে। তার পোলা শেখ কামাল গোলাগুলি করেছে। তারা পাকিস্তান আর্মিকে অস্ত্রের ভাষায় মোকাবেলা করেছে। পাকিস্তান আর্মি তো পুলিশও না। ইপিআরও না। তারা প্রফেশনাল আর্মি। আর্মি উচিত জবাব দিয়েছে। মাঝখানে ক্রস ফায়ারিং-এ পড়ে খুন হয়েছে শেখ মুজিব। আর্মি তাকে হত্যা করতে চায়নি।
কিন্তু ওই চাষাভুষা-বান্দির পুত খাদিম রাজা। সে মুজিবকে জিন্দা ধরে এনেছে। ইয়াহিয়া যদি তখন ঢাকায় থাকতো, এই ভুল হতে দিত না। ইয়াহিয়া মাতাল হতে পারে, ইয়াহিয়া বেগমবাজ হতে পারে, কিন্তু এই রকম নির্বোধ নয় যে বুঝবেনা, বত্রিশ নম্বরে নিজবাড়িতে হত্যা আর ক্যান্টনমেন্টের হেফাজতে হত্যা, একজিনিস নয়। ক্যান্টনমেন্টে আনার পর আর ক্রসফায়ার দেয়া যায় না। ক্যান্টনমেন্টে আর যাই হোক, নাম কা ওয়াস্তে হলেও কোর্ট মার্শাল দরকার। হুটহাট তা হয়না। আর্মি পারসন হলে হুটহাট কোর্টমার্শাল করা যায়। কিন্তু মুজিবের মতো লিডারকে হুট করে ফায়ারিং স্কোয়াডে দেয়া মুশকিল। মুজিবও মনে হচ্ছে ধুরন্ধর কম নয়। সে নিশ্চয়ই এই ব্যাপারগুলো আন্দাজ করতে পেরেছে। আর্মিও শোচ-বুদ্ধি কি সেটা ফাইন্ড আউট করেছে। ঠান্ডা মাথায় সে ঝুঁকি নিয়েছে। ভেবেছে, একবার যদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানি হেফাজতে যেতে পারে, তাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে টাইম লাগবে ইয়াহিয়ার। মুজিব তার জীবনকে বাজি রেখেছে। তাজুদ্দিনদের দিয়ে আগেই সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লীগ আন্ডার গ্রাউন্ডে যাবে, মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং শিডিউলও ফাইনাল করে রেখেছে। যদি মুজিব বাঁচে তো গাজী। যদি সে মরে, তাহলেও মহানায়ক। নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে ইয়াহিয়া। একটা জবরদস্ত আর্মি জেনারেল হয়েও কেন সে মুজিবের স্ট্রাটেজি ধরতে পারল না। ভুট্টো নিজেকে এত ফক্স-হেডেড কানিং ভাবে, সেও কেন আন্দাজ করতে পারল না।
মুজিব একটা চিজ। ইয়াহিয়া চেষ্টার কোনো কসুর করে নাই। মুজিবকে ফাঁসিতে লটকানো দরকার। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল রহিমুদ্দি খা-কে দিয়ে একটা কোর্ট মার্শাল করল। নামকা ওয়াস্তে কোর্ট। রহিমুদ্দি তার অতি বশংবদ। অতি বিশ্বস্ত। ইয়াহিয়া যে হুকুম দেবে, কোর্ট মার্শাল থেকে সেই অর্ডারই আসবে। খাদিম রাজার মতো আলগা মাতুব্বরি করবে না রহিমুদ্দি।
কোর্ট মার্শালে হাজির করা হলো শেখ মুজিবকে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল, বিগ্রেডিয়ার মিলিয়ে পাচঁজন আর্মি অফিসার; কয়েকজন সিভিল সার্ভেন্ট সহযোগীকে নিয়ে কোর্ট বসল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো, রাষ্ট্রদ্রোহ,পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, ইস্ট পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র ইত্যাদি।
মুজিবের জন্য একটা সাক্ষী গোপাল উকিল দিল পিন্ডি সরকার। কিন্তু শেখ মুজিব তর্জনী তুলে নাকচ করে দিলেন সেই উকিলকে। বললেন, কিসের বিচার। কার বিচার। কে করে কার বিচার! এটাতো প্রহসন। তিনি বললেন, জজ সাহেব, আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের এখান থেকে যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এটা হচ্ছে গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। সামরিক বাহিনীর কেউ নই। আর আপনারা করছেন আমার কোর্ট মার্শাল। এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর হয় না।
শেখ মুজিব নাকচ করে দিলেন সেই ক্যারিকেচার। কিন্তু বন্দী মুজিবকে জোরজবরদস্তি করে মার্শাল কোর্টে হাজির করা হচ্ছিল।
আর্দালি বিচারকগুলো নিজেরাই শলাপরামর্শ করে। আর্দালি উকিল খালি আদালতে খুব সওয়াল জওয়াব করে। মুজিবের বিরুদ্ধে কঠিন কঠিন চার্জ গঠন করে। প্রতিটি অপরাধের শাস্তিই একমাত্র ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু- তারা সোল্লাসে সাব্যস্ত করে।
শেখ মুজিব কেবলই দর্শক। তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখেন। বাংলার মানুষের কি অবস্থা, দুশ্চিন্তায় তার মাথা ভারী হয়ে যায়। আদালতকে তিনি পরিস্কার ভাষায় বলেন, ফাঁসি দেন, ফায়ারিং স্কোয়াডে দেন, ইনজেকশন পুশ করেন; বিষ খাইয়ে মারেন, কোনো সমস্যা নাই। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য আমি দেহের সর্বশেষ রক্তবিন্দু দিতে প্রস্তুত। এই প্রহসনের বিচার দিয়ে বাংলার মানুষের অধিকার স্তব্ধ করা যাবে না। ইয়াহিয়া খান আর আপনাদের ক্ষমতা আর কতটুকু। এক মুজিবকে আপনারা লোকান্তরে পাঠাবেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিরে কেমন করে হত্যা করবেন। কত রক্ত চায় ইয়াহিয়া! সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি আজ স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে। বাংলার স্বাধীনতাকে পর্যুদস্ত করতে পারবেন না। ইনশাল্লাহ, একজন মুজিবের মৃত্যু বাংলার মুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে।
বিচারকরা বিব্রত। তারা তড়িঘড়ি কোর্টমার্শাল গুটিয়ে রাওয়াল পিন্ডি ছুটে যায়। সেখানে স্বয়ং ইয়াহিয়া খান তাদেরকে ডেকেছেন। চুড়ান্ত রায়ের ড্রাফট হবে সেখানেই।
ইয়াহিয়ার দপ্তরে কোর্ট মার্শালে অর্ডার সেশন বসলো। রায় ঠিক হলো, মুজিবকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি।
ইয়াহিয়া তখন অস্থির। নভেম্বর মাস খেকেই তার পাগলা কুত্তার দশা। কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনাই কাজে আসছে না। তার সহযোগী জেনারেলরা মাশাল্লাহ সব স্ট্রাটেজি দিচ্ছে। টিক্কা নিয়াজি ঢাকা থেকে ট্রাংককলে আবদার করছে, ফাঁসির হুকুম দিন মুজিবকে। দেরী যেন না করা হয়। মুজিবের ফাঁসিই এখন ইস্ট পাকিস্তানকে রক্ষার একমাত্র কবজ।
অন্যদিকে, ফরেন মিনিস্টার ভুট্টোর শলা ভিন্ন। মুজিবকে লটকালে আর্ন্তজাতিক দুনিয়ায় কি কি প্রতিক্রিয়া হবে, তা নিয়ে তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বাঙ্গাল কমজাতকে হারামজাদা গালি দেয়া সহজ। কিন্তু মুজিবকে হত্যা এখন বড়ই মুশকিলের হবে। ভুট্টো এটাও বলছে, মুজিবকে ফাঁসি দিলে সারা ইস্ট পাকিস্তান লণ্ডভণ্ড হবে। সেখানে এখনও প্রায় একলাখ জিন্দা পাকিস্তানি আর্মি রয়েছে। একটা পাঞ্জাবিও আর জিন্দা ফিরে আসতে পারবে না। সবকটাকে মেরে মাটির একশ হাত নীচে পুঁতে ফেলবে মুক্তিরা। সেখানে লাখ লাখ বিহারী রাজাকার আলবদর রয়েছে, সবার কবরস্থান হবে ইস্ট পাকিস্তান। একটাকেও জিন্দা পাওয়া যাবে না।
ভুট্টোর কথা আমলে না নিয়ে পারে না ইয়াহিয়া। বিহারী, রাজাকার, গোলামের বাচ্চাদের মারে মারুক, কিন্তু একলাখ পাঞ্জাবি সৈনিক সেখানে মওজুদ, এদের কথা অবশ্যই ইয়াহিয়াকে ভাবতে হচ্ছে। এদের জান কবজের ঝুঁকি নিয়ে মুজিবকে কতল ঠিক হবে কিনা, ইয়াহিয়া চিন্তিত বটে।
জেনারেলগুলোর ওপরও ভরসা করতে পারছে না ইয়াহিয়া। সবগুলো রান্ডিকা আওলাদ; রান্ডিকা খসম। ইয়াহিয়া আর কি মদ খায়। ওদের মাথার ঘিলুর মধ্যে মদের তাণ্ডবনৃত্য চলছে।
রান্ডিবাজগুলো তাকে বলেছিল, ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার দিয়ে হিন্দুস্থান দখল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। গজনীর সুলতান মাহমুদের মতো এখন হেঁটে গিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করা সম্ভব। একটা মুজাহির জেনারেল আবার ইতিহাসবিদ। সে বখতিয়ার খিলজির দৃষ্টান্তও টানল। বলল, হিন্দুস্থানিরা তাদের সকল শক্তি সামর্থ্য ইস্টার্ন কমান্ডের দিকে মোতায়েন করেছে। ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় বিগ্রেড ময়দানে পাবলিক এড্রেস করতে যাচ্ছে। ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার তাদের একমাত্র প্রায়োরিটি। দিস ইজ দ্য টাইম। এখন ইন্ডিয়ার ওয়েস্টার্ন পার্ট অরক্ষিত। এখনই হামলা চালাতে হবে দিল্লিতে। ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে দিল্লি-হরিয়ানা-পাঞ্জাব। বম্বিং করে কবরস্থান বানিয়ে ফেলতে হবে। ওদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে হবে। সকালে হামলা চালালে দুপুর নাগাদ দিল্লির লাল কেল্লায় কফি কিংবা শরাবে চুমুক দেয়া সম্ভব। বখতিয়ার খিলজি এই কাজটাই করেছিলেন। মাত্র সতেরজন আর্মি নিয়ে লাখো সৈনিকের মালাউন রাজা বল্লাল সেনকে পরাস্ত করেছিল।
মাস্টার প্লান শুনে পিন্ডি জেনারেলদের মহা উল্লাস দেখে কে! এয়ার মার্শাল পারলে তখনই ফ্লাইং শুরু করে। ইয়াহিয়ার কাছে তার জোর তদবির, আমাকে আজকেই বিমান নিয়ে যেতে দিন। আপনি কাল এসে আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবেন।
ইয়াহিয়া আহ্লাদে আটখানা। এ তো মেঘ না চাইতেই পানি। তার খায়েশও চুড়ান্ত। ঢাকায় টিক্কা-ফিক্কা যা পারে নি, পিন্ডিতে বসে সে দেখিয়ে দেবে ওস্তাদ কা খেল। সে ঠিক করে ফেলল, স্বয়ং সে এই রণক্ষেত্রে থাকবে। ইন্দিরাকে দিল্লি থেকে কয়েদ করে আনবে।
শরাবান তহুরার ফোয়ারা বইতে লাগল। আনন্দ আর আনন্দ। কিন্তু শেখ মুজিবের কি করা যায়। তাকে লটকানো কবে হবে!
এক জেনারেল বলল, হিন্দুস্থানে পিন্ডির হুকুমত কায়েম হলে শেখ মুজিব কোনো বিষয়ই না। তাকে মাছির মতো পিষে মারা যাবে।
এয়ার ভাইস বললো, জব্বর আইডিয়া আছে তার কাছে।
কী আইডিয়া!
বম্বিং করে উড়িয়ে দেয়া হবে লয়ালপুর জিন্দানখানা। কিছু দাগী ক্রিমিনালের সঙ্গে মুজিবও ফিনিশ। পরে বলা যাবে, ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের বম্বিং-এ মুজিব খতম হয়েছে। লাঠিও ভাংবে না। সাপও মরবে।
এক ফিল্ড জেনারেল আরেক প্লান দিল। বলল, হিন্দুস্থান ফ্রন্টে যুদ্ধ বাধলে সব জায়েজ। সব হালাল। সারা দুনিয়া পাক-ভারত যুদ্ধের দিকে নজর রাখবে। তখন শেখ মুজিব মরল-না বাঁচলো, কারও হেডেক হবে না। জিন্দানখানায় ট্রেইন্ড ট্রুপস পাঠানো হবে। ওরা জেলখানার মধ্যে মুজিবরের সেলে ঢুকে খতম করবে তাকে। ব্রাশফায়ার করে ঝাঝড়া করা হবে। পাক-ইন্ডিয়া যুদ্ধের ডামাডোলে কি হয়েছে কেউ টেরও পাবে না। পরে একসময় বলে দেয়া যাবে, জিন্দানখানার কয়েদিরাই ক্ষেপে গিয়ে হিন্দুস্থানি দালালকে গণহামলা করে মেরেছে।
মুজিবের লাশ কি করা হবে! তা নিয়েও পরিকল্পনার শেষ নেই। একটা জেনারেল বলল, কয়েকটা টুকরা করে জেলখানার মধ্যেই পুঁতে দেয়া হোক। লাশের যেন কোনো ট্রেস না থাকে। কেউ খুঁজে যেন না পায়।
এয়ার মার্শালদের মাথায়ও নানা ফন্দি। একজন বলল, তার লাশ উড়িয়ে নিয়ে সাগরের মাঝখানে ফেলতে হবে। কুমীর-হাঙরের খাবার হবে মুজিব।
এই বাঙ্গালটাকে কবর দেয়া যাবে না। বাঙ্গলায় কোনোভাবেই লাশ পাঠানো যাবে না। তাহলে তার কবরে মাজার হবে। বাঙ্গালরা জিয়ারত করবে সেই মাজার। মুজিব কবরে গিয়ে মহাশক্তিশালী হয়ে উঠবে। আজ হোক, কাল হোক, তার রেজারেকশান ঠেকানো যাবে না।
একের পর এক উর্ব্বর পরিকল্পনা। উল্লাস আর উল্লাস।
লয়ালপুর কারাগারে পরের দিনগুলোয় বিভীষিকার রাজত্ব। শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে ফাঁসির হুকুম হয়েছে।
তাকে রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র এক সেলে। আলো নেই। অন্ধকার। থাকার জন্য অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। দাড়ি টুপি পরা একটা মওলানা এসে বলে যায়, ফাঁসির হুকুম হয়েছে আপনার। যে কোনো দিন জল্লাদখানায় নেয়া হবে। সময় নষ্ট করবেন না। আল্লাহ বিল্লাহ করেন। দোয়া দরুদ পড়েন। এই যে নিকৃষ্ট জায়গায় রয়েছেন। কবর এর চাইতেও ভয়ঙ্কর জায়গা। আলো নাই। বাত্তি নাই। মাত্র সাড়ে তিনহাতের আজাবস্থান। নামাজে থাকেন। সিজদা দেন। জিকিরে ফিকিরে থাকেন। সময় নষ্ট করিয়েন না।
ঘাবড়ান না শেখ মুজিব। নিজের জীবনের ফিকির তিনি করছেন না। সাচ্চা মুসলমান। মরণে তার ভয়ডর নাই। ভয় তার কর্ম্ম ও জবাবদিহি নিয়ে। বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হলো কিনা; বাঙ্গালি স্বাধীন জাতি হিসেবে দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারল কিনা, তার মাথায় সেই এক চিন্তা। সেলের মধ্যে তার ওজুরও বন্দোবস্ত রাখে নাই ইবলিশকুল। মুজিব সেলের দেয়ালে তায়াম্মুম করেন। ওজু সারেন। তারপর আল্লাহর দরবারে দাখিল করেন নিজেকে। তার চোখ জুড়ে আসে পানি। খোদার কাছে আর্জি জানান, বাঙ্গালিদের স্বাধীন করে দাও আল্লাহ। মুক্ত করো। হাজার বছরের গোলামির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করো। তোমার সান্নিধ্যে আমার জানকে কবুল করার আগে বাঙ্গালির স্বাধীনতা যেন নিশ্চিত হয় খোদা। তাহলে আমি মৃত্যুকেও পরোয়া করি না; তোমার সামনে উপস্থিত হতে আমি প্রস্তুত। (চলবে…)
অলংকরণ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন