চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাবাদের ব্যাগে থাকে আগামীর সূর্য

কৈশোরে আমি কখনোই সকাল ৮টা/৯টার আগে ঘুম থেকে উঠিনি। আর এমন তীব্র শীতে তো প্রশ্নই ওঠে না। ডে শিফটে স্কুল থাকায় এ সুযোগটা ছিলো ছেলেদের। তবে বিপত্তি বাঁধতো বাবার খুটুর খাটুর শব্দে। কি শীত কি গ্রীষ্ম। বাবা বারো মাসই ভোরে উঠতেন। তাকে সাভার গিয়ে সকাল ৯টায় অফিস ধরতে হতো। অযু করা, হালকা ব্যায়াম করা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ছেড়ে দাড়ি কামানো সব শব্দই কানে বাজতো আমাদের ড্রইং ডাইনিংসহ চার কামরার বাসায়। শব্দ এড়াতে যতই লেপ মুড়ি দিতাম বাবা ততই গলা ছাড়তেন। (৯০ দশকে শীত নিবারণে তুলা দিয়ে তৈরি এক ধরনের ভারি বস্তুকে লেপ বলা হতো। কম্বল থাকতো যাদের কোন ঘনিষ্ট আত্মীয় মধ্যপ্রাচ্যে থাকে শুধু তাদের বাসায়)। তার এক কথা- ভোরে মাথা ঠান্ডা থাকে তুই জুট রচনাটা অথবা নার্সিং অ্যাজ এ জব প্যারাগ্রাফটা মুখস্ত করে ফেল।

আমি তো মহা বিরক্ত। এখনো বিছানা গরম হয়নি, উঠবো মানে!!! শেষমেষ বাবার ঘ্যানঘ্যানানিতে উঠতেই হতো। কানে কিছু কথা যেতো কিছু কথা যেতো না। কুয়াশার মতো অস্পষ্ট লাগতো তার কথাগুলো। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বাক্য মনে পড়ে এখনো। মানুষ হতে হবে, অনেক বড় হতে হবে, বাবা মায়ের জন্য কিছু করতে হবে, দেশের জন্য করতে হবে, লেখাপড়ার বিকল্প নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কেবল অপেক্ষা করতাম বাবা কখন বেরুবে অফিসের উদ্দশ্যে। আমি আবার ঘুম দিবো।winter

বাবা হাতে গোনা তিন/চারটে প্যান্টের একটি পড়া সাথে খুব কমন ডোরা কাটা সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ৭টার মধ্যে বেরিয়ে পড়তেন। ততক্ষণে ঘুম কেটে যেতো। আমি ভীষণ অবাক হতাম এই ভেবে এমন শীতে একটা মানুষ গোসল করে কিভাবে! আমি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে বাবাকে পেছন থেকে দেখতাম, ভেজা চুলের স্পর্শে সোয়েটারের কলার ভিজে যাচ্ছে। বাবার সে খেয়াল নেই। তখন তার জীবনের একটাই লক্ষ্য, ৯টার মধ্যে অফিস ধরতে হবে। বেসরকারি চাকরি বলে কথা। একটুও নড়চড় হলে চলবে না। এতো বড় একটা সংসার তার মাথায়। সম্বল তো ওই একটি চাকরি। (আমার বাবাদের সময়ে পারটাইম বলে কিছু ছিলো না।)

আমার মনে হতো মুক্তিযুদ্ধের সময়ও হয়তো তিনি এতটা সিরিয়াস ছিলেন না যতটা সিরিয়াস ছিলেন ৯টার মধ্যে অফিসে পৌছানো নিয়ে। কিছু কিছু আমি বুঝতাম, শুধু একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকতো না বাবার কি শীত লাগে না নাকি !! তারও অনেক পরে, অনেক শীত বসন্ত শেষে বুঝতে পেরেছি।শীত

এখন আমিও তীব্র শীতে ঘুম ভেঙে উঠি। গোসল করি, অযু করি, কুয়াশা ভাঙার আগেই পথ ভেঙে অফিস ধরি। এখন বুঝি মধ্যবিত্ত বাবারা আমির খান, সালমান খানের মতো মাসলম্যান না হলেও তারা হিরো। ঝড়- বৃষ্টি-গরম কিংবা শৈত্যপ্রবাহ কোন কিছুই তাকে কাবু করতে পারে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের এক দায়িত্ববোধের উষ্ণতা ঘিরে থাকে তার চারপাশ। বাবা অফিসে যান শিশির মাড়িয়ে ঘন কুয়াশা কেটে কেটে। কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে আগামীর সূর্য।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)