শুরু হলো ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি। আর এর সঙ্গেই আজ থেকে বাংলা একাডেমির আয়োজনে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। কিন্তু এবারের বইমেলা শুধু নতুন প্রকাশিত বই, লেখক আর মেলার নিয়ম-অনিয়মের আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকাণ্ড এবং এ নিয়ে মেলা কর্তৃপক্ষের এবারের অবস্থান।
এসব নিয়েই নিজের কষ্ট ও হতাশা প্রকাশ করে ভাষার মাসের প্রথম দিনে ফেসবুকে একটি বর্ণনাত্মক স্ট্যাটাস দিয়েছেন লেখক ও ব্লগার আরিফ জেবতিক। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন:
‘ফেসবুকের মেমরি নোটিফিকেশন দেখি, অনেক বছর আগে শেষবার বই লিখেছি, সেই বইয়ের প্রচ্ছদ উঁকি দেয়। তারপর আর বই লেখা হলো না। প্রতিবছর জুন-জুলাই থেকেই দীপন ভাই ফোন দেয়া শুরু করতেন, ভাই, এবার কিন্তু বই লাগবেই লাগবে।
আমাকে আর ফোন দেয়ার কেউ নেই, তাড়া দিয়ে লিখিয়ে নেয়ার মানুষ নেই আমার-আমি আর কবে লিখব দীপন ভাই!
অন্য অনেকেই পান্ডুলিপি চাইলে হাসিমুখে বলেছি, যদি লিখি তো দীপন ভাইয়ের জ্বালাতনে লিখব, দীপন ভাইয়ের চোখের সামনে দিয়ে অন্য কারো কাছে পান্ডুলিপি দেয়ার মতো সাহস নেই আমার। সেই দীপন ভাই চলে গেছেন, অথচ এবারও লেখা হলো না। কে আমাকে তাড়া দিয়ে লিখিয়ে নেবে বই?
দেশ থেকে অনেক দূরে আছি। অন্য সময় কক্ষনো ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বাইরে থাকি না আমি, বইমেলার ধুলো মাখি, আড্ডা মারি একেবারে মেলার ঝাপ নেমে যাওয়া পর্যন্ত, ঐ সময়টা কেমন যেন আপন আপন মনে হয়।
অথচ এ বছর কোনো তাড়া বোধ করছি না। নাহ, বয়েস হয়েছে বলে নয়, কেমন যেন সুতো কেটে গেছে।
মেলার পরিসর বড় হয়েছে আর মন ছোট হয়েছে মেলার মানুষগুলোর। গতবার রোদেলা প্রকাশনী বন্ধ হলো, তারপাশে দিব্যি হতে থাকল বইমেলা। দুয়েকটা ব্ল্যাকশিপ ছাড়া সেটার প্রতিবাদে এগুলো না একজনও প্রকাশক।
অভিজিৎ মারা গেলেন, আমাদের দামড়া দামড়া লেখকগুলোর একটারও মেরুদণ্ড নেই, একটা যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করানো গেল না দামড়া গোছের কাউকেই। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুনলাম, ‘ওসব লিখতে গেল কেন?’
এইসব লেখক থাকলে কী হয় সমাজে আর না থাকলেই বা কী হয়! যত্তসব ছয়ফর্মার বস্তা বস্তা আবর্জনা উৎপাদন করে চলছে বছরের পর বছর, গরীব দেশের কাগজের অপচয় ছাড়া কোন কাজে লাগে এগুলো। তুমি আমি আর সে- এই ত্রিচক্রের বাইরে এদের সৃষ্টিশীলতা নেই, তথাকথিত উপন্যাসগুলো শনিবার বিকেলে পড়লে রবিবার সকালে উঠে গল্পটাই মনে থাকে না। অথচ প্রতিদিন বইমেলায় এদের টিভি ইন্টারভিউ, সন্ধ্যার আয়োজনে সুন্দরী উপস্থাপিকার পাশে বসে জাবর কাটা। যে কয়জন ভালো লেখক এর ফাঁকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে, এসব দামড়াগুলোর শোরগোলে চাপা পড়ে যায়।
আর মুদ্রাকর আর প্রকাশকের তফাৎ জানে না এইদেশ। যে যা দিচ্ছে সব ছেপে দেয়ার নাম প্রকাশনা নয়, ওটা বড়জোর প্রেসব্যবসা হতে পারে। ধ্রূব এষ আর সব্যসাচী হাজরা-এই দুই প্রচ্ছদ শিল্পীর উপর দাঁড়িয়ে আছে গোটা প্রকাশনা শিল্প। এক ডজন প্রচ্ছদ শিল্পী তৈরি করতে পারল না এরা একযুগেও।
এদের নিয়েই আমাদের বইমেলা।
আয়োজক বাংলা একাডেমী, দুনিয়ার একমাত্র ‘গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ যারা কমার্শিয়াল মেলার আয়োজন করে! এদের সর্দার নাকি এবার প্রকাশকদেরকে আগাম হুশিয়ারি উচ্চারণ করে দিয়েছে, ‘উল্টোপাল্টা’ বই ছাপানো নিষেধ। এই দামড়ার যুগে কবি নজরুল বেঁচে থাকলে বেচারা বইমেলায়ই আসতে পারতেন না, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালু ছাপার অপরাধে স্টল বন্ধ থাকত, বেগম রোকেয়াকে দেখলে নির্ঘাত তেড়ে যেতেন এই ভদ্রলোক!
এসব রাশি রাশি অযোগ্য অদক্ষদের সমাহারে পরিণত হয়েছে বইমেলা, অথচ একদিন দ্রোহের রূপ এর ধুলোতে উড়ে বেড়াত!
বানিজ্য মেলায় প্লাস্টিকের হাড়িপাতিল পাওয়া যায় আর বইমেলায় প্লাস্টিকের মানুষ।
এই বইমেলা আমি মিস করি না, এই বইমেলায় ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া বোধ করি না আর।
পত্রিকায় পড়লাম টুটুল ভাইয়ের স্টলের জন্য মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি জানি না দীপন ভাইয়ের অবর্তমানে জলি আপা কীভাবে সামলাচ্ছেন জাগৃতির সব যজ্ঞ।
শুধু এদের জন্য ফিরে যেতে ইচ্ছা করে।
দশ বছর আগে জাগৃতি থেকে আমার প্রথম বই বের হয়েছিল, কোনদিন স্টলে বসে বই বেচিনি। এবার মনে হয় জাগৃতির স্টল পাহারা দেয়ার জন্য আমার প্রতিদিন যাওয়ার দরকার ছিল। টুটুল ভাইয়ের পাশে বসে থাকার জন্য বইমেলায় ফেরার প্রয়োজন ছিল।
যদি পারি, ফিরে আসব শিগগির।
এই দুটো স্টলের কোনো একটাতে বসে আশেপাশে কিলবিল করে চরে বেড়ানো মেরুদণ্ডহীন সরিসৃপগুলোকে দেখে গা ঘিনঘিন করবে-একসঙ্গে এত এত অমেরুদণ্ডি সরিসৃপ দেখার বেদনাময় আনন্দের জন্য হয়তো ফিরে আসব আমি…’