চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাজেট নিয়ে এত আলোচনা নজিরবিহীন

আগামী অর্থ বছরের (২০১৭-১৮) প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে যতো আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে তা স্মরণকালের কোন বাজেট নিয়ে হয়নি। তাই এ বাজেটকে নজিরবিহীন হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই ভ্যাট আইন এবং ব্যাংক হিসেবের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সংসদের ভেতরে বাইরে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

চলতি বাজেট অধিবেশনে এ বিষয়গুলো নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় সরব হয়েছেন সরকার দলীয় এমপি মন্ত্রীরাও। এমনকি অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগে মামলা করারও দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির একজন সাংসদ। কিন্তু এর আগে কখনও ঘোষিত বাজেট নিয়ে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বিষয়টি নিয়ে অর্থনীনিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: প্রথম বারের মত বাজেট নিয়ে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের এতোটা সমালোচনামুখর দেখছি। এরআগে কখনও এমনটি দেখা যায়নি।

অধ্যাপক আবু আহমেদ

সংসদে কার্যকর বিরোধী দল না থাকাকে এর জন্য দায়ী করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন: এর আগে সংসদে বিরোধী দল ছিল। বাজেট নিয়ে কোন অসংগতি চোখে পড়লে তা নিয়ে তাদেরকেই সরব দেখা যেত। এখন যেহেতু কার্যকর কোন বিরোধী দল সংসদে নেই। তাই হয়তো জনস্বার্থে সরকার দলীয় সাংসদেরাই বিষয়গুলো নিয় প্রশ্ন তুলছেন।

তবে ভ্যাট আইন পাশ হয়ে যাওয়ার পর এ সরকার দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের এভাবে সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার নেই বলে মনে করেন অর্থনীতি বিষয়ের সিনিয়র সাংবাদিক এবং দৈনিক প্রথম আলোর বিজনেস এডিটর শওকত হোসেন মাসুম।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: ২০১২ সালে যখন ভ্যাট আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয় এবং জাতীয় সংসদে পাশ হয় তখন এ সরকারই ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তখন এ বিষয়টি নিয়ে তখন কোন মন্ত্রী-এমপি কথা বলেননি। কিন্তু এখন বাস্তবায়নের প্রাককালে এসে তাদের এ ধরনের সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার নেই।

আইন পাশ করার সময় মন্ত্রী-এমপিদের নীরব থাকা এবং বাস্তবায়নের প্রাককালে তা নিয়ে সমালোচনামুখর হওয়াকে মন্ত্রী-এমপিদের আইনটি সম্বন্ধে ভালো জানা না থাকাকে দায়ী করেছেন অধ্যাপক আবু আহমদ এবং সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুম।

তাদের মতে, যদি আইন সম্বন্ধে বিশদভাবে জানা থাকত তাহলে অনুমোদন এবং পাশ হওয়ার সময়ই অনেকে কথা বলতেন। কিন্তু এখন তা প্রকাশ হওয়ার পর জনমনে যখন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তখন তারা এ নিয়ে সমালোচনামুখর হয়েছেন। তার মানে এটা বোঝা যায় যে, আইনটি সম্পর্কে তাদের বিশদ ধারণা ছিল না।

অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যমতে, ১৯৯১ সালে যখন প্রথম ভ্যাট আইন পাশ হয় তখনও এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তাই বিভিন্ন পণ্যের ওপর বিভিন্ন হারে ভ্যাট আরোপ করে তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হয়। তারপরেও তা নিয় এতটা আলোচনা-সমালোচনা হয়নি যতটা বর্তমান বাজেট নিয়ে হচ্ছে।

ঘোষিত বাজেটের দুটি বিষয় নিয়ে সব মহলে আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তার একটি ভ্যাট আইন এবং অপরটি ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ।ব্যাংকে জমানো মূলধনের ওপর আবগারি আরোপের বিষয়টিকে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করে ইতোমধ্যেই মতামত ব্যক্ত করেছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, এতে সরকারের যত রাজস্ব আয় হবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এ আবগারি শুল্কের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়ের মানুষেরা ব্যাংক হিসাব খুলতে নিরুৎসাহী হবেন।ফলে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির (ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন) বাইরে চলে যাবে। তাতে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।

‘আমাদের ধারণা ব্যাংক হিসেবে থেকে যদি সরকার আবগারি শুল্ক আদায় করে তবে তা থেকে কমবেশি ১৩শ কোটি টাকা আয় হবে।

শওকত হোসেন মাসুম, বিজনেস এডিটর, দৈনিক প্রথম আলো

কিন্তু তাতে যে বিরাট জনগোষ্টি ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশনের বাইরে চলে যাবে, তাতে সামগ্রিক অর্থনীতি আরও অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে’ বলেন অধ্যাপক আবু আহমেদ।

সরকারের শেষ সময়ে এসে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা এবং ব্যাংক হিসেবের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপকে সরকারের কৌশলগত ভুল হিসেবে দেখছেন সাংবাদকি শওকত হোসেন মাসুম।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: এ ধরনের আইন নিয়ে অনেক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়। তাই তা বাস্তবায়ন করতে হলে যেকোন সরকারের মেয়াদের শুরুর দিকে করা ভালো। শেষ দিকে এসে করলে জনমনে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যা প্রভাব ফেলতে পারে আগামী নির্বাচনে।

১৯৯৩ সাল থেকে নিয়মীত বাজেট ফলো করে আসা সিনিয়র এ সাংবাদিকের মতে ঘোষিত বাজেট তার দেখা সবচেয় খারাপ বাজেটের একটি।

ভ্যাট এবং আবগারি শুল্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে বাজেটের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আড়ালে চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আবু আহমদ।

তিনি বলেন: ভ্যাট আইন এবং ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক আরোপের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে কর্পোরেট ট্যাক্স, শেয়ার বাজারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না।

‘‘পৃথিবীর কোন দেশে কর্পোরেট ট্যাক্স এতবেশি নেই। তাছাড়া শেয়ার বাজার নিয়ে বাজেটে স্পষ্ট কোন বক্তব্য নেই। অতিগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলোও আলোচনার দাবি রাখে। কিন্ত আশ্চর্যজনকভাবে এ বিষয়গুলো নিয়ে কেউ কথা বলছে না। এমনটি এর সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত তারাও চুপ রয়েছেন “

অর্থনীতির স্বার্থে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন থাকলেও এত বেশি হারে আরোপ করলে তা বাস্তবায়ন করা দুরুহ হবে। তাই এ আইন বাস্তবায়ন করতে হলে হার কমিয়ে করতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংক হিসেবের ওপর থেকেও আবগারি শুল্ক তুলে নেওয়া উচিত বলে মত অর্থনীতিবিদদের। পাশাপাশি কর্পোরেট কর এবং শেয়ার বাজার নিয়ে আরও ব্যাপকভাবে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত দেন তারা।