বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সম্ভাবনার সাপেক্ষে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট কিছুটা সঙ্কোচনমুখি হবে- এমনটিই কাম্য। তবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন কাটছাট করা একেবারেই সমিচীন হবে না। বরং এ খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে, সেই বর্ধিত বরাদ্দের বৃহত্তম অংশটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ বরাদ্দ করাটাই এখন সময়ের দাবি।
আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের আয়োজনে ‘স্বাস্থ্য বাজেট বিষয়ক অনলাইন জাতীয় সংলাপ’ অনুষ্ঠানে আলোচকরা এ মতামত ব্যক্ত করেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-এর ষষ্ঠ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ আসছে নাগরিকদের পকেট থেকে, আর সরকারের কাছ থেকে আসছে ২৩ শতাংশ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ সরকারী ব্যয় বাড়ানো গেলে নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা।
এই অনলাইন আলোচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্যে অংশ নেন- ডা. সামিল উদ্দিন আহম্মেদ শিমুল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১), ডা. হাবিবে মিল্লাত (সিরাজগঞ্জ-২), ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত (কুমিল্লা-৭), ডা. আ. ফ. ম. রুহুল হক (সাতক্ষিরা-৩), মো. আব্দুল আজিজ (সিরাজগঞ্জ-৩) এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান (ঢাকা-১৯)। বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কনভেনর ড. মোশতাক রাজা চৌধুরী, বিআইডিএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এস. এম. জুলফিকার আলি, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। আলোচনা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের থিমেটিক গ্রুপের সভাপতি ড. রুমানা হক।
মূল নিবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. আতিউর বলেন, স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিকভাবে মোট বাজেটের ৫-৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সচরাচর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মোট স্বাস্থ্য বরাদ্দের ২৫ শতাংশের মতো বরাদ্দ দেয়া হয়। এই অনুপাত আসন্ন অর্থবছরে ৩০ শতাংশ এবং মধ্যমেয়াদে ৩৫-৪০ শতাংশ করার পক্ষে মত দেন তিনি। তিনি আরও বলেন যে, বর্তমানে বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহের জন্য যে বরাদ্দ আছে তা তিনগুন করা গেলে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে নাগরিকদের নিজস্ব খরচ ৬৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫৮ শতাংশের নিচে নেয়া সম্ভব।
ড. মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা বিশেষত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনের জন্য সহজলভ্য করতে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করার কথা ভাবা যায়। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠি তাদের আয়ের ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা বাবদ ব্যয় করতে বাধ্য হয় উল্লেখ করে ড. জুলফিকার আলি এই জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচি চালু করার উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান।
ড. জুলফিকার আলি বলেন, ‘হেলথ শক’ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ, আর এই দুর্যোগের ভুক্তভোগী আমাদের দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও অল্প সময়ের মধ্যে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের জন্য করোনা টিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সকল স্তরের মানুষের জন্য মান সম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সরকারের সদিচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য মো. আব্দুল আজিজ এমপি দেশের ৪৯৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাহিদা মতো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ধাপে ধাপে এগুলোর আধুনিকায়নের পরামর্শ দেন। ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত তাঁর আলোচনায় দেশের বাজারে যে ঔষধ পাওয়া যায় তার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ঔষধ প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জাতীয় বাজেটে সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমার জন্য বরাদ্দ দেয়ার আহ্বান জানান।
আজকের এই আলোচনাতে উঠে আসে স্বাস্থ্যখাতের অপর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং বরাদ্দকৃত বাজেটের সম্পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য কমিশন গঠন, স্বাস্থ্য বীমা চালুর তাগিদ। এই আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য সেবা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি অংশীজনদের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ।