জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের জন্য ৩ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। নতুন বাজেট জাতীয় আয়ে প্রবৃদ্ধি আনবে ৭.২% এবং একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে নিয়ে আসবে ৫.৮ শতাংশে। প্রস্তাবিত বাজেটটি গত বছরের মূল বাজেটের তুলনায় সাড়ে ১৫% এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২৯% বড়।
বাজেট পেশ করার আগ থেকেই এত বড় বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে অভিমত প্রকাশ করে আসছেন সুশীল সমাজের অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা অবশ্য এরকম অভিমত প্রতি বছর বাজেট উপস্থাপনের পর সংবাদ মাধ্যমে দিয়ে থাকেন। বছর শেষে দেখা যায় বাজেটের ৮০-৯০% বাস্তবায়ন হয়েছে। এরকম করতে করতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ বাজেট, ২০০৮-০৯ সালের ১ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট থেকে বিগত সাত বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৩৪০% বা ৩.৪ গুণ। যারা আগামী ৫ বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২৫ বছরের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে চায় তাঁদের সামর্থের শেষ বিন্দু শক্তি দিয়ে দৌড়াতে হয়। তাই টার্গেট একটু বেশি করে নির্ধারন করতে হয়। প্রশাসনিক অপচয় এবং দূর্ণীতির লাগাম টেনে রাখতে পারলে এ বাজেট অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।
বাজেট বক্তৃতায় অনেক তথ্য উপাত্ত থাকলেও পাই না অর্থনৈতিক বৈষম্য পরিমাপ করার মাপকাঠি গিনি কোইফিশিয়েন্ট। একটি সরকারের সাফল্য বিচার করার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে গিনি কোইফিশিয়েন্ট। যে সরকারের সময় অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকগুলো ঠিক রেখে গিনি কোইফিশিয়েন্ট কমতে থাকে সে সরকারকে সফল সরকার বলতে কারো কোন দ্বিধা থাকার কথা নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাজেট বক্তৃতায় গিনি কোইফিশিয়েন্ট নিয়ে কোন আলোচনা থাকে না।
প্রতি বছর গিনি কোইফিশিয়েন্টের উঠানামার তথ্য থাকলে সরকার ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কতটা কমাতে পারল না বাড়িয়ে দিল তা নিয়ে সামাজিক আলোচনা করা যেত। কম আয়ের লোক যেহেতু দেশে অনেক বেশি, ভোটের আশায় গিনি কোইফিশিয়েন্ট নিম্নমুখী করার দিকে সরকারের আগ্রহ থাকত। সামাজিক আলোচনার মাধ্যমে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেত; জনগণ কল্যাণমূলক সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারত। বাংলাদেশে গিনি কোইফিশিয়েন্ট পরিমাপ করা হয় পাঁচ বছর অন্তর। প্রতি বছর এটার পরিমাপ করতে অসুবিধা কী? প্রতি বছর গিনি কোইফিশিয়েন্টের উঠানামা জানতে পারলে এবং একে সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রে আনতে পারলে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক, ব্যবসায়ীক দূর্বৃত্তায়ন কমে যাবে; গণমানুষের অধিকার সুরক্ষা সহজ হবে; গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।
গিনি কোইফিশিয়েন্টের হিসাব না দিলেও এবারের বাজেট বক্তৃতা প্রথম বারের মত ‘সমতা এবং ন্যায্যতা’ নামে একটি প্যারাগ্রাফ যোগ হয়েছে। ১৮৪ নম্বর প্যারাগ্রাফে সমতা এবং ন্যায্যতা’র আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অতি দরিদ্র এবং দরিদ্রের সংখ্যা কমলেও আয় বৈষম্য একটি সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে’। তার এ বক্তব্য আয় বৈষম্যের বিরাজমান সমস্যার সরকারী স্বীকৃতি লিখিতভাবে মিলেছে। কিছুদিন আগে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে এক প্রাক বাজেট আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যেটা মনে করি, আয় বৈষম্য কিছু বাড়বে। কিন্তু এটা এমন পর্যায়ে যাচ্ছে না, যেখানে ডিভাইড, সোস্যাল প্রব্লেম, বিদ্রোহ-টিদ্রোহ … এই রকম পর্যায়ে যাতে না যেতে পারে, সেই জন্য আমরা সচেষ্ট আছি’।
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আয় বৈষম্য বিষয়ে তার চিন্তাধারা পরিষ্কার হয়েছে। তিনি ইউরোপ-আমেরিকার বৃহৎ পুঁজিপতিদের মত করেই আয় বৈষম্য সমস্যার সমাধানের উপায় ভাবছেন। অর্থাৎ ধনীরা আরও ধনী হতে থাকবে তাতে ঐ পর্যন্ত অসুবিধা নেই যে পর্যন্ত বিপ্লব বা বিদ্রোহ না হয়। অন্য কথায়, ১% শোষণকার্য চালিয়ে যাও, তবে খেয়াল রেখ যাতে কৃষক-শ্রমিক খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। কৃষক-শ্রমিকদের পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখে যাতে তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার যোগ দিয়ে পণ্য উৎপাদক করে ধনীদের জন্য অধিক মুনাফার সুযোগ করে দিতে পারে।
অর্থমন্ত্রীর এই পুঁজিবাদী চিন্তা অত্যন্ত ভয়ংকর। তার এই চিন্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থী। বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি প্রবর্তন করে বাকশাল সৃষ্টি করেছিলেন লুটেরা পুঁজিপতিদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য। আজকের দিনে অর্থমন্ত্রী সমাজতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে অর্থমন্ত্রণালয় পরিচালনা করতে পারবেন না – এ কথা যেমন ঠিক তেমনি একথাও বাস্তব যে সাম্যবাদী ভাবধারা নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব।
অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সাম্যবাদী চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে ব্যাক্তি কর হার ও সম্পদের উপর সারচার্জ বাড়ানো, পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ এবং প্রতিবন্ধী ও দুঃস্থ ভাতা প্রচলনকে দেখানো যায়। ১৯৯৭-৯৮ অর্থ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ্ এ এম এস কিবরিয়া বাংলাদেশে প্রথম ৪ লক্ষ মানুষের জন্য ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ প্রকল্প চালু করেন। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যা বাজেটের ১৩% এবং জাতীয় আয়ের ২.২%।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আয়ের সুষম বণ্টন নামে একটি অংশ রেখেছেন। সেখানে তিনি আয়ের সুষম বণ্টনের উপায় হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এই ব্যবস্থাগুলোর মাধ্যমে অনগ্রসর এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে যা আয় বৈষম্য রোধে সহায়ক হচ্ছে। তবে এই ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে নিশ্চেষ্ট প্রক্রিয়া। এতে কর্মক্ষমতাহীন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু উপাদানের সংস্থান হচ্ছে। কিন্তু সমাজের দুর্বল অংশের মানুষের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ বাড়ছে না, আয় বাড়ছে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ধনী লোকেদের নীট পরিসম্পদের উপর সারচার্জের হার বাড়ানো হয়েছে এবং কাঠামোর পুনর্বিন্যাশ করা হয়েছে। এতে আগের তুলনায় সম্পদ কর (সারচার্জ) বেশি আদায় করা যাবে নিঃসন্দেহে। তবে তা কতটুকু বেশি? এই পরিমাণ সম্পদ কর দানের মাধ্যমে আয় এবং সম্পদ বৈষম্য কতটুকু কমানো যাবে? এই কর ধনী লোকেদের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় কমিয়ে সামাজিক সাম্য সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট হবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই।
হাজার কোটিপতিদের সম্পদের পরিমাণ এত বেশি হয়েছে যে তারা এখন আর সঞ্চিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন। তারা এ অর্থ বৈদেশিক লেনদেনের সঙ্গে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। তা দিয়ে বিভিন্ন ‘কর স্বর্গে’ বিনিয়োগ করছেন, কানাডার বেগম পাড়ায় জমি কিনে পরিবারের নাগরিকত্ব কিনছেন; মালয়শিয়ায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন। এর ফলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে যার পরিমাণ ২০১৩ সালে ছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অতি ধনীদের সম্পদ আহরণের হাতিয়ারসমূহে এখনই লাগাম লাগাতে না পারলে আয় এবং সম্পদ বৈষম্য দিনকে দিন বাড়তেই থাকবে যা শুধু সামাজিক অস্থিরতাই নয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পশ্চিমা বিশ্বে অর্থনৈতিক বৈষম্য একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এখনো তাদের মধ্যে যথেষ্ট সংশোধনমূলক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
পশ্চিমা বিশ্বে এই ধারা চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক বৈষম্য মহামারীর রূপ নিয়ে মহামন্দা ডেকে আনবে বলে সতর্ক করছেন পশ্চিমা অর্থনীতিবিদেরা। আমাদের সাবধান হওয়ার শেষ সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে। অতি ধনীদের আরও বেশি ধনী হওয়ার সুযোগ বন্ধ করা এবং সব পেশার জন্য নিম্নতম মজুরী নির্ধারন করে দরিদ্র শোষণের পথ বন্ধ করা, দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তের জন্য অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোন কৌশল বা উপায় চোখে পড়েনি। পানামা পেপার এবং অফশোর লিংকসে প্রকাশিত কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচারকারীদের কাছ থেকে কিভাবে সে অর্থ উদ্ধার করা যাবে, কিভাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে – এসব বিষয়ের কোন উল্লেখ নেই বাজেট বক্তৃতায়। ব্যাংক লুটেরাদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট উদ্যোগের আলোচনাও প্রস্তাবিত বাজেটে পাওয়া যায়নি।
বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ তার অর্থনৈতিক দুনিয়া কাঁপানো ‘দ্যা প্রাইস অফ ইনেকুয়ালিটি’ বইয়ে দেখিয়েছেন, বর্তমান বাজার ব্যবস্থা না পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক, না সুস্থিত। প্রতিযোগিতা না বাড়িয়ে এই বাজার ব্যবস্থা সামান্য কিছু মানুষের হাতে অর্থ সঞ্চিত করার জন্য উদ্গ্রীব। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সরকারি নীতি নির্ধারন এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এই প্রবণতা মোকাবেলা না করে তা বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনীতি বাজারকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে যে তা গরীবের বিপরীতে ধনীদের সুবিধা দিয়েছে।
এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন দূর্বল হয়ে আরও বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা ধনীদের হাতে তুলে দিয়েছে। স্টিগলিজের এই বক্তব্য বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে না হলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন কিছু নয়। রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক এবং ব্যবসায়ীক দুর্বৃত্তদের হাত থেকে দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি রক্ষা করে সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করার এখনই সময়। এ কাজে এখনই সফল হতে না পারলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে; দেশ আবার স্বাধীনতা বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতে পড়বে। বাংলাদেশ আবারও পিছিয়ে যেতে থাকবে, তলিয়ে যেতে থাকবে ধর্মান্ধতার অন্ধকার কূপে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)