৩ জুন বৃহস্পতিবার ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হয়েছে। এদিন বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ে এবারের বাজেট ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ আরও বেশি এই কারণে যে বর্তমানে সারা বিশ্ব এক মহাদুর্যোগময় সময় অতিবাহিত করছে। আমরা সবাই-ই জানি করোনা নামক এক মহাদুর্যোগ সারা বিশ্ববাসীর স্বাভাবিক জীবনাচারকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে। বিশ্বের উন্নত, মধ্যম, দরিদ্র সব দেশকেই এই মহাদুর্যোগ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিদিন করোনার কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু সেই মৃত্যুহারের চেয়েও ভয়ংকর হলো করোনার কারণে বৈশ্বিক যোগাযোগ, আমদানি-রপ্তানি, কলকারখানার উৎপাদন, পণ্য বিপণন সবই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার কারণে সারা বিশ্বেই দারিদ্র্যের আনুপাতিক হার বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশও সেই বৃত্তের বাইরে নয়। গত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল, সেই সাফল্যেও করোনা বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। গত এক দশকে দারিদ্র্য আর অতিদারিদ্র্যের হার বাংলাদেশ কমিয়ে এনেছিল মারাত্মকভাবে। বিশ্বে যে সাফল্য নিয়ে বারবার আলোচনা হচ্ছিলো। কিন্তু করোনার কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের সেই গতি থমকে গেছে। উল্টো প্রতিদিনই যেনো নতুন গরিবের সংখ্যা বাড়ছে। কর্মহীন হয়ে পড়ছে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ। বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের মতে, বর্তমানে নতুন করে গরিব হয়েছে কয়েক কোটি মানুষ। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতেই বাজেট ঘোষিত হয়েছে।
এবারের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ‘জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেটে বলা হয়েছে এবারের বাজেটে দেশ ও জাতির উন্নয়নের পাশাপাশি অগ্রাধিকার পেয়েছে পিছিয়ে পড়া মানুষ-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন জীবিকা।
কিন্তু বাজেটের কোথাও দেশের এক কোটি চরবাসীর জন্য কোথাও কোনো প্রতিশ্রুতি বা বরাদ্দ রাখা হয়নি। সামাজিক নিরাপত্তা খাত, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাত, পল্লী সড়ক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা- কোথাও চরবাসীর উন্নয়ন সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। গ্রামীণ অর্থনীতি সঞ্চালনের জন্য বিবিধ বরাদ্দ ও পরিকল্পনার কথা বলা হলেও চরের দরিদ্র জনগণের উন্নয়নে সরকার কী ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বা সার্বিকভাবে চরের অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য ভাবছে তা সুস্পষ্ট নয়। ফলে বাজেটের কোথাও চরবাসীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে কোনো নির্দেশনাও নেই। চরের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে অভিগম্যতা বা প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান তৈরি, উৎপাদিত পণ্য বিপণনে অধিক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা – এসবই যেনো মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে।
চর এবং আমাদের সমতলে বসবাসরত মানুষের চ্যালেঞ্জের জায়গাগুলো একেবারেই আলাদা। সমতলে বসবাসরত মানুষগুলো বেশ সুরক্ষিত। কিন্তু চরের মানুষকে জীবন ও জীবিকার জন্য পুরো বছর ধরেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। এর কারণ নীতি-নির্ধারক এবং গবেষকদের অজানাও নয়। প্রথমত চরগুলো বরাবরই দুগর্ম, কোনো কোনো চর বিচ্ছিন্নও বটে। বিশেষ করে আইল্যান্ড বা দ্বীপচরগুলো এক ধরনের বিচ্ছিন্ন জনপদ হিসেবেই পরিচিত। এসব চরের মানুষ দেশের নাগরিক হিসেবে যে সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা তা থেকে কোনো না কোনো ভাবে বঞ্চিত। চরের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্যোগ। বলা যেতে পারে বছরের প্রায় পুরো সময়টা ধরেই তাদের বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। প্রতিবছরেই বন্যাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে চরবাসীর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কখনও কখনও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিও ঘটে। বিশেষ করে যখন বন্যায় ফসল ডুবে যায়, ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়-তখন আর্থিক ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ চরবাসীর আর্তনাদ, হাহাকার আমরা বহুবার দেখেছি। কিন্তু এসবের পরেও চরবাসী কখনই তাদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম থেকে সরে দাঁড়ায়নি। যে কোনো দুর্যোগেই তারা আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। চরের বিস্তীর্ন মাঠে মাঠে ফলিয়েছে সোনালী ফসল। বিশেষজ্ঞরা তাই বলে থাকেন- চর হলো বাংলাদেশের ‘হিডেন ডায়মন্ড’। বন্যার সময় বা পানি বাড়লেই নদীতে মারাত্মক ভাঙনও শুরু হয়। সেই করুণ এবং নির্মম ভাঙনের শিকার হন চরবাসীই। ভাঙন শুরু হলে এক চর ছেড়ে অন্য চরে চলে যেতে হয়। এসময় বাড়িঘর ভেঙেচুরে নিয়ে যেতে হয়। ভাঙনের কারণে চরের অনেক মানুষ আছেন যারা গড়ে ১০ থেকে ১৫ বার স্থান বদল করেছেন। কখনই তারা একটি নির্দিষ্ট চরে থিতু হতে পারে না। চরের মানুষের কষ্টের গল্প সারাদিন বলেও শেষ করা যাবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা চরাঞ্চলে বরাবরই খারাপ। মাতৃমৃত্যুর হার দুর্গম চরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। অনেক চরে খাদ্যভাব প্রকট। অবিশ্বাস হলেও সত্য অনেক দুর্গম চরের মানুষ দুবেলার বেশি খান না।
আমরা দেখছি চরবাসী বারবারই উন্নয়নের ধারায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। উন্নয়নের আজ যে মহাপরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনার কোথাও চরবাসীর উন্নয়ন পদ্ধতি স্পষ্ট নয়। যদিও চরাঞ্চলের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এইতো কয়েকবছর আগে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন চরের মানুষের উন্নয়নে একটি বিশেষ তহবিল গড়ে তুলবেন। কিন্তু সেটির অগ্রগতি কিছু হয়েছে বলে জানা যায়নি।
সরকারের অনেক নীতি-নির্ধারকই চরবাসীর উন্নয়নে প্রতিশ্রতিবদ্ধ। বিশেষভাবে বর্তমান সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার কথা বলতে হয়। তিনি নিজের উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলের মানুষ। চরের মানুষের উন্নয়নের বিষয়টি সংষদে বহুবার উত্থাপন করেছেন। আসলে চরের মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়নে কোনো ধরনের বিশেষায়িত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বিধায় চরের মানুষের পদ্ধতিগত এবং টেকসই উন্নয়ন ব্যহত হচ্ছে। চরের সার্বিক উন্নয়নে এখন পর্যন্ত কোনো আলাদা টেকসই পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়নি। সবমিলিয়ে বৃহৎ চর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকারের কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকার কারণে জাতীয় বাজেটে চরের মানুষের উন্নয়নে থোক বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকার সুবিধাদি এর আগে চরের মানুষ পায়নি। ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চরের মানুষের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে ৫০ কোটি টাকা করে থোক বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা সেসময় খরচ হয়নি।
চরের মানুষের পদ্ধতিগত উন্নয়ন দৃশ্যমান না হওয়ায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে চরের মানুষের উন্নয়নে নিবেদিত অ্যালায়েন্স ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এনসিএ এর পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, বিষয় বিশেষজ্ঞদের বহুবার দৃষ্টি আকর্ষণেও কার্যকর কোনো ফলাফল আসেনি। অথচ নীতি-নির্ধারক এবং উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সবাই এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, একটি টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনের মধ্যে দিয়েই চরের মানুষের যথার্থ টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স অনেক আগেই প্রস্তাবনা দিয়েছে চরবাসীর উন্নয়নের একটি বিশেষায়িত সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনের। এর নাম হতে পারে জাতীয় চর ফাউন্ডেশন/ বোর্ড বা অন্যকিছু। চর উন্নয়নের বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড়াও এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেশ ও বিদেশ থেকে সামাজিক দায়বোধ সম্পন্ন বাড়তি তহবিল সংগ্রহ করে চরের মানুষকে অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করবে। মূলত সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থায় এই ফাউন্ডেশন তার কর্ম সম্পাদন করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হলো না। চরবাসীর জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিশেষ কোটা দেওয়া-কোনো কিছুই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হলো না। চরবাসীর জন্য এবারের বাজেটেও আলাদা করে কিছু নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)