ছোটবেলায় প্রবাদ শুনেছিলাম- “আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা”। একজন পূর্ণবয়স্ক নারী যেমন মন চাইবে তেমন পোশাক সে পরতে পারে। তার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পোশাক পরার স্বাধীনতা অবশ্যই আছে। তা যেন হয় শালীন পোশাক। মনে রাখতে হবে আমরা বাঙালি। আদর্শ নারীদের অনুসরণ করেও আমরা পোশাক নির্বাচন করতে পারি। আবার ছাত্রী বা কর্মব্যস্ত নারী পোশাক পরবে তাদের সুবিধামত।
আমার মা বা শাশুড়ি যখন সালোয়ার কামিজ পরছেন তা আমার ভালো লাগছে না। আবার আমি নিজেই তা পারছি। আমার বোন যখন স্লিভলেস জামা পরে ও গলায় ওড়না পেচিয়ে চলছে তা ভালো লাগছে না। আবার আরেক বোন যখন মাথায় হিজাব পেঁচায় তাতেও আমি বিরক্ত! আসলে এসবই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। আমাদের পরিবার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের যা শিক্ষা দেয় তা সারা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে। শিক্ষক ও অভিভাবক তাদের রয়েছে অনেক ভূমিকা।
অনেক স্কুলেই দেখা যায় স্কুল ড্রেসের সাথে স্কার্ফ বা এক্সট্রা ওড়না ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এটা স্কুলের নিয়ম নয় হুজুর শিক্ষকের আদেশ। যা সত্যিই বিব্রতকর। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু বলে না, ধর্মের কাছে নতজানু হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে অন্য কোন ধর্মের পোশাকের বাড়াবাড়ি দেখা যায় না। শুধু নির্দিষ্ট একটি ধর্মের দোহাই দিয়ে পোশাক নির্বাচন হয়। সেই ইসলাম ধর্ম নারীর পোশাক নিয়ে যা বলছে: হযরত আয়শা (রা.) বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, যে মেয়ের ঋতুবতী বয়স হয়েছে, ওড়না ব্যবহার ছাড়া তার নামাজ কবুল হবে না। (হাসিদ ৩৫৪, তিরমিজি)।
পবিত্র কোরআনে সুরা নূর এর ৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “ঈমান আনয়নকারী নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযাত করে। তারা যেন যা সাধারণত: প্রকাশমান তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।’
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলে মেয়েদের পোশাক নিয়ে একটি নোটিশ টানানো হয়েছে। ‘সকল আবাসিক ছাত্রীদের জানানো যাচ্ছে যে, হলের অভ্যন্তরে দিনের বেলা অথবা রাতের বেলা কখনোই অশালীন পোশাক (সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি) পরে ঘোরাফেরা অথবা হল অফিসে কোনো কাজের জন্য প্রবেশ করা যাবে না। অন্যথায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য হল কর্তৃপক্ষ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। – আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ।’ এই নোটিশকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় ওঠে। পরে কর্তৃপক্ষ নোটিশটির ভাষা পরিবর্তন করে। পরবর্তী নোটিশটি হলো: ‘সকল আবাসিক ছাত্রীদের জানানো যাচ্ছে যে, ছাত্রীদের কক্ষ, বারান্দা, বাথরুম ও ব্যক্তিগত এলাকা ব্যতিত অত্র অফিস এলাকায়/ হল অফিসে কোনো কাজের জন্য যথাযথ পোশাক পরিধান করে আসতে হবে। হলের ভাবমূর্তি রক্ষার দায়িত্ব সকলের। – আদেশক্রমে হল কর্তৃপক্ষ।’
আমি বলতে চাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন একটি নোটিশ দিলে ক্ষতি কি? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো অনেক কিছুই শেখাবে। হয়তো একথা শুনে অনেকে বললেন, আপনার কাছে যা শালীন আমার কাছে তা নাও হতে পারে। আমি সে কথার জবাবে বলব, আমার কাছে যা শালীন আপনার কাছে তা ভিন্ন নয় কারণ শালীনতার একটি মাপকাঠি আছে। যদিও তা দেশ, সমাজ ভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে আমরা বাঙালি। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করেই আমাদের চলতে হবে।
আবার অনেকেই বিরোধীতা করার জন্যই হয়তো বলবে বাঙালির পোশাক ধারণের দায়িত্ব কি শুধু নারীদের? আমি বলতে চাই, আগে আমি আপনি শুরু করি, দেখবেন এক সময় অনেকজন হয়ে যাবে।
পুরুষেরাও হাফপ্যান্ট বা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ঘুরলে আমাদের চোখে কিন্তু ভালো লাগে না। সেটিও অফিস এলাকার পোশাক হতে পারে না। সবাই জানেন, কোন পরিবেশের পোশাক কেমন হওয়া দরকার। শিক্ষার্থীরাও জানেন। তারপরও কোনো কোনো বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, পোশাকের সঙ্গে ভালো লাগা মন্দ লাগার ব্যাপার জড়িত। কারোর সামঞ্জস্যহীন অসুন্দর পোশাক যেমন দৃষ্টিতে আটকায় একইভাবে জেনে বুঝেও যখন অশালীন কোনো পোশাক কেউ পরেন সেটিও মানুষের দৃষ্টিতে আটকায়। পরিবেশটি অসুন্দর হয়ে ওঠে। কোন প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কর্তৃপক্ষ ওই নোটিশ দিয়েছে তা এখনও জানি না, তবে বোঝাই যায় এর পেছনে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বিষয় রয়েছে। যে কারণে হল কর্তৃপক্ষ মেয়েদের সতর্ক করতে বাধ্য হয়েছেন।
একজন শিক্ষক, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, সংষ্কৃতি কর্মীদের কাছে সমাজের অন্যান্যদের অনেক বিষয় শেখার থাকে। তার আচরণ, চাল-চলন-বলন, উদারতা, মহানুভবতা অনেক কিছু। তাদেরকে আমরা সমাজের আদর্শ ভাবি। বর্তমানে আমাদের চারপাশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা দেখা যায় তাতে হতাশ হতে হয়। আবার কেউ যদি কখনো কিছু একটা বলে ফেলে তো রক্ষা নেই। সাথে সাথে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ব্যক্তি আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। তখন সবাই সবকিছুকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যায়। যিনি সমাজের আদর্শ হবেন, তার এমন ব্যক্তিগত বিষয় কেন থাকবে যা অন্যায়, যা সমালোচিত হয়।
মানুষের জীবনে ভুল থাকতে পারে। ভুল আর অন্যায় কখনও এক নয়। অনেকে হয়তো বলবেন তার কাজটুকু নেন, ব্যক্তিগত জীবন নয়। আমি বলতে চাই ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। যা কিছু সব প্রকাশ্য। যা অন্যের ক্ষতির সাথে জড়িত তা ব্যক্তিগত বলা যাবে না। প্রতিটি মানুষের স্বভাব-চরিত্র হতে হবে স্বচ্ছ। যা পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দেয়। আমরা সেই আদর্শকে ধারণ করতে চাই- পোষাকে, চিন্তায়, মননে যা একজন আধুনিক বাঙালির পরিচয় বহন করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)