চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাংলার হেমন্ত আর হাওয়ার দিক বদলের খেলা

একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে চরাচরে। একটু দূরে একটা নদী শুয়ে আছে। নদীর ওপারে দিগন্তধরা মাঠ। মাঠে মাঠে ফসলের কানাকানি। বাতাসে পাকা ধানের শিষ হেলেদুলে ঝুমঝুমি তরঙ্গ তোলে। একটু একটু হিমের ছোঁয়া এসে লাগে গায়ে। শরীরে কোন সুদূরের একটা টান এসে লাগে! তাহলে কি হাওয়া দিক বদলালো? তাহলে কি শীতের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে হেমন্তকাল?

এই বাংলায়, ছয়কালের এই বাংলাদেশে, ঠিক এখন নদীছোঁয়া যে কোনো গ্রামে, ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে, ফসলের ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে; একটু ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলেই, কান পাতলেই, হেমন্তের শব্দ শোনা যাবে।

হেমন্ত বাংলার এক সমৃদ্ধ ঋতু। বর্ষার দাগ মুছিয়ে দিয়ে কাল থেকে কালান্তরে বাংলার ঘরে ঘরে হেমন্তে লক্ষ্মীমন্ত ধান উঠতো। ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব হতো। নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি পিঠার গন্ধে ভরে যেত সংসারের উঠান। এই চিত্র খুব বেশিদিন আগের কথা নয়।

কিন্তু নগর? নগর তো সারাজীবন এই ঋতুচক্র থেকে কিছুটা দূরেই থাকে, একা একা, কঠিন মন নিয়ে। তবুও নগরে হেমন্ত আসার চকিত ছবি দেখা যায়! যদিও আজকাল হেমন্তের আগমন এই নগরীতে বড় ফ্যাকাশে, দেখার বাইরে থাকা এক অদ্ভুত বিষয়। যারা বহুকাল আগে এই হেমন্তকে চেনেন তারা টের পান হয়তো। এখনো গ্রাম প্রধান বাংলাদেশ। ফেসবুকের দৌলতে কুয়াশামাখা ছবি দেখা হয় বন্ধুদের পোস্ট থেকে। উত্তরের স্বজনরা জানান দেন সন্ধ্যার পর থেকে হিম নিয়ে বাতাস আসে আরো উত্তরের হিমালয় থেকে। এবার কার্তিকের কাইতান, তিন দিনের টানা বৃষ্টি আগে ভাগেই শীতের আগমন বার্তা দিয়ে গেছে। তবে শহুরে শীত এখন ‘মাধবী এসেই বলে যাই’ টাইপ। শীত কালেও শীতের স্বাদ পায় না নগরবাসী; যদি না দু-একটা শৈতপ্রবাহ বয়ে যায়!

তবে ভোরে ঘুমের মায়া ছেড়ে বাইরে বেরুলে দেখা যায় কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে বেশ। মাঝরাতে পথে বের হলে দেখা যায় হালকা কুয়াশার মসলিন জড়িয়ে নিয়েছে নিজের শরীরে ঘুমন্ত শহর। জনহীন পথ, নিদ্রাতুর পথ-আলো, বাতাসে ঠান্ডা স্পর্শ এই নগরীকে দূরের কোন জনপদে রূপান্তরিত করে দেয়। নগরীর ঘোমটা ঢাকা এই রূপের দিকে তাকালে মনে হয় না দিনের আলোয় খর সূর্যের আলোয় এই পথে মানুষের মন প্লাবিত হয়ে যায়, এই পথে জীবনের বিচিত্র ধ্বনি ওঠে, এই পথে মানুষ সব ভুলে, সব হারিয়ে ছুটতে থাকে।

এই নগরীতে ধানের গন্ধ নেই। নেই শুকনো পাতা পোড়ানোর ঘ্রাণ। বিকেলের ম্লান আলো কাউকে ঘেরাও করে রাখে না এই শহরে। তবুও হেমন্তের হঠাৎ বৃষ্টির পর ছাতিমফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে বাসাতে ভর দিয়ে। ব্যস্ত সড়কের পাশে বুড়ি তার পুরনো কম্বলটা রোদে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটু একটু করে বাজার ভরে ওঠে তীব্র সবুজ সব্জীতে। গলি ধরে হেঁটে গেলে কোন নির্জন দুপুরে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে কপি ভাজার গন্ধ। নগর এমনই। চকিতে মনে করিয়ে দেয় হেমন্তের কথা। মনে পড়ায় শীত আসার কথা। নগর তার বেদনায়, ক্লান্তিতে, হাহাকারে আর স্বপ্নে কখনো ফিরে যায় ঋতুদের পুরনো গন্ধের কাছে।

মহান মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্রাবলী’ আমাদের জন্য এক রত্নভার। সেই অতল ভান্ডারের ১৬৭ নম্বর চিঠিটি ১৮৯৪ সালের ২৩ অক্টোবর, মঙ্গলবার রবি ঠাকুর লিখেছিলেন শান্তিনিকেতন থেকে। পড়া যাক সেই চিঠির কিছু অংশ ‘পরশু থেকে খুব অল্প অল্প শীত পড়ে চারিদিক আরও যেন প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। বাতাসের ভিতর থেকে সেই ক্লান্তির ভাবটা চলে গেছে। সকাল বেলায় স্নান করে সাফ কাপড়টি প’রে এসে বসে যখন গায়ে এই প্রভাতের ঠান্ডা বাতাসটি লাগতে থাকে, তখন সর্বাঙ্গে আরও যেন খানিকটা নির্মলতার সঞ্চার হয় চোখের উপরে যে আলোটি এসে পড়ে মনে হয় স্নিগ্ধ শিশিরে অভিষিক্ত এবং শিউলি ফুলের সুশীতল গন্ধে পরিপূর্ণ। আকাশ নীল, গাছপালাগুলি ঝলমল করছে, মাঠের মাঝে-মাঝে সবুজ ধানের ক্ষেত রৌদ্রে কোমল পাণ্ডু আভায় মণ্ডিত হয়েছে, বাতাস কতদূর থেকে অবারিত বেগে শিশিরসিক্ত তৃণাগ্রভাগ চুম্বন করে চলে আসছে তার সন্ধান নেই, শূন্য মাঠের মাঝখানে জনহীন রাঙা বাঁকা রাস্তাখানি কোথা দিয়ে কোথায় চলে গেছে তার শেষ দেখা যাচ্ছে না। আমি এরই মাঝখানে হেমন্তের তুষারনির্মল আলোকপ্লাবনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে, শিশির স্নিগ্ধ বাতাসের দ্বারা সর্বাঙ্গমনে অভিনন্দিত হয়ে, সম্মুখে একটি- প্লেট স্তুপাকার শিউলি ফুল নিয়ে পুলকিত হয়ে বসে আছি আমাকে কেউ বিরক্ত করবার নেই, দোতলার তিনটি ঘর সম্পূর্ণ আমার এবং দিবসের অষ্টপ্রহর আমার স্বাধীন অধিকারের মধ্যে।’

এই হলো হেমন্তের আগমন বর্ণনা আর এই হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দুই.
আর জীবনানন্দ দাশ? কী বলছেন তিনি হেমন্তকাল নিয়ে?

প্রথম ফসল গেছে ঘরে,
হেমন্তের মাঠে-মাঠে গেছে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশ-পাতা মরা ঘাস আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
ধান ক্ষেতে মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা; ঝিমায়েছে এ-পৃথিবী,
তবু পাই টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে
শিশিরে পালক ঘ’ষে-ঘ’ষে
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে- দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রাণের রাতে
সেই পাখি;..’

এই হলেন জীবনানন্দ দাশ, ‘পেঁচা’ কবিতায় তিনি হেমন্তের ঘ্রাণমাখা ছবি এঁকেছেন এভাবে।

বাংলাদেশের হেমন্তকাল রূপে, লাবণ্যে বরাবরই অনন্য। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা, জীবনযাপনে হেমন্তের উপস্থিতি আলোকময়। ধরা যাক, আজ থেকে ঠিক একশ’ বছর আগে। তখন বাংলাদেশ মানে বর্ষায় চারিদিকে থৈ থৈ পানি। বর্ষার ছোবল শেষে নীল আকাশে সাদা মেঘেদের ওড়াউড়িতে শরৎ আসতো তখন। বর্ষার পানি যে পলি ফেলে রেখে যেতো মাঠে মাঠে সেখানে সোনার ধান ফলতো, ফসলের ঘ্রাণে ঘ্রাণে হেমন্ত বয়ে আনতো কৃষকের মুখে হাসি।

তারপর মাঠের ফসল ঘরে এলে, কৃষকের গোলায় হলুদবর্ণ ধান উঠলে শীত নামার আগে আগে বসতো নবান্ন উৎসব। সেই হেমন্তে কতো কিছু হতো বাংলায়। মেয়ের বিয়ে স্থির করে পাকাকথা তোলা থাকতো হেমন্তের জন্য। কৃষাণী বধূর গায়ে উঠতো পাছাপেড়ে শাড়ি। কী মিষ্টি বাতাস, না শীত- না গরম। আকাশে নক্ষত্রের জলসা বসতো। সেই জলসার ঝলক এসে পড়তো মাটিতে। পরিপাটি লেপা উঠানে খেজুরপাতার পাটি ফেলে দাদিরা-নানিরা, দিদারা গল্পের আসর বসাতেন। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী নেমে আসতো রূপকথার পাখায় ভর করে। ডালিমকুমার কী করে হাজার পাহাড় ডিঙিয়ে রাজকন্যা কঙ্কাবতীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে রাক্ষসপুরী থেকে, সেই পরমকথায় রাত প্রায় কেটেই যেতো। শেষ রাতে, হিমপড়ার আগে ঘুমলাগা চোখে মায়েরা ছোটদের কোলে তুলে নিয়ে ঘরমুখো হতেন, আর উঠানে গড়াগড়ি খেতো দূর আকাশের শুকতারার আলো, হেমন্তের ঘোরলাগা বাতাস। কোথায় কোনো গাছের মগডালে গেয়ে উঠতো একলা একটা পাখি।

তিন.
এইতো ছিলো বাংলার হেমন্ত। আজো কি তেমনি আছে? জানি না, আমরা নিশ্চিত করে জানি না। তবে মহাকালের হেমন্ত, বাংলার হেমন্তকাল, নবান্ন গ্রাম ছাড়িয়ে শহুরে রূপ পেয়েছে। প্রতিবছর এখন নিয়ম বেধে এই শহরে নবান্ন উৎসব হয়। ফেলে আসা গ্রাম, ধূসর হয়ে যাওয়া অতীতকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য শহরে বেশ জানান দিয়েই করা হয় নবান্ন উৎসব, তবে তাতে প্রাণ কতোটা থাকে সে প্রশ্ন উঠতেই পারে! নগরজুড়ে হাহাকারে এই সময়ে, দেশজুড়ে হিংসা-বিদ্বেষের এইকালে, শিশুর কোমল শরীর-মনে পিশাচের ছোবলের উল্লাসকালে এই হেমন্ত ভাবনা, বর্ণনা কী মানে রাখে?

তবুও রবীন্দ্রনাথ তো গাইবেন-ই। আমরাও গাইবো তার সঙ্গে-

‘হায় হেমন্ত লক্ষ্মী,..
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)