চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক জোরদারে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা কেনো গুরুত্বপূর্ণ?

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর, দুই দেশের বর্তমান সম্পর্কের গুরুত্ব এবং সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে দুইপক্ষের সমস্যা ও তার সমাধানের বিষয়ে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বস ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আরাফাত কবিরের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের উল্লেখযোগ্য সুসম্পর্কের দারুণ অগ্রগতির মধ্যে ভারতে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফরকে দুই দেশের সম্পর্ক নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। অবশ্য এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও বহুল প্রতীক্ষিত অভিন্ন তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তিসহ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার কিছু সমস্যার সমাধান না হওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোকপাত করেছেন আরাফাত কবির।

এই সফরের আগের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি লিখেন, শেখ হাসিনার সফর নিয়ে দুই দেশের গণমাধ্যমে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে তিস্তা চুক্তির উপর জোর দিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যম। আর প্রতিরক্ষা চুক্তির উপর গুরুত্ব দেয় ভারতের গণমাধ্যমগুলো। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লীতে পৌঁছানোর আগের দিনই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, তিস্তা চুক্তি এ মেয়াদে হচ্ছে না। গুঞ্জন ওঠে যায় তিস্তার পরিবর্তে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা চুক্তি না হলেও প্রতিরক্ষা সমঝোতার আওতায়, বাংলাদেশকে ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। যদিও বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে ঠিক কি ধরণের অস্ত্র কিনতে সহায়তা দিতে যাচ্ছে ভারত। এছাড়াও দুই দেশের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের একত্রে কাজ করা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য আরও দুটি চুক্তি সই হয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা সমঝোতার গুরুত্ব
ভারত চেয়েছিলো বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘমেয়াদী এবং ব্যাপক প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করতে। বাংলাদেশ ও চীনের ক্রমবর্ধমান বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে দিল্লী আগে থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলো। গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনিপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।

গত মাসেই চীন থেকে বাংলাদেশে আসে দুটি সাবমেরিন। ওই সময়েই দিল্লী বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে তাদের উদ্যোগের উপর গুরুত্বারোপ করে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে টেক্কা দিতেই ভারতের এমন তৎপরতা তা বুঝতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না। শুধু তাই নয়, এই চুক্তিতে ভারতের আগ্রহের প্রমাণ দিতে হাসিনার সফরের আগেই বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।

বাংলাদেশ ভারতের সাথে এমন কোন চুক্তি করতে চাচ্ছিলো না, যাতে চীনের সঙ্গে তার বর্তমান সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। উল্লেখ্য বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সিংহভাগই আসে চীন থেকে আসে। এ জন্য একটি বিস্তর প্রতিরক্ষা চুক্তির করা ঢাকার চেয়েও দিল্লীর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। যা ভারতকে তার দুইটি উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করতো । প্রথমত: বেইজিংকে এই বার্তা দেয়া যেতো যে, ভারত এখনও দক্ষিণ এশিয়াকে তাদের নিজেদের প্রভাবিত অঞ্চল হিসেবেই দেখছে। দ্বিতীয়ত: এই চুক্তির প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ক্যাম্পেইনে আরো গতি লাভ করতো। যাতে ভারতকে নেতৃত্ব স্থানীয় অস্ত্র রপ্তানীকারক দেশ হিসেবে জাহির করা যেতো। সর্বোপরি, দেশে উৎপাদিত অস্ত্র বিক্রির জন্য ভারতের ক্রেতা দরকার।

ঘটনার পরবর্তী অংশে বাংলাদেশ খুব কৌশলের সাথে পরিস্থিতির সামাল দেয়। কারণ ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি না করলে চীনও উদ্বিগ্ন হবে না। কিন্তু ‍দুই দেশের ভালো-মন্দো সম্পর্কের মাঝেও ভারতের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় সূচনা যার শেষ হতে পারে প্রতিরক্ষা চুক্তি দিয়ে।

হাসিনা: দিল্লীর বিশ্বস্ত বন্ধু
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ককে একটি বিচ্ছেদ হওয়া বৈবাহিক সম্পর্কের পুর্নস্থাপন হিসেবে বর্ণনা করে আরাফাত কবির লিখেন, ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে যেতে শুরু করে। তার সরকার স্থানীয় চরমপন্থী ভারত-বিরোধী কার্যক্রমের যুক্তদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে। সব থেকে বড় রাজনৈতিক চালটি ছিলো চুপচাপ অনুপ চেটিয়াকে দিল্লীর কাছে হস্তান্তর করা। পানি ও ভূমির ট্রানজিটের পাশাপাশি দিল্লীর বিশেষ অনুরোধে দেশটির উত্তর অংশের সাথে সহজে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করতে বিশেষ ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট সুবিধা দেয় ঢাকা। সংক্ষেপে বলা যায় যে শেখ হাসিনা দিল্লীর বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হন।

এই সম্পর্কের পরীক্ষা হয় ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়। বহুল বিতর্কিত ওই নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলসমূহ বর্জন করে। এই নির্বাচন হাসিনাকে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করে। এই নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক সহিসংতা ছিল নজিরবিহীন যা হাসিনা সরকারকে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ফেলে দেয়। ওই নির্বাচনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনসিং হাসিনাকে সমর্থন দেয়। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে নিরপেক্ষ নির্দলীয় অন্তবর্তীকালীন সরকারের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিবর্তনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৯ সালে। এখন পর্যন্ত এটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি আবারও হবে কি না। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সামনের নির্বাচনে ভারতকে পাশে চান শেখ হাসিনা। ভারতের রাজনৈতিক সহায়তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, নরেন্দ্র মোদির সরকারের সাথে হাসিনা একটি সখ্যতা রাখতে চায়। দিল্লীর রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে শেখ হাসিনা একটি শক্তিশালী ব্যক্তি ইমেজ তৈরি করতে পেরেছেন যা তার জন্য খুবই সহায়ক। মোদি প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে শেখ হাসিনাকে এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানান। এটি হয়তো সে ইঙ্গিত বহন করে।

ভারসাম্যহীন স্বপক্ষ বিরোধীতার সুবিধা
যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ভালো এবং দেশ দুটির মধ্যে সমস্যাও কমেছে। তথাপি দেশ দুটির সম্পর্কের অগ্রগতির ভবিষ্যতের পথে তিস্তা চুক্তি নিশ্চিতভাবে বিপত্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০০৮ সালের পর থেকে নরেন্দ্র মোদির সাথে শেখ হাসিনার দেখা হয়েছে মোট চার বার। প্রতিবারই ভারতের একটি প্রদেশের সরকারের অনিচ্ছার কারণে তিস্তা চুক্তি থেমে গেছে। সে কারণে হাসিনা সরকারকে দেশের ভিতর থেকে সমালোচনার শিকার হয়েছেন। এমনটি বলা হয়েছে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যা পেয়েছে তার থেকে বেশি দিয়েছে।

তার মতে, দুই দেশের মধ্যে বেড়ে চলা বাণিজ্য ঘাটতিও বাংলাদেশের বড় চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার তাগাদা দেয়া হলেও শুল্ক ও শুল্কমুক্ত বাজার এবং সীমান্ত এলাকায় বাজার সৃষ্টির বিষয়ে ঢিলেমি করছে ভারত। আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ভারতের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনীর গুলি। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত বিশ্বের অন্যতম বিবাদমান সীমান্ত হিসেবে পরিচিত। ভারতের অফিসিয়াল সূত্র অনুযায়ী সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে গত দশ বছরে প্রায় ৬০০ বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আর আনঅফিসিয়ালি এ সংখ্যা দ্বিগুন হবে। সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে এবং এই সমস্যার সমাধান হবে- ভারতের পক্ষ থেকে এমন আশ্বাস দেয়া হলেও এ বিষয়ে লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি এখনও অনুপস্থিত।

বড় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছে ভারতের চাওয়া অনেক। এই এক কারণেই বাংলাদেশ এই প্রত্যাশা বেশি করে যে ভারত আরও উদার হবে। এই ভারসাম্যই দুই দেশের ভবিষ্যতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নির্ধারণ করবে। তাই, অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানের জন্য ভারত যতো দ্রুত উদ্যোগ নেবে, তা তাদের জন্য ততো ভাল হবে। যার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ বিষয়ে চীনের ভূমিকাকে অনুকরণ করতে পারবে।

দীর্ঘ সাত বছর পর গত ৭ এপ্রিল ৪ দিনের ভারত সফরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন প্রটোকল ভেঙ্গে নয়াদিল্লীর পালাম বিমান ঘাঁটিতে তাকে ফুলেল অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই সফরে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে।