অধ্যাপক কবীর চৌধুরী প্রথিতযশা একাডেমিসিয়ান বুদ্ধিজীবী। একাধারে লেখক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, সফল অনুবাদক এবং সাংস্কৃৃতিক ও সামাজিক সক্রিয় ব্যক্তিত্ব।
তিনি জন্মে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৯২৩ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে, যদিও তার পৈত্রিক বাসভূমি নোয়াখালি জেলায়। তার বাবা ছিলেন খানবাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী, মায়ের নাম উম্মে কবীর আফিয়া চৌধুরী। তার স্ত্রী ছিলেন সুপরিচিত শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী।
১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে ইংজেীতে বিএ (অনার্স) এবং পরের বছর এমএ ডিগ্রী নেন। দুটি পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৯৫৭-৫৮ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে সরকারী বৃত্তি নিয়ে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালিফোর্নিয়া পাবলিক প্রশাসনে এমএ ডিগ্রী নেন।
নানা পদে চাকুরি করে ১৯৮৩ সলে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। অবসর গ্রহণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে বেশ ক’বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপকে বৃত হন।
নানা পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন তিনি। এরমধ্যে রয়েছে স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একুশে পদক।
আমি আমার আলোচনার সূচনা করতে চাই একটি ‘জঘন্য’ শব্দ মৌলবাদ উচ্চারণ করে― ইংরেজীতে যাকে বলা হয় fundamentalism। আমার প্রবন্ধের শিরোনামে বলেছি বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার সঙ্কট এবং মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতার উত্থান। শিরোনামে বাংলাদেশের কথা বলা হলেও বস্তুত সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া আজ মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতা রোগে আক্রান্ত আর কট্টর ধর্মীয় উন্মাদনায় আচ্ছন্ন। আমরা নিশ্চয় কয়েক বছর আগে গুজরাটে, বিশেষ করে আহমদাবাদে আজকের ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে প্রধানত মুসলিম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা বিস্মৃত হইনি― যে দাঙ্গায় একজন বিজ্ঞ বিচারপতিও নিহত হন।
বাংলাদেশে ১৯৫০ ও সর্বশেষ ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা আমরা ভুলে যাইনি। লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও অমুসলমান গণগোষ্ঠী সে সময় দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। সে বেদনার কথা আমরা আজও ভুলিনি। দিনের পর দিন সাংবাদিক সম্প্রদায় মিছিল করে পথে নেমেছিল দাঙ্গা রোধে- বঙ্গবন্ধু (তখনও বঙ্গবন্ধু হননি) শেখ মুজিব উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও’।
আমি গোড়াতে বলেছি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল মৌলবাদ, উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন। দক্ষিণ এশিয়া বলতে ব্যক্তিগতভাবে আমি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝাতে চাই, যদিও এ নিয়ে আমাকে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়, সেসব দেশ যে দেশগুলো অভিহিত হচ্ছেঃ উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতীয় ইউনিয়ন যার অন্তর্ভুক্ত ‘সাত বোন’ নামে পরিচিত ভূখণ্ডগুলি (আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা) প্রভৃতি নামে।
নামের অর্থগুলিও কী চমৎকার। ত্রিপুরি জাতির দেশ ত্রিপুরা, মিজো জাতির দেশ মিজোরাম, মনিপুরী জাতির দেশ মনিপুর, যে অঞ্চলে নাগা জাতির বাস তা নাগাদের ভূমি বা নাগাল্যান্ড, যেখানে মেঘের বাস তা মেঘালয়, যেখানে প্রভাতী সূর্যের সতত আনাগোনা তা ‘অরুণাচল’, আর আসাম হল সমতলবাসীদের দেশ। আমি অবশ্য জানি, আমার এই দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের সংজ্ঞার সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন।
এই সংজ্ঞা দানের ক্ষেত্রে আমার প্রধান বিবেচনা হলো প্রাচীন মহাকাব্য ‘মহাভারত’। কী বৈচিত্র্যময় এই মহাভারত- বলা হয়ে থাকে ‘যাহা নাই মহাভারতে, তাহা নাই ভারতে’। আর স্বল্প হলেও রামায়ণ কাব্যের প্রতিও আছে আমার সশ্রদ্ধ দৃকপাত। এছাড়া রয়েছে বৌদ্ধ সাহিত্য উৎসৃষ্ট জাতক কাহিনীর ভিত্তি। এ সবই যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলটিকে ও এই অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে আসছে।
মৌলবাদ বিশেষ করে ধর্মীয় মৌলবাদ ভয়ানক ভাবে উগ্রবাদের চেতানয় সম্পৃক্ত বা এই বিশ্বাসের অনুসারীরা প্রচন্ডভাবে উগ্রপন্থী এবং সহিংস তাদের গ্রুপের সাথে একমত না হলে বিরুদ্ধবাদীদের শুধু তত্ত্বীয়ভাবে নয় পার্থিব বা দৈহিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে পিছপা হয় না। বাংলাদেশের মৌলবাদীরাও বিশেষ করে ধর্মান্ধ সহিংস ইসলামী মৌলবাদীরাও এর ব্যত্যয় নয়। গত বছর (২০১৫) ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় উগ্রপন্থীদের হাতে বিজ্ঞান মনষ্ক লেখক ও জনপ্রিয় ‘মুক্তমনা’ ওয়েব সাইটের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর অভিজিৎ রায়ের নিহত হওয়াটা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ ও উদাহরণ।
অভিজিতের দোষ সে নাকি নাস্তিক ঈশ্বর বিশ্বাসহীন। সো হোয়াট? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে তার ঈশ্বরে আস্থা নেই, তাহলে ইসলামীবাদীরা আইন নিজের হাতে তুলে নেবে? তাকে চাপতির আঘাতে প্রকাশ্যে হত্যা করা কী ইসলাম ও কোরআন সম্মত বিধান! দেশে কি আইনের শাসন নেই- সরকার নেই? সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংগঠন আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন- আদালতের আশ্রয় নিতে পারতেন, এই অভিযোগ করে যে অভিজিত ধর্মের, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছে।
কিন্তু সংক্ষুব্ধরা সে পথে হাটে না, নিজ হাতে চাপাতি তুলে নিয়ে দেশের একজন প্রথিতযশা মুক্তচিন্তার ধারক ও অমিত সম্ভাবনাময় লেখকের জীবনাসন করেছেন। আমি প্রশ্ন তুলতে চাই এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে কতজন নব্যমুসলিমের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে? বিশ্বে কোটি কোটি লোক ইসলামের পরিমণ্ডলের বাইরে আছেন, হয় তারা ভিন্নধর্মী বা নিরীশ্বরবাদী, তাদের হত্যা করা বা তাদের বিরুদ্ধে জেহাদে যাওয়া কী ইসলামী মৌলবাদীদের ফরজ?
বিশিষ্ট পদার্থবিদ, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ পল কুর্জ অ্যাগনস্টিক অর্থাৎ গড আছেন কি না তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। এই মতাদর্শের কারণে কী মৌলবাদীরা তাকে হত্যা করবেন? রিচার্ড ডকিন্স একজন বিশ্বসেরা জীববিজ্ঞানী- কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, এ কারণে খ্রিশ্চিয়ান বা ইসলামী মৌলবাদীরা এই শ্রেষ্ঠ জীববিজ্ঞানীকে হত্যায় অগ্রসর হবেন? স্যাম হ্যারিস বিশিষ্ট আমেরিকান চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও লেখক কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠিত ধর্মে আস্থা নেই- এ কারণে তাকে হত্যা করতে হবে? ভেক্টর জে স্ট্রেঙ্গার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যেতির্বিজ্ঞানের ইমারিটাস অধ্যাপক। তার কালজয়ী লেখা `God : The Failed
Hypothesis – How Science shows that God does not exist’- এ বই লেখার কারণে তাকে হত্যার কথা ভাবতে হবে? এরকম অসংখ্য বুদ্ধিদীপ্ত নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী লেখক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী রয়েছেন- তাদের বৈপরিত্যময় চিন্তাধারার জন্য হত্যা করতে হবে? তাহলে গ্যালিলিওর বিচার পরিচালনা পর্ষদ আর কী দোষ করেছিল!
যে কোনো সাধারণ বহিরাগত ভ্রমণকারীর কাছে দক্ষিণ এশিয়াকে মনে হবে বেশ বৈচিত্র্যময়- ভৌগলিকভাবে, আবহাওয়ার দিক থেকেও, এবং জনগণ সম্বন্ধেও, কিন্তু একজন একনিষ্ঠ ও নিবিড় দর্শক লক্ষ্য করবেন যে এই আপাত বৈচিত্র্যের মধ্যে নিহিত আছে এক ধরনের ঐক্য বা সমঝোতা অর্থাৎ সমতান। মহান কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনের সাধনা ও স্বপ্ন ছিল এই এ অঞ্চলের “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” অনুসন্ধান করা এবং সত্য আবিস্কার করা… এর কৃষ্টয় (কৃষ্টিক) ঐক্য বা এখনকার পরিভাষায় সাংস্কৃতিক একত্ব, ঐতিহাসিক সাদৃশ্য এবং ঐতিহ্যিক একত্ব।
রবীন্দ্রনাথ সত্যিই এ ধরনের কোনো সূত্র আবিস্কার করেছিলেন কি না যার প্রয়োগে এই আপাতপ্রতীয়মান বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্ব সঞ্চার করা সম্ভব- এ বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা এক মত নাও হতে পারেন। মতপার্থক্য প্রদর্শন করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল যে দক্ষিণ এশিয় জনগণ প্রথমে পরস্পর কলহে লিপ্ত হয়, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাতে প্রত্যেক গোষ্ঠীর সুসংবদ্ধ সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ক্ষমতার পীঠস্থানসমূহের ধ্বংস সাধন করা যায়। এর একটি উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের ক্ষমতার দূর্গ চূর্ণ করে স্ব স্ব কৃষ্টিক-আধ্যাত্মিক-ধর্মীয় সার্বভৌমত্ব বা আধিপত্য পরাজিতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। কিন্তু তাদের এই আধিপাত্যবাদ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত জনগণকে আত্মীকরণ বা গেলাতে ব্যর্থ হয়।
বিশেষ করে পরাভূত জনতা যদি সংস্কৃতিবান, জ্ঞানবান এবং সাহিত্য-শিল্প-রুচিশীল-সৃষ্টিশীল কর্মের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তাই আগ্রাসী বা অধিকারী আগন্তুক গোষ্ঠী যদি উল্লিখিত বিষয়াদিতে পশ্চাদগামী হয় কিঞ্চিদধিক, তাহলে এই আগ্রাসী গোষ্ঠী পরাজিতের সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে। অনেক সময় গ্রহণ করে স্থানিক সংস্কৃতি ও ইতিহাস, নিজেদের সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক-ঐতিহ্যিক অহমিকা বোধ সত্ত্বেও, বিশেষ করে আগন্তুক জন যদি সংখ্যায় পরাজিত জনের তুলনায় কম হয়। এই ক্রান্তি লগ্নেই শুরু হয় অন্তর্মিলনের প্রক্রিয়া আর এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লেষণের মধ্যদিয়ে আবির্ভূত হয় নতুন জন ও সমাজ- জন্ম নেয় একটি নতুন মিশ্র সভ্যতা- যার রয়েছে ইতস্ততমুখী বৈচিত্র্যময় প্রসার এবং সৃষ্টিশীলতা। একটি নতুন ঐতিহ্যের সৃষ্টি হতে থাকে পুরানো ঐতিহ্য-পুঞ্জের ওপর।
বিশ্বকবির মতে এটিই হলো দক্ষিণ এশিয় জনগণের বৈশিষ্ট্য আর এর মধ্যেই তারা খুঁজে পায় ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্ব’ এবং অনুসন্ধান করে কীভাবে এই শত বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্রে বসবাস করা যায়।
আমি শুরু করেছি মৌলবাদ শব্দটি দিয়ে। সাধারণত শব্দটি ধর্মের সাথে ওতোপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত― আমরা অহরহ বলে থাকি হিন্দু মৌলবাদ, খ্রিষ্টিয় মৌলবাদ, ইসলামী মৌলবাদ এমন কি বৌদ্ধ মৌলবাদ। পণ্ডিতজনের মতে মৌলবাদ ল্যাটিন ক্রিয়াপদ থেকে উদ্ভুত- যার অর্থ প্রতিষ্ঠা করা, বের বা অবিস্কার করা বা সুনিশ্চিত করা। এর সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ধর্মীয় অতিরিক্ত গূঢ়ার্থ বা দ্যোতনা যা নির্দেশ করে অবিচ্ছিন্ন সংযুক্ত এক সেট অবিচলিত অপরিবর্তনীয় বিশ্বাসের প্রতি। ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবণতা রয়েছে কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিশেষ ধর্মশাস্ত্রীয় বিধিমালা, অন্ধবিশ্বাস বা ভাবাদর্শ ইত্যাদি ধারণার প্রতি যাকে বলা যায় কঠিন লিটারেলিজম গভীরভাবে অনুগত থাকা। এসব প্রতিষ্ঠিত মৌলবাদে বৈচিত্র্যময় বা ভিন্নধর্মী মতবাদে বা বহুত্ববাদের কোন স্থান নেই।
ঘটনা বা বিষয়ের উপর নির্ভর করে মৌলবাদ নিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যময় না হয়ে, মর্যাদাহানিকর হতে পারে, ঠিক যেমন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতিবিদরা নিজেদের ‘দক্ষিণপন্থী বা ‘বামপন্থী’ নামে অভিহিত করে থাকেন, তবে তা অনেক সময় ঋণাত্মক দ্যোতনায় বা অর্থে পর্যবসিত হতে পারে।
Rajiv Gandhi institute for future administrators and
development studies October 23,
2012 এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অক্টোবর ২৩, ২০১২ আয়তনে মৌলবাদের অবতারণা এভাবে করা হয়েছে: কোনো ধর্মের তত্ত্বগত মতবাদের প্রতি আদর্শগতভাবে সংযুক্ত ও অনুসরণকে আমরা ‘মৌলবাদ’ নামে আখ্যায়িত করতে পারি; আর যারা এই নীতিমালা অনুসরণ করবে না তাদেরকে ঘৃণা বা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা বাঞ্ছনীয়। মৌলবাদীরা আধুনিকতায় বিশ্বাস করে না- কেবল ধর্মীয় শাস্ত্রে যা উল্লিখিত হয়েছে তাকে অতীত গৌরব হিসেবে তুলে ধরতে চায়- তারা যুক্তি ভিত্তিক শৃঙ্খলা শাস্ত্রকে বা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে বিশ্বাস করতে চায় না বরং এর তীব্র সমালোচনা করে আর অতীতের গৌরবকে বড় করে দেখে।
এই মৌলবাদী তত্ত্ব সেক্যুলারিজম বা লোকায়ত বিশ্বাস বিরোধী, কারণ মৌলবাদ সঙ্কীর্ণ ও বিশেষ তত্ত্বীয় আদর্শের অনুসারী। এই মতাদর্শ বা গোড়ামি ও সঙ্কীর্ণতার উদ্ভব ঘটে ব্রিটিশ পর্বকালে। সে সময় এই সঙ্কীর্ণবাদীরা সংগঠিত হয় হিন্দু মহসভা, মুসলিম লীগের ছত্রতলে। মুসলিম লীগ প্রচারণা শুরু করে যে ভারতীয় মুসলমানরা একটি হিন্দু বা শিখদের থেকে আলাদা জাতি বা নেশন। তারা মুসলমান ও অমুসলিম জনগণ পৃথক জাতি হিসেবে গণ্য করে দ্বিজাতি তত্ত্বের অবতারণা করে। মুসলিমের এই আন্দোলন ও তৎকালীন ব্রিটিশ নীতির কারণে পাকিস্তানের উদ্ভব ঘটে। পাকিস্তান সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ বা নীতিমালা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেক্যুলারিজম পরিত্যক্ত হয়। অবশ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে অতীতের মুসলিম লীগের ধ্যান ধারণা পরিত্যক্ত হয় এবং সেক্যুলারিজম ও অহিংসতা রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়।
সেক্যুলারিজম: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে
গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয় জনগণ নির্বাচিত একটি লোক সভার মাধ্যমে পার্লামেন্টারি কেবিনেট বা মন্ত্রিসভার মাধ্যমে। আমরা সেক্যুলারিজম বলতে কি বুঝি সংক্ষেপে তা উল্লেখ করা যাক। ‘সেক্যুলারিজম’ এর প্রকৃত অর্থ ‘ধর্মের সাথে সংশ্রবহীনতা’। সরকারী শাসন-প্রশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এর সঠিক অর্থ হলো- সরকারের সাথে ধর্মের সম্পর্কহীনতা। রাষ্ট্র একটি লোকায়িত ব্যবস্থা বা সিসটেম এর কোনো ‘রিলিজিয়ন’ বা ‘ধর্ম’ থাকতে পারে না। সেক্যুলারিজম পদটি ব্রিটিশ লেখক জর্জ হোলিয়ক প্রথম ব্যবহার করেন ১৮৫১ সালে, যদিও সেক্যুলারিজমের ধারণা বা ভাব বেশ পুরাতন। এর সাথে জড়িয়ে আছে ইউরোপে রেনেসাঁ আন্দোলন- যখন ইউরোপীয় সমাজ লোকায়ত বিষয়সমূহে চার্চের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে আসে এবং সামাজিক ও লোকায়ত ব্যাপারে মানবতাবাদকে মুখ্য মতবাদ বা ডক্ট্রিন রূপে গ্রহণ করে।
এটি অবশ্য আমাদের বুঝতে হবে যে সেক্যুলারিজমে’র পেছনে যে ধারণা বিদ্যমান তা হলো সেক্যুলারিজম হলো ধর্ম থেকে স্বাধীন বা উদাসীন- সেই অর্থে আমাদের বাংলা শব্দ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যথার্থ ও যথাযথ। আমাদের একথাও মনে রাখতে হবে সেক্যুলারিজম ধর্ম বিরুদ্ধ নয়। সেই অর্থে সেক্যুলারিজম নাস্তিকতা থেকে একবারেই স্বতন্ত্র; নাস্তিকতা বা ‘এথিইজম’র সুষ্পষ্ট মুখ্য মতবাদ বা ডক্ট্রিন হলো এই তত্ত্ব কোনো ধরনের ধর্ম বা ঈশ্বর বা কোনো ধরণের সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে না। সেক্যুলারিজম দুটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত বা সৃষ্ট, প্রথমতঃ বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব থাকতে পারে অর্থাৎ ধর্মের বহুত্বতা বা প্রকার ভেদ রয়েছে যেমন- সনাতন বা হিন্দু ধর্ম, খ্রিষ্ট ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম বা প্রকৃতি ধর্ম এবং দ্বিতীয়তঃ সরকারের সকল কার্যক্রম-কর্মসূচিসহ সমগ্র তৎপরতা অবশ্যই হবে ধর্ম নিরপেক্ষ।
এবার আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে সেক্যুলারিজমকে দেখতে ও বুঝতে চাই। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, তবে ১০-১২% অমুসলমান রয়েছে যার প্রধান অংশ হিন্দু। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ ও ক্রিশ্চিয়ান। এখানকার মুসলিম অধিবাসীরা ধর্মপ্রাণ এবং সুফিমতবাদ দ্বারা প্রভাবিত, আর সে কারণে এরা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মতো ওহাবী মতবাদ দ্বারা আচ্ছন্ন এবং উগপন্থী নয়, বরং শান্তিপ্রিয়।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ একটি বহুধর্মীয় দেশ যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং অধিবাসীরা সহ মর্মিতা ও শান্তির সাথে যুগের পর যুগ পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। তবে চলমান সেক্যুলারিজমের ধারণাটি আধুনিকতার ফসল, বিশেষ করে উপমহাদেশটি যখন ব্রিটিশ শাসনের সংস্পর্শে আসে। অবশ্য, ব্রিটিশ শাসনের আগে পরিস্থিতি এমনটি ছিল না- সেক্যুলারিজম, আজ যেমনটি বুঝি সেরকম ধারণার অস্তিত্ব ছিল না, বরং সে কালে রাজনীতি ও ধর্মকে বিবেচনা করা হতো পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম- এই ছিল সাধারণ নীতি। পারস্পরিক ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নির্ভর করতো সময় ও শাসকের ওপর। উদাহরণ হিসেবে ভারতে মোগল শাসনের কথা উল্লেখ করা যায়। আকবরের সময় ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল উৎকৃষ্টতম। আবার ঔরঙ্গজেবের শাসনামলে হিন্দুদের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না।
ব্রিটিশদের আগমনের সাথে ভারত, বিশেষ করে বাঙালী সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রবেশ করে আধুনিকতার যুগে- তারা সংস্পর্শে আসে পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন ও চিন্তাধারার সাথে। জন্ম নেয় বাঙালীর রেনেসা- বহু বাঙালী মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে। সেক্যুলারিজম এরই ফসল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন কালে বাঙালী ও ভারতীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দ সেক্যুলারিজমের ধারণাকে সম্যকভাবে আত্মস্থ করতে সমর্থ হয়, বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে। তাই স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্রে সেক্যুলারিজমের স্থান ও গুরুত্ব প্রতিফলিত হয় যথাযথভাবে। বাংলাদেশর গঠনতন্ত্রও সেক্যুলার ও উদার গণতান্ত্রিক। জেনারেল এরশাদ কর্তৃক বাংলাদেশের গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অবক্ষেপন একটি অপেরন মাত্র, স্বাভাবিক নয় ।
আমরা বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল বা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছি। গত কয়েক বছরে উত্থান ঘটেছে সশস্ত্র মৌলবাদের― যাদের এক কথায় বলা যায় জঙ্গীবাদের অভ্যুদয়, গোষ্ঠী হিসেবে আবার সংগঠন হিসেবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত ও শিবিরের অস্তিত্ব সকলের জানা সংগঠন হিসেবে রয়েছে। ‘বাংলা ভাই’, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা’ (যারা দাবি করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার আশীর্বাদপুষ্ট সংগঠন হিসেবে), আইএস বা ‘ইসলামিক স্টেট’র বাংলাদেশে সাংগাঠনিক অবস্থান স্পষ্ট নয়, যদিও এর অস্তিত্ব সরকার অস্বীকার করে আসছে। এছাড়া রয়েছে হরকাতুল জেহাদ, হাফেজ্জী হুজুরের দল, তেতুঁল হুজুরের গোষ্ঠী। তাছাড়া ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৈরি বিদেশী জঙ্গী গোষ্ঠীর অনেক দল বাংলাদেশে তৎপরতা চালায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে, আমরা কয়েকটির নাম উল্লেখ করছি মাত্রঃ
১. আল-কায়েদা (বিশ্ব জুড়ে তৎপরতা)
২. আনসার আল ইসলাম (ইরাক ভিত্তিক)
৩. আর্মড ইসলামিক গ্রুপ (আলজেরিয়া)
৪. হারকাতুল মুজাহেদিন (পাকিস্তান― কর্মতৎপরতা উপমহাদেশ ব্যাপী)
৫. জয়স-এ-মহম্মদ (কাশ্মীর ভিত্তিক)
৬. লস্করে তৈয়বা (পাকিস্তান ও কাশ্মীর)
৭. লস্করে ঝংভি (পাকিস্তান- কর্মতৎপরতা উপমহাদেশ ব্যাপী) ইত্যাদি…
উল্লিখিত তথ্যাবলি থেকে এটি স্বতঃস্পষ্ট যে জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতায় সশস্ত্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর কর্মতৎপরতা প্রবলভাবে বেড়েছে। এরা স্থানীয়ভাবে ‘হত্যা কোষ’ গঠন করে তথাকথিত নাস্তিক, মুক্তচিন্তার অধিকারী ও তথাকথিত ব্লগারদের তালিকা তৈরি করে অভিলক্ষ্য ব্যক্তিদের নিশ্চিহ্ন করায় লিপ্ত। এই সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনগুলো ৮০ জন ব্যক্তির তালিকা করেছে যাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে। ইতোমধ্যেই তালিকার কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে- ড. অভিজিৎ রায়, ওয়াশেকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নিলাদ্রী নিলয় চ্যাটার্জী প্রমুখকে ইতোমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে; জাগৃতি প্রকাশনার মালিক দীপনকে হত্যা ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনার মালিক টুটুল ও কর্মকর্তা রনদীপম বোসসহ কয়েকজনকে গুরুতরভাবে আহত করে। ড. অভিজিৎ রায়ের সহধর্মিনী বন্যাকেও গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে অভিজিতের সাথে গুরুতরভাবে ক্ষতবিক্ষত করে মৌলবাদী জঙ্গীরা। এই হত্যকারীরা এখনও পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই ব্যর্থতা আমাদের আরও আতঙ্কিত করে।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘু
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা পরস্পর অন্বিষ্ট নিবিড়ভাবে। বিষয়টিতে বিস্তারে যাবার আগে সাম্প্রদায়িকতা কী তার একটা সংজ্ঞা দাড় করানোর চেষ্টা করা যাক। এক সময় আমার এক প্রথিতযশা ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কীভাবে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সাম্প্রদায়িক সংঘাত’ পদ- দুটি সংজ্ঞায়িত করব। আমি বলেছিলাম এটি একটি কষ্টসাধ্য বিষয়, বিশেষ করে এটি একটি সম্প্রদায় অন্য আর একটি সম্প্রদায়কে কীভাবে দেখছে সেই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। যদি কোনো একটি সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক মর্যাদা, সামাজিক উন্নয়ন এবং চাকুরীর নিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করে- তাদের এই পদক্ষেপকে আমি কোনভাবেই সাম্প্রদায়িক বা সাম্প্রদায়িক অনুভূতি নামে অভিহিত করব না; যা আমি বলতে চাই তা হলো সাম্প্রদায়িক অনুভূতি আর সাম্প্রদায়িকতা সমার্থক নয়।
কিন্তু নিষ্ঠুর বা আগ্রাসী কোনো সম্প্রদায় যদি অন্য কোনো সম্প্রদায়কে যে আকারেই হোক না কেন আঘাত বা ক্ষতিগ্রস্ত করে তাহলে এই কাজকে সাম্প্রদায়িকতা বলা যেতে পারে। এই আগ্রাসী কাজ হত্যা, যৌন হয়রানী বা ধর্ষণ, লুটপাট, সম্পদ, সম্পত্তি, বাসস্থান ধ্বংস এমন কি অশালীন ভাষায় মৌখিক গালাগাল, অসম্মান জনক ব্যবহার ইত্যাদির দিকে সম্প্রদায়কে ধাবিত করতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা এক সম্প্রদায় কর্তৃক অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি প্রকাশ পেতে পারে যৌথভাবে বা ব্যষ্টিস্তরেও।
আমি নিশ্চিত নই ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলি রেকর্ড করা হয়েছে কি না, আর হলেও তা কীভাবে রয়েছে। কোনো নগরীর ধ্বংস সাধন বা সম্পদ লুণ্ঠন, অধিবাসীদের হত্যা বা নারীদের যৌন হয়রানি, শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণ প্রভৃতি ঘটনাবলীকে আমি কোনভাবেই সাম্প্রদায়িকতা বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নামে অভিহিত করব না। আগ্রাসী সেনাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো নগরটির ধ্বংসসাধন ও ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ ও অর্থ লুণ্ঠন। আগ্রাসী সেনাদের এ ধরণের কার্যাবলি ঐতিহাসিক আচরণ মাত্র।
প্রকৃত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাক্ষ্য আমরা পাই ব্রিটিশ যুগে। ১৯৪৬ সালের বিশাল কলকাতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যার পরপরই সংঘটিত বিহার ও নোয়াখালি দাঙ্গা উপমহাদেশের মানুষের স্মৃতিতে ভাস্বর। আমরা উপমহাদেশের ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিভৎসতা দেখেছি যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে নিজেদের ভিটেমাটি সম্পদ-সম্পত্তি ছেড়ে পরদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর পরেও ২০০১ সালে সাম্প্রদায়িকতার বিভৎস বর্হিপ্রকাশ আমরা আবার দেখলাম যখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ‘বিজয়ী সৈন্যরা’ নির্বাচন পরবর্তীকালে বিজয় উৎসব পালন করল নিরীহ সংখ্যালঘুদের ওপর হিংস্রতা প্রদর্শনের মাধ্যমে। সময় এবং স্থানের অভাবের কারণে আমি এই হিংস্রতা-লুণ্ঠনের বিশদ বিবরণ দেয়া থেকে বিরত রইলাম। আমি কেবল নিপীড়ন ও অত্যাচারের কতিপয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছি-
ক. সামাজিক মর্যাদা, ধনী-দরিদ্র, বয়স এবং নারী-পুরুষ নির্বিচারে সংখ্যালঘু মানুষেরা সাধারণভাবে চরম নিষ্ঠুতায় অত্যাচারিত হয়েছে। নিকট অতীতে এত বিপুল সংখ্যক অসহায় সাধারণ মানুষ, যারা সবাই নিম্ন আয়ের অন্তর্ভুক্ত যেমন- কৃষক, ভূমিহীন শ্রমিক, দিন মজুর, ছোট দোকানদার, জেলে সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়নি। এ ধরণের ঘটনার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের দাবী রাখে। এমন কি ৮-৯ বছরের সংখ্যালঘু কিশোরীরাও বা ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধারাও যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।
খ. এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে কেন্দ্রীয় উচ্চতম প্রশাসনই কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, এমন কি স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ দুঃখজনতভাবে সংখালঘুদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সহ বড় রাজনৈতিক দলগুলো এবং জেনারেল এরশাদ পরিচালিত জাতীয় পার্টি সংখ্যালঘু জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায়নি তাদের দুঃসময়ে। এটি অবশ্যই এসব দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতা। কেবল বাম ঘরানার কতিপয় ক্ষুদ্র দল যেমন সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ প্রমুখ সংখ্যালঘু জনগণের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু প্রশাসনের ওপর তাদের প্রভাব সামান্যই, যা প্রশাসনকে প্রভাবিত করবে এই নিষ্ঠুরতা দমনে।
গ. এবারের সহিংসতার আর একটি বৈশিষ্ট্য আমাকে অবাক করে, তাহলো সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া- সাধারণ মানুষ কেন জানি সংখ্যালঘুদের পাশে সংগঠিতভাবে দাঁড়ায়নি, যা পূর্ব বাংলার মানুষ অতীতে করেছে। যেমন ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় পূর্ববাংলার মানুষ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সংখ্যালঘুদের পাশে এসে দাঁড়ায় ধনাত্মক শ্লোগান নিয়ে “বাঙালী রুখিয়া দাঁড়াও।”
ঘ. কেবল মাত্র কতিপয় সিভিল সোসাইটি নিজেদের সংগঠিত করে অসহায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে এসে দাঁড়ায়, এদের সাথে যুক্ত হয়েছিল কতিপয় ‘এনজিও’ এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সমূহ বিস্তীর্ণভাবে ঘুরেছেন সীমিত সাহায্য এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত আক্রমণ রুখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। হিন্দুদের একমাত্র অপরাধ ছিল যে তারা নাকি নৌকায় ভোট দিয়েছিল।
সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ণের নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের জন্য আমি নীচে একটি সারণী উত্থাপন করছি (১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর, ২০০১)
Nature of |
Nature of |
Number |
Killing |
Male/Female/chidren |
27 |
Rape |
Female |
269 |
Rape |
Children |
1 |
Physical |
Male |
2,619 |
Physical torture |
Female |
1,430 |
Kidnapping |
Male & |
100 |
Forcible Evection from home |
Family |
38,500 |
Rampage |
Church, |
155 |
Setting of |
Business |
4,551 |
এই পটভূমিতে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আয়তন ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে আর এর স্থান ক্রমাগ্রসরভাবে উগ্রপন্থী মৌলবাদীরা দখল করছে। এর ফলে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার সঙ্কট প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার আবেদন মুক্তচিন্তার মানুষদের প্রতি বিশেষ করে জাগ্রত তরুণ সমাজের প্রতি, ছাত্রসমাজের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষকদের প্রতি ‘আসুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহাসিকতাকে ধারণ করে মুক্তবুদ্ধির বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে আর একবার ঝাঁপিয়ে পরি- জয় আমাদের অনিবার্য।’ কবিগুরুর সোনার বাংলা আমরা গড়বই- যে বাংলা হবে দেশবন্ধু, ফজলুল হক, মুজিব, তাজউদ্দিন আর জীবনানন্দের বাংলা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)