চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কেনো অস্ত্র হাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছিল বীর বাঙালি

দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পরে এই ডিসেম্বর মাসেই এসেছিল প্রাণের স্বাধীনতার বিজয় লগ্ন। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে সোনালী অর্জন, বাঙালির গৌরবের বিশেষয়াত্বনে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও অমূল্য সম্পদ।

সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে, কৃতিত্ব দেখিয়ে মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে যুদ্ধে জয়লাভ করার ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতি হিসেবে সারাবিশ্বে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। এই বাংলা, বাঙালি, বাঙালিত্ব, বাংলার দর্শন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলার সংস্কৃতি যতদিন থাকবে ঠিক ততদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সুফল ভোগ করবে বাংলার জনগণ। তবে এ অর্জনের পিছনে বাঙালি জাতির নিরলস সংগ্রাম, অকুণ্ঠচিত্তে নেতার নির্দেশ পালন, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তেজস্বী আন্দোলন, সর্বোপরি আত্মত্যাগের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতার সূর্যকে নিজেদের আঙিনায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন দেশপ্রেমিক বাঙালিরা তথা মুক্তিযোদ্ধারা।

তবে বৃহৎ এই সংগ্রাম ঠিক কী কারণে বা সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা কী ছিল, তা অনেকেই জানি না নয়তো ভুলে যাই। বঞ্চনা আর শোষনের বেড়াজাল ভাঙতে কয়েকটি বিশেষ দিককে সামনে রেখে তথা মূলমন্ত্রকে উপজীব্য করে বাঙালিরা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন এবং তারই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

প্রথমত: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত আলোয় পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা বাঙালির মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠাকরণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে কারণ সে সময় অধিকাংশের মুখের ভাষা ছিল বাংলা তথাপি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করে বাঙালি জাতির উপর শোষণের ভিত্তি হিসেবে ১ম পদচিহ্ন এঁকে দেন। চেতনা বলতে বোঝায়; ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, এই ভাব হতে পারে ভাষাগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক এবং যে কোন বাধা ছাড়াই সকলেই যেন তাদের ভাব প্রকাশ করার সক্ষমতা দেখাতে পারে এবং রাষ্ট্রের সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, হোক সে বাঙালি কিংবা অবাঙালি।

একমাত্র ধর্মীয় স্বকীয়তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয় এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও অনেকাংশে ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতেই হয়েছিল। বাঙালিরা যেহেতু মুসলিম, নন-মুসলিম পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করত তাই পাকিস্তানি শাসকদের নীতিবিরোধী চিন্তা চেতনার ভয়াবহতা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার জন্যই আলাদা হওয়ার চিন্তা করে থাকে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শোষণ ও নির্যাতন বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে ইন্ধন যোগায়। তাই স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ভাবে শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার জন্য বাঙালিরা পাকিস্তানিদের শোষণ এবং নির্যাতন থেকে সরে আসার চিন্তা করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা তাদের স্বঘোষিত রায় দেয়। কিন্তু হানাদার সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে যুদ্ধের দিকে বাঙালিকে ধাবিত করে।

দ্বিতীয়ত: বাঙালিরা জন্মলগ্ন থেকেই সংগ্রামী, বাঙালিরা শোষণকে ভেঙ্গে গড়ে তোলে শৃঙ্খল কাঠামো। কাজেই সে বাঙালিরা কোনভাবেই সামরিক সরকার তথা মিলিটারি সরকারের শাসনামল কিংবা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া কোন রাষ্ট্র প্রধানকে মেনে নিতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই অবাঙালি শাসকেরা বাঙালিদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করায় বাঙালিরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সরকারের দাবি জানায় শাসকগোষ্ঠীর নিকট। বাঙালির দাবি আদায়ের জন্য প্রস্তাবিত ১১ দফা ও ৬ দফায় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার দাবি জানানো হয়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীকে বারংবার অনুরোধ করেন। কিন্তু হায়েনা শাসক গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের অনুগত লেজুড়বৃত্তি প্রকৃতির মানুষদের শাসনভারের দায়িত্ব দেয়, যেখানে গণতন্ত্র সুদূর পরাহত। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি খুবই সুসংহত হয়, কারণ সে সময়ে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ সহ সমমনা দলগুলোর সাথে একত্র হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক মুক্তির জন্য শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলে।

তৃতীয়ত: অর্থনৈতিক সমতা ও স্বাধীনতা তথা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বাঙালিরা ১১ দফা ও ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৭০ সনের নির্বাচনের দাবি আদায়ের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সমাজতন্ত্রের চেতনাও ঐ সময়টায় সকল দলকে একত্রিতকরণের ক্ষেত্রে মুখ্য উদ্যোগ হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানেও রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সবটুকুই খরচ করা হত পশ্চিম পাকিস্তানিদের পিছনে। এক জরিপে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে ১৯৪৯-৫০ এ ১৭ শতাংশ, ১৯৫৯-৬০ এ ৩২ শতাংশ এবং ১৯৬৯-৭০ এ ৬১ শতাংশ বেশি ছিল। নির্মম বৈষম্যের এ মাত্রা সম্বন্ধে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সেভাবেই জানেন না, শুধু জানে স্বাধীনতা দরকার ছিল, আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু কতটা প্রকট পর্যায়ে চলে গিয়েছিল শোষণ ও বঞ্চনার মাত্রা তা পরিসংখ্যান-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

চতুর্থত: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং আন্দোলনে সকল ধর্মের মানুষ বাংলার মুক্তির জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাই তো দলমত এবং ধর্ম বিবেচনা না করে সকল ধর্মের মানুষ দেশের তরে জীবন দিয়েছিল, দেশকে করেছিল শত্রুমুক্ত। তারই ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের অন্যতম প্রধান নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কারণ এই মুক্ত বাংলা সকল মানুষের জন্য সেখানে ধর্ম, পেশা, বর্ণ, গোত্র বিবেচ্য বিষয় নহে। চেতনা বলতে ইহাই বোঝায় যেখানে একে অন্যের প্রতি যথাযথ সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শন করবে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা সকলের জন্য একই থাকবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে গাঁথুনি হিসেবে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে আমরা একটি সুসজ্জিত বাহিনীকে হারাতে সক্ষম হয়েছি।

পরবর্তীতে দেশগড়ার কাজেও মুক্তিযোদ্ধারা এইসব মূলমন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাজাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরাজিত পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা দেশি বিদেশি যোগসূত্রের মাধ্যমে বারংবার বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাতে চেয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে, কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা আছে হয়তো কিন্তু তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা আমাদেরই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের দায়ও কোন অংশেই কম নয়, নতুন প্রজন্মের দায় নিতে হবে দেশগড়ার কাজে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, এখন সেই দেশটিকে বিনির্মাণের দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের। যদি বর্তমান প্রজন্ম এই যুদ্ধে সফল হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)