স্বাধীনতা প্রত্যয়টি অত্যন্ত ভাবাবেগের, মর্যাদার ও অনুশীলনের। বাঙালি জাতির নিকট স্বাধীনতার মর্মার্থ আরো অর্থপূর্ণ, কারণ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার সুবাতাসের জন্য বাঙালি জাতির ইতিহাস জগদ্বিখ্যাত, অন্যদের জন্য অনুকরণীয় ও দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমাদের পূর্বপুরুষদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারছি বিশ্বব্যাপী। পাশাপাশি এটিও সত্য, একটি মহল সর্বদাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিয়ে কুৎসা রটাতে ব্যস্ত। কাজেই নতুন প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বর্ণনা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘোষণার পাশাপাশি ইপিআরের মাধ্যমে সারাদেশে ঘোষণাপত্রটি প্রচারের জন্য বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নেতাকর্মীরা স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের উজ্জ্বলতাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে থাকেন। দূরদর্শী ব্যক্তিত্বের কারণে বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ ব্যতীত স্বাধীনতার সচিত্র প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালিকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে থাকেন এবং যথাসময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। পাশাপাশি ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে সম্যক নির্দেশনা প্রদান করেন।
স্বাধীনতার মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র ৭ কোটি বাঙালির উপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ ঘোষণা করতো, তবে আমরা সে যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারতাম। কিন্তু তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করলো। তখন বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম, বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারে আত্নসচেতন হতে হবে। দেশবাসী জানেন, একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা হাওয়ার উপর থেকে হয় নাই। যদি কোনো নির্দেশ না থাকতো তবে কেমন করে একই সময়ে একই মুহূর্তে সব জায়গায় সংগ্রাম শুরু হলো?” বিচক্ষণ নেতৃত্ব গুণের কারণে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে বার্তা প্রেরণ করে জানিয়েছিলেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার ফলশ্রুতিতে বাংলার মুক্তিকামী জনগণ সমর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো।
বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক বাঙালি জাতি বিজয় নিশ্চিত করেই ঘরে ফেরে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে বাংলাদেশের পবিত্র রক্ষাকবচ সংবিধান প্রবর্তনের তারিখের মধ্যে প্রণীত বলিয়া বিবেচিত সকল আইন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা যে কোন আইন বা কৃত সকল কার্য এতদ্দারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং তাহা আইনানুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল। কার্যত সংবিধানের ভাষ্যানুযায়ী, ২৬ মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয় কারণ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই বাঙালি জাতি ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত বার্তা পায়।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে থাকে। স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত মুজিবনগর সরকারের ভাষ্য হচ্ছে: বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান (স্বাধীন সার্বভৌম গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর বাংলাদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯৭১)। স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত এর থেকে অকাট্য প্রমাণের আর প্রয়োজন পরে না। কারণ, মুজিবনগর সরকারই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। তবুও একদল স্বার্থান্বেষী মহল সর্বদা তটস্থ থাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ভিন্নরূপে বিকৃত করে প্রচার করার জন্য।
স্বার্থান্বেষী মহল যুদ্ধের বিভীষিকার সময়ে বিশ্বখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করতেও দ্বিধা করে না। বর্হিবিশ্বের স্বনামধন্য পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত বেশ কিছু পত্রিকার নিউজের শিরোনামের যাচাইয়ের মাধ্যমেই সহজেই প্রতীয়মান হয়, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসে উল্লেখ করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের সংবাদে উল্লেখ করে, শেখ মুজিব কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ টাইম পত্রিকায় শীর্ষ নিউজ পরিবেশন করে বাংলাদেশ নিয়ে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
নিউজউইক ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়; শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ২৮ জুলাই ১৯৭১ মার্কিন সিনেটরের কংগ্রেশনাল রেকর্ড এ উল্লেখ রয়েছে-শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য উৎস থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে অকাট্য দলিল থাকা স্বত্ত্বেও যারা স্বাধীনতা তথা মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসেকে বিকৃত করার চেষ্টা করে তাদের প্রতি ধিক্কার এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
সবশেষ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এবং বিচারপতি এম মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২১ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় প্রদান করেন। এছাড়া দেশি বিদেশী গবেষণাগ্রন্থে ও দালিলিক প্রমাণে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা ইতিহাস স্বীকৃত। ছোট এ নিবন্ধটিতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক প্রমাণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।
এতদস্বত্ত্বেও একটি বিশেষ মহল স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্তে মুখরোচক আলোচনা করে থাকেন যা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। এই নিবন্ধে বেশ কয়েকটি যথোক্তি প্রমাণের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিকতাকে যুৎসই প্রমাণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। সমগ্র বাঙালি জাতির আবেগের জায়গা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, সেই ইতিহাসের বিকৃতি স্বাধীনতা প্রেমীরা কখনোই মেনে নিতে পারে না। কাজেই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইতিহাস বিকৃতিকারীদের প্রতিরোধ করতে হবে। এখনই সময় নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসকে পৌঁছিয়ে দেয়া, যার মাধ্যমে দেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন ইতিহাস সম্বন্ধে ছেলেমেয়েরা সঠিক তথ্য জেনে দেশ গড়ার কাজে আত্নপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)