চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাংলাদেশের সুনাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী “প্রিয়া সাহা চক্র”

ধর্মের নামে ‘নির্যাতিত’ হয়েছেন – এমন বিভিন্ন দেশের মানুষদের নিয়ে গঠিত প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গত বুধবার নিজের ওভাল অফিসে দেখা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিভিন্ন দেশে ‘নিপীড়নের’ শিকার হওয়া লোকজনের পক্ষে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন ওই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। প্রতিনিধি দলে চীন, তুরস্ক, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমারসহ ১৭টি দেশের নির্যাতিত ব্যক্তিরা ছিলেন। সেখানে “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের” সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া রানী সাহা (প্রিয়া সাহা) বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর “মুসলিম মৌলবাদীদের” করা নিপীড়নের অভিযোগ তুলে এর থেকে উত্তরণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহযোগিতা কামনা করেন।

প্রিয়া সাহা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথোপোকথনের দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণঃ

প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, প্রিয়া সাহা বলেছেন বাংলাদেশে ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লক্ষ) হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রীস্টান “disappear” বা “উধাও” হয়েছে বা “নিখোঁজ” রয়েছে! প্রিয়া সাহা কিন্তু ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লক্ষ) হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানের বাংলাদেশ থেকে “deportation” বা “বিতাড়ণ”-এর অভিযোগ তুলেননি। তিনি আরও অনেক বড় অভিযোগ তুলেছেন। বাংলাদেশের ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লক্ষ) সংখ্যালঘুদের “উধাও” বা “নিখোঁজ” হয়ে যাওয়া মানে তাদের কোন নাম নিশানা পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের কোন ঠিকানা জানা যাচ্ছে না। অর্থাৎ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এ কি করে সম্ভব? এভাবে ৩৭ মিলিয়ন (তিন কোটি ৭০ লক্ষ) সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশে নিশ্চিহ্ন করা হল, কিন্তু কেউ কিছু জানলো না? প্রিয়া সাহার তথ্য অনুযায়ী এখনও বাংলাদেশে ১৮ মিলিয়ন (১ কোটি ৭০ লক্ষ) সংখ্যালঘু জনসংখ্যা রয়েছে, সেকুলার সুধী সমাজ রয়েছে। তারাও কোন প্রতিবাদ করলো না? টু শব্দটি করলো না?

এদিকে অনলাইন পোর্টাল আমাদের সময়.কম-এর কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের” সভাপতি রানা দাশগুপ্ত তার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার করা অভিযোগের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। জনাব রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, “প্রিয়া সাহা যা বলেছেন, সেগুলো নতুন কোনো বক্তব্য নয়। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিলো ২৯.০৭ শতাংশ। যা ১৯৭০ সালে কমে হয় ১৯.২০ শতাংশ। এই সংখ্যাও কমে ২০১১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের আরেক জরিপে জানা যায় ০৯.০৭ শতাংশ হয়েছে। তবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নাকি ২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.০৭ শতাংশ। তা হলেও স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিম্নাঙ্কেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। যা খুবই আশঙ্কার বিষয়।” রানা দাশগুপ্ত আরও বলেছেন, “বিভিন্ন সময় হিন্দুদের ঘরবাড়ি জ্বালানো থেকে শুরু করে মন্দিরগুলোতে হামলা হচ্ছেই। এতে করে অনেক হিন্দু পাশের দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।”

আমি হতবাক হচ্ছি, “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের” সভাপতি রানা দাশগুপ্ত কি করে তার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহাকে সমর্থন করতে গিয়ে “ধান ভানতে শিবের গীত” গাইলেন তা দেখে! ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সালের সময়কালে বাংলাদেশ তিনি কোথায় পেলেন আমি জানি না। বাংলাদেশের তো তখন জন্মই হয়নি। তাহলে সেই সময়কালে যদি এই ভারতীয় উপমহাদেশের কোন অঞ্চলে সংখ্যালঘু কোন সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমে যায় তার দায়িত্ব কি বাংলাদেশের ওপর বর্তায়? তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের খড়গে কোন অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমেছে, কোথাও আবার মুসলমান সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমেছে। এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মপূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশের সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা হ্রাসের দায়ভার কি বাংলাদেশকে নিয়ে বসে থাকতে হবে? এ তো যুক্তিহীনতার চূড়ান্ত উদাহরণ!

এখন আসি বাংলাদেশ জন্মের পরবর্তী ইতিহাসে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সেখানে শুধু হিন্দুরাই ছিলো না, ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরাও। আর আজকে আমরা যখন দেখি অনেকেই (সকল সম্প্রদায়ের) বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে বসত গেড়েছেন, তার কারণ কি একটাই? বেশিরভাগই দেশ ছাড়ছেন বিদেশে ভাল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায়, উন্নত জীবন যাপনের আশায়, নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায়। রানা দাশগুপ্ত কি কোন জরিপ দেখাতে পারবেন যেখানে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন একাত্তর পরবর্তী সময়ে যারাই দেশ ছেড়ে গেছেন তারা সকলেই সংখ্যালঘু ছিলেন, এবং তারা বাংলাদেশে নির্যাতিত হওয়ার কারণেই দেশ ছেড়েছেন? পারবেন না। “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের” বক্তৃতা মঞ্চ আর যুক্তির মঞ্চ এক নয়। রানা দাশগুপ্ত বলছেন “deportation” বা “বিতাড়ণ”-এর গল্প, আর এদিকে তার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযোগ করলেন “disappearance” বা “উধাও”/ “নিখোঁজ”এর।

এই “উধাও” বা “নিখোঁজ” নিয়ে কোন কথা উঠলেই আমার বেশ কয়েকটি ষড়যন্ত্রের কথা মনে আসে। “স্মৃতিভ্রষ্ট শিলং সালাহউদ্দিন”, “অর্চনা মগ্ন লুঙ্গী মাজহার” অথবা “শাপলা চত্ত্বর প্রান্তে লাখ লাখ লাশের পাহাড়” – এক একটি চাঞ্চল্যকর “উধাও” আমাদের বহু বিনিদ্র রজনী কাটাতে বাধ্য করেছে। কিন্তু জাতি হতাশ হয়েছে শেষ পর্যন্ত – বিজলি চমকালো বটে তবে বর্ষালো না! এখন “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের” সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার দাবীকৃত বাংলাদেশের ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লক্ষ) সংখ্যালঘুদের “উধাও” ব্যাপারটিও তেমনি একটি ষড়যন্ত্র নয় কি? এই “প্রিয়া সাহা চক্র”কে তাই আমাদের প্রতিহত করতেই হবে।

প্রিয়া সাহা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথোপকথনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলঃ প্রিয়া সাহা বলেছেন বাংলাদেশের ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লক্ষ) সংখ্যালঘুদের “উধাও” হওয়ার ব্যাপারটি সংঘটিত করেছে বাংলাদেশের “মুসলিম মৌলবাদী” দল যাদেরকে পৃষ্টপোষকতা করে আসছে বাংলাদেশের সরকার। যদি অভিযোগ সত্য হয় তাহলে তো ভয়ানক ব্যাপার। বাংলাদেশ সরকারের সাথে কোন গাঁটছড়া বাঁধা মোটেই উচিৎ হবে না “প্রিয়া সাহা চক্রের”। যে সরকার মৌলবাদীদের উস্কানি ও মদদ দেয়, আর যাই হোক সেই সরকারের কোন পর্যায়ে “প্রিয়া সাহা চক্রের” কারো উপস্থিতি কাম্য নয়, সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু “প্রিয়া সাহা চক্র” খুব চালাক, “আগাও খায়, গোড়াও কাটে”। প্রিয়া সাহার স্বামী জনাব মলয় সাহা, বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারি পরিচালক হিসেবে কর্মরত। প্রিয়া সাহা যখন সুদূর মার্কিন মূলুকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযোগ করছেন, বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করছেন, তখনও প্রিয়া সাহার স্বামী মলয় সাহা বহাল তবিয়তে বাংলাদেশে সরকারী চাকুরী করে যাচ্ছেন। এমনকি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযোগ করতে প্রিয়া সাহা যখন ঢাকা থেকে আমেরিকাতে রওনা করেছেন, তখনও দুদকের গাড়ি ব্যবহার করে এয়ারপোর্টে পৌছে দেন তার স্বামী সরকারী চাকুরে মলয় সাহা। মৌলবাদী মদদদাতা বাংলাদেশি সরকারের চাকুরী করতে, বেতন নিতে, গাড়ি ব্যাবহার করতে দেখি এরা কুন্ঠিত বোধ করেন না। কিন্তু সুযোগ মত বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করতে এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করেন না। বাহ!

আরেকটা ব্যাপার হল, এই যে “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের” সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযোগ করলেন এবং তার সাহায্য চাইলেন, কি করবেন এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? বাংলাদেশ সরকারকে শাসাবেন? বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন? বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকাকে কেন হস্তক্ষেপ করতে বলছেন প্রিয়া সাহা? কি উদ্দেশ্য “প্রিয়া সাহা চক্র”-এর? দয়া করে মনে রাখবেন “প্রিয়া সাহা চক্র” এরকম কাজ কিন্তু আগেও করেছে। ২০১৬ সালের জুন মাসে ঠিক একইরকম ভাবে “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের” সভাপতি (তখন সাধারণ সম্পাদক) রানা দাশগুপ্ত হিন্দু সুরক্ষায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী  নরেন্দ্র মোদী তথা বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সকল মূলধারার গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছিল। রানা দাশগুপ্ত অবশ্য পরে তা অস্বীকার করেন। কে জানে, প্রিয়া সাহাও হয়তো সে পথে হাঁটবেন!

ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম নষ্টের কাজটি সুনিপুণভাবে করে ফেলেছেন এই “প্রিয়া সাহা চক্র”। তাদের এই জঘন্য প্রয়াস রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। অবিলম্বে এদের বিরুদ্ধে যথাযথ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার জন্য এদের থেকে সকল সরকারী সুযোগ-সুবিধা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিৎ। এরাই আসলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দিয়ে আমাদের সমাজকে কলুষিত করার চেষ্টা করছে। মনে রাখতে হবে, মৌলবাদী শক্তির কোন নির্দিষ্ট রূপ থাকে না – তারা যে কোন ধর্মের, যে কোন বর্ণের, যে কোন গোত্রেরই হতে পারে। অতএব, সাধু সাবধান!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)