চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থান: যেসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সেনা অভ্যুত্থানগুলি নিয়ে প্রতি বছরই সংবাদপত্রে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়। অভ্যুত্থানগুলির সময় চাকুরিতে ছিলেন সেনাবাহিনীর এমন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং অন্যান্য গবেষকদের লেখা বিভিন্ন বইতেও সেই ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেনা অভ্যুত্থানগুলি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সূচিত করেছিল বড় পরিবর্তন। কিন্তু সেই ঘটনাগুলির সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর নানা লেখালেখির পরও জানা যায়নি। ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়, কিন্তু কেন ঘটনাগুলি ঘটেছিল তা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হয় না। এই দিকগুলি নিয়ে অনুসন্ধান এবং গবেষণার উদ্যোগও খুব কম। ফলে খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান এবং আবুল মঞ্জুরের মতো মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের কাদের পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়েছিল তা জানা সম্ভব হয়নি এখনো। এই লেখাতেও অভ্যুত্থান-কেন্দ্রিক জরুরি কিছু প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবে দেয়া সম্ভব হবে না। এই লেখা মূলত তুলে ধরবে কিছু প্রশ্ন কারণ সেইসব অভ্যুত্থানের অজানা দিকগুলি সম্পর্কে জানার জন্য কোন দরকারি প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি তাও আলোচনা করা প্রয়োজন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাসদের অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ঢাকা সেনানিবাসে সিপাহী বিপ্লব শুরু করতে সক্ষম হলে সেখানে বন্দী জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যুক্ত সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে ২ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়েছিল। তখন থেকে সিপাহী বিপ্লব শুরু হওয়া পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের প্রতি বিশ্বস্ত সেনা কর্মকর্তারা বলতে গেলে ক্ষমতাহীন অবস্থায় ছিলেন। জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পরই তারা জিয়ার পাশে সমবেত হন। লক্ষণীয়, সেই সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসারদের সংখ্যা বেশি হলেও, নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা এবং পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের সঙ্গে একটি নীরব দ্বন্দ্ব থাকলেও সেনাবাহিনীতে তখন পর্যন্ত বেশি প্রভাবশালী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারাই। ক্ষমতার জন্য বার বার দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়া থেকেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে একতা নষ্ট হতে শুরু করে। শীর্ষ মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তারা একে অন্যের বিরোধী ছিলেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান এবং আবুল মঞ্জুর নিহত হওয়ার পর বিতর্কিত সেনা বিচারের মাধ্যমে তের জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হয়। সেই সেনা বিচারে অনিয়ম করা হয়েছিল এমন অভিযোগ আছে। সেই সময় বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হয়, অনেককে অকালীন অবসর প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তখন থেকে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন পাকিস্তান-প্রত্যাগতরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান মুক্ত হলে তার অনুগত সেনা কর্মকর্তারা সেনানিবাসে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের অনুসারী সেনা অফিসারদের বন্দী করা হয়। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিবেশ সৃষ্টিতে সেনাবাহিনীতে জাসদের অনুসারী গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সক্রিয় থাকলেও, মুক্ত হওয়ার পর জিয়া এবং তার আস্থাভাজন অফিসাররা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের আর গুরুত্ব দেননি। বরং কিছুদিন পর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের দমন করা হয়। নিজের অনুগত অফিসারদের মাধ্যমে জিয়া যখন তার কর্তৃত্ব আবার প্রতিষ্ঠা করছিলেন তখন খালেদ মোশাররফ তার দুই সহযোগী কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারকে নিয়ে শেরেবাংলা নগরে রংপুর থেকে ঢাকায় আগত একটি পদাতিক ইউনিট ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে উপস্থিত হন। এই রেজিমেন্টটি মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর সেক্টরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২ নভেম্বরের পর খালেদ তার অবস্থান শক্তিশালী করার জন্যই রংপুর থেকে এই ব্যাটালিয়নটিকে ঢাকায় আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন এই ব্যাটালিয়নটির অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল নওয়াজিশ উদ্দীন। তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে যখন জিয়াউর রহমান নিহত হন, তখন নওয়াজিশ একজন কর্নেল হিসেবে চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশনে ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। জিয়া হত্যায় জড়িত ছিলেন এই অভিযোগে অন্য আরো দু’জন মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেড কমান্ডারের সাথে নওয়াজিশকেও তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং প্রশ্নবিদ্ধ সেনা বিচারের পর তিনজনকেই ফাঁসি দেয়া হয়।

৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর খালেদ মোশাররফ অন্য কোথাও না যেয়ে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হয়েছিলেন হয়তো এই চিন্তা করে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাটালিয়নের সদস্যরা তার প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। খালেদের সাথে রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল নাজমুল হুদাও সেই সময় রংপুর থেকে আনা এই ব্যাটালিয়নে উপস্থিত হয়েছিলেন। সাধারণভাবে চিন্তা করলে এই ব্যাটালিয়নে তাদের নিরাপদ থাকারই কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এই ব্যাটালিয়নের কিছু অফিসার আর সৈনিকই খালেদ মোশাররফ, হুদা আর হায়দার এই তিন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। যদি ধরে নেয়া যায় যে বাইরে থেকে আসা সৈনিকরা এই তিন অফিসারকে হত্যা করেছিল তখন প্রশ্ন ওঠে যে কেন ১০ বেঙ্গলের অফিসার-সৈনিকরা বহিরাগত সৈনিকদের প্রতিরোধ করলো না? সেই সময় খালেদ মোশাররফ ক্ষমতাহীন তা দেখেই কি ১০ বেঙ্গল আর তাদের পাশে দাঁড়াতে চায়নি? প্রশ্ন ওঠে, খালেদ-হুদা-হায়দারকে হত্যা করার জন্য ১০ বেঙ্গলের অধিনায়ক এবং অফিসারদের কি কেউ বা কোনো ক্ষমতাশালী চক্র হুকুম দিয়েছিল? সেই সময় ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের দপ্তরে অবস্থান নিয়ে জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতা সংহত করেছেন। তার সাথে রয়েছেন তার প্রতি বিশ্বস্ত অন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা যেমন মীর শওকত আলী, আমিনুল হক, মইনুল হোসেন চৌধুরী প্রমুখ। একই সাথে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরাও সেই সময় ছিল সক্রিয়। সক্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্রের এবং খন্দকার মোশতাকের অনুসারী ডানপন্থী সেনা সদস্যরা। এরা সবাই ছিলেন খালেদ মোশাররফের বিরোধী।

এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধান হয়নি সেদিন কাদের হুকুমে কারা হত্যা করেছিল তিনজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে। এই অনুসন্ধান না হওয়া এবং বিচারহীনতা পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে আরো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল বললে ভুল বলা হবে না। কারণ বিচারহীনতা অন্যায় করার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের হাতে যে ক’দিন ক্ষমতা ছিল, তারা কাউকে হত্যা করেননি। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পর খালেদ মোশাররফ একদিনও বেঁচে থাকতে পারেননি। এখানে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের তৎকালীন অফিসারদের সমালোচনা করাও যৌক্তিক। কারণ তারা তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা বিচারে হত্যা করার অন্যায় প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায় আরেকটি ঘটনার কথা। খালেদ মোশাররফের পক্ষে থাকা চারজন সেনা অফিসারকে (মেজর হাফিজ, মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন তাজ আর ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ্) বন্দী করার কিছুদিন পর তারা বন্দীদশা থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় নেন। তারা চারজনই ছিলেন প্রথম বেঙ্গলের অফিসার। প্রথম বেঙ্গলের সেনাসদস্যরা জীবনের বিনিময়ে হলেও এই চারজন অফিসারকে বাঁচানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। জিয়াউর রহমান এবং তার সহযোগীরা বার বার চেষ্টা করেও প্রথম বেঙ্গল থেকে এই চারজন অফিসারকে পুনরায় গ্রেফতার করতে পারেননি। পরবর্তীতে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চাপেই খালেদ মোশাররফের পক্ষে থাকা মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিচার করতে পারেননি জিয়াউর রহমান। যদিও সেই অফিসারদের চাকুরিচ্যুত করা হয়। প্রথম বেঙ্গল নিজেদের অফিসারদের নিরাপত্তা দিলেও, ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এবং পরবর্তীতে তাদের ব্রিগেড অধিনায়ক কর্নেল হুদার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়নি। দ্রুত তারা তাদের আনুগত্য বদলে ফেলে ক্ষমতাশালীদের পক্ষ অবলম্বন করে। অনুসন্ধান করা হলে ১০ ইস্ট বেঙ্গলে তখন চাকুরীরত ছিলেন এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমেই খালেদ-হুদা-হায়দারের হত্যাকান্ডে কারা জড়িত ছিলেন সেই সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব। কিন্তু অনুসন্ধানের এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি কখনো।

১৯৭৫ সালে সেনাসদস্য কর্তৃক বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরও যথার্থ অনুসন্ধান এবং নিষ্ঠার সাথে নিয়ম মেনে বিচার না হওয়ার পরিস্থিতিতে পরবর্তী বছরগুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বার বার অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখ জিয়াউর রহমান যখন তিন দিনের সফরে মিশর যান তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত জেনারেল জিয়াকে জানিয়ছিলেন যে মিশরের আর্মি ইন্টেলিজেন্স জানতে পেরেছে বাংলাদেশ সেনা ও বিমানবাহিনীর কিছু বামপন্থী সদস্য জিয়াউর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে দেশে একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছে। জিয়াউর রহমান দেশে ফিরে ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। সেদিন ঘটে যায় দুটি ঘটনা। বগুড়া সেনানিবাসে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা বিদ্রোহ করে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তারা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সিপাহী বিপ্লবের যে স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ধরনের স্লোগান দেয়, কয়েকজন জুনিয়র সেনা অফিসারকে হত্যা করে, অনেক অফিসারকে বন্দী করে, আর জেল থেকে পূর্বে বিদ্রোহের জন্য আটক করা সেনাসদস্যদের মুক্ত করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জাতীয় রক্ষীবাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের যখন সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়, তখন তৃতীয় রক্ষী দলকে রূপান্তরের মাধ্যমে ২২ ইস্ট বেঙ্গল নামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই নতুন পদাতিক ব্যাটালিয়নটি তৈরি করা হয়েছিল। এই ব্যাটালিয়নের প্রায় সব সদস্যই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সেই বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনী থেকে ২২ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন বিলুপ্ত করে দেয়া হয়।

সেই দিনই সকালে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে ১৫৬ জন যাত্রী আর ১৪ জন ক্রু নিয়ে অবতরণ করে জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান। জাপানের সরকার বিরোধী উগ্র বামপন্থী জাপানি গোষ্ঠী ‘রেড আর্মি’র হিদাকা গ্রুপের পাঁচ জন সদস্য বোম্বে থেকে ব্যাংককগামী এই বিমানে ওঠে এবং উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কী করে তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং বিস্ফোরক নিয়ে বোম্বে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা বলয় অতিক্রম করে বিমানে উঠে পড়লো তা রহস্য সৃষ্টি করে। কলকাতায় তারা অবতরণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কলকাতা বিমানবন্দরে তাদের নামার অনুমতি দেয়া না হলে তারা ঢাকায় চলে আসে। ঢাকা বিমানবন্দরেও তাদের অবতরণের অনুমতি শুরুতে দেয়া হয়নি। কিন্তু বিমানের ফুয়েল শেষ হয়ে গেছে এই কথা বলে তারা জোর করেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। অবতরণের পর ছয় ঘন্টা ছিনতাইকারীরা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেনি। এরপর তারা জানায় জাপানে বন্দী রেড আর্মির নয় জন সদস্যকে মুক্তি দিয়ে তাদের কাছে এনে দিতে হবে এবং তাদের ছয় মিলিয়ন ডলার দিতে হবে। তাদের দাবী মানা না হলে তারা বিমানে বন্দী যাত্রীদের হত্যা করা শুরু করবে। বিমানে বিভিন্ন দেশের যাত্রীরা ছিলেন। ছিনতাইকারীরা জানায় তাদের দাবী অনুযায়ী কাজ না করলে একজন মার্কিনী ব্যাঙ্কার জো গ্যাব্রিয়েলকে হত্যার মাধ্যমে যাত্রী হত্যার সূচনা করা হবে (এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, পৃষ্ঠা. ১২২)।

পরবর্তী তিন দিন বিমান ছিনতাইকারীদের সাথে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের আলোচনা অব্যাহত থাকে। এক পর্যায়ে জাপান সরকারের প্রতিনিধিরা জাপানের কারাগারে বন্দী রেড আর্মির ছয় জন সদস্য আর ছয় মিলিয়ন ডলার নিয়ে ঢাকায় আসেন। ছিনতাইকারীদের দাবী মেটানো হলে তারা বেশির ভাগ যাত্রীকে মুক্তি দেয়। ২ অক্টোবর প্রায় ভোর পর্যন্ত যাত্রীদের মুক্ত করার প্রক্রিয়া চলে। সেই সময় হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ঘটে যায় আরেকটি বিদ্রোহ। সেনাবাহিনীর সিগনাল ইউনিটের কিছু সদস্য আর বিমানবাহিনীর সৈনিকরা এই বিদ্রোহ ঘটায়। বিদ্রোহীদের বিভিন্ন দল সেনানিবাস আর শহরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। একটি দল আসে তেজগাঁও বিমানবন্দরে, এবং সেখানে ছিনতাইকারীদের সাথে আলোচনা চলার পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনের জন্য উপস্থিত বিমানবাহিনীর বিভিন্ন পদমর্যাদার এগারো জন অফিসারকে বিদ্রোহীরা গুলি করে হত্যা করে। বিদ্রোহীরা রেডিওতে সেই সময় ভাষণ দিয়ে বলেছিলো যে দেশে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা হবে। এই সেনাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন আফসার নামে বিমানবাহিনীর একজন সার্জেন্ট। জানা যায়, সার্জেন্ট আফসার ছিলেন সেই সময়ের একটি গোপন বামপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী। এই আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনের একটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ছিল যা ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি ইউনিয়ন’ নামে পরিচিত ছিল। জানা যায়, সার্জেন্ট আফসার গোপনে এই সংগঠনের কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতেন এবং বিমান সেনাদের মধ্যে তার অনুসারী তৈরি হয়েছিল (আনোয়ার কবির, পৃষ্ঠা. ৯৬-৯৭)।

এই বিদ্রোহ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট দ্রুতই কঠোরভাবে দমন করে। সার্জেন্ট আফসারসহ সেনা ও বিমানবাহিনীর অনেক নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিককে বন্দী করা হয়। তারপর সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খুব দ্রুত বহু নন-কমিশন্ড অফিসার আর সৈনিককে ফাঁসি দেয়া হয়। তবে যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে তারা সবাই অপরাধী ছিলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ যথেষ্ট সময় নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যাচাই ও তদন্ত করা হয়নি। সাংবাদিক জায়েদুল আহসানের রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি বইতে এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে:

অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়া বিদ্রোহী সৈনিকদের বিচার করার জন্য যে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন তা ছিল মূলত দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করার জন্যই। কারণ, বাংলাদেশ আর্মি ও এয়ারফোর্স অ্যাক্ট অনুযায়ী শুধু জেনারেল কোর্ট মার্শাল মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। এ রকম কোর্ট মার্শালে বিচারক হিসেবে কমপক্ষে পাঁচজন অফিসার থাকতে হবে। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া এ ধরনের নিয়মমাফিক কোর্ট গঠনের জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন, তাও দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। সশস্ত্র বাহিনীর আইনও এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তিনি মার্শাল ল অর্ডারে রাতারাতি মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল গঠন হয় আর ৯ অক্টোবরই ফাঁসি কার্যকর শুরু হয়। এক দিনের ব্যবধানে বিচারপর্ব ও ফাঁসি কার্যকর করার মধ্যেই বোঝা যায়, দ্রুত ফাঁসি দেওয়াটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য (পৃষ্ঠা-২৮)।

কর্নেল  তাহের

যে অভ্যুত্থানের কারণে প্রাণ হারালেন সামরিক বাহিনীর অনেক নিরপরাধ অফিসার-সৈনিক, সেই অভ্যুত্থানটির মূল পরিকল্পনাকারী কারা ছিল তা এখনো অজানা। কাদের পরামর্শে বা প্ররোচনায় বা ভরসায় সার্জেন্ট আফসার তার অনুসারীদের নিয়ে এই বিদ্রোহ করেছিলেন? জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি কি এই অভ্যুত্থানকে সহায়তা করার সাথে সম্পর্কিত? জাপানি রেড আর্মি একটি উগ্রপন্থী বাম সংগঠন। তাদের সাথে কি কোনোভাবে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামক বাংলাদেশের গোপন বামপন্থী সংগঠনের যোগাযোগ ছিল যে দলের অনুসারী ছিলেন সার্জেন্ট আফসার? বামপন্থী সেনা সদস্যদের অভ্যুত্থানের ঠিক আগে বিদেশি উগ্রপন্থী বাম সংগঠন কর্তৃক ছিনতাই করা বিমানের ঢাকায় অবতরণ কী কেবলই কাকতালীয় ঘটনা? কেন রেড আর্মির ছিনতাইকারীরা কলকাতায় নিষেধের পর অবতরণ না করলেও, ঢাকাতে নিষেধ করা হলেও জোর করে অবতরণ করেছিল?

জানা যায়, বগুড়ায় ২২ ইস্ট বেঙ্গলের অভ্যুত্থানের পর সার্জেন্ট আফসার মন্তব্য করেছিলেন যে এবার ঢাকাতেও অভ্যুত্থান হবে (আনোয়ার কবির, পৃষ্ঠা. ৯৮)। বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা চলছে তা মিশরের গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারলো অথচ দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি জানলো না? মিশরের প্রেসিডেন্টের সতর্কবাণী, তারপর বগুড়ায় ২২ বেঙ্গলের বিদ্রোহ, সার্জেন্ট আফসারের আসন্ন বিদ্রোহ সম্পর্কে অন্যদের কাছে মন্তব্য করা প্রভৃতি ঘটনার পরও ২ অক্টোবর ভোরে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনার তথ্য সেনা গোয়েন্দা সংস্থার না পাওয়া কী অস্বাভাবিক নয়? প্রশ্ন তৈরি হয় তাহলে কি কোনো পক্ষ চেয়েছিল যে এই বিদ্রোহগুলি সংঘটিত হোক যার মাধ্যমে নিজেরা নিরাপদ থেকে স্বার্থ উদ্ধার করে নেয়া সম্ভব হবে? এই বিদ্রোহগুলির পর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অনেক অফিসার-সৈনিক হারিয়ে দুর্বল হয়ে যায়। সেনাবাহিনী থেকে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিলুপ্ত করা হয় যেখানে প্রায় সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর সিজিএস পদ থেকে মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে বদলী করা হয় চট্টগ্রামে, আর সাভারে ৯ পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক পদ থেকে আরেক মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মীর শওকত আলীকে বদলী করা হয় যশোরে। ঢাকা থেকে জ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দূরে সরিয়ে দেয়া কাদের জন্য সুবিধা নিয়ে এসেছিল?

চার বছর পর চট্টগ্রামে ঘটে যায় আরেকটি বড় অভ্যুত্থান যার কারণে প্রাণ হারান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। অভ্যুত্থানের দায়ভার চাপানো হয় চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল আবুল মঞ্জুর এবং তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের উপর। দ্রুতই মঞ্জুরকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর তাকে পুলিশের কাছ থেকে সেনানিবাসে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি না করে হত্যা করা হয়। বলা হয় ক্ষুব্ধ সাধারণ সৈনিকরা মঞ্জুরকে হত্যা করেছে। কাদের নির্দেশে জিয়া এবং মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছিল সে সম্পর্কে যথাযথ এবং প্রকৃত তথ্য এখনো অজানা। আর আন্তরিকভাবে এই সত্য উদঘাটনের চেষ্টাও করা হয়নি।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জেনারেল মঞ্জুরের অধীনে সেই সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য, এই অফিসাররা জিয়ারও ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কারণ খালেদ মোশাররফ বা কর্নেল আবু তাহেরের ঘনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা সেই সময় সেনাবাহিনীতে আর কর্মরত ছিলেন না বললেই চলে। জেনারেল মঞ্জুরও মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই জিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সেই সময় চট্টগ্রামে কর্মরত অন্য গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা যেমন ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্নেল নওয়াজিশ বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবও ছিলেন জিয়ার ঘনিষ্ঠ। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর তারা জিয়ার প্রতিই বিশ্বস্ত ছিলেন, খালেদের অনুসারী অন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সাথে তারা যুক্ত হননি। যদিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুব মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফের সেক্টরেই যুদ্ধ করেছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুব ছিলেন জেনারেল মঞ্জুরের আপন ভাগ্নে। চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিদের রাজনীতিতে নিয়ে আসা, অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রদান, কিছু বিএনপি নেতা আর কিছু উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা সংহত করার পর সেনাবাহিনী থেকে দূরে সরে যাওয়া প্রভৃতি কারণে মঞ্জুর এবং অন্যান্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের সাথে জিয়াউর রহমানের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। মঞ্জুর শান্তি বাহিনী সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু জিয়া শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে চান যা মঞ্জুরকে অখুশি করে। সবশেষে ১৯৮১ সালের মে মাসে মঞ্জুরকে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট হিসেবে বদলির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে চট্টগ্রামে মঞ্জুরের অধীনে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা জিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

তবে এই সব কারণেই এতোদিন জিয়ার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা জিয়াকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলেন এমন বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বরং চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে হামলায় অংশ নেয়া বিভিন্ন অফিসারের বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায়, বিভিন্ন দাবি নিয়ে কথা বলার জন্য সেই রাতে সার্কিট হাউস থেকে প্রেসিডেন্টকে জোর করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে নিয়ে আসার কথাই তাদের বলা হয়েছিল। সার্কিট হাউসে হামলার পরিকল্পনা যারা করেছিলেন এবং জিয়া হত্যার পর যারা বেশি সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুব, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেলোয়ার, মেজর খালেদ আর মেজর মোজাফফর। জেনারেল মঞ্জুর কি জানতেন সার্কিট হাউসে তার অধীনস্থ অফিসাররা হামলা করতে যাচ্ছেন? আমরা দেখেছি জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের পর যখন জেনারেল মঞ্জুর একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম থেকে, তার সেই ঘোষণায় ঢাকা সেনানিবাসসহ দেশের অন্য কোনো সেনানিবাস সমর্থন দেয়নি। দ্রুতই চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অনেক অফিসার এবং সৈনিকরাও ঢাকায় অবস্থানরত সেনাপ্রধান এবং অন্য উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ত্যাগ করে। জেনারেল মঞ্জুর এবং তার ঘনিষ্ঠ অফিসারদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কেউ কেউ এই সময় মারা যান, অনেককে গ্রেফতার করা হয়।

খালেদ মোশাররফ

মাত্র কয়েকজন অফিসারের উদ্যোগে দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হলে যে পুরো সেনাবাহিনীর সমর্থন পাওয়া যাবে না তা নিশ্চয়ই জেনারেল মঞ্জুরের মতো একজন অভিজ্ঞ সেনা অধিনায়কের জানা ছিল। একজন মেধাবী এবং বুদ্ধিদীপ্ত সেনা অফিসার হিসেবে মঞ্জুর পাকিস্তানের এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সুপরিচিত ছিলেন। জিয়াউর রহমানের প্রতি ক্রোধের কারণে তিনি তার অনুগত অফিসারদের দিয়ে তাকে হত্যা করিয়ে দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারবেন এমন অবাস্তব চিন্তা মঞ্জুরের মতো বিচক্ষণ অফিসার করেছেন তা ভাবাও কঠিন। তাহলে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার পরিকল্পনা কারা করেছিলেন এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ সেই পরিকল্পনার তথ্য কেন জানতে পারলো না? কেউ বা কোনো গোষ্ঠী কি জিয়াকে বন্দী বা হত্যা করা হলে মঞ্জুর এবং তার সহযোগী অফিসারদের সমর্থন দেবেন তা জানিয়েছিলেন? তাদের ভরসাতেই কি চট্টগ্রামের কিছু অফিসার জিয়াকে আটক বা হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল? জানা যায়, সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হঠাৎ গুলি করে হত্যা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান। মতিউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করে তিনি ‘বীর বিক্রম’ খেতাব পেয়েছিলেন। কার নির্দেশে মতিউর রহমান সেদিন জিয়াকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন এই জরুরি তথ্যটি এখনো অজানা। এই তথ্য মতিউর রহমানের বা সার্কিট হাউস হামলার অপর গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবের মুখ থেকে জানার উপায় ছিল না কারণ এই দুজন অফিসারই চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পালাবার সময় একটি সেনাদলের সাথে গোলাগুলিতে প্রাণ হারান। জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেফতার করার পর তাকেও বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরিয়ে এনেই তাকে হত্যা করা হয়। বলা হয়, উশৃঙ্খল সৈন্যরা তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে মঞ্জুরের মাথার পেছনে মাত্র একটি গুলির আঘাত দেখা গিয়েছিল। এক দল উশৃঙ্খল সৈন্য তাকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করলে নিশ্চয়ই তার শরীরে আরো আঘাতের চিহ্ন থাকতো।
তাই প্রশ্ন ওঠে, কেন মঞ্জুরকে যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে বিচারের মুখোমুখি না করে তাকে অতি দ্রুত হত্যা করা হয়েছিল? মঞ্জুর বেঁচে থাকলে এবং তথ্য প্রকাশ করলে কার বা কাদের ক্ষতি হতো যার কারণে তার বিচারের ব্যবস্থা না করে তাকে দ্রুত হত্যা করা হলো? সার্কিট হাউস হামলার পরিকল্পনার সাথে যুক্ত দুই লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান আর মেহবুবকেও কেন গ্রেফতার না করে হত্যা করা হলো? আরো প্রশ্ন ওঠে জিয়া হত্যার সাথে যুক্ত ছিলেন এমন অভিযোগে পরবর্তীতে কেন শুধু মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেরই বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল? সেই সময় ২৪ পদাতিক ডিভিশনে চার জন ব্রিগেড কমান্ডারের তিন জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিন জনকেই কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়। আর পাকিস্তান-প্রত্যাগত ব্রিগেড কমান্ডারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আনা হয়নি। একইভাবে অভিযোগ আনা হয়নি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত অন্য পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসারদের বিরুদ্ধেও। অথচ জিয়া হত্যার পর যে ক’দিন সেনানিবাসে মঞ্জুরের প্রভাব ছিল সেই ক’দিন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মতো পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসাররাও মঞ্জুরের সাথে ছিলেন। কিন্তু কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয় কেবল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। তাদের বিচার করার জন্য যে সামরিক কোর্ট গঠন করা হয় তার সাত সদস্যের ছয় জনই ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত। এই কোর্টের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মেজর জেনারেল আবদুর রহমান যিনি মুক্তিযোদ্ধা-বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে তিনিই নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি থাকাকালীন সময়ে দেশে সামরিক আইন জারির পক্ষে জেনারেল এরশাদকে সবচেয়ে জোরালোভাবে সমর্থন প্রদান করেন এবং এরশাদের শক্তির মূল উৎস হয়ে ওঠেন (মনজুর রশীদ খান, পৃষ্ঠা. ১৭৩)।

সেই কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত অফিসারদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী দুজন অফিসার তৎকালীন কর্নেল মোহাম্মদ আইনউদ্দিন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আর তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন সেই কোর্ট মার্শালে অনেক নিয়ম মানা হয়নি, অনেক অন্যায় আর অবিচার করা হয়েছে। ইবরাহিম বলেছেন, “সেই কোর্ট মার্শাল সম্পর্কে আমার এটিই বক্তব্য যে অনুপাতের বাইরে অনেককে শাস্তি দিয়েছে, নির্দোষ অনেকে শাস্তি পেয়েছে, দোষী ব্যক্তি অনেকে বাইরে থেকে গেছে। আদালত যেদিন শেষ হবে সেদিন আমরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট চিত্তে, অসন্তুষ্ট মন নিয়ে আদালতের কক্ষ থেকে বেরিয়েছি” (আনোয়ার কবির, পৃষ্ঠা. ১৫৫)।

আর আইনউদ্দিন লিখেছেন: “পরে বাইরে গিয়ে জেনারেল আবদুর রহমান যিনি কোর্ট মার্শালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আমাকে থ্রেট করলেন যে আমি বেশি কথাবার্তা বললে উনি আমাকে দেখে নেবেন। কোর্ট মার্শালের পরে একটি হোয়াইট পেপার পাবলিশ করা হয় আইএসপিআর-এর মাধ্যমে। সেই হোয়াইট পেপারটিকে আমি বলতে চাই এটি ব্ল্যাক পেপার ছিল এবং সত্যের অপলাপ ছিল। যা ছিল তার সবই ছিল এক তরফা এবং সাজানো ঘটনা” (আনোয়ার কবির, পৃষ্ঠা. ১৫৯)।

জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের উপরই। জিয়া এবং মঞ্জুরের মতো দু’জন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারকে হত্যা করা হয়, প্রাণ হারান মেহবুব আর মতিউর রহমান, প্রশ্নবিদ্ধ বিচারে ফাঁসি দেয়া হয় তের জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে যাদের অনেকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আর সেই সাথে চাকুরিচ্যুত আর অকালীন অবসর দেয়া হয় আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে। জেনারেল জিয়ার সাথে সার্কিট হাউসে সেদিন প্রাণ হারান জিয়ার প্রধান নিরাপত্তা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাইনুল আহসান আর অপর নিরাপত্তা অফিসার ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ খান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহসান মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে ২৪ বেলুচ রেজিমেন্ট ত্যাগ করে পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে পৌঁছান। কিন্তু এরপরই দ্রুত দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় তিনি আর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। আর ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ ছিলেন রক্ষীবাহিনীর অফিসার। রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীতে আত্তীকৃত হবার পর তিনি সেনাবাহিনীর অফিসার হন। সেদিন মারা যান প্রেসিডেন্ট’স গার্ড রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈনিক আর একজন পুলিশ সদস্য। এই দুজন অফিসার আর সৈনিকদের কথা কোথাও উল্লেখ করা হয় না বললেই চলে। অথচ রাষ্ট্রপতিকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে তারা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তারা তো তাদের দায়িত্ব ফেলে পালিয়ে যাননি। প্রশ্ন থাকে, জিয়া-মঞ্জুর সহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার-সৈনিকের হত্যাকান্ডের এবং দুর্ভোগের পর দেশের সেনাবাহিনী এবং রাজনীতিতে মূল সুবিধাভোগকারী হয়েছিলেন কারা?

খন্দকার মোশতাক

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান সেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়াকে গুলি করে হত্যা না করলে হয়তো পরবর্তী ঘটনাধারা অন্যরকম হতো। মতিউর রহমান সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য আর লেখায় জানা যায় আরেকটি কথা। ১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার কিছুদিন আগেই মতিউর রহমান ঢাকায় এসেছিলেন বিদেশে স্টাফ কলেজে গমনের ব্যাপারে সেনাসদরে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য। এমনিতে হাসিখুশি ব্যক্তি হলেও এই সময় নাকি তিনি বেশ কিছুটা উত্তেজিত আর অন্যমনস্ক ছিলেন তা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা যায় (এম সাখাওয়াত হোসেন, পৃষ্ঠা. ১৩৮)।

জিয়া হত্যার পর জেনারেল মঞ্জুরের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মেজর রেজাউল করিম একটি সাক্ষাতকারে, এবং মেজর রফিকুল ইসলাম তার লেখা বইতে উল্লেখ করেছেন ঢাকায় সেই সময় মতিউর রহমান সেনাপ্রধান এরশাদসহ আরো কয়েকজনের সাথে দেখা করেছিলেন (আনোয়ার কবির, পৃষ্ঠা. ১৮৭; মেজর রফিকুল ইসলাম, পৃষ্ঠা. ৩০)। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান তখন কী আলোচনা করেছিলেন ঢাকায় এই ব্যক্তিদের সাথে তা জানা যায় না। এর ক’দিন পরই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মতিউর রহমান একাই গুলি করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেন।

জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর যাদের ফাঁসি হয়েছিল তাদের একজন ছিলেন কর্নেল এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্বের জন্য তিনি দুই বার ‘বীর বিক্রম’ খেতাব পান। কর্নেল মাহফুজ ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়ার পার্সেনাল সেক্রেটারি এবং ৩০ মে রাতে তিনি জিয়ার সাথে সার্কিট হাউসেই ছিলেন। যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। জিয়া হত্যার পর তাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে হাউস অ্যারেস্টের মতো করে রাখা হয়। পরবর্তীতে মঞ্জুর এবং তার সহযোগী অফিসাররা ক্ষমতাচ্যুত হলে কর্নেল মাহফুজ ঢাকায় ফিরে যান। কিন্তু কিছুদিন পরই তাকে আবার গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জিয়া হত্যায় অভিযুক্ত অন্য অফিসাররা তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানিয়েছিলেন ঢাকায় গিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন জিয়া হত্যার কিছুদিন আগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান কেন ঢাকায় আসলো, কার সাথে দেখা করে কী আলোচনা করলো। তিনি বলেছিলেন এই নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। তারপরই তাকে অ্যারেস্ট করে জেলে পাঠানো হয়েছে (আনোয়ার কবির, পৃষ্ঠা. ১৮৭)। জেলে আটক চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অন্য অফিসারদের সাথে কর্নেল মাহফুজকেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের জন্য প্রচণ্ড টর্চার করা হয়েছিল। হেভি টর্চার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া অনৈতিক এবং নিময়বিরুদ্ধ। সামরিক আদালতে তাদের হয়ে মামলা পরিচালনাকারী তৎকালীন কর্নেল আইনউদ্দিন জানিয়েছেন, বন্দী সামরিক অফিসারদের উপর অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন ব্রিগেডিয়ার মোহসীন, কর্নেল নওয়াজিশ, কর্নেল রশিদ প্রত্যেকেরই গায়ের চামড়া প্রায় উঠানো হয়েছিল আর নখ উপড়ানো ছিল (আনোয়ার কবির, পৃষ্ঠা. ১৫৭)। তিনি জানিয়েছেন, প্রচন্ড টর্চারের ফলে কর্নেল মাহফুজের হাতের আঙুলে কোনো নখই ছিল না। সবগুলো নখ সুঁই ফুটিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছিল (জুলফিকার আলি মাণিক, পৃষ্ঠা. ৩৭)। প্রশ্ন তৈরি হয়, মতিউর রহমানের ঢাকায় এসে আলোচনা করা নিয়ে কর্নেল মাহফুজের তোলা প্রশ্ন কাদের জন্য ভীতি এবং অস্বস্তি তৈরি করেছিল?

জিয়াউর রহমান

সেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং নিয়ম উপেক্ষা করা গোপন সামরিক বিচার চলার সময় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাত্তার দেশে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিলেন। তারা কী সেই অনৈতিক বিচারের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারেন? সেই সময় অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইবরাহিম এই সামরিক কোর্টের অন্যায়ের জন্য জেনারেল এরশাদকে আর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে দায়ী হিসেবে অভিহিত করেছেন (কবির, পৃষ্ঠা-১৫৫)। আইনউদ্দিনও জানিয়েছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ এই সাজানো কোর্ট মার্শালের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারবেন কিনা তা সময়ই বলে দেবে (জুলফিকার আলি মাণিক, পৃষ্ঠা-৫০)। আইনউদ্দিন স্পষ্টভাবে বলেছেন, পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরও জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নেয়ার পর যখন তাকে হত্যা করা হলো তখন যাদের তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন সেই সামরিক ব্যক্তিদের বিচার হওয়া দরকার ছিল। এবং মঞ্জুর কিভাবে মারা গেল তা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তো তা নিয়ে যথাযথ তদন্ত করে প্রকৃত সত্য দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। সেই সত্য প্রকাশে অনীহা কেন? কাদের স্বার্থের জন্য সেই সত্যকে ঢেকে রাখা হচ্ছে?

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সামরিক অভ্যুত্থানগুলো নিয়ে এমন অনেক প্রশ্নেরই উত্তর এখনো অজানা। সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগও নেই বললেই চলে। সেই ঘটনাগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারবেন এমন অনেকেই আছেন, কিন্তু তাদের কাছ থেকে তথ্য জানার চেষ্টা নেই। প্রশ্নগুলো তাই ঢাকা পড়ে আছে। কিন্তু অতীতে কার কী ভূমিকা ছিল, তা স্পষ্টভাবে জানার জন্যই অজানা বিভিন্ন দিক নিয়ে সত্য প্রকাশিত হওয়া জরুরি। আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া সামরিক অভ্যুত্থানের কিছু দিক সব সময় রহস্যাবৃত থাকবে তা কাম্য নয়। কারণ এই অভ্যুত্থানগুলি দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভাবিত করেছিল। আর যেহেতু সেই সামরিক অভ্যুত্থানসমূহের কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু মানুষ, তাই তাদের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী ছিল সেই তথ্যসমূহ জানা অবশ্যই প্রয়োজন। আশা করা যায়, আগামী দিনগুলিতে এই প্রশ্নগুলি নিয়ে অনুসন্ধান এবং তদন্ত হবে। প্রকাশিত হবে অজানা অনেক তথ্য এবং সেই সত্য যা ঢেকে রাখা হয়েছিল।

সহায়ক গ্রন্থসমূহ
জায়েদুল আহসান, রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি, ঢাকা: চর্চা, ২০১৫
আনোয়ার কবির, সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ প্রামাণ্য চিত্রের গ্রন্থরূপ, ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৪
মনজুর রশীদ খান, আমার সৈনিক জীবন: পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১২
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১, ঢাকা: পালক পাবলিশার্স, ২০০৭
জুলফিকার আলি মাণিক, জিয়া হত্যাকান্ড: নীল নকশার বিচার, ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০৬
মেজর রফিকুল ইসলাম, একাশির রক্তাক্ত অধ্যায়, ঢাকা: আফসার ব্রাদার্স, ২০০২,
Air Vice Marshal A. G. Mahmud (Retd.), ¸ Destini“, Dhaka: Academic Press and Publishers Library, ২০১৩.

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)