চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাংলাদেশের শহর নারীর জন্য নিরাপদ নয়: একশনএইড

বাংলাদেশের শহরগুলোর ৫৪ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হন। এই নারীরা আইন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে খুব বেশি সহযোগিতা পান না। গণপরিবহন ও নগর কাঠামোও নারীবান্ধব নয় এদেশের শহরগুলো। তাই নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে নেপাল, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, জর্ডান, ব্রাজিল এবং জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলোর থেকে খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড-এর নতুন এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বৃহস্পতিবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে “কার শহর?” নামের এই গবেষণাটি প্রকাশ করে একশনএইড বাংলাদেশ। একইদিনে বাংলাদেশসহ ৪৫টি দেশে গবেষণাটি প্রকাশ করা হয়।

একশনএইড কার্যক্রম আছে আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার এমন ১০টি দেশের উপর গবেষণাটি করা হয়। এসব দেশের নারীর প্রতি সহিংসতার তথ্য, আইন, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, বাজেট, পরিসংখ্যান ও জনসেবার মত বিষয়ের উপর বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি করা হয়। এসব বিষয়ে কোন দেশ কোন অবস্থানে আছে তা বিশ্লেষণ করে ১০০ নম্বরের উপর ভিত্তি করে দেশগুলোর পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ৩৯.৩২, অবস্থান ষষ্ঠ এবং প্রাপ্ত গ্রেড ‘ডি’। অর্থাৎ বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার হার উচ্চ। নগরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই খারাপ পরিস্থিতিতে আছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা, আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, জেন্ডারবান্ধব নগর পরিকল্পনার অভাব, নারী ও মেয়ে শিশুর জন্য সীমিত এবং অনিরাপদ গণপরিবহণের কারণে বাংলাদেশের এই অবস্থা। প্রতিবেদন বলছে, নারীর নিরাপত্তার বিষয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত কঙ্গোর মত অবস্থা বাংলাদেশের।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই গবেষণা প্রতিবেদনটি সরকার, গবেষক, উন্নয়নকর্মীদের সামনে তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার কাশফিয়া ফিরোজ। যে পাঁচটি বিষয়ে গবেষণাটি করা হয় তার সুনির্দিষ্ট ফলাফল তুলে ধরেন তিনি।

‘কার শহর?’ গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, নগরে নারী তাদের প্রতিদিনের কাজ করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। শহরের ৫৪.৭ শতাংশ নারী কোন কোনভাবে সহিংসতার শিকার হন। এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেও নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। গবেষণার একটি ফলাফল বলছে, বাংলাদেশের শহরের সহিংসতার শিকার নারীদের ৬৫ ভাগ সমাধান খুঁজতে গিয়ে দ্বিতীয়বার হয়রানির শিকার হন পুলিশের কাছে। তাই ৫৭ শতাংশ নারী মনে করেন, তাদের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে নেয়া হবে না।

এসময় র‌্যাব-এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ মুফতি মাহমুদ খান এ বিষয়ে বলেন, রাস্তা-ঘাটে নারীদের হয়রানি বা সহিংসতার বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। কারণ সহিংসতাকারীদের পাওয়া যায় না। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক নারী হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যেগুলো সমধান করাও কঠিন। সহিংসতার মাত্রা একদম শূন্যতে নিয়ে আসা অসম্ভব। অনেক সহিংসতার ঘটনা ঘটে কিন্তু সেটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পর্যন্ত আসতে হবে এবং তা প্রমাণ সহকারে।

গবেষণা বলছে, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে বাংলাদেশে সমন্বিত আইন আছে। তবে গণপরিসরে নারীদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট আইন নেই। আবার যে আইন আছে সেখানে যৌন হয়রানি বন্ধে সরাসরি কোন বিধান নেই। যে কারণে জনপরিসরে যৌন হয়রানি হলে আইনীভাবে প্রতিকার খুবই কম পান নারীরা। আবার ঘরের বাইরে সংঘটিত যেকোন যৌন হয়রানিকে বিবেচনা করে কোন আইন প্রণীত হয়নি। ‘যৌন হয়রানি’ শব্দটির কোন আইনে পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়ন নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, দুঃখের বিষয় যৌন হয়রানি বন্ধে এখনো আমাদের সুনির্দিষ্ট আইন নেই। তাই সহায়তা চাইতে গেলে পুলিশের কাছে কম সহযোগিতা পান নারীরা। উল্টো নারীদের যেভাবে প্রশ্ন করে সেটাও কিন্তু এক ধরনের অপরাধ। রাস্তা-ঘাটে যে হয়রানি করা হয়, তা থামানোর জন্য আইন করতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি মাথায় নেয়া হয় না। শহরের যে কোন রাস্তা বা স্থাপনার সময় নারীদের কথা বিবেচনা করা হয় না। তাই এখানে বাংলাদেশের স্কোর ০ (শূন্য)। বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাটিতে নারীর অংশগ্রহণ নগন্য, যার অর্থ হলো নারীকে নগর পরিকল্পনায় বিবেচনা করা হয় না।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আক্তার মহমুদ বলেন, নগর পরিকল্পনা যখন করা হয় তখন নারীর অংশগ্রহণ কম ছিল। তাই শহরটি পুরুষের শহরে পরিণত হয়েছে। তাই শহরের অবকাঠামো নারী বান্ধব না। রাস্তা, ফুটপাত, ভবন, যানবাহন, পার্ক, উন্মুক্ত স্থানে নারী স্বাভাবিক ও নিরাপদভাবে চলতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, নারী বান্ধব শহর তৈরিতে নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। প্রত্যেকটা জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, নারীরা গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে নানা অনাকাঙ্খিত স্পর্শ, না জানিয়ে ছবি তোলা, নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি ও কটুক্তিসহ নানা সহিংসতার শিকার হন। ৪৯ শতাংশ নারী গণপরিবহণে এবং ৪৮ শতাংশ গণসেবা গ্রহণে অনিরাপদ অনুভব করেন । গণপরিবহনে নারী যে হয়রানির শিকার হন, তাতে প্রতিবাদের সংস্কৃতি এখানে অনুপস্থিত। এছাড়া গণপরিবহণের নকশা ও চলাচলে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি মাথায় রাখা হয় না।

এ বিষয়ে বিআরটিএ-এর সচিব শওকত আলী বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা আমাদের কম। ঢাকা শহরে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার গণপরিবহন আছে। আবার এর মধ্যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। নারী যাত্রীদের বাসে উঠতে দেয়া হয় না। এটা অন্যায়। আমরা সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি। নগর ব্যবস্থাপনায় যে কর্তৃপক্ষগুলো আছে তারা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। আছে সমন্বয়ের অভাব। সমন্বিতভাবে কাজ করলে পরিবহন ব্যবস্থা নারী বান্ধব হবে।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, গত ৪০-৪৫ বছরেও আমরা নারীর নিরাপত্তার জন্য শহরে যাত্রী ছাউনি করতে পারিনি। ঘরে, বাইরে, রাস্তায় যেভাবে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। কিশোর, যুবা, বৃদ্ধ, সব বয়সের মানুষের সহিংসতার শিকার হচ্ছে নারী। এ শহরে নারীকে বাদ দিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিস্থিতি উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। এখন আমরা এমন একটি অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতেই হবে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, এ শহর পুরুষের। সকালে অফিসের জন্য বের হলে রিক্সা/পরিবহন চালক পুরুষ এবং অফিসের দারোয়ানও পুরষ। ঢাকা শহর একটি অপরিকল্পিত শহর। যেখানে আমরা সভ্য মানুষ হিসেবে আচরণ করি না। তাই চাইলেও হুট করে আমরা একটি আইন করতে পারি না। যেমন, গণপরিসরে যৌন হায়রানি বন্ধে আইন করা যায়। তবে দেখা যাবে ওই আইনের আওতায় ফাঁসিয়ে দেয়ার প্রবণতা তৈরি হবে।

তিনি আরো বলেন, যৌন হয়রানি বিষয়টি কঠিন। মূল কথা হলো আমাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতায়।

১৬ দিনব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কঙ্গো, জর্ডান, লাইবেরিয়া, নেপাল, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়েতে করেছে একশনএইড। গবেষণায় কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়।