‘আমি এতটা আশা করিনি। আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। তারা হয়তো ফুটবল সম্পর্কে জানে, কিন্তু তাদের মাঝে এতটা আগ্রহ দেখিনি। আমি এমন একটা দেশে এসেছি যেখানে শুধু ফুটবল খেলাই হয় না, ফুটবলটা এখানে নেশা। ফুটবলই জীবন।’
কথাটা বলেছেন জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। এমন এক সময়ে ঢাকার মাটিতে পা পড়ল ফিফা প্রেসিডেন্টের, যখন তার আসার একদিন আগেই শক্তিশালী ভারতকে তাদের মাটিতেই ১-১ গোলে রুখে দিয়েছে বাংলাদেশ। তাই প্রথমবারের মতো ঢাকার মাটিতে পা দিলেও ফুটবল নিয়ে দেশের মানুষের উন্মাদনা ঠিকই টের পেয়েছেন খেলাটির অভিভাবক সংস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি। নিজেও প্রকাশ করলেন উচ্ছ্বাস। চাইলেন বিনিয়োগ।
এশিয়ান দেশগুলোতে ঝটিকা সফরে বেড়িয়েছেন ফিফা প্রধান ইনফান্তিনো। সেই ধারাবাহিকতায় মঙ্গোলিয়া ঘুরে বুধবার দিবাগত রাতে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা থাকলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে ভোরে এসে পৌঁছায় ইনফান্তিনোকে বহনকারী বিমান।
এরপর সারাদিনই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন ফিফা প্রধান। সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সৌজন্য সাক্ষাৎ-আলোচনা পর্ব সেরেছেন। সেখানে তার হাতে লাল-সবুজদের ১০ নাম্বার জার্সি তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। আর ফিফার তরফ থেকে ইনফান্তিনোর উপহার ছিল ‘শেখ হাসিনা ১০’ লেখা একটি জার্সি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবন পরিদর্শনে যান ফিফা প্রধান। সেখান থেকে চলে আসেন ঢাকার অভিজাত এক হোটেলে, সংবাদ সম্মেলনের জন্য। প্রায় একঘণ্টা দেরিতে শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময় মাতিয়ে রাখলেন ফিফার নবম এ প্রেসিডেন্ট। নিজে হেসেছেন, হাসিয়েছেন সবাইকেই। এসেই করলেন বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রশংসা।
‘আপনাদের দলটা মাত্রই ভারতের সঙ্গে দারুণ খেলে ড্র করল। কেবল শেষ মিনিটের গোলে ১-১ ব্যবধানে অমীমাংসিত রয়ে গেল। ওই গোলটা না হলে বাংলাদেশই জিতে যেত। ফুটবলে সবকিছুই সম্ভব।’
‘শেষ কয়েক বছরে এই দেশের ফুটবলে দারুণ উন্নতি হচ্ছে। পুরুষ-নারী সবখানেই।’
ট্র্যাফিক জ্যাম নিয়ে এমনিতেই কুখ্যাতি আছে ঢাকার। গত কয়েক বছর ধরে মেট্রোরেলসহ একাধিক উন্নয়ন কাজের জেরে সেই জ্যামের অবস্থা আরও বেগতিক। এদিন জ্যামে প্রায় একঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে ইনফান্তিনোকেও। তা নিয়ে মজা করতে করতেই বললেন, একদমই সময় নষ্ট করেননি তিনি।
‘ধন্যবাদ ট্র্যাফিক জ্যামকে! এই জ্যামের কারণেই আমরা এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে গাড়িতে বসে আলোচনা করতে পারলাম। সেখানে আমরা ভবিষ্যতের ফুটবল উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছি। এই দেশের এবং এই অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে। এখানে ফুটবল নিয়ে যে উন্মাদনা দেখেছি, আমি বলবো এখানে ফুটবলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ফুটবলকে আরও জনপ্রিয় করতে ফিফা বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ায় কাজ করে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, এ অঞ্চলে সবার জন্যই ফুটবলকে কাছে আনতে কাজ করছি আমরা।’
‘আমি যখন বাংলাদেশ ছাড়বো তখন আমার এক চোখ কাঁদবে আর আরেক চোখ হাসবে। কারণ আমি জানি একটা ফুটবলই ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটাবে। আমাদের যা করতে হবে তা হল, সবার জন্য স্বপ্ন ও আশার যোগান দেয়া।’
সংবাদ সম্মেলন শেষেই লাওসের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা ইনফান্তিনোর। যাওয়ার আগে বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নতির জন্য এগিয়ে আসতে বললেন সবাইকেই, ‘আমাদের স্বচ্ছ একটা পরিকল্পনা আছে। আমরা বাংলাদেশের পেশাদার লিগগুলোর দিকে নজর রাখছি। একটা বিষয়ে সবার মতাদর্শ এক যে, বেশি করে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা দরকার। সরকার, ফেডারেশন, ফিফা। সবাইকে এখানে বিনিয়োগ করতে হবে। আমরা কিশোর-কিশোরীদের জন্য আরও কিছু টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে চাই। আমরা চাই আরও বেশি করে সবার মাঝে উৎসাহ সৃষ্টি করতে।’
ছেলেদের পাশাপাশি বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলও এগিয়েছে দারুণ। তাই মেয়েদের ফুটবলেও সমান বিনিয়োগ ও অংশগ্রহণ চেয়েছেন তিনি, ‘ছেলেদের ফুটবলে অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বীতা। জাপান, কোরিয়া, ইরানদের মতো দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে গেলে অনেকে হালই ছেড়ে দেয়। অথচ বিশ্বকাপে এই অঞ্চল থেকে সুযোগ পায় মাত্র ৪টি দল। পরের বিশ্বকাপে সেটা আরও বাড়বে। এখানে ছেলেদের চেয়ে বিশ্বকাপে মেয়েদের খেলার সু্যোগই বেশি।’
‘বিশ্বজুড়ে মেয়েদের ফুটবল ভালো করছে। বাংলাদেশেও। তাই আমি বাফুফেকে বলেছি তারা যেন মেয়েদের ফুটবলে বেশি করে বিনিয়োগ করে। ইউরোপের মতো এসব অঞ্চলে এখনও মেয়েদের ফুটবল খুব একটা শক্তিশালী হয়নি। ছেলেদের চেয়ে এ অঞ্চলে মেয়েদের সম্ভাবনাই বেশি। তাই আমি চাই এই দিকটায় যেন একটু ভালোভাবে নজর দেয়া হয়। ’
ইনফান্তিনো ফিফার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট যিনি বাংলাদেশ সফরে আসলেন। এর আগে আশির দশকে হোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ প্রথম ফিফা সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর ২০০৬ ও ২০১২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন সেপ ব্ল্যাটার।