তখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা তুঙ্গে। রাষ্ট্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সীমান্তরক্ষীরা নির্বিচারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করছে, অগ্নিসংযোগ করছে, তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে জন্মভূমি থেকে। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা তখনও ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। গুলির মুখ থেকে বেঁচে এসে এদেশীয় মানুষের আপ্যায়নে মুগ্ধ তারা। এ দফায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা তখন পাঁচ লাখেরও বেশি। এসব রোহিঙ্গারা টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং গ্রামে গঞ্জে অবস্থান করছে। তাদের মুখে মুখে এখন শুধু এদেশের মানুষের ভালোবাসার কথা। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে একেবারে প্রান্তীক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত সবার ভালবাসা এবং আন্তরিকতা রোহিঙ্গাদের অনেকটাই অভিভূত করেছে।
রোহিঙ্গাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তারা বললেন, বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসা, আন্তরিকতা ও সহযোগীতার কথা তারা জীবনেও ভুলতে পারবেন না। আশ্রিত সব রোহিঙ্গারা অকপটে কৃতজ্ঞতার কথা স্বীকার করছেন। শরণার্থী ক্যাম্প, নদীর পাড়, সড়কের পাশে, বাসা-বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এবং শিশু-কিশোরদের সাথে আলাপকালে স্থানীয়দের প্রতি তাদের ভালবাসা ও সহযোগীতার কথাই জানা গেছে।
স্থান সংকুলান না হওয়ায় রাতে ভালো করে ঘুমাতেও পারে না রোহিঙ্গারা। এরপরও চোখে মুখে যেন আনন্দের সুবাতাস। কেউ না কেউ এসে দিয়ে যাচ্ছে খাবার। চাহিদা না মিটলেও যে যেভাবে পারছে রোহিঙ্গাদের খাবারের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞল থেকে প্রতিদিন বাস-ট্রাকে করে ত্রাণ আসছে প্রতিনিয়ত। স্থানীয়রা যে যেভাবে পারছে সেইভাবে তাদের থাকার খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। যে না পারে সে অন্তত কলসী মাথায় নিয়ে পানি খাওয়াচ্ছে তাদের। সহযোগীতার যেন অভাব হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের।
মাতৃভূমি থেকে পালিয়ে এসে নতুন যে দেশে তারা এসেছে, এদেশের মানুষ আর মাটি যেন আরও খাটি। এখানকার মানুষের ভালবাসায় তারা মুগ্ধ। অথচ এদেশ তাদের নয়। তাদের দেশ মিয়ানমার। নাফের ওপাড়ে। না, সেখানে এখন কিছুই নেই। নেই ঘর, নেউ সংসার, নেউ গোয়াল ভরা গরু। সবকিছুই শেষ । এখন সেখানে শুধু পুড়ি যাওয়া ঘরের ছাই অবশিষ্ট আছে। মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত। রোহিঙ্গাদের সাথে কথা হলে উঠে আসে তাদের সুখ-দুঃখের কথা।
কুতুপালং সি ব্লকে কথা হয় হালিমের সাথে। তিনি রাখাইনের বুথেডংয়ের জব্বারপাড়ার বাসিন্দা। তার কুড়েঘরে ঢুকতেই চট বিছিয়ে দিলেন। বসলাম তার পাশে। ওই সময় জুনাইদ মুড়ি এবং বিস্কুট খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘এদেশের মানুষ অনেক ভালো। যেখানে আমাদের দেশের সরকার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে, নির্যাতন করেছে সেখানে এদেশের মানুষ আমাদের খেতে দিচ্ছে। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে!’ জুনাইদের সাথে কথা শেষ করে চলে আসার পথে দেখা হয় মংডু’র টাউনশিপের সিতরীক্ষা এলাকার শফিউল্লাহর ছেলে আবদুল মজিদের সাথে। তিনি বলেন, ‘তিনি (অং সান সুচি) আমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এদেশের মানুষের ভালবাসা ও সহযোগীতা পেয়েছি। এখানে এসে নতুন করে জীবন পেলাম।
পথ চলতে চলতে গিয়ে পৌঁছলাম বালুখালী। সেখানেতো রাস্তার পাশে পাহাড়ে যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই শুধু রোহিঙ্গাদেরকেই চোখে পড়বে। রাস্তার পাশে ঝুপড়ির এক কোণায় চোখে পড়ে শতবর্ষী এক বৃদ্ধ মহিলাকে। তার ডান হাতে একটি লাঠি। বয়সের চাপ বহন করে ওই লাঠি। মংডু’র হাচ্ছুরতা গ্রামের এই বৃদ্ধ মহিলাটির নাম আলফা বেগম। জানতে চাইলাম, কেমন আছেন? প্রথম প্রশ্নেই অনর্গল কথা বলতে লাগলেন বৃদ্ধা। তিনি বললেন, ‘অ বাজি এদেশের মানুষ এন ভালাদে ন, জাইনতাম। পর দেশ আইলেও নিজের দেশেতুন ভালা আছি। রাতিয়া থাকিয়ে হষ্ট আইলেও, খানাফিনাদ্যি ভালা আছি’। যার অর্থ হলো- ‘এদেশের মানুষ এত ভালো তা জানতাম না। পর দেশ হলেও নিজের দেশ থেকে ভালো আছি। রাতে একটু কষ্ট হলেও খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা হচ্ছেনা।’ এভাবে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা জানালেন তাদের কথা। আর এ কারণেই বাঙ্গালীদের নিঃস্বার্থ ভালবাসায় মুগ্ধ হচ্ছেন এপারে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
এ বিষয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সমন্বয়কারী, সহকারী কমিশনার প্রণয় চাকমার সঙ্গে কথা। তিনি জানান, সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যাতে রোহিঙ্গাদের কোন সমস্যা না হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ত্রাণ সামগ্রীগুলো সবার মাঝে বন্টন করে দিচ্ছি। সবাই যাতে ঠিক মতো খাবার পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখছি। বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়ে রোহিঙ্গারা খুশি। তবে প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়গুলো তাদের ভোগাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে। কথা হয় কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে।
এটা খুবই দীর্ঘ এবং অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক ভ্রমণ ছিল। এসময় আমার ক্ষতস্থানটিতে ইনফেশন হয়ে যায়। আমরা মিয়ানমারে সবকিছু ফেলে চলে এসেছি তা চিন্তা করে আমি খুবই দুঃখিত বোধ করতে থাকি। নিরাপদভাবে বাংলাদেশে পৌঁছতে পেরে এবং খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থানসহ চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার কারণে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ বোধ করছি। কিন্তু আমাদের কোনো আশ্রয় নেই, নেই কোনো ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎ আছে বলে তখনই মনে করতে পারব যখন দেখব বাড়িতে শান্তি আছে। কিন্তু যা বর্তমানে আমাদের সামনে ঘটছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।‘আমরা বাড়ি ফিরতে চাই এবং শান্তি চাই। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্ব আমাদের সংকট দেখছে এবং তারা আমাদের সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ কথাগুলো ইব্রাহিম নামের এক রোহিঙ্গার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)