বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয় ‘তিস্তা চুক্তি’। শুক্রবার চারদিনের সফরে ভারত পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ৩৩টি চুক্তিত স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। এসব চুক্তির মধ্যে বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি নিয়ে দেশবাসীর আগ্রহ অনেক।
বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তা। কিন্তু কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের সিকিমে। সিকিম থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলা-গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং রংপুরকে প্রভাবিত করেছে। ওই অঞ্চল দেশের অন্যতম শস্যভান্ডার বলে পরিচিত।
তিস্তা বিষয়ে ২০০৩ সালের এশিয়া ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ফ্ল্যাড প্লেইন এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ১৪ ভাগ কাভার করেছে তিস্তা। এবং তা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭.৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য সরাসরি জীবিকার ব্যবস্থা করেছে।
বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই নদীটি অনেকদিন ধরে পানি সংকটে ভূগছে। ফলে এই জনপদের কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে ব্যহত হচ্ছে। আবার বর্ষায় একতরফাভাবে ভারতের ছেড়ে দেয়া পানিতে বির্স্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ভোগান্তিতে পড়তে হয় অসংখ্য মানুষকে। ভাঙনে নিঃস্ব হয় হাজার হাজার পরিবার। মূলত ভারতের দ্বিমুখী নীতির কারনেই তিস্তার এই অবস্থা বলে অভিযোগ রয়েছে। নিজেদের স্বার্থে তারা তিস্তার পানির পূর্ণ ব্যবহার করছে।
যদিও তিস্তা কিছুটা আগের অবস্থা ফিরে পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের পরিচালক মোঃ মাহমুদুর রহমান। চ্যানেল আই অনলাইনকে মোঃ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘গত দুই বছরে তারা তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে পারছেন। এর ফলে কৃষকরা ভালোভাবে কৃষিকার্য চালাতে পারছেন। গতকাল বৃহস্পতিবারও তিস্তায় ১৩ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের কথা তিনি নিশ্চিত করেন। তিস্তা চুক্তি হলে এই সংকট থাকবে না বলেও তিনি জানান।
ভারতের সিকিমে তিস্তা নদীতে ছোট-বড় অসংখ্য ড্যামের নেটওয়ার্ক রয়েছে। দার্জিলিং অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প রয়েছে। সিকিমেও নেয়া হয়েছে একটি বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। তিস্তার বাংলাদেশ অংশের অবস্থা ভালো থাকলে কৃষিকাজের পাশাপাশি এখানেও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এসব জনপদের জমিতে পানি সেচ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে নির্মাণ করা হয় তিস্তা ব্যারেজ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সেচ প্রকল্প এলাকায় সেচ দেয়া এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে ২০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। এরমধ্যে শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক। আর নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন চার কিউসেক পানি।
কিন্তু কয়েক বছর বাংলাদেশ তিস্তা ব্যারেজের সুবিধা নিতে পারলেও ১৯৯৬ সালের শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। হুমকির মুখে পড়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প। গজলডোবায় পানি প্রত্যাহারের মাত্রা ডালিয়াকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দেয়। শুধু তাই নয় শুষ্ক মৌসুম শেষ হওয়ার পর পানির প্রবাহ ছেড়ে দেয়ার ফলে বাংলাদেশের বিপুল অংশ তলিয়ে যায়। এরপর থেকেই ভারত তিস্তার পানির একতরফা প্রবাহ অব্যাহত রাখে।
তিস্তাকে বাঁচাতে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই ভারতের সাথে চুক্তি করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ অনেক বেশি থাকলেও ভারত নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধামন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে দুদেশের মধ্যে চুক্তির বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এই চুক্তির বিরোধিতা করেন। এমনকি নরেন্দ্র মোদির সরকারও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তির বিষয়টি মেনে নেয়। কিন্তু মমতা মেনে নেননি।
২০১৫ সালে মোদির ঢাকার সফরকালে দু্ই দেশের স্থল সীমান্ত চুক্তির দলিল বিনিময়কালে মমতা ব্যানার্জী তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। কিন্তু তিস্তা নদীর বণ্টন বিষয়ে তিনি নীরবতা পালন করেন।
এখন সবাই তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের দিকে। যদিও এই সফরেও তিস্তা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে চুক্তিটির বিষয়ে রূপরেখা আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।