এক বা দুই নয়। গুণে গুণে চারবার নিউজিল্যান্ড সফর করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু একবারও জয়ের মুখ দেখেনি টাইগাররা। সেটা সাদা বা রঙিন যে পোশাকেই হোক না কেনো। পুরনো দুঃস্মৃতি নিয়ে আবারও নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ। তিনটি করে ওয়ানডে ও টেস্টের সফর। বুধবার যার শুরু হচ্ছে ওয়ানডে দিয়ে। যেটা হতে পারে কিউই মাটিতে বাংলাদেশের জয়ের খাতা খোলার সিরিজ। নেপিয়ারে ম্যাচ শুরু হবে বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টায়।
অনেক বৈপরীত্য নিয়ে শুরু হচ্ছে। গত ১০ বছরে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের কাছে হারেনি বাংলাদেশ। অর্থাৎ, সেই ২০১০ থেকে কিউইদের কাছে নিজেদের মাটিতে অপরাজিত টাইগার বাহিনী। তবে এর উল্টো ছবিও আছে। সেই বাংলাদেশকেই আবার নিজেদের ঘরের মাঠে কোনদিনই জিততে দেয়নি নিউজিল্যান্ড।
নিরপেক্ষ ভেন্যুর সর্বশেষ লড়াইয়ে আবার এগিয়ে বাংলাদেশই। ২০১৭’র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কিউইদের হারিয়েছিল মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা বাহিনী। আর দুদলের মুখোমুখি শেষ পাঁচ ওয়ানডের ফলাফলেও বৈপরীত্যটা লক্ষণীয়। শেষ পাঁচ ম্যাচের মাত্র একটি হেরেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে শেষ পাঁচ ম্যাচের চারটিতে হেরেছে নিউজিল্যান্ড।
ভারতের কাছে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ৪-১ ব্যবধানে হেরে একরকম গর্তে নিউজিল্যান্ড। সিরিজে একটি ম্যাচেই মাত্র কিউইরা জিততে পেরেছে, যে ম্যাচে আবার ভারত অলআউট হয়েছিল মাত্র ৯২ রানে। কিন্তু বাকি ম্যাচগুলোতে ভারতীয়দের বিপক্ষে চাপ নিতে পারেনি তারা।
ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগে তাই অনেকের ধারণা, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে জিততে বাংলাদেশের জন্য এটা সেরা সুযোগ। ইনজুরির কারণে যদিও দলের সেরা তারকা সাকিব আল হাসান ও ফর্মে থাকা পেসার তাসকিন আহমেদ দলে নেই।
ভারতের কাছে ওয়ানডে হারলেও কিউইরা টি-টুয়েন্টি জিতেছে ২-১ ব্যবধানে। হারা ওয়ানডে সিরিজে কেন উইলিয়ামসন, রস টেলর ও টম ল্যাথাম প্রত্যেকেই রানের মধ্যে ছিলেন। সঙ্গে ট্রেন্ট বোল্ট ও ম্যাট হেনরিরা বল হাতে সফলতা দেখিয়েছেন।
তবে কিউইদের চিন্তা টিম সাউদিকে নিয়ে। কোহলিদের বিপক্ষে মোটেই নিজের মতো ছিলেন না এ পেসার। সাউদির ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশের বিপক্ষে পেস আক্রমণে যোগ হতে পারেন লোকি ফার্গুসন। তবে স্পটলাইটে থাকবেন ম্যাট হেনরিই। ভারতের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে চার উইকেট পাওয়া এই বোলারের পেসটাও দারুণ।
কিউইদের পেস আক্রমণ সামলানোর জন্য প্রস্তুত আছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তামিম ইকবালের সঙ্গে সৌম্য সরকার ও লিটন দাস তাল মেলাতে পারলে পরের দিকে কিউইদের ওপর চাপ বাড়াতে পারবেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা। শেষ দিকে ফিনিশিং টাচটা দিয়ে দিতে পারেন সাব্বির।
সৌম্যকে নিয়ে আশা যায়, কারণ ৩৫.৯ গড়ে রান করা এই ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইকরেটটা প্রায় একশ’র কাছাকাছি (৯৮)। এই ম্যাচে স্পটলাইটেও থাকবেন তিনি। কারণ, সবশেষ ওয়ানডে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিলেটে অপরাজিত ৮০ রানের ইনিংস খেলেছেন তিনি।
পেসে নিউজিল্যান্ডের ইটের জবাবে পাটকেল ছোড়ার মতো রসদ আছে বাংলাদেশের। মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে রুবেল হোসেন ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
এই ম্যাচের আগে নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পত্রিকা মোস্তাফিজকে বিপজ্জনক বোলার বলে উল্লেখ করেছে। সেই ফিজকে বিশ্বের সব পেসারদের সেরা ধূর্ত প্রতিনিধিও বলেছে। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের ষষ্ঠ স্থানে আছেন মোস্তাফিজ। স্লোয়ার এবং কাটারের অস্ত্রে ভরপুর ফিজের ওয়ানডে ইকোনমিটাও দুর্দান্ত। ৪.৬ ইকোনমিতে তার বোলিং গড় ২০.৬।
পেসের সঙ্গে বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণটা তো আরও বেশি শক্তিশালী। সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে যদিও বাড়তি চাপ থাকবে মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাঈম হাসানের ওপর। ২১ বছরের মিরাজের বোলিং ইকোনমি ৪.৩। আর ১৭ বছরের নাঈম তো অভিষেক টেস্টে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে গত বছরই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ৪০ উইকেটই তুলে নেন বাংলাদেশের স্পিনাররা। ফলে নিউজিল্যান্ডের রানের চাকা আটকে দিতে পারেন এই স্পিনাররাই।
যদিও নিউজিল্যান্ডে আদর্শ স্পিন উইকেট পাবেন বলে আশা করেন না বাংলাদেশ কোচ স্টিভ রোডস। ম্যাচের আগেরদিন বলেছেন, ‘উইকেট থেকে আমি অনেক বেশি টার্ন আশা করি না। আমার মনে হয়, পিচে বাউন্স এবং গতি থাকবে। স্পিনারদের জন্য যদি পিচে কিছু থাকে, সেটা অল্প হলেও সুবিধা নিতে পারব।’
কিউইদের বিপক্ষে নিজের দলকে অবশ্য ‘আন্ডারডগ’ হিসেবেই দেখছেন রোডস। বলেছেন, ‘আমরা জানি এটা খুবই কঠিন হবে। আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে। আমরা নিঃসন্দেহে আন্ডারডগ। তবে আন্ডারডগ হয়ে আমরা অনেককে অবাক করে দিতে পারি। আমি মনে করি, আমাদের হারাতে গেলে নিউজিল্যান্ডকে অনেক অনেক ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে।’
আন্ডারডগ মনে করলেও আবার জেতার আশা ছাড়েননি বাংলাদেশ কোচ, ‘এটা সত্যিই যে কাজটা কঠিন, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা জিততে পারি না।’
ভারত চলে যাওয়ার পর সামনে নতুন প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের শক্তি বা দুর্বলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন একটা সময় নেই নিউজিল্যান্ডের। কোহলি-রোহিতদের কাছে ৪-১’র হার থেকে বের হওয়াই তাদের আসল লক্ষ্য।
জয়ই যেহেতু একমাত্র টার্গেট, তাই বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা কোনো পরিকল্পনাও নেই নিউজিল্যান্ডের। দলের কোচ গ্যারি স্টিডের কথায় তেমনটাই ইঙ্গিত, ‘ওয়ানডেতে শুরু থেকে আমাদের একই পরিকল্পনা। ভারতের বিপক্ষে যেমনটা ছিল, বাংলাদেশের বিপক্ষে তার চেয়ে বেশি কোনো পরিকল্পনা নেই। আমাদের একটাই কথা, আমরা ক্রিকেটটা খেলতে চাই।’
কোচ তেমন কোনো পরিকল্পনার কথা না বললেও বাংলাদেশ ম্যাচের আগে কার্ডিফ স্মৃতি মনে পড়ছে মার্টিন গাপটিলের। ইংল্যান্ডে হওয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেই ম্যাচে কিউইদের ধরাশায়ী করেছিল টাইগাররা। সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ টেনে নিউজিল্যান্ড ওপেনার ম্যাচের আগেরদিন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের একটি মানসম্পন্ন দল আছে, তারা সেটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দেখিয়েছে। তাদের কাছে আমরা শেষ ম্যাচটা হেরে গিয়েছিলাম!’
ভারতের বিপক্ষে চতুর্থ ওয়ানডেতে চোটে পড়েছিলেন। চোট থেকে সেরে ওঠায় বাংলাদেশ সিরিজে সুস্থ মার্টিন গাপটিলকেই পাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। প্রথম দুই ওয়ানডে থেকে কলিন মুনরো বাদ পড়ায় হেনরি নিকোলসের সঙ্গে ওপেন করবেন মারকুটে এই ব্যাটসম্যান।
আর বাংলাদেশ দলে সাকিব না থাকায় ব্যাটিং শক্তি বাড়াতে রুবেল হোসেনের জায়গায় সুযোগ পেতে পারেন পেস-অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন।
সেখানে এর আগে কোনো ম্যাচেই যেহেতু জিততে পারেননি বাংলাদেশ। তাই নেপিয়ারেও জেতার প্রশ্ন-প্রসঙ্গ আসছে একটু রয়েসয়েই! তবে নেপিয়ারের পিচ ভাবাচ্ছে স্বাগতিকদের। গত মাসেই ভারতের বিপক্ষে এই মাঠে তারা অলআউট হয় ১৫৭ রানে।
নেপিয়ার এমনিতেই সুন্দর মাঠ। তার ওপর মঙ্গলবারের আবহওয়াটাও দারুণ। ওয়েদার ডটকম জানাচ্ছে, বুধবারও ঝকঝকে থাকবে নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কের আকাশ। বাংলাদেশের পারফরম্যান্সটাও তাতে ম্যাকলিন পার্কের আকাশের মতো হলেই হয়।