মেয়ে একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়তো। ওকে স্কুল থেকে নেয়ার জন্য আমি মাঝেমধ্যে যেতাম এবং স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে অভিভাবকদের বিভিন্ন কথোপকথন শুনতাম। কথা প্রসঙ্গে অনেক মাকেই গর্বের সাথে বলতে শুনেছি ‘জানেন আপা আমার বাচ্চাতো বাংলা পারেই না। ইংরেজি বই দেন পড়ে ফেলবে, আর বাংলা বই পড়তেই চায় না । বাচ্চারা পড়বেইবা কীভাবে, বাংলাটা কিন্তু বেশ কঠিন।’ কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, ‘আমার ছেলেতো বাংলা ভাষাটাও ঠিকমত বলতে পারে না। খুব নাকি কঠিন মনে হয়।’ আমি যেহেতু ঐ সমাবেশে নিয়মিত নই, অনেককে চিনতামও না তাই কথাগুলো শুধু শুনতাম ।
শুনে অবাক হতাম। ভাবতাম বাচ্চাগুলো না হয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে। পঠন-পাঠনে তাদের কাছে বাংলা একটু কঠিন লাগতেই পারে। কিন্তু তাতে মায়েদের গর্বিত হওয়ার মত কী ঘটলো? মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ওই বাংলা না জানা ছাত্রছাত্রীগুলো আসলে ইংরেজিটা কেমন জানে, কতটা জানে? নিশ্চয়ই বাচ্চাগুলো ইংরেজিতে ওস্তাদ। কিন্তু পরে সূত্র মারফত জানতে পেরেছি, সন্তান বাংলাটা পারে না বলে যেসব অভিভাবক গর্বিত ছিলেন, তাদের সন্তান নাকি শুদ্ধ ইংরেজিটাও পারতো না। এই তথ্যটা পেয়ে মনে পড়ল কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ‘বাংলাটা ঠিক আসেনা’ কবিতাটির কথা —-
“বাংলা যেন কেমন-কেমন, খুব দুর্বল প্যানপ্যানে
শুনলে বেশি গা জ্ব’লে যায়, একঘেয়ে আর ঘ্যানঘ্যানে।
কীসের গরব? কীসের আশা?
আর চলে না বাংলা ভাষা
কবে যেন হয়, ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না?
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।”
আরেকটি ব্যাপারও আমার মাথায় ঢুকতো না। তা হচ্ছে, যে মায়েরা ওখানে দাঁড়িয়ে বাংলাকে কঠিনতম ভাষা বলছিলেন, তারা বোধকরি অনেকে বাংলা মাধ্যমেই পড়াশোনা করেছেন। তাহলে তারাইবা কেন বাংলাকে কঠিন ও প্রায় অচ্ছুৎ একটি ভাষা বলে মনে করছিলেন। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের সবার জন্যই আধুনিক দুনিয়ায় ইংরেজি জানাটা খুব জরুরি। আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি, কাজেই এটা না জানা থাকলে নিজেরই বিপদ। কিন্তু তাই বলে বাংলাকে মানে নিজের মায়ের ভাষাকে খাটো করে ইংরেজি চর্চা করাটা হীনমন্যতার পরিচয় বহণ করে। বরং নিজের ভাষাটা শুদ্ধভাবে শিখে অন্য একটি ভাষা শেখাই উত্তম। এ প্রসঙ্গে মাইকেল মধুসুদন দত্তের কথা স্মরণে রাখা উচিৎ। কবি তাঁর জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন: মায়ের ভাষাকে ছোট করলে, নিজেকেই করুণার পাত্র হতে হয় এবং তিনি তা স্বীকার করে গিয়েছেন তাঁর রচনায়। এই বাংলাদেশেই বহু প্রতিষ্ঠিত মানুষ আছেন, বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ জন্মেছেন যারা বাংলা ও ইংরেজিতে সমান দক্ষ।
আমরা বাংলায় কথা বলি, গান গাই, লেখাপড়া করি, আড্ডা মারি, গালাগালি করি, মিটিং-মিছিল করি তাহলে এই ভাষায় কথা বলা ও লেখায় আমাদের এত ভুল হয় কেন? কেন আমরা বাংলায় এত দুর্বল? যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, তাদের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী মোটেই বাংলা চর্চা করে না বলে বাংলা পারে না। অনেকে হয়তো বাংলা জানা বা শেখাটাকেই অর্থহীন ও সেকেলে বলে মনে করে, তাই তারাও শেখে না। কেউ কেউ মনে করে বাংলা শিখে কী হবে, চাকরির জন্যেতো দরকার ইংরেজি । সত্যিই তাই প্রচুর প্রাইভেট কোম্পানি, কর্পোরেট ও এনজিও আছে যেখানে কনটেন্ট জানার চেয়ে ইংরেজি জানাটা জরুরি। বাংলা সেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
আর বাংলা মাধ্যমে যারা পড়ছে, তাদেরও বেশ কষ্ট করে সঠিক বাংলাটা শিখতে হচ্ছে। ইংরেজি ও অংক শেখার অবস্থা আরো জটিল ও ভয়াবহ। কিছু ছাত্রছাত্রী তাদের পরিবার ও প্রাইভেট শিক্ষকের দৌলতে সঠিক ভাষাজ্ঞান লাভ করলেও দেশের অগণিত শিশু-কিশোর ভুলে ভরা, নীচু মানের বইগুলোই পড়তে বাধ্য হয় এবং হচ্ছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তক যে কতটা ভুলে ভরা, সে আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। জানুয়ারি থেকেই এই পাঠ্যপুস্তকের ভুল নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে। প্রতি বছরই তোলপাড় হয় কিন্তু অবস্থার উন্নতি ঘটে না। আর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের প্রধান সমস্যা হচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় টেক্সট ও রেফারেন্স বই অধিকাংশই ইংরেজিতে। ভাষা শিক্ষার এই শংকর অবস্থা আমাদের খুবই ঝামেলায় ফেলে দেয়। আমরা না শিখতে পারি ইংরেজি, না বাংলা। কোনটাই মানসম্মতভাবে শেখা হয়ে উঠে না।
এই কথাটা কেন বললাম, এর কারণ হচ্ছে বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে অনেক বাংলা কপি আমাকে দেখতে হয়েছে বা হয়। দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ বাংলা লেখা দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। এদের কেউ ছাত্রছাত্রী, কেউবা পেশাজীবি, কেউবা চাকরিজীবি। অবশ্য পাঠ্যপুস্তকের যে অবস্থা, তাতে শুরুতেই আমাদের ভাষাশিক্ষার বারোটা বাজার জন্য যথেষ্ট। সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ভাষাগত ও কাঠামোগত অনেক ভুল চোখে পড়ে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন আব্বা বলতেন পত্রিকা পড়, বই পড় তাহলে ভাষা শিখবে। বাংলা শেখার জন্য বাংলা পত্রিকা ও ইংরেজি শেখার জন্য ইংরেজি বই ও পত্রিকা। ভাষা শেখার জন্য আসলে বইয়ের কোন বিকল্প নেই। তা না হলে গ্রামে বেড়ে ওঠা, গ্রামের স্কুল, কলেজ থেকে পাশ করে আসা মানুষগুলো বাংলা ও ইংরেজি দু’টো ভাষাই এত ভালভাবে শিখেছিল কেমন করে?
সেই দিক থেকে দেখলে আমরা বলতেই পারি পাঠ্যপুস্তক দুর্বল ও ভুলে ভরা, বই পড়ার অভ্যাসটাও দিনে দিনে কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে, পত্রপত্রিকাও ক্রমশ গুটিয়ে আসছে, আর মানুষ এখন কোনকিছু পড়ার চাইতে দেখার ব্যাপারে আগ্রহী বেশি। শিশু থেকে বুড়ো সবাই এখন বই না পড়ে শুধু দেখি এবং সেটা রীতিমত এডিকশনের পর্যায়ে। ভাষা শেখার মাধ্যমগুলো আমরা হারিয়ে ফেলছি দিনে দিনে নিজেদের চর্চার অভাবে ।
সেদিন একটি রেডিও স্টেশনের একজন আরজে’র সাথে কথা হচ্ছিল। মেয়েটি যে কায়দায় বাংলা ভাষাটি বলছিল, তাতে আমার মনে হলো ওর বেশ কষ্ট হচ্ছে বাংলা বলতে। এমনকি কথা বলার সময় ও বেশ ছোট ছোট ইংরেজি শব্দেরও বাংলা খুঁজে পাচ্ছিল না। একটা পর্যায়ে দেখলাম মেয়েটি ’ছিয়ানব্বই’ ইংরেজিতে কী হয়, জানতে চাইলো। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো বিদেশেই বড় হয়েছে, তাই ভাষার এই ছন্নছাড়া অবস্থা। কিন্তু না, পরে দেখলাম ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে সে। এইসব এফএম রেডিও যখন চালু হলো, তখন ব্যাপক উৎসাহবোধ করেছিলাম। আধুনিক ও মজাদার একটা কিছু হলো। পথ চলতে চলতে শুরু হলো রেডিও শোনা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি হয়রান হয়ে পড়লাম আরজেদের ‘বাংরাজি’ শুনতে শুনতে। পরে অবশ্য কয়েকটি রেডিও তাদের আরজেদের উচ্চারণের ক্ষেত্রে অনেকটাই লাগাম টেনেছে। মানুষ হয় বাংলা বলবে, নয়তো ইংরেজি বলবে; দুটোর মিশ্রণে বাংরাজি শুনতে কারোই ভাল লাগে না।
কাজের ক্ষেত্রেও এ ধরণের আরো অনেক উদাহরণ দেখতে পারছি। কিছু কিছু কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী আছে, যারা বাংলা ভাষাভাষি, এদেশে জন্ম, এদেশে বেড়ে ওঠা এই মানুষগুলো এত অদ্ভুতভাবে বাংলা বলে যে অবাক লাগে। যখনই শুনি, তখুনি ভাবি কেন এরা এভাবে কথা বলছে? কেন এরা পারতপক্ষে বাংলা ব্যবহার করে না? বাংলা ব্যবহার করলেও এত ভুলভাবে কথা বলে কেন? এটাও কি এক ধরণের কমপ্লেক্স নয়?
সেদিন অত্যন্ত মাননীয় একজনের ফেইসবুক একাউন্টে গিয়ে তার পরিচিতিতে এত ভুল বাক্যগঠন ও তথ্যবিভ্রান্তি দেখলাম যে অবাক হয়ে গেলাম। তিনি সরকারের এতবড় একটা পদ অধিকার করছেন, অথচ তার একাউন্টে এত ভুল কী করে? কেউ কি তাকে ব্যাপারটা ঠিক করে দিতে পারেননি? উনি নিজেও কি এই ভুলগুলো ধরতে পারেননি? ইংরেজি না জানা বা কম জানার মধ্যে কোন সমস্যা নেই, সমস্যা সেখানেই যখন মানুষ তার এই না জানাটাকে প্রকটভাবে তুলে ধরে। ইচ্ছে করে বাংলা বাদ দিয়ে ভুল ইংরেজির ব্যবহার করার মধ্যে কোন গর্ব থাকে না।
আর তাই হয়তো উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রায় তিন বছর পরও বাংলায় বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড লেখা নিশ্চিত করা যায়নি। সরকার শুধু আদেশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে, সেই আদেশ মানুষ বাস্তবায়ন করছে কিনা, তার তদারকি নেই। দৈনিক প্রথম আলো রিপোর্ট করেছে, “ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ইংরেজি শব্দে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম রাখার প্রবণতা বেশি। এছাড়া ইংরেজিতে (রোমান হরফে) লেখা সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলকের ছড়াছড়ি । বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, দোকানপাট, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা । তবে সরকারি দপ্তরের সাইনবোর্ড বা নামফলক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলায় রুপান্তর হয়ে গেছে।” পথ চলতে গিয়ে একটু লক্ষ্য করলেই দেথা যায় যে ইংরেজিতে লেখা এসব বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, দোকানের নামে অনেক হাস্যকর ভুল চোখে পড়ে। কিন্তু তাতে কী, ইংরেজি বলে কথা। ভুল হলেও ইংরেজিতে ভুল। তবে একথাও ঠিক যে সমানভাবে বাংলা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সর্বস্তরে ভুল চোখে পড়ে এবং এটাই আমাদের জন্য বেশি লজ্জার। আবার কবির কথা মনে হলো —
” বিদেশে কী বাংলা চলে? কেউ বোঝে না বাংলা কথা
বাংলা নিয়ে বড়াই করার চেয়েও ভালো নিরবতা ।
আজ ইংলিশ বিশ্বভাষা
বাংলা ফিনিশ, নিঃস্ব আশা
বাংলা নিয়ে আজকাল কেউ সুখের স্বর্গে ভাসে না
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)