বাংলা ভাষাকে বিশ্বে পৌছাতে হলে এটাকে ব্রিজ আপ করতে হবে ইংরেজীর সাথে, এমনটাই মনে করেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান শায়ক।
প্রশ্ন: আপনি দেশের প্রকাশনা শিল্পকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। প্রকাশনা শিল্পের এখনকার অবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?
কামরুল হাসান শায়ক: বাংলাদেশের এখনকার প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি, যে বাজেট সম্প্রতি পাশ হলো তাতে প্রকাশনা শিল্পের জন্যে বিশেষ ভাবনার একটা বিষয় ছিল। আমরা দেখেছি যে, গতানুগতিকভাবে প্রকাশনা শিল্পের জন্যে সংষ্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটা বরাদ্দ থাকে। গেল বছরের মতো এবারও তাই আছে।
প্রশ্ন: আপনাদের প্রত্যাশা কী?
কামরুল হাসান শায়ক: সরকারি বেসরকারি উদ্যোগের জয়েন্ট কোলাবরেশন, আমাদের চাহিদার জায়গাগুলো সরকারকে বোঝানো। আমাদের দক্ষতা যোগ্যতারও একটি বিষয় আছে। আর আমাদের সুপারিশগুলো সরকার কতোটা আন্তরিকতার সাথে দেখছে সেটিও দেখার বিষয়। তবে আশার বিষয় হলো- এই জায়গাগুলোতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছে। কিন্তু যতোটা ভাবছে তা আমাদের দৃষ্টিতে যথেষ্ট না।
প্রশ্ন: বিশ্ব মানের সাথে তুলনা করলে সেই জায়গায় আমরা কি পিছিয়ে আছি প্রকাশনা শিল্পে?
কামরুল হাসান শায়ক: আমরা তো প্রচণ্ড রকমভাবে পিছিয়ে আছি। যেমন, মনে করেন যে, আমরা মাত্র ভাবছি এখন। বিশ্বমানের জায়গায় যেতে হলে ভাষার একটি বিষয় আছে। বাংলা ভাষাকে বিশ্বে পৌঁছাতে হলে এটাকে ব্রিজ আপ করতে হবে ইংরেজীতে। ইংরেজীতে যেতে হলে অনুবাদের উপরে আমার বড় বাজেট চিন্তা করতে হবে। সেই চিন্তা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে শুরু করেছে।
প্রশ্ন: অনুবাদ নিজে তো একটা শিল্প?
কামরুল হাসান শায়ক: অনুবাদ নিজে একটা শিল্প। কিন্তু এই শিল্পের পেছনে তো অনেক টাকা খরচ করতে হবে। কারণ মেধাবী মানুষদের এখানে ইনক্লুড করতে হবে। আমাদের দেশে অনুবাদ করার মতো সেই মানের ব্রিলিয়ান্ট মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এই জায়গায় আমাদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনুবাদের এক্সপার্ট যারা, যেমন- দিল্লীকেন্দ্রীক আছে, ইউকেকেন্দ্রীক আছে। অনুবাদের উপরে তারা ডেডিকেটেডলি কাজ করেন।
সম্প্রতি মাননীয় সংষ্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এই বিষয়ে ভাবছেন। আমাদের ভাষা ইন্সটিটিউট আছে। ওখানেও অনুবাদের একটি শক্তিশালী উইং থাকতে পারে। যেখানে বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন ভাষায় কিংবা ইংরেজী মাধ্যমে ট্রান্সলেট করে আমাদের সাহিত্য ও প্রকাশনাকে শুধু দেশে না সারা দুনিয়াতে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি। পাশাপাশি আমাদেরকে কী করতে হবে? সারাদেশে আমাদের যে পাঠাগারগুলো ঝিমিয়ে আছে- এই জায়গায় বড় জাগরণ দরকার। পাঠাগার আন্দোলনকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
প্রশ্ন: এখন মাদক বিরোধী আন্দোলন চলছে- এই মাদকের বিরুদ্ধে বই বড় অস্ত্র হতে পারে?
কামরুল হাসান শায়ক: মাদকের বিরুদ্ধে বই এবং আমাদের সংস্কৃতি চর্চা, গান বাজনা সব শাখাকে যদি অর্গানাইজ করে জাগরণের দিকে নিতে পারি তাহলে মানুষ অবশ্যই বিপথগামীতার পথ পরিহার করবে।
প্রশ্ন: আগে বিশেষ দিনে বই উপহারের কালচার ছিল সেই জায়গা থেকে আমরা সরে এসেছি- এটিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
কামরুল হাসান শায়ক: এই জায়গায় এভাবে চিন্তা করতে চাই যে, আমি তাদেরকে দোষ দিতে চাই না। আমি জোর করে বলি যদি বই উপহার দিন। যাকে উপহার দিচ্ছি তিনি যদি খুশি না হন তাহলে কী হবে? এমন একটা কালচার তৈরি করতে হবে যে, বই দেওয়ার কাজটিও প্রেস্টিজিয়াস আর যে বই গ্রহণ করছেন তার ভেতরেও সেই উদ্দীপনা থাকতে হবে। আগে আমাকে ওই কাজটি করতে হবে। আমি যদি স্লোগান সর্বস্ব বলি- ইন্টেলেকচুয়াল ভাষায় বলি, বই উপহার দিন। বই উপহার দিলে এটা হবে, ওটা হবে। এর চেয়ে জরুরি তার ভেতরে বই পড়ার মোটিভেশন তৈরি করা। তাকে পাঠক হিসেবে তৈরি করতে হবে।
আপনি যদি ভালো পাঠক হন তাহলে বই পেলে কিন্তু আমি খুশি হবেন। এই জন্যে বলছিলাম- পাঠাগার আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা পাঠক তৈরি করতে পারি। আমাদের প্রজন্মকে একেবারে ছোটবেলা থেকে, ছোটবেলায় যেমন আমরা খেলনা দিচ্ছি তেমনি বইকেও আমরা খেলনা হিসেবে দিতে চাই। যেন সাইকোলজিক্যালি শিশু মনে করে বইটাও একটা আনন্দের বিষয়। বই প্রকাশ করতে হবে সেই শিশুদের জন্যে সেই রকমের কালারফুল এবং ফ্রুটফুল টেক্সট দিয়ে এমনভাবে বই তৈরি করতে হবে আকর্ষণীয়ভাবে। যেনো বইকে সে ভালবাসতে পারে এবং বই যেনো তাকে টানে। ছোটবেলা থেকে যখন শিশুর বইয়ের প্রতি প্রেম বইয়ের প্রতি ভালবাসা এবং বই পাঠের আনন্দে সে যাতে আপ্লুত হয় তাহলে একটা বই উপহার পেলে ওই শিশু কিন্তু খুশি হবে।
প্রশ্ন: আপনি বাংলাদেশে চেইন বুক শপ তৈরি করেছেন। যাতে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে উন্নত পরিবেশে বই কিনতে পারে?
কামরুল হাসান শায়ক: পিবিএস আমার বুক চেইন শপ- এটি নিয়ে আমাদের ভাবনাটা এই রকম। আমরা ছোটবেলায় কিন্তু পিবিএস এর মতো প্রতিষ্ঠান পাইনি। যার ফলে আমাদের পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি আমরা অন্যান্য বই বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু বই পেয়েছি। খুবই সামান্য পরিমাণে অন্যান্য বই আমরা পেয়েছি যেগুলো পড়ে আমরা খুবই আনন্দিত হতাম এবং আস্তে আস্তে যখন আমরা বড় হয়েছি তখন আমরা কিন্তু দেখেছি যে, বইয়ের প্রসার বাড়ছে। কিন্তু আমাদের প্রজন্মকে আমরা পৃথিবীর বই এনে দিতে পারছি না। আমি দেখলাম একটা বই পাবলিশ হয়েছে কিন্তু বইটি পাচ্ছি না আমরা। দেখা গেলো কেউ বিদেশে যাচ্ছে তাকে বলছি বইটি এনে দিতে। এই সামগ্রিক বিষয়কে আমরা অনুধাবন করেছি যে, আমরা যদি একটি ছাঁদের নীচে দেশের সেরা বইগুলো। এর পাশাপাশি পৃথিবীর সেরা বইগুলোকে অর্গানাইজ করতে পারি এবং তাদেরকে একটি সুন্দর পরিবেশ দিতে পারি। এর সাথে পৃথিবীর এই সপ্তাহের সেরা একটি বই বের হয়েছে- আমি অনলাইনে দেখছি কিন্তু তা পাচ্ছি না। এই পাওয়ার বিষয়টি আমরা ইজি করে দিচ্ছি। সে পিবিএস এ গিয়ে দেখে শুনে বই কিনতে পারবে। ফ্ল্যাপে লেখা দেখেও বুঝতে পারবে বইয়ে কী আছে?
প্রশ্ন: আপনি আগে বাজেটের কথা বলেছেন। এবারের শিক্ষা বাজেট নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই? আর নোট বই প্রসঙ্গে কিছু বলুন।
কামরুল হাসান শায়ক: আমাদের বাজেট হওয়া উচিত রিসোর্সফুল। রিসোর্সফুল কেমন? বই যারা তৈরি করছেন কনটেন্ট থেকে শুরু করে সামগ্রিক বিষয়গুলো- সেই জায়গায় দক্ষতার বিষয় আছে। আমরা কোন মানের বই প্রডিউস করতে পারছি- আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যে? মানসম্পন্ন বই প্রডিউস করতে হলে যেমন ভালো মানের লেখক দরকার এবং সেই মানের বইটি প্রকাশ করতে হলে সেই মানের প্রকাশক দরকার। এই যে টোটাল কেমিষ্ট্রি এটাকে যদি আমরা পৃষ্ঠপোষকতা না করি রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি এর মনিটরিং না হয় তাহলে কী হবে? আমরা কিন্তু আল্টিমেটলি বিশ্বমানের বই পাব না। বিশ্বমানের বই যদি আমরা না করতে পারি তাহলে আগামী প্রজন্ম তো বিশ্বমানের হবে না। আজকে বাংলাদেশের একটি শিশু জন্ম নিলে তাকে পৃথিবীর আসপেক্টে মেধাবী হতে হচ্ছে। তাহলেই সে সংগ্রাম করে দুনিয়ায় নিজে লিডার হতে পারবে এবং নিজের দেশকে প্রেজেন্ট করতে পারবে। সমসাময়িক বিশ্বমানে তাকে যেতে হবে। আর তাহলে তার হাতে ওই মানের এলিমেন্ট দিতে হবে। সব জায়গায় রিসোর্সফুল লোক তৈরির জন্যে বাজেটে অবশ্যই বড় বরাদ্দ থাকতে হবে।
আপনি নোট বইয়ের কথা বলেছেন। আসলে নোট বইয়ের অস্তিত্ব এখন বাংলাদেশে নেই। এগুলো হচ্ছে সবই অ্যাকটিভিটি বুক। টেক্সট বইয়ের পাশাপাশি এগুলো হলো অ্যাকটিভিটি বুক। ৮০, ৯০ সালে যে নোট বুক অ্যাক্ট হয়েছে এবং তখনই এটি বন্ধ হয়েছে এবং বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ২০০৮ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে সব কিছুই হলো অ্যাকটিভিটি। এখানে শিক্ষার্থীরা কোন কিছুই কমন পায় না।