চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বরিস জনসনের বাজিমাত ও একজন করবিন

ব্যক্তিগত যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা, আদর্শ, নির্বাচনী মেনিফেস্টো-সব কিছুতেই তিনি ছিলেন প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক উঁচুতে। এমন নেতা ব্রিটেনে খুব কমই দেখা গেছে। এবারের নির্বাচনের আগে অনেকেই মনে করেছিলেন, ব্রিটেনে হয়তো তার হাত ধরে নতুন ইতিহাস রচিত হতে চলেছে। ব্রিটিশ ভোটারেরা জেরেমি করবিনের লেবার পার্টিকেই বিজয়ী করবে। কিন্তু না, ব্রিটিশ ভোটারেরা ব্যাপকভাবে বিজয়ী করলেন বিতর্কিত নেতা বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টিকে। পাঁচ মাস আগে টেরেসা মে-র বিদায়ের পরে বরিস জনসন যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন, তখন দুনিয়ার বহু মানুষ বলেছিলেন, অচিরেই তাকে বিদায় নিতে হবে— অস্থিরমতি, অবিবেচক, অশোভন আচরণের জন্য বরাবর কুখ্যাত এই রাজনীতিকের পক্ষে ব্রেক্সিট-তুফান সামলে দেশের জটিল রাজনীতিকে পরিচালনা করা অসম্ভব। কনজ়ারভেটিভ পার্টির ভেতরেরও তাকে নিয়ে আপত্তি কম ছিল না, প্রায় দুই ডজন সতীর্থ কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন: বিনা চুক্তিতে ইইউ ছেড়ে যাওয়া তারা মানবেন না। বরিস দলের মধ্যে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্মমভাবে ছেঁটে দেন। ব্রেক্সিট নীতি নিয়ে বিতর্ক এড়াবার জন্য পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকতে না দিয়া সুপ্রিম কোর্টের কঠোর ভর্ৎসনা শুনতে হয় তাকে। নির্বাচনী প্রচারের সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে অস্বীকার করেও নিন্দাভাজন হন। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তিনি একটি অবস্থানে অবিচল ছিলেন— ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারির সর্বশেষ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই ব্রেক্সিট ঘটবে, ইইউ-এর সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হোক বা না হোক।

বলা হয় থাকে, এই অবস্থানই শেষ পর্যন্ত এই ‘গোঁয়ার-গোবিন্দ’কে ব্রিটিশ ভোটারদের আস্থা এনে দিয়েছে। মার্গারেট থ্যাচারের পরে এমন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হবার স্বাদ কনজ়ারভেটিভ পার্টি পায়নি। এই জয় আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক। অনেকে অবশ্য এই জয়ের পেছনে বিরোধী লেবার পার্টি, বিশেষত তার নেতা জেরেমি করবিনের ভূমিকাকেও দুষছেন। আর্থিক নীতি, বিশেষত সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে ‘বৈপ্লবিক’ নীতির পশরা সাজিয়ে তিনি একসময় ব্রিটিশ রাজনীতির মাঝমাঠ দখল করেছিলেন, কিন্তু ব্রেক্সিট প্রশ্নে আগাগোড়া দোলাচলে থেকে উত্তরোত্তর জমি হারিয়েছেন, বিশেষত বরিস জনসনের জমানা শুরু হবার পরে তাকে অস্বাভাবিক দুর্বল দেখিয়েছে, নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্বটুকু বাদ দিলে তিনি জনসংযোগের উদ্যমও দেখাতে পারেননি। তদুপরি ‘ইহুদি-বিদ্বেষ’এর অভিযোগ তিনি মুছতে পারেননি, মুছবার যথেষ্ট চেষ্টাও করেননি। বাংলাদেশের বামপন্থীদের মতো লেবার পার্টির অস্তিত্বের লড়াইও বুঝি শেষ হবার নয়!

এই ফল আরও এক বার বুঝিয়ে দিল, একটি বিষয়ে দুনিয়ার ভোটদাতারা এক হয়েছেন— তারা শক্তের ভক্ত। নীতি, আদর্শ, সত্যনিষ্ঠা ইত্যাদি নিতান্ত গৌণ ব্যাপার, যে নেতা দাপটের সঙ্গে বলতে ও চলতে পারেন, তিনিই জনগণের রায় পান। তার অনুগামী হলে যদি সম্ভাব্য সুযোগসুবিধা হারাতে হয়, এমনকি অজানা বিপদে পড়তে হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। বরিস জনসন শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও ঘোর সংশয় আছে। চুক্তি না করেই ইইউ ছাড়লে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বড় রকমের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এই নির্বাচনে স্কটল্যান্ডে স্বাতন্ত্র্যকামী দল এসএনপি-র সাফল্য নতুন করে সেই প্রদেশের স্বশাসনের দাবিকে উত্তেজিত করবে। ভোটদাতারা এই সবই বিলক্ষণ জানেন। তার পরেও এই অস্বাভাবিক সাফল্য একটি বার্তা দেয়। গণতন্ত্রের পিঠে সওয়ার হয়ে ‘মাথা-মোটা নায়কতন্ত্রের’ দিগ্বিজয়ের বার্তা। বার্তাটি আশা দেয় না, উদ্বেগ জাগায়। গভীর উদ্বেগ!

জেরেমি করবিনের লেবার পার্টি দুঃখজনকভাবে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর তিনি নেতৃত্ব থেকে সরে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণা গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী ঠিকই আছে; কিন্তু গণমানুষের রাজনীতির জন্য এটা একটা বড় দুঃসংবাদ। জেরেমি করবিন শুধু ব্রিটেনে নয়, বিশ্বরাজনীতির একজন আদর্শবান নেতা। তিনি রাজনীতিতে জনগণের পক্ষের নতুন এক রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করে গেছেন।

করবিন দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও লেবার পার্টির শীর্ষ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন মাত্র চার বছর আগে। একজন বামপন্থী রাজনীতিক হিসাবে যিনি ৩০ বছর সংসদের পেছনের আসনে থেকে গেছেন, বিতর্কিত নানা ইস্যু সমর্থন করেছেন, বিবেকের তাড়নায় হরহামেশা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, সেই জেরেমি করবিন ২০১৫ সালে দলের নেতা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিস্ময় তৈরি করেন।

নেতৃত্বের নির্বাচনে অংশ নিতে লেবার পার্টির বামপন্থী অংশটি করবিনকে রাজি করিয়েছিলেন। তবে ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেননি, তিনি নির্বাচিত হবেন। স্বল্পভাষী, দাড়িওয়ালা ৬৬ বছরের এই এমপির ব্যক্তিত্বে এমন অজানা কিছু ছিল যা লেবার পার্টির সদস্যদের আকর্ষণ করেছিলো। অন্য তিন চৌকশ, কমবয়সী রাজনীতিকের বদলে তারা করবিনকে বিপুল ভোটে নেতা নির্বাচিত করে ফেলেন।

টনি ব্লেয়ার এবং গর্ডন ব্রাউনের নেতৃত্বের সময়ে লেবার পার্টির প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যারা তাদেরকে আবার উদ্বেলিত করতে সমর্থ হন জেরেমি করবিন। দলে দলে লেবার পার্টিতে নাম লেখাতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ যুবকরা। যে বামধারার রাজনীতিকে লেবার পার্টি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন টনি ব্লেয়ার, জেরেমি করবিনের নির্বাচনে তার পুনরুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন লেবার পার্টির এমপিদের সিংহভাগ। তারা বলতে থাকেন করবিন আবার লেবার পার্টিকে অতীতে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তাতে দলের ক্ষমতায় ফিরে আসার সমস্ত সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। ছায়া সরকার থেকে একের পর এক লেবার এমপি পদত্যাগ করেন। খোলাখুলি বিদ্রোহ শুরু করেন নেতার বিরুদ্ধে। চাপের মধ্যে কয়েক মাসের মধ্যে আবার নেতা নির্বাচন ডাকেন জেরেমি করবিন। আবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। নেতৃত্ব নেয়ার চার বছরের মধ্যে দুটি সাধারণ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয়েছে তার। লেখাপড়াও বেশি করেননি। তার মা ছিলেন শিক্ষক, বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। দুজনেই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। স্কুল ছাড়ার প্রায় পরপরই পোশাক শ্রমিকদের ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন জেরেমি করবিন। পরে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিকাল ইউনিয়নে এবং ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পাবলিক এমপ্লয়িজের সঙ্গে যুক্ত হন।

কিন্তু তার আসল উৎসাহ ছিলো লেবার পার্টি। ১৯৭৪ সালে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে উত্তর লন্ডনের হ্যারিংগে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। নিজের সাদাসিধে জীবনযাপন নিয়ে জেরেমি করবিন ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি বেশি টাকা পয়সা খরচ করিনা, খুব সাধারণ জীবন আমার। আমার কোনো গাড়ি নেই। সাইকেলে যাতায়াত করি। আমি উচ্চশিক্ষায় যাইনি কখনো, ফলে যাদের উচ্চশিক্ষা নেই, তাদের প্রতি নিচু চোখে তাকাইনি। আবার যাদের উঁচু ডিগ্রি রয়েছে তাদের প্রতি আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকিনি। আমাদের রাস্তাগুলো যারা ঝাড় দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই এই সমাজের অত্যন্ত মেধাবী লোকজন।”

১৯৮৩ তে লন্ডনের ইজলিংটন এলাকা থেকে লেবার পার্টির হয়ে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন মি. করবিন। তখন থেকে বারবারই তিনি সেখানকার এমপি। টনি ব্লেয়ারও উত্তর লন্ডনের একই এলাকার বাসিন্দা। একই সময়ে দুজন সংসদে ঢোকেন । কিন্তু রাজনীতি তাদের ব্যবধান বিশাল। টনি ব্লেয়ারের অবাধ বাণিজ্য নীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন জেরেমি করবিন। সে জন্য বার বার সরকারের আনা বিভিন্ন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন তিনি। দলের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

লেবার পার্টির প্রয়াত বাম নেতা টনি বেনের শিষ্য ছিলেন তিনি। টনি বেনের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। দুজনেই বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সরকারের হাতে থাকতে হবে। একতরফা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের সমর্থক ছিলেন তারা। অভিন্ন আয়ারল্যান্ডের সপক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।

ফিলিস্তিনীদের স্বশাসনের পক্ষে কথা বলেছেন সবসময়। শান্তি আলোচনায় হামাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। একসময় আইআরএ-র সঙ্গে মীমাংসা আলোচনার কথা বলেছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ এবং দক্ষিণপন্থী মিডিয়া এই সব প্রশ্ন তুলে তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে।

তবে সেসব অগ্রাহ্য করে জেরেমি করবিন ক্রমাগত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, রেলখাতের রাষ্ট্রীয়করণ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর কথা বলে গেছেন। বহু মানুষ তার এই সব বার্তায় আকৃষ্ট হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পাননি।

জেরেমি করবিন চার বছর আগে নেতা নির্বাচিত হবার পর লেবার পার্টিকে মধ্যপন্থী সুবিধাবাদী ধারা থেকে সরিয়ে বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে এসেছেন। কেননা শ্রমজীবীদের মধ্যে যেখানে লেবার পার্টি তার সমর্থন হারিয়েছে সেখানে স্বাস্হ্য সেবা, আবাসন, কর্ম সংস্থান এই ইস্যুগুলো আগামীতে আবারো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে।

বেক্সিট ইস্যু সমাধান হয়ে যাবার পর করবিন প্রবর্তিত জনপ্রিয় হওয়া গণমুখী কর্মসূচিগুলো নিয়ে ধারাবাহিক কাজ করলে লেবার পার্টি দ্রত তাদের জায়গা আবারো মজবুত করতে পারবে বলে অনেকেই মনে করেন।

ছলচাতুরি আর মিথ্যে বুলির রাজনীতির বিপরীতে সততা ও গণমানুষের পক্ষের যে রাজনীতির ধারা জেরেমি করবিন সূচনা করেছেন সেটা ব্রিটেনের রাজনীতির ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আজন্ম লড়াই করে যাওয়া জেরেমি করবিন পরিবর্তনকামী তরুণদের মধ্যে এক আশার মশাল হয়ে থাকবেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)