চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘বন্ধ হতে থাকে নিঃশ্বাস, রক্তে ভেসে যায় শরীর’

রানা প্লাজায় পা হারানো রেহেনার আর্তনাদ

অন্যদিনগুলোর মতো সেদিনও সকাল ৮টায় গার্মেন্টে গিয়েছিলেন রেহেনা। ঝকঝকে এক সকালে শুরু করেছিলেন কর্মব্যস্ত দিন। কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন সহকর্মীদের। হঠাৎ শুনতে পান বিকট শব্দ। সাথে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি।

মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে যায় চারপাশ। নিজের পায়ের ওপর অনুভব করতে থাকেন ভারী কোনো  বস্তুর উপস্থিতি। এক সময় হারিয়ে যায় তার শরীরের সমস্ত শক্তি। বন্ধ হয়ে আসতে থাকে নিঃশ্বাস। সারা শরীর ভেসে যায় রক্তে।

এত কিছুর মধ্যেও নিজের পিঠের নিচে তিনি শুনতে পান দু’জন সহকারীর আর্তনাদ। বুঝতে আর দেরি থাকেনা- যে ভবনে কাজ করেন, সেই ভবনের নিচেই চাপা পড়েছেন তারা।

হঠাৎ নরক হয়ে উঠা চারপাশে তখন শুধুই বাঁচার আকুতি। সেই চাপা পড়া অবস্থায় প্রায় ৬ ঘণ্টা কাটে রেহেনার। তবে তাকে উদ্ধারের পর আর কিছুই মনে করতে পারেন না। জ্ঞান ফেরে হাসপাতালের বিছানায়। জানতে পারেন তার একটি পা আর নেই, কেটে ফেলা হয়েছে।

রানা প্লাজা ধসে পা হারানো রেহেনা এভাবেই চ্যানেল অাই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার সেই দুর্বিষহ স্মৃতি। যে স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। ঘুমের ঘোরেও যেন পিছু ছাড়েনা সেই দুঃস্বপ্ন।

যশোরের শার্শা উপজেলার মেয়ে রেহেনা আক্তার। স্বামী-সন্তানসহ জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসেন ২০১২ সালে। কাজ নেন রানা প্লাজার ৮ তলায় নিউ ওয়েস্ট স্টাইল লিমিটেডে কেয়ালিটি কিউসি হিসেবে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া ছেলে আবু বকর আর স্বামী মনির হোসেনকে নিয়ে ভালই কাটছিল রেহেনার দিন। কিন্তু সবকিছু উলোট-পালোট হয়ে যায়, বছর না পার হতেই।

২৪ এপ্রিল ভবন ধসের প্রায় ৬ ঘণ্টা পর উদ্ধার হন তিনি। চিকিৎসার জন্য প্রথমে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এরপর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। তারপর পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। সেখানেই কেটে ফেলা হয় তার একটি পা।

পা হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন রেহেনা। এর মাঝেই রান্নাবান্নাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ করছেন তিনি। নিয়মিত খেতে হয় ওষুধ। ভবন ধসে নাকে আঘাত পেয়ে হাড় বাঁকা হয়ে যাওয়ায় ভুগতেন শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত জটিলতায়। এখন অপারেশনের পর কিছুটা সুস্থ রয়েছেন।

সাভারে সিআরপি’র পেছনে একটি ছোট্ট ঘরে স্বামী সন্তানসহ থাকেন রেহেনা। স্বামী মনির হোসেন গার্মেন্ট কর্মী। সরকারের পক্ষ থেকে রেহেনা পেয়েছেন ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র।

পা হারানো রেহেনার আর চাওয়ার নেই কিছুই। তবে মনের ভেতর ঘুরে ফিরে শুধুই একটি ভাবনা; ‘আজ যদি আমি সুস্থ থাকতে পারতাম। কাজ করতে পারতাম। কারো উপর নির্ভর না করতে হতো, তাহলে আমার জীবনটা আরো বেশি সুন্দর হতে পারতো।’

২৩ এপ্রিল রেহেনাসহ ভবনে কর্মরত কেউ কেউ প্রথম ভবনের ফাটল সম্পর্কে জানতে পারেন। সেদিন দুপুর সাড়ে বারোটার সময় ছুটি দিয়ে দেয়া হয় ভবনের সকল অফিস, গার্মেন্টস, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

বলা হয় সংস্কার কাজের জন্য ঘণ্টখানেক বন্ধ থাকবে সব। পরে আবার যেতে বলা হয় তাদের। তবে সেদিন ওই ভবনে কর্মরতদের বেশিরভাগই আর ফেরেননি অফিসে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সবাই যখন কাজে ব্যস্ত, ঠিক সেসময় সকাল পৌনে নয়টার দিকে ভেঙ্গে পড়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডের অদূরে রানা প্লাজা ভবনটি। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে।

এ দুর্ঘটনায় প্রায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। বাংলাদেশের পোশাক কারখানার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা ঘটে।