বনানী থেকে মহাখালীর প্রধান রাস্তার পাশের ফুটপাত ধরে যারা যাতায়াত করেন, প্রায়শই তাদের এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়। ‘মামা, লাগবো নাকি’ অশ্লীল-অস্বস্তিকর এই আহ্বান শুনেননি সেখানে, এমন পথচারী কাউকে পাওয়া যাবে না। সেই ফুটপাতের এমন কিছু স্থান আছে যেখানে সবসময়ই দেখা পাওয়া যায় কোন না কোন দালালের, যারা কিশোর-তরুণ থেকে সব বয়সীদেরই প্রলুব্ধ করতে চায়। সম্প্রতি সরেজমিনে সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করা যায় দালালদের দৌরাত্ম্য।
অভিযোগ জানানো অনেকের একজন মারুফুর রহমান একটি আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভিনিং এমবিএ’তে পড়ছেন। কাফরুলের এই বাসিন্দা বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা অন্য কোন প্রয়োজনে মাঝেমধ্যেই গুলশান বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যান। চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তিনি তার অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ওই রাস্তা দিয়ে গেলেই এমন কথা শুনতে হয়। পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেও মাঝে মাঝে তারা একদম গায়ের উপরই এসে পড়তে চায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরেতো তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে।
বহু বছর ধরেই এমনটি চলছে বলে জানান আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ’র (এআইইউবি) ছাত্র রিফাত। বিবিএ শেষ বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, ওখান দিয়ে কোন মেয়ে সহপাঠির সাথে বা বান্ধবীর সাথে চলাফেরা করলে সবচেয়ে বিব্রত হতে হয়। তারা এমনভাবে সেই অশালীন ইঙ্গিত বা ডাক দেয় যে খুবই বিব্রত হয়ে পড়ি। আমাদের নিজেদের মধ্যেই চরম অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। পরে সহজ হতেও অনেক সময় লাগে।
আরও কয়েকজন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীর কাছে এমন পরিস্থিতির কথা শুনে সরেজমিনে সেখানে গিয়ে প্রতিবেদকেও তার সাক্ষী হন। তবে পথচারীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে বনানী থানার ওসি বিএম ফরমান আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি বিষয়টি জ্ঞাত নন বলে জানান। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোন অভিযোগ আসে নাই। যদি কেউ সুনির্দিষ্টভাবে এই বিষয়ে অভিযোগ করেন তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিষয়টি আরেকটু খতিয়ে দেখতে গেলে পাওয়া যায় কিছু বিষয়। যেমন: সৈনিক ক্লাবের রাস্তা থেকে বের হয়ে হাতের বাম পাশে বনানীর ১১ নম্বর রোডের সাথে যে ওভারব্রিজটা তার নিচে বা আশেপাশে দু-একজন দালাল সবসময়ই থাকে। ওভারব্রিজ থেকে কাকলীর দিকে গেলে আরও বেশ কয়েকজনের দেখা পাওয়া যায়। আবার মহাখালী (আমতলী)র কাছেও কাউকে না কাউকে দেখা যায় সবসময়ই। সম্প্রতি চার-পাঁচদিন বেলা সাড়ে তিনটা, সকাল ১০টা এবং রাত নয়টার দিকে সেখানে গিয়ে তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
এদের মধ্যেই ছয়-সাতজনের সাথে পরিচয় গোপন রেখে ভিন্ন ভিন্ন সময় কথা হয় প্রতিবেদকের। তারাও একজন গ্রাহক ভেবেই আকৃষ্ট করতে সবধরণের চেষ্টাই চালায়। তারা নাখালপাড়া, আগারগাও তালতলা, মিরপুর ১০ নম্বর শাহ আলী মার্কেটের বিপরীতে, আল হেলাল হাসপাতালের পাশে কোন ভবন, মিরপুর ১৩তে বিটিআরসি ভবনের পাশে কোন এক স্থানে নিয়ে যেতে চায়, যা তাদের ভাষ্যে ‘গেস্ট হাউস’। পুলিশেরও কোন ঝামেলা নেই বলে দাবি তাদের।
তবে বনানীর রেললাইনের পাশে একটি জীর্ণ আবাসিক হোটেলের কাছেও নিয়ে যায় একজন। পরে আরও একজন ‘দালাল’ এই স্পটে নিয়ে আসতে চায়। প্রথমজনের সাথে, যে নিজের নাম বলে আকাশ, সেখানে গিয়ে এমন হোটেলের দেখা মেলে।
পরে আকাশ মিরপুর ১৩ তে সেই ‘গেস্ট হাউসে’ নিয়ে যেতে অনেকটা জোরও করে।
মনোবিদদের ভাষায় এই ধরনের অসামাজিক কাজের প্রতি আহ্বান সমাজে একটি প্রবল নেতিবাচক ছাপ ফেলছে।
‘উঠতি বয়সী বা কিশোর-তরুণদের মধ্যে এই ধরনের অভিজ্ঞতার নেতিবাচক প্রভাব কতটা?’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, রাজধানীর বনানী বা মহাখালী এলাকার এই বিষয়টি তিনি অবগত নন। তবে এমনটি যদি আসলেই হয়ে থাকে তবে এর “নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়ছে। তাদের (উঠতি বয়সী, কিশোর) মনে স্বভাবতই কৌতুহল জাগে সেখানে আসলে কি হচ্ছে? এই আগ্রহ থেকে তারা সেখানে গেলে একটা ফাঁদে পড়ে যায়। তবে তাদের মানসিকতার চেয়ে সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি। কারণ তাদের মধ্যে ধারণাটা জন্ম নিচ্ছে যে সমাজটাই তো খারাপ।”
টিন এজার থেকে ব্যক্তিজীবনে-সমাজে এই অশালীন আহ্বানের তীব্র নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি উঠে আসে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালের মন্তব্যে। আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রবণতার সাথে এমন অভিজ্ঞতা যোগ হলে মানসিকতায় এর প্রভাব ভয়ঙ্কর বলে অভিমত তার। তিনি বলেন, এখনকার সময়ে কম্পিউটারে, মোবাইলে পর্ন সাইটগুলো সহজেই দেখতে পারার কারণে অল্প বয়সেই ছেলে-মেয়েদের হাইপোথেলামাস সক্রিয় হয়ে যায়, মানে তাদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ তাদের যৌন ক্ষুধা জেগে উঠে। এমন সময় এই ধরনের আহ্বানে তারা আগ্রহী হয়ে উঠে। শারীরিক চাহিদা মেটাতে তারা সেখানে যায়।
“আসলে এটা একটা ট্র্যাপের মতো। তারা এতে সাময়িকভাবে তৃপ্তি পেলেও তাদের মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠে। শারীরিক ও মানসিক এই দ্বন্দ্বের ফলে তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ বেড়ে যায়।”
এতে করে নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ধরনের ছেলেরা মেয়েদের যৌন ভোগের বস্তু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। যার প্রভাব পড়ে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। কারণ তখন সে তার গার্লফ্রেন্ডের কাছেও সেটা চায়। আর তা না পেলেই আগ্রাসী হয়ে উঠে, রেপ করে। এসব ঘটনাগুলোই আসলে পরস্পর সম্পর্কিত।