বিষয়টা এরকম না যে আগের সবকিছুই ভেঙ্গে পড়েছে। আবার বিষয়টা এরকমও না যে আমাদের বার্তাকক্ষগুলো ঠিক আগের মতোই আছে। গত কয়েক বছরে গণমাধ্যমের সংবাদকক্ষে একটা পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটছে। এর মাধ্যমে আমরা একটা গুণগত পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা এখানে যারা উপস্থিত আছি তারা সকলেই নানাভাবে সেই পরিবর্তনের অংশ। সাধারণভাবে বলা যায়, পরিবর্তনটা এনেছে বা আনছে দুটি জিনিস: ১. ইন্টারনেট এবং ২. মোবাইল ফোন। এ দু’টি বিষয় যখন এক হচ্ছে তখন তাকে চূড়ান্ত রূপ দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আমাদের এখানে বিশেষ করে ফেসবুক এবং ইউটিউব।
ইন্টারনেট সংযোগসহ হাতে মোবাইল ফোন থাকা জনগোষ্ঠির কাছে পৌঁছাতে গণমাধ্যমগুলো এখন আর শুধু তার আগের পরিচয়ে থাকছে না। মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্টসহ একেকটি পত্রিকা হয়ে উঠছে টেলিভিশন, আর টেলিভিশনগুলো টেক্সট কন্টেন্টসহ একেকটি পত্রিকা। এভাবে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে ভেতর থেকে বদলে যাচ্ছে সংবাদকক্ষ এবং প্রায়োগিকভাবে বার্তাকক্ষের কাজের ধরন। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন রূপ নিচ্ছে বার্তাকক্ষ। এখন পর্যন্ত সেই পরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে মোবাইল ফোন।
এটা সবাই স্বীকার করবেন যে মোবাইল ফোন এখন বিশ্বের এক নম্বর ডিজিটাল প্লাটফর্ম। কিন্তু, এটাও ঠিক, যে পরিমাণে সম্ভাবনা এবং সুযোগ আছে, মানুষ মোবাইলে এখনো সেই পরিমাণ সংবাদ হজম করে না। এর প্রধান কারণ যারা সবকিছুর জন্যই মোবাইল ফোনের উপর নির্ভর করে অনেক সময়ই তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে সংবাদ থাকে না। গান শোনা কিংবা গেম বা ছবি তোলা অথবা ফান ভিডিও দেখা থেকে শুরু করে অনলাইনে কেনাকাটা বা অফিসের কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার মতো বিষয়-আশয়গুলো ছাপিয়ে অনেক সময়ই তাদের কাছে প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে সংবাদ আসতে পারে না ।
ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের সাংবাদিকতার অধ্যাপক পলা পয়েনডেক্সচার তার ‘নিউজ ফর অ্যা মোবাইল-ফার্স্ট কনজ্যুমার’ বইয়ে লিখেছেন, মোবাইল ফোনে এতোসব প্রয়োজন মেটানোর পর সংবাদ আসলেই খুব নীচের দিকের অগ্রাধিকার। এ কারণে মোবাইলে আরো বেশি পাঠক/দর্শক/শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর জন্য গণমাধ্যমের বিনিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পয়েনডেক্সচারের ভাষায়, স্মার্টফোন এখন আর শুধু যেকোন একটি ডিভাইস না, হাতেরই বর্ধিত অংশ।
‘নিউজ ফর অ্যা মোবাইল-ফার্স্ট কনজ্যুমার’ বইয়ে দুটি মার্কিন জরিপের বরাতে বলা হয়েছে, মোবাইল ব্যবহারকারীরা তিন ধরনের: ১. ‘মোবাইল ফার্স্ট’ অর্থাৎ যাদের কাছে সবকিছু ছাপিয়ে মোবাইল ফোন এক নম্বরে, যারা সবকিছুর জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন; ২. ‘মোবাইল স্পেশালিস্টস’ অর্থাৎ যারা বিশেষ কিছু কাজে মোবাইল ব্যবহার করেন, যেমন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার (১৯%), ইন্টারনেট সার্চ (১৮%), গেমিং (১২%), বিনোদন (৯%), সংবাদ (৮%), অন্যান্য (৩৩%); এবং ৩. মোবাইলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠি যারা মোবাইল ফোনের আসল যে কাজ ছিল ‘কথার যোগাযোগ’ শুধু সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এরা সংবাদের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময়ে টেলিভিশন সেটের সামনে বসেন কিংবা কাগজের পত্রিকা পড়েন। মোবাইল যুগে এ পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠি এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু, কোন সন্দেহ নেই যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যা কমতে থাকবে।
বাংলাদেশে এরকম সুনির্দিষ্ট গবেষণার কথা জানা নেই। গবেষণা না থাকাটা এ বিষয়ে আমাদের কম মনোযোগ থাকাটাকেও ইঙ্গিত করে। তবে, বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখন মোবাইল সংযোগের সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। এর মধ্যে ৬ কোটির ডেটা অর্থাৎ ইন্টারনেট সংযোগ আছে। সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট গবেষণা না থাকলেও ফেসবুক জানাচ্ছে, বাংলাদেশে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে প্রায় তিন কোটি।
আমরা যদি আমাদের ফেসবুক ইউজারদের পলা পয়েনডেক্সচারের ভাষায় ‘মোবাইল স্পেশালিস্ট’ ধরি তাহলে তার বক্তব্যটার দিকেও একটু নজর দিতে পারি। তিনি বলছেন. ‘মোবাইল স্পেশালিস্ট’রা কোন না কোনভাবে মোবাইলের মাধ্যমে আপনার প্রকাশিত সংবাদের পাঠক বা শ্রোতা কিংবা দর্শক হবেন কারণ সেই মানসিকতা নিয়েই তারা মোবাইল ব্যবহার করছেন। কিন্তু, ‘মোবাইল ফার্স্ট’ যারা এখন সংখ্যালঘু হলেও ভবিষ্যতে সংখ্যাগুরু হবেন, তারাই হওয়া উচিত নতুন টার্গেট অডিয়েন্স। এজন্য সেই বিনিয়োগ এবং জনশক্তি গড়ে তোলার কথা বলেছেন তিনি। স্কুল পর্যায় থেকে ‘নিউজ লিটারেসি’ গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন ফর্মে এবং ফরম্যাটে মোবাইলে সংবাদ পরিবেশনের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে তার ‘নিউজ ফর অ্যা মোবাইল-ফার্স্ট কনজ্যুমার’ বইয়ে।
এসবই এখানে এখনো পুরোপুরি শুরু না হলেও হয়তো হবে। তাই এখনকার সাংবাদিকরাই হয়তো শেষ প্রজন্ম যারা হয় শুধু পত্রিকা অথবা শুধু টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে তাদের সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেছিলেন। আগামীর যে বার্তাকক্ষ গড়ে উঠছে সেখানে একজন সাংবাদিককে শুধু প্রিন্ট বা শুধু টেলিভিশনে কাজের যোগ্যতা নিয়ে এলে হবে না। তার যেমন বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহের যোগ্যতা থাকতে হবে তেমনি বিভিন্ন মাধ্যমে তা প্রচার, প্রকাশ এবং সম্প্রচারের যোগ্যতাও থাকতে হবে, এমনকি অনলাইন রেভিনিউ’র বিষয়টাও বুঝতে হবে।
মূলতঃ মোবাইল অডিয়েন্সকে সামনে রেখে আগামীর সংবাদকক্ষ তাই হবে একেকটি মাল্টিমিডিয়া স্টুডিও। এখান থেকে সাংবাদিকের যেমন সরাসরি সম্প্রচারের যোগ্যতা থাকতে হবে তেমনি জানতে হবে কীভাবে একটি টেলিভিশন প্যাকেজ বানাতে হয়। আগামীর বার্তাকক্ষে একজন সাংবাদিকের যেমন লেখার যোগ্যতা থাকতে হবে তেমনি তা সুন্দরভাবে ছোট বা বড় যেকোন মনিটরে দেখানোর জন্য গ্রাফিক্স জ্ঞানও থাকতে হবে। আগামীর সাংবাদিকের যেমন স্টিল এবং ভিডিওচিত্র ধারণের যোগ্যতা থাকতে হবে তেমনি জানতে হবে কীভাবে ওই ভিডিও সম্পাদনাও করতে হয়।
আগামীর বার্তাকক্ষ যেমন একদিকে টেক্সট, অডিও, ভিডিও, গ্রাফিক্সসহ সব ধরনের মাল্টিমিডিয়া এবং লাইভ সম্প্রচারের সুবিধায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, তেমনি একজন সাংবাদিককেও এই সবগুলো মাধ্যমে কাজের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। বিষয়টা আর শুধু লেখা বা বলা কিংবা দেখানোর প্রচলিত সাংবাদিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, অনেক বেশি প্রযুক্তিগত বিষয় যোগ হবে এর সঙ্গে। আসলে পুরো বিষয়টাই এক ধরনের প্রকৌশলবিদ্যায় পরিণত হচ্ছে বা এরইমধ্যে হয়ে গেছে, যার নাম কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং যেখানে ডিভাইস ইঞ্জিনিয়ারিংও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর বদলে যাওয়া হয়তো আমরা সবাই জানি। নতুন সংবাদকক্ষকে তারা শুধু এ বছর বা আগামী বছরের নিউজরুম বলছে না। তারা একে বলছে ‘দ্বাবিংশ শতকের’ বার্তাকক্ষ যেখানে একসঙ্গে সাংবাদিক এবং প্রযুক্তিবিদেরা কাজ করছেন, যারা আসলে প্রযুক্তিবিদ-কাম-সাংবাদিক কিংবা সাংবাদিক-কাম-প্রযুক্তিবিদ। নিয়মিত রিপোর্টার এবং এডিটরদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছেন ভিডিওগ্রাফার, ফটোগ্রাফার, ডিজাইনার এবং অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া এডিটর। আর সাংবাদিকরা সেখানে শুধু লিখছেনই না, একটি মাল্টিমিডিয়া সংবাদকক্ষে একজন সংবাদকর্মীর যত ধরনের কাজ থাকতে পারে সবই তারা করেন। একইসঙ্গে তারা প্রিন্ট, অনলাইন এবং ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট এবং সঙ্গে একেকজন প্রযুক্তিবিদ।
উদাহরণের খতিরে হয়তো আমরা ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’র কথা বলছি। বিশ্বজুড়েই এটা ঘটছে। পত্রিকাগুলো যেমন মাল্টিমিডিয়া হয়ে যাচ্ছে তেমনি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম অনলাইনে নিজেও পত্রিকার মতো উপস্থিত হচ্ছে। যেকোন গণমাধ্যমই এখন অডিও, ভিডিও, টেক্সট এবং গ্রাফিক্সসহ নিজেকে গড়ে তুলছে আর নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেভাবেই গড়ে তুলছে তাদের বার্তাকক্ষ।
কিন্তু, কেন?
অন্যদের মতো ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’র ডিজিটাল পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধির হার বছরে ৭৮ শতাংশ, যাদের ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। পাঠকের অভ্যাসে পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন পাঠকের প্রায় পুরোটাই ডিজিটাল। পরিবর্তনটা খুব দ্রুত হচ্ছে। সৃজনশীলতাই এখন নিউজরুমের প্রাণ যেখানে প্রধান উপাদান মাল্টিমিডিয়া। সংবাদকক্ষগুলোতে তাই এখন ডিজিটাল অপারেশনে পারদর্শী সাংবাদিকের পাশাপাশি আরো বেশি প্রকৌশলীরা যোগ দিচ্ছেন। যাদের কাজ ওয়াশিংটন পোস্টের ভাষায় শুধু সাইটকে ‘খুব দ্রুতগতির’ বানানো নয়, আধেয় যেন পাঠকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় সেটাও নিশ্চিত করা। এর কারণ পাঠকরা এখন শুধু পাঠক নন, দর্শকও। তারা শুধু সংবাদ পড়েন না, সংবাদ দেখেনও; সংবাদে নিজেদেরও খুঁজে বেড়ান। এজন্য নতুন ধরণের সংবাদকক্ষে এক বড় জায়গা করে নিয়েছে বা নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর মতো আরেক প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’। এর এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন বলছে: পত্রিকাটি খুব দক্ষতার সাাথে ডিজিটাল জার্নালিজমের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। কিন্তু, এর পরিবর্তনটা আরো দ্রুত হওয়া খুব জরুরি। এজন্য রিপোর্টার এবং এডিটরদের আরো বেশি প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল ‘নানা কাজের কাজী’ ধরনের সাংবাদিক নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাঠকদের সঙ্গে আরো সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন ও তা শক্তিশালী করার কথাও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
২০২০ সালকে সামনে রেখে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ যে অভ্যন্তরীণ গবেষণটি করেছে ঠিক সেরকমভাবে আরেকটি গবেষণা করেছে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। এর মধ্যেই অনেকে সেখানে ‘চাকুরিচ্যুত’ হলেও ডিজিটাল অপরেশনকে সামনে রেখে এরকম পত্রিকাসহ সবারই লক্ষ্য উচ্চমানসম্পন্ন সাংবাদিকতায় আরো কীভাবে কম জনশক্তি দিয়ে বেশি ‘আউটপুট’ দেয়া যায়। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে আছে: সম্পাদনার ধাপগুলো কমিয়ে আনা অর্থাৎ সম্পাদনায় পারঙ্গম আরো দক্ষ রিপোর্টার নিয়োগ যার মানে কমসংখ্যক সম্পাদক এবং আরো বেশি ভিডিও কাভারেজ। একইসঙ্গে পাঠক-দর্শকের চাওয়ার বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে যেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর এখন মূল লক্ষ্য এরকম একটি ডিজিটাল নিউজরুম যা ছোট কিন্তু কার্যকর। এজন্য চাকুরিও হারাচ্ছেন অনেকে। সহজভাবে বললে ডিজিটাল অপারেশনে খুব ভাল না হলে তাকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। রিপোর্টারদের করতে হচ্ছে ‘জুতো সেলাই থেকে চ-িপাঠ’। জগদ্বিখ্যাত পত্রিকাটির এখন অগ্রাধিকার তালিকায় আছে গ্রাফিক্স, পডকাস্ট, ভিডিও এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। ২০২০ সলের মধ্যে পত্রিকাটি ডিজিটাল আয় ৮০০ মিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে চায়। গত বছর তাদের ডিজিটাল আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল, ২০১৫ সালে ছিল ৫০০ মিলিয়ন এবং ২০১৪ সালে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। একসময় কয়েক হাজার মিলিয়ন ডলারের পত্রিকাটির রাজস্ব এখন কয়েকশততে নেমে এসেছে, তবে এর বেশিরভাগটাই আসছে অনলআইন থেকে। সেটাকেই তারা আরো উপরে নিয়ে যেতে চায়।
আয় বাড়াতে গিয়ে শুধু যে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ই ছাঁটাইয়ে যাচ্ছে এরকম না। রয়টার্স বলছে, আগামীতে নিউজ ইন্ডাস্ট্রিজুড়েই চাকরিচ্যুতি ঘটতে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে আরো কিছু সংবাদপত্র হয় বন্ধ হয়ে যাবে নয়তো সেগুলো শুধু অনলাইনে প্রকাশ হবে। দেশে দেশে ডেটা ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, রয়টার্সের গবেষণা বলছে, গ্রাফিক্যাল ডাটা এবং ফিগার ব্যবহারের পাশাপাশি সাংবাদিকতাতেও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো আরো প্রভাবশালী হবে।
আগামীর ডিজিটাল জার্নালিজম নিয়ে রয়টার্সের আরো কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। এসবের মধ্যে আছে: সাইট ও অ্যাপসগুলোতে সাইন-ইন বা রেজিস্ট্রেশন বাড়ানোর চেষ্টা, পাঠক-দর্শকের জন্য আরও ব্যক্তিগত কনটেন্ট, মেসেজিং অ্যাপসের মাধ্যমে আরো বেশি ‘সংলাপধর্মী সাংবাদিকতা’। ফেসবুক লাইভকে সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা রয়টার্স একথাও বলছে, টিকে থাকার জন্য প্রকাশকরা প্রয়োজনে ফেসবুক লাইভের বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারেন। তবে, তাদের মতে, ফেসবুক সোশ্যাল এবং লাইভ অডিও ফরম্যাটে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে পডকাস্ট।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম ধীরে ধীরে হলেও সেই বাস্তবতা বুঝতে পারছে। ডিজিটাল এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য গণমাধ্যমকে তাই আরো বেশি ডিজিটাল হতে হবে। তবে, শুধু যে পত্রিকাগুলো বদলে যাচ্ছে বা তাদেরকে বদলে যেতে হচ্ছে এমন নয়। বদলে যাচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও। লাইভ কাভারেজের জন্য টেলিভিশন সবসময়ই সবার উপরে থাকলেও অডিয়েন্স সেটা কোন মাধ্যমে দেখছে সেটা ভাবতে হচ্ছে তাদের। আগ্রহী কেউ কোন লাইভ কাভারেজ মিস করলে সে পরবর্তী বুলেটিনের জন্য অপেক্ষা না করে মোবাইল ফোনে কত দ্রুত দেখতে পারে সেটা যেমন ভাবতে হচ্ছে, তেমনি এটাও মনে রাখতে হচ্ছে যে সন্ধ্যার প্রাইম নিউজে মানুষ আর দিনের বেলা ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখতে চায় না, তারা ফলোআপের সঙ্গে বিশ্লেষণও চায়।
ডিভাইস বিশেষ করে মোবাইলের এ যুগে বিবিসি-সিএনএনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও তাই তাদের বার্তাকক্ষকে আরো বেশি ডিজিটাল যুগের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলছে। এমনকি রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্য বিখ্যাত বিবিসির এখন প্রথম অগ্রাধিকার অনলাইনে ডিজিটাল কনটেন্ট। সেটা যেমন কেন্দ্রীয়ভাবে ঘটছে তেমনি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিসেও। বিবিসির নতুন যে ১১টি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিস হয়েছে তার মূল ফোকাস অনলাইন। আগে থেকে সক্রিয় ২৮টি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিসেও তাই। একসময় রেডিওর জন্য খুব জনপ্রিয় বিবিসি বাংলাও অনলাইন কনটেন্টকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এসবই ঘটছে কেন্দ্রীয়ভাবে বিবিসির নিউজরুমে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায়।
বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোও এখন অনলাইনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। একইভাবে পত্রিকাগুলোর অনলাইন এবং ‘অনলাইন ওনলি’ গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিচ্ছে মাল্টিমিডিয়া বিশেষ করে ভিডিও কনটেন্টকে। এক্ষেত্রে তাদের চিন্তায় থাকছে মোবাইল। সব মিলিয়ে তাই দেশের সংবাদকক্ষগুলোও এক ধরনের পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় ঢুকছে। ধীরে হলেও কাছাকাছি সময়ে আমরা দেশের সব ধরনের গণমাধ্যমে যে বার্তাকক্ষ দেখবো সেগুলো হবে অনেক বেশি ডিজিটাল নিউজরুম।
তাই বলে কি সাংবাদিকতার মূল দর্শন হারিয়ে যাবে? না, সেটা কখনোই হবে না। বরং প্রতিদিনই আরো বেশি মানুষের মোবাইল এবং ইন্টারনেট সংযোগে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর মৌলিক দিকটা আরো শক্তিশালী হবে। মূলধারার গণমাধ্যম এতোদিন শুধু বার্তা দিয়ে গেছে। অন্যপক্ষ থেকে শোনার বা জানার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। এখন একটি সংবাদ যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে আরো বেশি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে তেমনি গণমাধ্যম ফেসবুক থেকে পাওয়া কমেন্টের মাধ্যমে পাঠকের চাওয়া, চিন্তা এবং আকাঙ্খার কথা জানতে পারছে। এভাবে পাওয়া ফিডব্যাকের ভিত্তিতে এজেন্ডা সেটিংয়েও ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারছে গণমাধ্যম।
এখানে শুধু সাংবাদিকতা এবং কনটেন্টকেন্দ্রিক কথা হলেও ডিজিটাল যুগে নতুন যাত্রায় গণমাধ্যমের আয় কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আলোচনাও জরুরি। অনলাইন মাধ্যমে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক দু’ ধরনের মিডিয়ারই একে অন্যের রাজস্বে ভাগ বসানোর সুযোগ আছে। আগামীর সাংবাদিক গড়ে তোলার পাশাপাশি সৃজনশীল সেই মানবসম্পদও গড়ে তুলতে হবে। এটাও ভাবতে হবে যে গুগল এবং ইউটিউবকে আমরা রাজস্বের বড় অংশই দিয়ে যাবো? নাকি নিজেরা কোন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি? বাংলাদেশের বাস্তবতায় একা একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু, অ্যাটকো এবং নওয়াব যদি যৌথভাবে কোন উদ্যোগ নেয়– তা হলে গবেষণা থেকে শুরু করে এর বাস্তবায়ন পর্যন্ত অসম্ভব কিছু না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)