বছরের শেষ দিনে আলোচিত দুটি হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন রেখে গেছে। এর একটি ঘটনার শিকার খুলনার শিপ্রা কুণ্ডু। যিনি নিতান্তই একজন গৃহবধূ। পূজা-অর্চনার জন্য ফুল কিনে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তিনি। যদিও তিনি হত্যাকারীদের লক্ষ্য ছিলেন না। খুলনা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে হত্যা করতে ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তা শিপ্রার বুকে লাগলে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো ভয়ংকর। গাইবান্ধা-১ আসনের (সুন্দরগঞ্জ) সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে সন্ধ্যায় শাহবাজ গ্রামে তার বাড়িতে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, শনিবার মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পর দুটি মোটরসাইকেলে এসে তিন যুবক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে লিটনকে গুলি করে পালিয়ে যায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান তিনি। ঘটনার পর পরই এর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রের নির্দেশে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রংপুরে গিয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকও একই দাবি করেছেন। আর ঘটনার পর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর জরুরি সভা শেষে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাপুরুষোচিত কাজ। ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসলে আমরা কেউই বলতে পারি না এ ঘটনার সঙ্গে করা জড়িত। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্যকে শুধু হত্যার জন্যই হত্যা করা হয়নি। এর পেছনে অবশ্যই বড় ধরনের পরিকল্পনা আর ষড়যন্ত্র রয়েছে। শিশু সৌরভকে গুলি করাসহ নানা কারণে আলোচিত ছিলেন লিটন। তিনি একাধিকার প্রকাশ্যেই বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের হুমকির মুখে আছেন। আমরা জানি ওই এলাকাটি জামায়াত-শিবিরের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সুন্দরগঞ্জে ব্যাপক তাণ্ডবের পর বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র ঘেরাও করে চার পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করে। পরে বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুরো সুন্দরগঞ্জেই ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। আমাদের প্রশ্ন এমন হুমকির পরও সরকার বা দলের পক্ষ থেকে লিটনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলো না কেনো? সরকার বিরোধীতার নামে যারা প্রকাশ্যে তাণ্ডব চালালো, দলীয় পরিচয় জানার পরও এখন পর্যন্তও তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হলো না কেনো? একজন সংসদ সদস্যের বাড়ির দিকে সবারই একটা বাড়তি দৃষ্টি থাকে, নানা তদবির-সুপারিশের জন্য সেখানে দিন-রাত ভিড় লেগেই থাকে। তাহলে ঘটনার দিন হত্যাকারীরা সুযোগটা পেল কিভাবে? তবে কি নিজের মধ্যেই কি কেউ সুযোগটা করে দিয়েছিল? খুলনার শিপ্রা কুণ্ডুর ঘটনা নতুন নয়। সেখানে যিনি হামলার লক্ষ্য ছিলেন, সেই জেড এ মাহমুদকে আগেই অন্তত দুইবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি নিজেও একটি হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামী। একটি গোষ্ঠির সঙ্গে তার বিরোধ দীর্ঘদিনের। আমরা মনেকরি এই বিরোধের পেছনের কারণগুলোও নিষ্পাপ নয়। আর প্রশাসনের পক্ষেও তা অজানা থাকার কথা নয়। যদি সেখানে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যেতো, তাহলে নিরাপরাধ শিপ্রা কুণ্ডুকে জীবন দিতে হতো না। আমরা এমন দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।