বঙ্গবন্ধু বিপিএল উদ্বোধনে ভারতীয় শিল্পী ও আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্যতা
আমরা আর কতদিন নিজের অর্থে পরের দাসত্ব করে যাবো?
বিপিএলের পুরো নাম ‘বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ’। এবার এর নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ’। ক্রিকেটকে জনপ্রিয় ও বাণিজ্যিকীকরণ করতে শর্ট ভার্সনের ২০ ওভারের এই টুর্নামেন্টের আইডিয়া ভারতের।
ভারতই প্রথম ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ বা আইপিএল নামে এই টুর্নামেন্ট শুরু করে। অনেক বলিউড তারকা বিভিন্ন দল কেনেন। তারা মাঠে উপস্থিত থেকে নিজ নিজ দলকে উৎসাহও দেন। স্বভাবতই সেই টুর্নামেন্টের উদ্বোধনে বলিউডের তারকাদের ঝলমলে উপস্থিতি দেখা যায়। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আইপিলে খেলছেন কয়েকবছর ধরে। তারপরও আইপিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কখনো বাংলাদেশের কোন সিনেমার তারকাকে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের জয়া আহসান বা শাকিব খান কিংবা ফেরদৌস কোলকাতায় বেশ জনপ্রিয়, তারপরও তাদের আমন্ত্রণ জানায়নি ভারত বা আইপিল কর্তৃপক্ষ। কারণ তারা বিশ্বাস করে তাদের সংস্কৃতি, বিনোদনের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। আইপিলে বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড় দলে স্থান পেলেও উদ্বোধনীতে স্থান দেয়ার কোন কারণ নেই।
বিপিএলের উদ্বোধন ও বাঙ্গালীর বলিউড প্রেম
বরাবরের মতো এবারও হয়ে গেলো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ বা বিপিএলের উদ্বোধন। উদ্বোধনীতে বাংলাদেশি গায়ক জেমস গান গাইলেও সবকিছু ছাপিয়ে গেছে সঙ্গিত শিল্পী সনু নিগম, কৈলাস খের, বলিউড তারকা সালমান খান, ক্যাটরিনা কাইফের উপস্থিতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও তাদের পারফরম্যান্স উপভোগ করেছেন। তারাও ঝানু পারফরমারের মতো প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করে মঞ্চে দু চারটা কথাও বলেছেন।
আর সুন নিগম তো রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন ‘একটি মজিবরের কন্ঠে’ গানটি গাওয়ার জন্য। তাদের দোষ দেয়ার কিছু নেই। তারা শিল্পী। তাদের কোটি কোটি টাকা খরচ করে আনা হয়েছে। তারা তো তাদের সর্বোচ্চ মেধা দিয়ে চেষ্টা করবেন দর্শককে বিনোদিত করতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ সালমান খানসহ ভারতীয় শিল্পীদের আনতে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আহা বাংলার টাকা আকাশে ওড়ে। কার টাকা কে নিয়ে যায়!
চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বিপিএল: বাংলার তারকারা পুরস্কার পেলেও বিপিএল উদ্বোধনে হরিজন
একইদিন ঢাকায় দুটো আয়োজন ছিলো। দুটোই জমকালো, বর্ণাঢ্য এবং দুটোতেই প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলচ্চিত্র পুরস্কার যারা পেয়েছেন তারা তো বটেই, যারা উপস্থাপনা করেছেন তারাও বাংলাদেশের জনপ্রিয় তারকা। শাকিব, পূর্ণিমা, মৌসুমী, ফেরদৌস, জয়া আহসান বাংলাদেশে তো বটেই পশ্চিমবঙ্গেও জনপ্রিয়। অথচ তাদের কারো স্থান হয়নি বিপিএলের মঞ্চে। আমাদের দেশে একটি কথা আছে ‘গেয়ো যোগি ভিক পায় না’ অর্থাৎ ঘরের গুণীর কদর নেই। জাতিগতভাবে আমাদের এই রোগ যেনো আরো একবার নগ্নভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটলো বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। গ্রীনিচ বুকে স্থান পেলেও জনপ্রিয় মমতাজ সময় স্বল্পতায় গানই গাইতে পারেননি।
‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না’
জনপ্রিয় রম্য লেখক ও কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, যে দেশে গুণীর কদর হয় না সে দেশে গুণী জন্মায় না। স্বভাবগতভাবে আমাদের যেনো পাশের বাড়ির বড় মানুষকে ছোট করতে পারলে, হেয় করতে পারলে আমাদের গৌরব বাড়ে। অথচ বিশ্ব সভায় যখন আমাদের কেউ বড় অর্জন করেন তখন তিনি একা অর্জন করেন না বাংলাদেশ অর্জন করে, এটি আমরা প্রায়ই ভুলে যায়। আমাদের এই দাসত্বের মানসিকতা থেকেই বার বার যেনো উৎকট হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে আমারে সাস্কৃতিক দৈন্যতা। একদিকে চলচ্চিত্র পুরস্কারে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তার বৈচিত্র্য এবং এগিয়ে চলা নিয়ে অহংকার করছি। আবার বিপিএলে ভারতীয় শিল্পী এনে বুঝিয়ে দিচ্ছি আমাদের তারকারা আন্তর্জাতিক মানের নয়। এ কেমন দ্বি-চারিতা। আমরা যদি আমাদের তারকাদের মূল্য না দিই তবে কি ভারত দেবে?
আমি একটি টেলিভিশনের মার্কেটিং ডিরেক্টরকে এই দৈন্যতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট। তাই জনপ্রিয়তা বিচার করা হয়েছে। আমি তাকে বললাম, আমি তো আন্তর্জাতিকতার কিছুই পেলাম না। আন্তর্জাতিকতা দূরে থাক, ভারত ছাড়া উপমহাদেশের অন্য কোন দেশের শিল্পীই খুঁজে পেলাম না। অথচ ভারতের পাশাপাশি, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা বিপিএলে খেলেন। এসব দেশে জনপ্রিয় শিল্পী, তারকাও আছে যাদের বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা আছে।
একটি জাতি শুধু অর্থে ধনবান হলেই বড় হয় না, তাকে মনে, মননে, নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেও শক্তিশালী হতে হয়। ঐতিহাসিক আবদুল করিমের আগে বাঙ্গালি মুসলমান জানতোই না তাদের একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারা আছে, পুথি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে যেটি প্রবাহিত হয়েছে। দাক্ষিণারঞ্জন মিত্রের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আমাদেরও লোকজ সাহিত্য রয়েছে।
যে জাতি নিজ ভাষা, সস্কৃতিকে ধারণ করে না, তারা কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। আমরা আর কতদিন নিজের অর্থে পরের দাসত্ব করে যাবো?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)