চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বই মেলার রোদ আর রিমান্ডে লেখক

স্বাধীন বাংলাদেশের খোলাহাওয়ায়, এই শহরে কী কারণে, কেনো ‘মুক্তধারা’র চিত্তরঞ্জনসাহা বই নিয়ে বসেছিলেন বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে? কী ছিলো তার মনে? কে বা কারা তাকে এমনপরামর্শ দিয়েছিলেন, অথবা নিজেরই ভাবনা এবং উদ্যেগে তিনি একা করেছিলেন, এসব প্রশ্ন এখন আর কে করবে?

যখন অমর একুশের গ্রন্থমেলা, অর্থাৎবই মেলা যখন ডালপালা বিস্তার করেছে, বাণিজ্যে স্ফীতিলাভ করেছে। এখন আমাদের বই মেলা কেবল বাংলাভাষা-ভাষী নয়, দুনিয়া জুড়েই একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন বইমেলাকে ঘিরে অনেক প্রস্তুতি, অনেক আয়োজন, আর আলোচনা-সমালোচনা ও বিস্তর। মেলার আয়োজন বাংলা একাডেমীর দেয়ালের বাইরে গিয়ে ইতিহাস খ্যাত সোহরাওয়ার্দি উদ্যান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে গেলবার।

শুরুতে এ নিয়ে অনেক মহলের মৃদু আপত্তি থাকলেও সময়ের প্রয়োজন ঠেকানো যায় নি। মেলার আয়োজনের ত্রুটি নিয়ে প্রতিবারই কথা ওঠে, এবারও উঠেছে। তবে এবার বেশি বেশি করে কথা উঠছে মেলায় একটি বই-এর স্টল বন্ধ করে দেয়া, লেখককে আটক করে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায়। কথা উঠছে বই মেলায় বাংলা একাডেমীর ভূমিকা নিয়ে। বই মেলা বা অমরএকুশের গ্রন্থ মেলা, যা-ই বলা হোকনা কেনো, এ-তো বাংলাএকাডেমীর নিজস্ব কোনও চিন্তার ফসল নয়। একজন চিন্তাশীল প্রকাশক, একজন বইপ্রেমী মানুষ বই নিয়ে বসেছিলেনএকাডেমী প্রাঙ্গণে। কালে কালে সেই একার প্রয়াসে অনেকে এসে যুক্ত হয়েছেন। বাড়ির আঙিনায় পথিকএসেছে, তাই পিড়ি পেতে দিয়েছিলো বাংলাএকাডেমী। এবং এক পর্যায়ে দায়-দায়িত্বও নিয়ে নিলো প্রতিষ্ঠানটি। এই পর্যন্ত ভালোই ছিলো।

কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠানটি বই মেলাকে নিয়ে যে আচরণ করছে তা রীতিমত ‘মোড়লপনা’ ছাড়া আর কী হতে পারে। চিন্তা সব সময়ই মুক্ত। তেমনি মুক্ত সৃষ্টিশীলতা। মানুষের পক্ষে যা মঙ্গলময়, সভ্যতার জন্য যা কিছু আলোকবাহীতা যদি বই’র মধ্য দিয়ে মেলায় আসে, ক্ষতি কী? ক্ষতি আছে, তাই বাংলা একাডেমী মেলা পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে হুঁশিয়ার করে প্রকাশকদের তারা যেন এমন বই মেলায় না আনেন যা একটি ‘বিশেষ’ অনুভুতিতে আঘাত হানে।
এক সময় বই মেলায় প্রতিদিন হাজির থাকতেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। তখনো বই মেলা মাস ব্যাপি হয়নি। তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে মেলায় আসতেন। রাতে মেলা ভাঙার আগে বেরিয়ে যেতেন একা একা। মেলার ভেতর তিনি একটি নির্দিষ্ট স্টলে বসে তার পাঠকের সঙ্গে কথা বিনিময় করতেন। অটোগ্রাফ দিতেন, আর প্রতিক্ষণই বলতেন নতুন নতুন কথা। একদিন বললেন, বাঙালি মুসলমানের সব অনুভুতি বিলুপ্ত, বাকি আছে কেবল ধর্মানুভুতি। বলতেন, বাঙালি আধুনিকতায়, নতুন চিন্তায় আস্থা রাখতে পারেনা, তারা আস্থা রাখে বিশ্বাসে। তিনিবলতেন, এই দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া ঘোরতর অপরাধ, খুন করা নয়। বলতেন, ঘরে একটি মুকসেদুল মোমেনিন আছে- এর বাইরে আর বই থাকতে হবে কেনো, এই হল বাঙালি মুসলমানের ধারণা। তারপরও বই মেলাকে ঘিরে হুমায়ুন আজাদের বিস্তর আগ্রহ ছিলো। সমালোচনাকরতেন, তবু বই মেলার জন্য বছর ব্যাপি তার অপেক্ষা থাকতো। তিনি বাংলাএকাডেমীকে একবার গো-শালা নাম দিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। সমালোচনা করেছেন অনেক, তবুও বই মেলাকে তিনি দেখেছেন অন্য আলোয়। হুমায়ুন আজাদ শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষ ছিলেন। একটু উচ্ছিষ্ট পাওয়ার লোভে মঞ্চে মঞ্চে ছুটে বেড়াননি, ধর্ণা দেননি ক্ষমতার ড্রয়িং রুমে। তাই বই মেলা ছিলো তার এক ধরণের আনন্দের জায়গা। ‘ছাপান্নহাজারবর্গমাইল’ থেকে শুরু তার উপন্যাস। তারপর প্রতি বছরই একটি করে উপন্যাস সঙ্গে অন্যরকম বই নিয়ে মেলায় এসেছেন তিনি। আর সেই মেলা প্রাঙ্গণেই তাকে প্রাণনাশের জন্য কুপিয়ে জখম করে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা। সেই মরণ আঘাত নিয়েই তাকে চলে যেতে হয় পৃথিবী থেকে।
হুমায়ুন আজাদের সেই মেলাকে যদি দেওয়া হয় শর্তের পর শর্ত, তাহলে বই মেলার রোদটা থাকে কোথায়?

আর লেখার জন্য যখন লেখককে যেতে হয় হাজতে, যেতে হয় রিমান্ডে-তখন সেই মেলা, মেলার আয়োজকতো প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। কী সব অভিযোগ দাঁড় করিয়ে গত বছর মেলায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো একটি স্টল। তখন অবশ্য কাউকে হাজতবাস করতে হয়নি। এবার হলো। আমার প্রশ্ন একজন লেখককে রিমান্ডে রেখে এখনও বই মেলা চলছে কীকরে। কেনো প্রতিবাদ হচ্ছেনা? ‘বাঁশের কেল্লা’ চরম মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের ইলেট্রনিক প্রচারপত্র। এখান থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিবুদ্ধির বিরুদ্ধে বিষোদগার চালানোহয়। মুক্ত মনের মানুষদের হত্যার প্ররোচনা দেওয়া হয় এখান থেকে। সেই বাঁশের কেল্লার কথায় নিষিদ্ধ করা হলো বই, বন্ধ করে দেওয়া হলো ব-দ্বীপ প্রকাশনী। ‘ইসলামবিতর্ক’- বইয়ের লেখক নয়, অনুবাদককে নেয়া হলো রিমান্ডে। ঘটনায়প্রতিবাদ জানায়নি বাংলা একাডেমী। দু’একজন লেখক-প্রকাশকপ্রতিবাদ সমাবেশ করলেও উল্লেখ করার মতো কেউ সোচ্চার হননি এখন পর্যন্ত।

ঘটনা নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফরইকবাল। তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ইসলাম বিতর্ক বইটি যেনো কেউ না পড়েন। জাফর ইকবালকে তার পাঠকরা বরাবরই মুক্ত মনের মানুষ বলে মানে। তিনি মুক্তমনের মানুষ হিসেবে, বিজ্ঞান-মনষ্ক মানুষ হিসেবে মৌলবাদীদের কু-নজরে রয়েছেন অনেক আগে থেকেই। তিনি এমন অবস্থান কেনো নিলেন তা নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সবখানে জোর আলোচনা চলছে।
প্রশ্ন হলো আমাদের পুলিশ কি বাঁশের কেল্লার কথায় চলে? বাঁশের কেল্লা আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিরোধী একটি প্রচারণা মাধ্যম । পুলিশ এখন মপর্যন্ত এর হদিস খুঁজে পায়নি। ধরতে পারেনি এর সঙ্গে জড়িতদের। অথচ তারই কথায় আঘাত হানছে মুক্ত চিন্তায়।

তখন বিএনপি-জামায়াতের শাসনকাল। সাজানো মামলায় যখন তখন ধরা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাদের। বাদ যাচ্ছেননা লেখক-সাংবাদিকও। শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনকে ধরা হলো। দেওয়া হলো ‘দেশদ্রোহ’ মামলা। শাহরিয়ার কবির আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য হলো আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা চলে ইনকিলাব আর সংগ্রামের কথায়। যুদ্ধাপরাধী মওলানা মান্নানের পত্রিকা ইনকিলাব। আর যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র সংগ্রাম। রিমান্ডে নিয়ে শাহরিয়ার কবিরের কাছে তখন জানতে চাওয়া হতো- ইনকিলাব লিখেছে, সংগ্রাম বলছে আপনি এসব করেছেন।
পরিস্থতি এখনও তাই। কেবল সরকার পাল্টেছে।

আমাদের পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থায় সেই ইনকিলাবীভূত-সংগ্রামী শয়তান বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠানে নাম বদলে হয়েছে‘বাঁশের কেল্লা’। এই কেল্লার কথায় যদি পুলিশ চলে, গোয়েন্দা সংস্থা চলে তাহলে সর্বনাশের আর শেষ থাকবে না। আর এখন, যে লেখক, প্রকাশকরা চোখ বন্ধ করে ঝড়ের ঝাপটা থেকে রেহাই পেতে চাইছেন তারা জেনে রাখুন, বিপদ কিন্তু কড়া নাড়ছে দরোজায়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।