সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণারে’ বই ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সম্প্রতি এই কর্নারে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের প্রকাশনা সংস্থা নিয়ে দুর্নীতির সংবাদ আসে গণমাধ্যমে।
সেখানে আটটি বই কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে তার মধ্যে তিনটি বই নিয়েই জালিয়াতি করেছেন সাংবাদিক নাজমুল হোসেন। ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ এবং ‘৩০৫৩ দিন’ বইটির পাশাপাশি অধ্যাপক নাসরিন আহমদ সম্পাদিত ‘অমর শেখ রাসেল’ বইটিরও মেধাস্বত্ব চুরি করে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ‘জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড’ ও ‘স্বাধীকা পাবলিশার্স’ নামে দুটি প্রকাশনা সংস্থার মালিক নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে। যদিও নাজমুল দাবি করছেন, যা কিছুই হয়েছে তা বিধি মোতাবেকই হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, উল্লিখিত তিনটি বইয়ের মেধাস্বত্ব চুরি করে ২০ কোটি টাকার বিনিময়ে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য ছেপেছে ‘জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড’ ও ‘স্বাধীকা পাবলিশার্স’। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গত ২৭ জুনের প্রজ্ঞাপনে দেখা গেছে ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটির সম্পাদকের নাম অমিতাভ দেউরী অবিকৃত থাকলেও বদলে গেছে প্রকাশকের নাম। প্রথম সংস্করণে বইটির প্রকাশক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম থাকলেও সেখানে জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় সংস্করণে দেখা গেছে, ক্রেডিট লাইনের সবার নিচে থেকে একেবারে সম্পাদকের নামের ওপরে উঠে এসেছেন নাজমুল হোসেন। তার পরিচয় দেখানো হয়েছে প্রধান গবেষক ও প্রধান নির্বাহী, জার্নি। তৃতীয় সংস্করণে প্রকাশকেরই নাম বদলে গেছে।
প্রকাশক মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের জায়গায় ‘সমন্বয়ক ও প্রকাশক’ হিসেবে ছাপা হয়েছে নাজমুল হোসেনের স্ত্রী শারমীন সুলতানার নাম। সব সংস্করণেই উপদেষ্টা কিংবা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নাম রয়েছে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন নিয়ে লেখা ‘৩০৫৩ দিন’ বইটির লেখক বা প্রকাশক বাংলাদেশ কারা অধিদপ্তর এবং এর গ্রন্থস্বত্ব বাংলাদেশ জেল উল্লেখ থাকলেও বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য চূড়ান্ত ক্রয় প্রতিবেদনে পরিবর্তিত হয়ে সম্পাদক নাজমুল হোসেন ও গ্রন্থস্বত্ব বা প্রকাশকের নাম জার্নি মাল্টিমিডিয়া দেওয়া হয়েছে। যদিও সাবেক কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন স্বাক্ষরিত ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বরের এক চিঠিতে ‘৩০৫৩ দিন’ বইটির কপিরাইট নাজমুল হোসেনের জার্নি মাল্টিমিডিয়াকে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস থেকে বইটির মেধাস্বত্বও বাগিয়ে নিয়েছেন নাজমুল হোসেন।
কিন্তু গ্রন্থস্বত্ব বাংলাদেশ জেলের হলেও বইটির কপিরাইট নেওয়ার অনুমতি কীভাবে নাজমুল হোসেনকে দেওয়া হয়েছে তা জানতে সাবেক কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীনকে ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বইটির কপিরাইট কাউকে দিতে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্যক্তিগতভাবে অনুমতি দিতে পারেন কি না বা তা বিধিসম্মত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এ বিষয়ে বর্তমান আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা বলেন, ‘৩০৫৩ দিন বইটির প্রকাশক কারা অধিদপ্তর। কিন্তু এর প্রকাশক কীভাবে পরিবর্তন হলো তা আমি ঠিক এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’
এদিকে অধ্যাপক নাসরিন আহমদ সম্পাদিত ‘অমর শেখ রাসেল’ বইটিও লেখকের অনুমতি ছাড়া পৌনে ৩ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন অধ্যাপক নাসরিন আহমদ। গতকাল দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘বইটির এডিটরিয়ালের কাজ করেছি। আমি ছোট্ট রাসেলকে যতটুকু চিনতাম ততটুকুই গুছিয়ে একটু লেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এরপর বইটি কোথায় গেছে, কত টাকায় বিক্রি করা হয়েছে তার কিছুই আমাকে জানানো হয়নি, আমি খোঁজও নিইনি। বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য বইটি যে গেছে সে বিষয়েও কোনো আলাপ আমার সঙ্গে করা হয়নি। তাছাড়া আমি কিন্তু এটা নিয়ে তেমন চিন্তিতও নই।’
উল্লিখিত তিনটি বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব ও মেধাস্বত্ব চুরি করে ২০ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ মতে, প্রকল্পের মোট ২৮ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে ২০ কোটি ৭০ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০ টাকাই পাচ্ছেন ‘জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড’ ও ‘স্বাধীকা পাবলিশার্স’ নামে দুটি প্রকাশনা সংস্থার মালিক সাংবাদিক নাজমুল হোসেন। কিন্তু অভিযোগ ওঠার পর এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আকরাম আল হোসেন। তিনি বলেছেন, বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।